“রঘু কুল রীত সদা চলি আই/প্রাণ জাই পর বচন ন জাই”। রঘু কুলের হোন বা না হোন রাজা রঘু-র উত্তরপুরুষ রামের নাম যাঁদের রাজনৈতিক জীবনবীমা তাঁদের কথা রাখতেই হয়। বলেছিলেন তিনশো আসনে জিতে ক্ষমতায় ফিরবেন। কিঞ্চিৎ বেশিই কথা রেখেছেন। বলেছিলেন তেইশ আসন নিয়ে বাংলা দখলের সূচনা করবেন, তেইশ হয়নি বটে, কিন্তু সূচনা বেশ উচ্চকিত। বাজারে খবর, একুশে তাঁরাই এ-রাজ্যের শাসক; আর হাওয়ায় গুঞ্জন একুশের আগেই হয়তো সেটা ঘটে যাবে। আবার কোথাও কোথাও এখনি নাকি তাঁরা সুশাসনের অনুশীলন শুরু করে দিয়েছেন – হেথা হোথা এখনো বর্তমান শাসকদলের দখলে চলে যাওয়া সি পি এম বা কংগ্রেস দলের পার্টি অফিসগুলো নাকি তাঁরা উদ্ধার করে পুরনো মালিকদের হাতে ফেরত দিচ্ছেন। সুতরাং, আশা করাই যায়, তাঁরা আরো আরো কথা রাখবেন – হিন্দু ভারত, অর্থাৎ অ-হিন্দু মুক্ত ভারত তাঁরা গড়বেনই। গত পাঁচ বছরে পরীক্ষামূলক “খুচরো” মুসলমান নিধন ২০১৯-এর সাফল্যের পর ব্যাপক মাত্রা পাবে – মধ্যপ্রদেশে মুসলমান মহিলাদের পিটিয়ে যার বউনি হল। আসামে “অনুপ্রবেশকারী” পাকড়াবার মহড়া এবার পূর্ণত মঞ্চায়িত হবে। কাশ্মীর উপত্যকার লোকদের বেয়াড়া মানবাধিকারের দাবি তোলার অভ্যাস বদলে তাদের সু-শান্ত রামভক্ততে পরিণত করার গুরুদায়িত্ব পালনে কোনো খামতি থাকবেনা। লক্ষণীয়, নির্বাচনের ফল বেরোবার পর পরই ভারত মাতার জায়গা নিয়ে নিয়েছেন শ্রীরাম – মধ্যপ্রদেশের যে মহিলাদের পেটানো হল তাঁদের ভারত মাতার নামে জয়ধ্বনি দিতে নয়, বাধ্য করা হয়েছে জয় শ্রীরাম বলতে। আরো একটা বড় কর্তব্য – পাকিস্তানকে সবক শেখানো – কেবল বালাকোটের মতো নমুনা পরীক্ষায় আটকে থাকবেনা। এবং, “বিশ্বাসে মিলায় বস্তু”-তে কেউ যদি বিশ্বাস করতে না চায়, যদি তর্ক করতে চায়, তাকে রাষ্ট্রদ্রোহে অভিযুক্ত করে শাস্তিবিধানের রাজ-কর্তব্যকে সুউচ্চ মাত্রায় তুলে নিয়ে যাওয়া হবে। কথা তাঁরা রাখবেনই, ভারতের নির্বাচকমণ্ডলী তাঁদের কথা রাখার জন্যই নির্বাচিত করেছেন।
তাঁরা কত শতাংশ ভোট পেয়েছেন, ভারতের কত ভাগ মানুষ তাঁদের পক্ষে স্পষ্ট মত জাহির করেছেন, সে প্রশ্ন অবান্তর। ভারত সেই ধরণের গণতন্ত্রকে সাংবিধানিকভাবে গ্রহণ করেছে যেখানে জো জিতা ওহি সিকন্দর – তা সে জয়ের ব্যবধান যাই হোক না কেন। এ-দিক দিয়ে ভারতের বেশির ভাগ, বড় বড় রাজনৈতিক দল, নিছক পরাজিত পক্ষ। কংগ্রেস ধরাশায়ী, তার জোট সঙ্গী না হওয়া এস পি, বি এস পি, টি ডি পি, বিধ্বস্ত; তার জোটসঙ্গী হওয়া আর জে ডি, জে এম এম ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে।
সংসদীয় বামদের কথা কী-ই বা বলা? মাত্র দেড় দশক আগে যে বামফ্রন্টের মুঘল সাম্রাজ্যের মতো প্রতাপ, তাঁদের আজ স্বান্তনা পেতে হচ্ছে বি জে পির উত্থানের মধ্য দিয়ে তৃণমূলের প্রতাপ হ্রাস হওয়ার ফলে। যে দল তার কিংবদন্তী হয়ে ওঠা দলীয় শৃংখলার জন্য বিখ্যাত ছিল, সেই দলের বুনিয়াদি স্তরের সংগঠন পার্টির বিরুদ্ধে একটা নীরব বিদ্রোহ করে ফেলল – পার্টি নেতাদের তৃণমূল ও বিজেপি-কে সমান শত্রু চিহ্নিত করার বাণী নিচুতলার কর্মী সমর্থকদের কাছে পাত্তা পায়নি। যে বি জে পি ত্রিপুরা রাজ্যে বামপন্থীদের সরিয়ে ক্ষমতায় আসা মাত্র তাঁদের সেখান থেকে প্রায় দৈহিকভাবে উন্মুলনের জন্য বুলডোজার চালিয়ে দিল, সেই বি জে পি-র বচন রক্ষার কাজে এ রাজ্যের বাম সমর্থকরা প্রধান সহায় উঠলেন। আজ তৃণমূল দলের রাজা-রাজড়াদের অনেকে বামেদের দুর্বল হয়ে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করছেন; না করে উপায় নেই, বামেরা অন্তত আটটা আসনে সামান্য ভোট টেনেও তৃণমূলের আসন বাঁচিয়ে দিয়েছেন – অন্যথা এ রাজ্য থেকে বি জে পি-র লোকসভা সদস্যের সংখ্যা হত ২৬। কিন্তু, কোন মুখে তাঁরা মানবেন যে এমনকি পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বেছে বেছে বামেদের ওপর যে ভয়ংকর আক্রমণ এসেছে অনেকটা তার প্রতিক্রিয়াতেই এই পরিস্থিতি - বাম সমর্থকদের তৃণমূলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সম্ভাব্য বিজেতাকে ভোট দেওয়া।
এতে খুব অসঙ্গতি নেই। সবাই জানে, এটা বামেদের অবস্থানগত বাধ্যবাধকতা। তৃণমূলের হাতে নানাভাবে অত্যাচারিত, ঘরছাড়া, অপমানিত, কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে থাকা মানুষগুলো সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন, সেই সময় বাম দলগুলো আনতে পারেনি, বি জে পি এনেছে, তা যেভাবেই হোক না কেন। দুর্নীতি, স্ব-জনপোষণ, লুঠপাট এমন মাত্রায় গেছে যে লোকের পক্ষে তৃণমূল সরকারের জনমোহিনী নীতিগুলোর কথা স্মরণে রাখা সম্ভব ছিল না। ২০১১ সালে যেমন সাধারণ মানুষদের মধ্যে বামেদের ব্যাপারে একটা মতৈক্য তৈরি হয়েছিল – “এরা যাক”, তেমনি, বিশেষত ২০১৮-তে তৃণমূলের ৩৫ শতাংশ আসনে “বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী” হওয়ার পর, সারা রাজ্য জুড়েই একটা জোরালো দাবি তৈরি হচ্ছিল – আগে তৃণমূলের উৎখাত হোক তারপর দেখা যাবে। বাম সমর্থকদের বড় একটা অংশের মধ্যেই এই মনোভাব কাজ করেছে –তৃণমূল ও বিজেপি উভয়কে হারানোর যে আহ্বান নেতারা জানিয়েছিলেন, লোকে তা শোনেনি।
কিন্তু এই ব্যাখ্যায় অতি-সরলীকরণের সমস্যাটা থেকেই গেল। সাধারণ সমর্থক বা কর্মী না হয় ও-দিকে চলে গেলেন, কিন্তু লোক্যাল কমিটি স্তরের সদস্য যখন বি জে পি প্রার্থীর হয়ে খাটেন, তখন এটাকে পুরোপুরি “বাঁচবার” কৌশল হিসেবে দেখাটা – এবং সব দোষ তৃণমূলের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটা – আত্ম-প্রবোধের দিকে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু সত্যের অনুশীলনের দিক দিয়ে নয়। এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। বহু দিন ধরে বাম দলগুলোর একটা বড় অংশ বুনিয়াদি স্তরে রাজনৈতিক কাজ বলতে বুঝে এসেছিলেন, ছোট ছোট ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো সামলানো। সামাজিক মানসিকতার উত্তরণ যে প্রধান একটা কাজ সেই প্রশিক্ষণ তাঁরা পাননি। বামশাসনেই এ রাজ্যে নানা প্রান্তে ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে সংগঠন বাড়ানোর যে কাজ আর এস এস ও তার সহযোগী সংঅঠনগুলো চালিয়ে গেছে, তার বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতো ছিলই না, উল্টে, লালকৃষ্ণ আদবানীর সুরে সুর মিলিয়ে “মাদ্রাসাগুলো সন্ত্রাসবাদের আখড়া” বলে বাম নেতৃত্ব একদিকে যেমন মুসলমানদের বড় অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন তেমনি দলীয় কর্মীদের পরোক্ষভাবে একটা প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন – উভয় সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতার স্লোগানে যে বিরাট ফাঁক ছিল তা পূরণ করল একধরনের নরম হিন্দু-পাক্ষিকতা। এমনকি সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া কিছু দাঙ্গায় বাম কর্মীদের উজ্জ্বল ভূমিকাগুলোকেও দলীয় নেতৃত্ব দলের প্রধান কর্মপন্থার সঙ্গে যুক্ত করার কোনো চেষ্টা করেননি। সেখান থেকে শিক্ষা নেননি। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার যে উত্থান সারা রাজ্য জুড়ে ঘটে চলছিল, সেদিক থেকে তাঁরা চোখ ঘুরিয়ে রেখেছিলেন – উটপাখি যেমন ঝড়ের সময় বালিতে মুখ গুঁজে নিজেকে নিরাপদ ভেবে নেয়। তাঁরা তৃণমূল দলকে কমিউনিস্ট লব্জে যাকে প্রধান দ্বন্দ্ব বলা হয় সেরকমভাবে চিহ্নিত করলেন – যতই কেননা প্রকাশ্যে দু’মুখো সাপের বিরুদ্ধে লড়বার কথা বলুন না কেন। তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বি জে পি-র উগ্র, ঘোর আক্রমণাত্মক, সহিংস প্রচারের মধ্য দিয়ে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পিছনে শুধু তৃণমূল-ই দায়ী, এমন কল্পনাশ্রয়ী আত্মপক্ষ সমর্থন যুক্তির পরীক্ষায় টেকে না।
পশ্চিমবাংলার সমাজে গত দু-দশক বা তারও বেশি সময় ধরে একটা পশ্চাদমুখী পরিবর্তন ঘটে চলেছে – বামফ্রন্ট সরকারের গোড়ার দিকে শ্রমজীবী মানুষের উত্থানের গতি নতুন কর্মসূচির অভাবে রুদ্ধ হয় – রাজনীতি ক্রমশ সমাজের এমন একটা শ্রেণির হাতে চলে যায়, যে অংশটা চিন্তার দিক দিয়ে অনগ্রসর, কিন্তু আর্থিক দিক দিয়ে উদীয়মান। এই অংশের পক্ষে নৈতিকতা নয়, পক্ষ বেছে নেওয়ার ভিত্তি আত্মস্বার্থ, কিন্তু, সামাজিক মতাদর্শের দিকে দিয়ে বি জে পি-র হিন্দুত্ববাদের সঙ্গেই এদের সবচেয়ে স্বাভাবিক নৈকট্য। পুরুষ অহংকারে নির্মিত, নারী-বিদ্বেষী, শিশু-অবদমনকারী, মুসলমান-বিদ্বেষী, ধর্মাচরণকে প্রদর্শনীতে নামিয়ে আনা-র মতো নানা সামাজিক কূপমণ্ডূকতায় আচ্ছন্ন এই অংশের কাছে টাকা কামানোটাই মোক্ষ, সে টাকা যেখান থেকেই আসুক না কেন। পশ্চিম বাংলার যে রাজনীতি বহু দিন যাবৎ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের রাজনীতিতে টাকার খেলা থেকে নিজেকে শুদ্ধ রেখেছিল, তা হঠাৎ করে আমূল বদলে যায়নি। এই পরিবর্তনের পিছনে একাধারে বাজার ও অন্যপক্ষে প্রগতি-বিরোধী টান – যে দুটো বি জে পি-র রাজনীতির প্রধান উপাদান – সেগুলোর ভূমিকা অস্বীকার করা কঠিন। কিন্তু, যে নিরন্তর গণ আন্দোলন এখানে রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, ইত্যাদি পাপ থেকে মুক্ত রেখেছিল, সেই আন্দোলন – যে চাপেই হোক – স্তিমিত হয়ে পড়ল, তাকে গতিময় রাখার কোনো চিন্তাগত প্রয়াস দেখা গেলনা। বাম নেতৃত্বের তরফে এই বিকাশ বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান হয়েছে বলে জানা নেই। হয়তো তাঁরা এই পর্যবেক্ষণের ভার ছেড়ে রেখেছিলেন পেশাদার বুদ্ধিজীবীদের ওপর, বিস্মৃত হয়েছিলেন, বাম রাজনৈতিক দর্শনে বুদ্ধির চর্চাটা সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীদেরই করতে হয়, ঠিকাদার নিয়োগ করে এ কাজ চলে না, এবং বুদ্ধিজীবীদেরও কর্মী হয়ে উঠতে হয়। ফল হয়েছে মারাত্মক, পেশাদার বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এ-রাজ্যে একটা বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে।
এহ বাহ্য। তাহলে কি পশ্চিম বাংলার রাজনীতি উত্তরভারতীয় পথে পশ্চাদগমন করবে? এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, তৃণমূলের পক্ষে বি জে পি-র আগ্রাসন থামানোর উপায় নেই। যে নেত্রী সহ-নাগরিকদের একাংশকে দুধেল গরুর সঙ্গে তুলনা করেন, তিনি উন্নয়নের যত নজিরই রাখুন না কেন, তাঁর রাজনৈতিক কল্পনায় যে মানুষের প্রতি সম্মানের স্থান নেই তা বুঝতে মনস্ত্বত্ত্বের কঠিন বই পড়তে হয় না। তাহলে সম্ভাবনা কী? বাম আদর্শে বিশ্বাসীরা কিছুটা হলেও মুহ্যমান, পরিস্থিতির আকস্মিকতায় বিহ্বল। সারা দেশ জুড়ে বি জে পি-র জয়জয়কার, তা সে ভাবে, যে পথে আসুক না কেন, সুস্থ বুদ্ধিকে হতাশ করতেই পারে। কিন্তু, আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদীরা তাঁদের অনেক অস্ত্রই ব্যবহার করে বসেছেন। যদি একটু অন্যভাবে দেখি, নির্বাচনের কয়েক মাস আগে বালাকোট ঘটানো, গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া জুড়ে সংবিধান বহির্ভূত ভাবে প্রচার চালিয়ে যাওয়া – এ-সবের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাসের অভাবও দেখা যায়। তাঁরা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন। যে কারণে নানা অ-নৈতিকতার ব্যবহার তাঁরা করেছেন, এবং জিতেছেন। এই সঙ্গে এটাও ঠিক নতুন নতুন অ-নৈতিকতার আবিষ্কারে এঁরা তুখোড় “বিজ্ঞানী”! তাঁরা আবিষ্কার চালিয়ে যাবেন। আর বিপরীতে, পর্যবেক্ষকরা সঠিকভাবেই বলছেন, ছন্নছাড়া বিরোধী-পক্ষকে দায়ী করছেন – বি জে পি-র আগ্রাসন রুখবার মতো কোনো কার্যকর পরিকল্পনা ও জোট গড়ে তুলতে না পারার জন্য। কিন্তু, পূর্ণতর সত্য বোধ হয় আরো একটা স্বীকৃতি দাবি করে – অনৈতিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যে নৈতিক শক্তির প্রয়োজন ছিল, বিরোধীদের কাছে তা ছিল না। যাঁরা নিজেরাও নানা অনৈতিকতায় নিমজ্জিত, তাঁদের পক্ষে নৈতিক যুদ্ধে নেতৃত্ব করা কতখানি সম্ভব?
কিন্তু, তা বলে নৈতিকতা উধাও হয়ে যাবে, এমনটা হতে পারে না। আমরা জানি, গতি থাকলে তার বিরুদ্ধতাও থাকে। অনৈতিকতার বিপরীতে নৈতিকতা অবিরাম সক্রিয় থাকে। সেই সক্রিয়তাতে যাঁরাই পূর্ণোদ্যমে যোগ দিতে পারবেন, আজকের পরিস্থিতিতে, তাঁরাই বামপন্থী। বামপন্থা মানে কোনো বিশেষ পার্টি নয়, বিশেষ পতাকা নয়, এটা একটা নৈতিক ধারণা – এই ব্যাপারটাতে যাঁরা থিতু হতে পারবেন তাঁরাই এখানে বিরোধিতায় নেতৃত্ব দেবেন। আজ যদি মহাত্মা গান্ধী বেঁচে থাকতেন, তিনিই সব চেয়ে এগিয়ে থাকা বামপন্থী হিসেবে পরিচিত হতেন। যাঁরা নিজেদের বামপন্থী বলে দাবি করেন, তাঁদের বোধ হয়, বামপন্থার সংজ্ঞা নিয়ে একটু চিন্তা করা দরকার। চিন্তার শক্তি কমেছে, কিন্তু তার ভাণ্ডার অফুরন্ত।
যে লোক সারাদিন ঘাম ঝরিয়েও খাদ্যের সুরক্ষাটুকুও পায়না, যে লোকের কাছে দিবাভাগে অপমান ও অত্যাচা্রের ভারে রাত্রে স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছে, অ-শিক্ষা, অ-স্বাস্থ্য, অ-পুষ্টি যার জন্মজাত অভিজ্ঞান, তার পাশে দাঁড়ানোর যে ধ্রুপদী বামপন্থী কর্মপন্থা তাকে পুনরাবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে এই শক্তি অর্জন সম্ভব। লোকের চাহিদা সামান্য, শুধু একটা নির্ভেজাল, অ-কৌশলী কুশল প্রশ্ন, শুধু শুদ্ধ মনে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো, বিপদে-আপদে যতটুকু সম্ভব সাহায্য জোগানো-র আদর্শ কোনোদিন পুরনো হয়না। আর আজ আদর্শের সংকটের কালে আদর্শ নিয়ে ফাঁকা আওয়াজ না করেও তার অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া যায়। এ কাজে নেতৃত্ব দেওয়া সহজ নয়, কিন্তু কঠিন কাজ হাতে নেওয়াই তো বামপন্থা। নেতৃত্ব খুঁজে নিতে হবে।
একটু নিজের নিজের সংসারের দিকে তাকান, ওখানেই জমা আছে চিন্তার এবং লড়াইয়ের রসদ। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন, সংসারে সব চেয়ে কষ্ট সহিষ্ণু, সব চেয়ে লেগে থাকা, সর্বাপেক্ষা দৃঢ় মানুষটি কে? দুর্বিপাকে, ঘুর্ণিবাত্যায়, সংসারটাকে বাঁচান কে? উত্তর: বাড়ির মেয়েরা, বামপন্থীরা যাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য বলে মনে করেননি। তাঁরা যে কোনো গণ-আন্দোলনে যাঁদের যোগদান পুরুষের চেয়ে বেশি বই কম নয়, কিন্তু আন্দোলন স্তিমিত হওয়া মাত্র যাঁদের নিজের জায়গায় ফেরত পাঠানোর জন্য তৎপরতারও দরকার পড়েনা, এটাকেই তাঁরা ভবিতব্য বলে আত্মীকৃত করে নিয়েছেন। তর্ক করতেই পারেন, আমরা তো মহিলা প্রার্থী দিয়েছিলাম! কিন্তু, এখন বোধ হয় আত্মপক্ষ সমর্থন কাজের কথা নয়। পথ খোঁজাটাই কাজ। কঠোর সমালোচনা শুনে, কঠোরতম আত্মসমালোচনা করে, এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে বড় বিপ্লব আর কী-ইবা হতে পারে? আর সেই আগুনে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, নেতৃত্বে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনাটা কোনো পার্টিগত দাবি নয়, গোষ্ঠীগত দাবি নয়, এটা মানবতার দাবি। পথ নেই মানেই পথ আছে। পথ খোঁজাটাও একটা পথ।