১৪ই আগস্ট এর মধ্যরাত্রে নেহরু যখন স্বাধীনতা উদযাপন করছেন, ঠিক তখনই বিভক্ত ভারতের পূর্ব এবং পশ্চিমপ্রান্তে জন্ম হচ্ছিল মধ্যরাতের কয়েককোটি সন্তানের। জন্মলগ্ন থেকেই যারা অনাথ। রুশদির কাহিনির মতো, এঁদের কোনো বিশেষ ক্ষমতা ছিলনা। জন্মদাগ যা ছিল, তা হল যাযাবর জীবন। অজীবন সঙ্গী যা ছিল, তা হল স্থানচ্যুত হবার বেদনা। গোটা ভারতবর্ষের মূলধারার রাজনীতি এই দেশভাগের পাপকে ধামাচাপা দিয়ে দেবে, এবং এঁরা বসে বসে সেটা দেখবেন, তাই ছিল ললাটলিখন।
সেসব কেটে গেছে ৭৪ বছর আগে। এই অনাথরা ক্রমে প্রবীণ হয়েছেন, অনেকেই আর নেই। স্মৃতিতেও জমেছে ধুলো। কিন্তু বেদনা ওভাবে মোছেনা, ইতিহাস চাপা পড়েনা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, রক্তে, ভাষায় থেকে যায় দাগ। ১৯৪৭ উত্তর ভারতবর্ষ জন্ম দিয়েছিল নতুন কিছু শব্দবন্ধের। এই প্রবীণরা কখনও স্বাধীনতা বলেননি, বলেছেন পার্টিশন, তৃতীয় বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যে শব্দ ভারতের অবদান। পার্টিশনের হাত ধরে এসেছে উদ্বাস্তু। রিফিউজি কলোনি। তারও পরে এসেছে অনুপ্রবেশ। বসেছে কাঁটাতার। এসেছে এনআরসি, নতুন নাগরিকত্ব আইন। শুরু হয়েছে "বৈধ-অবৈধ" বিচার। শোনা যাচ্ছে, নতুন শব্দবন্ধ, "অবৈধ অনুপ্রবেশ"। যাঁরা বিচার করছেন, তাঁদের বিচার কে করে।
এসব শব্দের, আখ্যানের জন্ম হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেশভাগের এই আদি পাপ, মুছে দেবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এভাবেই থেকে গেছে বেদনায়, ভাষায়, আখ্যানে। থেকে গেছে, এবং এখনও যাচ্ছে। সেই আখ্যানসমূহের সামান্য কিছু অংশ, থাকল এবারের সংখ্যায়।
খুব ভালো পরিকল্পনা। যথাযথ বই সব। সম্পাদককে ধন্যবাদ।
সব পড়ে নিয়ে লিখছি।
বাংলা সাহিত্য, কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে উদ্বাস্তু বাঙ্গালী জীবনের হাহাকার।
কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের “উদ্বাস্তু” কবিতায়, দেখি ভূষণ এবং তার পরিবারকে সব কিছু ছেড়ে যেতে
“চারধারে কী দেখছিস? ছেলেকে ঠেলা দিল ভূষণ- জলা-জংলার দেশ, দেখবার আছে কী! একটা কানা পুকুর একটা ছেঁচা বাঁশের ভাঙা ঘর একটা একফসলী মাঠ একটা ঘাসী নৌকো-“
নিজেদের ঘর-বাড়ি, নিজেদের আজন্ম পরিচয় ছেড়ে, তারা চলেছে এক নূতন দেশে, যেখানে তাঁদের পরিচয় ‘মানুষ’ নয়, সেখানে তারা শুধুই ‘উদ্বাস্তু’ -
“আসল জিনিস দেখবি তো চল ওপারে, আমাদের নিজের দেশে, নতুন দেশে, নতুন দেশের নতুন জিনিষ-মানুষ নয়, জিনিস- সে জিনিসের নাম কী? নতুন জিনিসের নতুন নাম-উদ্বাস্তু।“
(“উদ্বাস্তু” - অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত)