পাটনা সহরে নভেম্বরের সকাল। ভূগোলের অনেকটা জুড়ে ঘুম অথবা সদ্য নিদ্রাভঙ্গের জড়তা। অনেকটা জুড়ে আবার কাজের ধুম। পথের ধারে চায়ের দোকানে খেটে খাওয়া লোকেদের ভিড় – রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, ঠেলাগাড়িতে ফল বেচতে বেরোনো ফেরিওয়ালা, এবং তাদের সহ-সম্প্রদায়। এখন ২০১৭। গত সহস্রাব্দে এ সহরে এক যুগ কাটিয়েছি – ১৯৯০ থেকে ২০০২। ফিরে ফিরে আসি, পা দেওয়া মাত্র ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা জাগে, বস্তুত স্মৃতিকাতরতা। কিন্তু, এ যাত্রায় ক্ষান্ত দিতে হল, কোনওক্রমে চা খেয়ে ডেরায় । শহরের আপাদমস্তক ধুলোর চাদরে মুড়ি দেওয়া, দম নেওয়া এ কারণে আরো কঠিন যে, ধুলো নামে যা অভিহিত তার সঙ্গে প্রগাঢ় মৈত্রীর অঙ্গীকারে মিশে আছে সিমেন্ট, পেট্রোলিয়াম বর্জ্য, কয়লা ও ঘুঁটের ধোঁয়া, ইত্যাদি। কিছু পরে ভূমিহার জাতির একজনকে জিজ্ঞাসা করব, নীতিশ কুমারের শাসনে সব চেয়ে বড় পরিবর্তন কী হয়েছে? তিনি উত্তর দেবেন, আইনশৃংখলার চরম উন্নতি। হক কথা। অপহরণ, খুন, দাদাগিরি, ইত্যাদি যে-সব ঘটনার জন্য বিহারের কুখ্যাতি ছিল, তার মাত্রায় সমূহ হ্রাস ঘটেছে। কিন্তু, সামান্য সময়ে রাস্তার ধারে চা খেতে খেতে যা দেখা গেল তাতে আইনশৃংখলা বিষয়ে একটা প্রশ্ন মাথায় এল: এটা কি কেবল খুন-জখমের ব্যাপার? সামনের মোড়ে, উলটো দিক থেকে আসা একটা বিপুলবপু গাড়ি ধাক্কা মারল এক সাইকেলওয়ালাকে, গতি শ্লথ থাকায় গুরুতর কিছু হয়নি, শুধু ছিটকে পড়ার কারণে লোকটার হাতে পায়ে খানিকটা ছড়ে যাওয়া ছাড়া। অবশ্য, তার জন্য আরো বিপদ অপেক্ষা করছিল – গাড়ির মালিক ও চালক উভয়ের মিলিত প্রহার, এবং যেন হাওয়া থেকে নেমে আসা দৈত্যের মতো পুলিশ। আইন যাই বলুক, শৃংখলা গাড়ি মালিকের পক্ষে। তার আরো এক নমুনা পাওয়া গেল, কিয়দ্দূরে রোগাভোগা একটা লোকের ওপর বলবানের অত্যাচারে। লোকটা এক ঝুড়ি তরকারি নিয়ে বসেছিল রাস্তার ওপর, কিন্তু রাস্তাটা কোনও এক মহাধনী-র প্রাসাদের সামনে- আই্নী অধিকার নাইবা থাকল, হুকুমতের প্রসাদে শৃংখলা বিদ্যমান। চড়-থাপ্পড় খেয়ে লোকটাকে সরে যেতে হল।
নীতিশকুমারের, বস্তুত বিজেপি-র, সমর্থকটি দাবি করবেন, “বহোত কাম হো রহা হ্যায়”। ঠিক-ই। পাটনা শহরের চতুর্দিক “কাজে” ঢাকা – ফ্লাইওভারের পর ফ্লাইওভার, নতুন নতুন সরকারি-বেসরকারি ইমারত। “কাজ” মানে এক ঢিলে দুই পাখিঃ চোখে আঙ্গুল দিয়ে আর্থনীতিক উন্নয়ন দেখিয়ে দেওয়া, স্টেট জিডিপি-র বাড়-বাড়ন্ত; পাশাপাশি, অথবা সেটাই মূল উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক আপনজনদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার পথ করে দেওয়া। লোকের জন্য পথ বলতে প্রায় কিছু নেই, যেটুকুবা আছে তা ধনাঢ্যের অশ্লীল বাহনের দখলে। চতুষ্পার্শে ভর্তি নোংরা, দুর্গন্ধে টেকা দায়। ধনিকের কিছু আসে যায়না, তাদের কাচ-তোলা গাড়িতে বাইরের বাতাসের প্রবেশ নিষেধ। আর দরিদ্র মানিয়ে নিতে নিতে একেই জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছে। করে নিয়েও বাঁচার সুরাহা হয়না। দুর্ভাগ্য যেন বিহারবাসীর সহজাত। সেই কবে শুরু হয়েছিল গ্রাম থেকে শহরে আসা – পাটনায় স্থান সংকুলান, অতএব কলকাতা। সে নগরী, ক্রমে, নিজেই হেঁপোরুগী। বঙ্গবাসী জনতাও আজ কাজের খোঁজে দলে দলে পাড়ি দিচ্ছে বিদেশ বিভুঁয়ে। অতএব, বিহারী কর্মজীবীকে কাজ খুঁজতে যেতে হয়, পঞ্জাব, হরিয়াণা, মহারাষ্ট্র, অথবা অন্যত্র। এমনই এক পরবাসী সমুদায়ের দেখা পাওয়া গেল বারাণসীতে।
একদা বরুণা নদী, যার নামে বারাণসীর অংশ (বাকিটা অসসি নদীর নাম থেকে নেওয়া), তা আজ বড়সড় নর্দমা মাত্র। তার তীর বরাবর যে সংসারগুলো তার কেউবা একেবারে স্থানীয়, কেউ এসেছেন বারাণসী সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের বিভিন্ন জেলা থেকে। আবার কেউ এসেছেন আমাদের এই বাংলার মুর্শিদাবাদ-বীরভূম থেকেও। প্রসঙ্গত, ডিস্ট্রিক্ট আর্বান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-র তথ্য অনুযায়ী, বারাণসীর মোট ভৌগোলিক এলাকার ১৭ শতাংশ তে ২১০ বস্তি, যেগুলোতে বসবাস নগরীর মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশের। এঁদের মধ্যে আবার নানা স্তর বিভাজন। ভাষা-সংস্কৃতির কারণে, জাতিগত মর্যাদার ভেদে, এবং বিশেষ যোগাযোগের বলে এক অংশ তুলনামূলক বেশি উপার্জন করেন, তাঁরা থাকেন ভাড়া বাড়িতে। এক এক বাড়িতে ২-৩ থেকে ১৮-২০ টি পরিবার। আর একটি অংশ আক্ষরিক অর্থে ছন্নছাড়া। প্লাস্টিকের ঢাকা দেওয়া আবাস। রাস্তার কল কাজ করলে জল পাওয়া গেল, না করলে দূর থেকে বয়ে আনা (১৪৫ বস্তিতে জলের সংযোগ নেই)। মুক্তাকাশের নিচে শৌচকর্ম (১৪৭ বস্তিতে পয়ঃপ্রণালী নেই) । শিশুরা পথে বড় হচ্ছে, চার-পাঁচ বছর বয়স হতে না হতে মা-বাব, দাদা-দিদি-র হাত ধরে চলে যাচ্ছে প্লাস্টিক-লোহা-কাগজ কুড়োতে। যেমন রামপুরহাট থেকে আসা চাঁদ মহম্মদ, “ঘরের কাছে কাজ নাই” বলে যাঁর নিরুপায় দেশান্তর (তাঁর সমগোত্রীয়দের সংখ্যাটা, ওয়াকিবহাল লোকমাত্রই জানেন, দিনে দিনে স্ফীত হচ্ছে)। তাঁর বাচ্চারা যেন মা-বাবার নিরক্ষর দুর্ভাগ্যের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলেছে, স্কুলে যায়না। দারিদ্র্যই স্কুলে না যাবার একমাত্র, এমনকি প্রধান কারণও নয়। কারণ নিকটে একটাই মাত্র সরকারি স্কুল, আর বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা ৯ (শহরের মোট ২১০ বস্তিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১৯৭টিতে) । সরকারি স্কুল চলে অথচ চলেনা। আর বেসরকারি স্কুলে পাঠানোর সুবিধা তাঁদের কল্পনাতে নেই। একেবারে হিন্দী মিডিয়ম সিনেমার কাহিনি – বেসরকারি স্কুলে গরিবদের জন্য রাখা কোটায় ভর্তি হয় সচ্ছল পরিবারের বাচ্চারা। আর হত দরিদ্র, ছিন্নমূল সাংসারগুলোতে বড় হয়ে উঠতে না উঠতে কিছু বাচ্চা জুড়ে যায় আয়-ব্যয়ের বাজারে, সন্ধ্যা হতে না হতে নদীর ধারে হরেকরকম নেশা, বিশেষত ড্রাগের ব্যবসা পর্যন্ত যার বিস্তার। নারীমাংসের ব্যবসা সম্ভাবনা বাড়িয়েছে নগরে জনসংখ্যায় মেয়েদের ভয়াবহ সংখ্যাল্পতা – প্রতি হাজার পুরুষ পিছু মাত্র ৮৮৭ নারী।
অবস্থা অনুসারে সংসারগুলোর নাগরিকত্বের পরিচয়। চাঁদ যেমন অনেকদিন আছেন, সেই সুবাদে জোগাড় হয়েছে “জীবনের সাম্প্রতিক নাম আধার কার্ড”, কিন্তু সকলের কপাল অতো মসৃণ নয়, ভারতমাতার সন্ততি প্রমাণপত্র না থাকায় জনধন, স্বচ্ছভারত, বা কর্মনিশ্চয়তাতো স্বপ্ন, কাজের এক্তিয়ারও সংকুচিত, কেননা যদিচ্ছা ঘোরাঘুরি করার উপায় নেই, পুলিশ ধরবে, ধরলে আরো টাকা নেবে। “আরো”-র নিগুঢ়ার্থ, পুলিশ এমনিতেই টাকা নেয়, কিন্তু এক্তিয়ার ছাড়ালে অংক বাড়বে।
জনসংখ্যার যে ৩৬ শতাংশ বস্তিবাসী, তাঁদের সবার অবস্থা যেমন একই রকম খারাপ নয়, তেমনি, যাঁরা বস্তিবাসী নন, সে অংশটির সবাই যে সুখে কালাতিপাত করেন, এমন বলা কঠিন। সাধারণভাবেই শহরের রাস্তাঘাটের অবস্থা খারাপ বললে কম বলা হয়, বহু এলাকায় বিশেষ করে মুসলমান বসতগুলোরতো কথাই নেই, কোনও এক অতীতে নির্মিত রাস্তা যেন পথচারিদের ধূলায় ধূলায় ধুসর করে তোলার জন্যই মেরামতির প্রলেপটুকুও পায়না। বস্তুত, গোটা শহর জুড়ে ধূম্রলিপ্ত ধূলার জয়ধ্বজা, এমনকি, সরণি জুড়ে বিলাসবহুল হোটেল গড়ে ওঠা ক্যাণ্টনমেন্ট এলাকার সংযোগপথগুলোও অনির্মিত-অর্ধনির্মিত। লোকসভায় এখানকার জনপ্রতিনিধির নাম নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। হিসেব বলছে, অদ্যাবধি তাঁর সাংসদ তহবিলের ধার্য মোট কুড়ি কোটি টাকার সাড়ে বারো কোটিই নির্বাচনকেন্দ্রে চলে এসেছে, এবং তার ৮৭ শতাংশই খরচ হয়ে গেছে। জানা গেল, বারাণসীকে সাজিয়ে তোলার জন্য প্রকল্পের পর প্রকল্প তৈরি হয়েছে, এবং “কাজ” চলছে। ঠিক সেইরকম কাজ যা আমরা পাটনায় দেখে আসলাম। বস্তুত, কাজ বিষয়ে দুই “ন”-এর ধারণাগত পার্থক্য নেই। বারাণসীর এক সমাজকর্মী যেমন বল্লেন, দুই “ন”-এর সাময়িক বিচ্ছেদটা একান্তই ব্যক্তিগত অহং-ঈর্ষার কারণে, নাহলে তাঁদের রাজনৈতিক-আর্থনীতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে কোনও তফাত নেই – দুজনের কাছেই উন্নয়ন মানে আরো ইট, আরো সিমেন্ট, আরো বড় বড় উড়াল পুল, মহাসড়ক, এবং অধিকতর সুবিধাবাদ ও মিথ্যাচার। খাদ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পরিবেশ, এসব তাঁদের কল্পনায় জায়গা পায়না। সুতরাং, বারাণসীর ঘাটগুলো সেজে উঠবে, শহরের চারপাশ জুড়ে মস্তো চওড়া রিং রোড হবে, উন্নত বিশ্বের প্রমোদপিপাসু রাষ্ট্রনায়ক ও বাণিজ্যপতিদের ঘুরিয়ে দেখানো হবে শহরের নির্বাচিত কিছু খণ্ড যেখানে ভারত মাতার প্রমাণিত-অপ্রমাণিত সন্ততিদের ক্ষূধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য-র ছায়াটুকুরও প্রবেশাধিকার থাকবেনা। বিশ্ববাজারে হিন্দুভারতের দোকান সাজিয়ে দেবে মুনাফার অহর্নিশ পূজা।
ফেরার পথে দেখি আমাদের এই কলকাতা মহানগরীও যেন নববস্ত্রে সেজে উঠছে। তার সাজ যত বাড়বে চাঁদ মহম্মদরা ততই ঘরছাড়া হবেন। তাঁরা যত ছিন্নমূল হবেন বঙ্গভূমি তত রিক্তা হবে, তা মহানগরীর শাড়ি যে বর্ণেই উজ্জ্বল হয়ে উঠুকনা কেন।