অচিন চক্রবর্তী এবং কুমার রাণা জনজীবনের যে সব সমস্যা এবং তাদের মোকাবিলার উপায় নিয়ে কথা বলেছেন, সেগুলো বিষয় হিসাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রচারে এই সব বিষয় নিয়েই আলোচনা এবং তর্কবিতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে যে প্রচার চলছে, এবং সেই প্রচার যে ভাবে বিভিন্ন ধরনের সংবাদমাধ্যমের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে আসছে, সেই ডিসকোর্সটার মধ্যে এই কথাগুলোর একটা বড়ো ভূমিকা থাকা জরুরি ছিল। অথচ বাস্তবে আমরা কী দেখছি? কী শুনছি? যা দেখছি এবং শুনছি, তার বেশির ভাগটাই অসার, এবং অনেকটাই কদর্য, যা শুনতে শুনতে শরীর খারাপ করছে। অর্থাৎ, যেটা হওয়ার কথা আর যেটা আসলে হচ্ছে, দুটো কেবল আলাদাই নয়, সম্পূর্ণ আলাদা, যেন দুই মেরুর ব্যাপার। এতটা দরকারি কথা যেখানে বলা প্রয়োজন, এত মানুষের জন্য প্রয়োজন, সেখানে যে কথাগুলো বলা হচ্ছে, সেগুলো শুধু খারাপ কথা নয়, সেগুলো সত্যিই অশ্লীল এবং কুৎসিত— ভয়ংকর।
আমাদের রাজনীতির নির্বাচনী প্রচার, বা আর-একটু বৃহত্তর অর্থে রাজনৈতিক ডিসকোর্স, যেমনটা দাঁড়িয়েছে, সেটা এ-রকম হল কেন? কিংবা— কোদালকে কোদাল বলাই ভাল— তার মান এতটা নীচে নেমে গেল কেন? সমস্যাটা আসলে কোথায়? আমার নিজের যেটুকু অভিজ্ঞতা— কর্মসূত্রে অভিজ্ঞতা এবং একই সঙ্গে দর্শক-পাঠক হিসেবেও অভিজ্ঞতা, তাতে মনে হয় যে, এর একটা বড় কারণ— কারণ বলা যায় কি না জানি না, কিন্তু একটা বড় ব্যাপার যেটা এর মধ্যে কাজ করে সেটা হল, এই প্রচারের জায়গা থেকে দেখলে রাজনীতি জিনিসটা বহুলাংশে বিনোদনে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রচার, নির্বাচনী প্রচার— সবটাকে দেখা হচ্ছে বিনোদন হিসেবে। এবং এর একটা জোরদার অর্থনীতি রয়েছে, তার একটা ব্যবসায়িক মডেল রয়েছে, যে মডেলের ভিত্তিতে সেই বিনোদনটাকে ‘সেল’ করা হচ্ছে। এটা তো এমনি এমনি নয়, যে কার্যত সব ক’টা টেলিভিশন চ্যানেল, আজকে নির্বাচনের মরসুম বলে নয়, গোটা বছর ধরে প্রত্যেক দিনই একই রকম ভাবে কতগুলো খুবই অকিঞ্চিৎকর, অসার জিনিস আমাদের সামনে রাজনীতি হিসেবে তুলে ধরে আর আমরা সেগুলো ‘কনজিউম’ করি। এবং সেইখানেই, কে কতটা বিনোদন দিতে পারছেন তার উপরেই নির্ভর করে তাঁদের ব্যবসাটা কতটা দাঁড়াবে। এই অঙ্কটা তো এখন আর নতুন কিছু নয়, এটা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি। মুশকিল হল যে, এই ব্যাপারটার এমনই একটা কাঠামো তৈরি হয়ে গেছে যে তার ভিতর থেকে এর খুব একটা সংশোধন, সংস্কার, উন্নতি— এ-সবের বিশেষ ভরসা দেখি না। এবং আমাদের সামগ্রিক অভিজ্ঞতা বলে যে, যত দিন দিন যাচ্ছে ততই, যাকে বলে ‘রেস টু দ্য বটম’, সেটাই ঘটছে।
এবার ঘটনা হল, কী করে আরও বেশি মানুষকে আকর্ষণ করা যাবে, সহজে আকর্ষণ করা যাবে, এই প্রবণতাটা ভীষণ ভাবে রাজনৈতিক প্রচারের, বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারের একেবারে ভিতরে ঢুকে গেছে। অর্থাৎ, এখন বহু প্রার্থী, বহু নেতা প্রচারটাকে যেন প্রায় এভাবেই তৈরি করেন, যাতে সেটা বিভিন্ন ভাবে ক্রমাগত সম্প্রচারিত হয়ে বহু মানুষকে আকর্ষণ করে নিতে পারে। এর ফলে যেটা হয়— বহু লোককে আকর্ষণের একেবারে সহজ বা সব থেকে সহজ উপায়টিই অবলম্বন করা হয়। আমি বিশ্বাস করি না যে, যাঁরা এটা করছেন তাঁরা জানেন না যে এটা সত্যিই কতটা করা উচিত বা উচিত নয়। তাঁরা জেনে-বুঝেই এটা করেন। সম্ভবত তার সব থেকে বড় কারণ হচ্ছে, এগুলো দিয়ে খুব সহজেই অনেক মানুষকে একসঙ্গে আকর্ষণ করে নেওয়া যায়।
তা হলে কী করণীয়? আমার কাছে সেটাই অনেক বড় প্রশ্ন। জনজীবনের যেগুলো মূল বিষয়— অচিন এবং কুমার দুজনেই যেগুলো নিয়ে পরিষ্কার করে বলেছেন— সেগুলিকে কীভাবে এই প্রচারের মধ্যে আনা যায়? এই পরিপ্রেক্ষিতে একটা কথা পরিষ্কার করে বলা দরকার। এগুলো আলাদা করে শুধু নির্বাচনী প্রচারে নিয়ে আসার ব্যাপার নয়। আমাদের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ডিসকোর্সের মধ্যে যদি এগুলো স্বাভাবিক ভাবে থাকে, তবেই নির্বাচনী প্রচারের মধ্যেও তারা স্বাভাবিক ভাবে আসবে। না হলে হঠাৎ নির্বাচনের সময় আলাদা ভাবে এই বিষয়গুলির উপর জোর দেওয়া হবে— এটা হয় না। আমাদের সমাজ যেরকম ভাবে চলছে, তার রাজনীতি যেরকম ভাবে চলছে, নির্বাচনী প্রচারও তাকেই অনুসরণ করে, আর-একটু বেশি রকম ভাবেই করে এবং তার সেই চরম রূপটা ক্রমশই আরও চরম হচ্ছে।
এখন, যদি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখার চেষ্টা করি, তা হলে এটাও কিন্তু লক্ষ করব যে, এবারের নির্বাচন এবং তার আগের বেশ কয়েক মাস ধরে একটা অন্য ধরনের ক্যাম্পেনও আমরা দেখছি, দেখেছি। সেটা গত এক বছরে কোভিডের সময়ের ভিতর থেকেই শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে জনজীবন যত কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে, মানুষ যত বাইরে আসতে পেরেছেন, ততই সেটা বেড়েছে। অনেক রাজনৈতিক দল এবং— অরাজনৈতিক বলব না, কারণ অরাজনৈতিক বলে কিছু হয় না— দলীয় রাজনীতির বাইরে নানা রকম সংগঠন, গোষ্ঠী, তাঁরাও তাঁদের কাজের মধ্য দিয়ে জনজীবনের এই মূল বিষয়গুলো নিয়ে মানুষের কাছে গিয়েছেন, নিজেদের কথা বলেছেন। এবারের নির্বাচনে, আমরা জানি, অন্তত কিছু কিছু দলের কিছু প্রার্থী, বিশেষত তরুণ প্রার্থী খুব জোরের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর কথা বলছেন, বিশেষ করে শ্রমজীবী গরিব মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিকে নিরন্তর সামনে রাখছেন। সম্ভবত গত বেশ কিছুকালের অভিজ্ঞতা, অতিমারীর সঙ্কট এবং তার মোকাবিলায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা, তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে প্রচার ও বিক্ষোভের অভিজ্ঞতা এই অন্য ধরনের নির্বাচনী প্রচারের পিছনে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে।
জনজীবনের প্রকৃত সমস্যাকে কেন্দ্র করে এই প্রচার সংবাদমাধ্যমে কতটা আসছে, সে প্রশ্ন থাকেই। মূল ধারার সংবাদমাধ্যম বলতে যেটা বুঝি সেখানেও যে এর স্বীকৃতি একেবারে নেই, তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে, অন্তত পক্ষে কিছু কিছু প্রিন্ট মিডিয়ায়, অর্থাৎ পত্রপত্রিকাতে সেই ধরনের ক্যাম্পেন, যেগুলো মানুষের কথা বলছে, সেগুলো যে একেবারে পাচ্ছি না, এমনটা বললে একটু অন্যায়ই বলা হবে। টেলিভিশন, অডিয়ো-ভিজুয়াল মিডিয়ার সমস্যা আরও বেশি। সেখানে এগুলোর কথা প্রায় কিছুই নেই। কিন্তু এই মূলধারার পাশাপাশি সমান্তরাল নানা ধরনের যে মাধ্যম তৈরি হয়েছে নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ঠিক যে-ধরনের প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা এই আলোচনা করছি, তাতে আমরা অনেক রকমের খবর পাচ্ছি, অনেক রকমের নির্বাচনী প্রচারও দেখতে পাচ্ছি, যেগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে এই রকম একটা সময়ের মধ্যে, এই রকম একটা পরিবেশের মধ্যেও অনেক দরকারি কথা বলা হচ্ছে। এটা মানতেই হবে যে, চারপাশের ডামাডোলের মধ্যে সেই দরকারি কথাগুলো আনুপাতিক ভাবে এতটাই কম শোনা যাচ্ছে যে এখনও অবধি মানুষের মনে তার কতটুকু প্রভাব পড়ছে, আমরা জানি না। কিন্তু এটা আমাদের একটা সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, যে, কী করে এই রাজনৈতিক প্রচারে— কেবল নির্বাচনী প্রচার হিসেবে না দেখে ব্যাপারটাকে সাধারণ ভাবে রাজনৈতিক প্রচার হিসেবে দেখতে চাই— জনজীবনের সমস্যাগুলোকে কার্যকর ভাবে নিয়ে আসা যায়। কী করে একটা রাজনৈতিক কথোপকথন তৈরি করা যায়। আশা করব— এখন আশাই বলব, সম্ভাবনা বললে হয়তো একটু বেশি বলা হয়ে যাবে, তবে একটা আশা সত্যিই তৈরি হচ্ছে যে— এটা হয়তো শুধু নির্বাচনের ব্যাপার না-ও হয়ে থাকতে পারে। এবং সেখানেই, আমরা, যারা মনে করি যে সোশ্যাল ডিসকোর্সে এই ধরনের কথা আনা দরকার, আমাদের সকলেরই দায়িত্ব, কী করে এই কথাগুলোকে আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
তার সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা কথা বলা দরকার। সাধারণ মানুষের যে দৈনন্দিন জীবন, যাকে জনজীবন বলা হচ্ছে, সেই জীবন থেকে যে প্রশ্নগুলো উঠে আসছে বা আসবে, যে সমস্যাগুলোর কথা আমরা আলোচনা করতে চাইব, সেই সমস্যাগুলো ঠিক কী এবং কীভাবে তার আলোচনা করা দরকার, সেই বিষয়ে কিন্তু আমাদের এখনও অনেকটা জানার আছে, শেখার আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই খুব জোর দিয়ে বলতে চাই যে, আমাদের কথা বলার ভাষাও আমাদের তৈরি করতে হবে। তৈরি করার থেকেও বড় কথা, আমাদের সেই ভাষা শিখতে হবে। আমাদের তথাকথিত নাগরিক, শিক্ষিত, সমাজসচেতন যে বর্গ, আমরা যারা এই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করি, তাদের ভূমিকা— আমাদের নিজেদের ভূমিকাটাকেও নিশ্চয়ই যথেষ্ট শ্রদ্ধা করার কারণ আছে, গুরুত্ব দেওয়ার কারণ আছে। যে সব রাজনৈতিক দল বা সংগঠন চেষ্টা করছেন অসার চিৎকারের বাইরে অন্য ধরনের কথা বলার, দরকারি কথা বলার, তাঁদের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। কিন্তু আমাদের এবং তাঁদের— রাজনৈতিক দল এবং দলের বাইরের যে রাজনীতি বা যে নাগরিক সমাজ— আমাদের সবারই তো একটা মস্ত বড়ো ঘাটতি আছে। সেই ঘাটতিটাকে পরিষ্কার স্বীকার করা দরকার। আমরা খুব কম শুনি। আমরা অনেক বেশি বলি। আমরা বলতে ভালোবাসি। আমরা বলতে চাই। বলাটা খুব জরুরি। কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের শোনাটাও তো ভীষণ জরুরি। এবং আমরা বহুলাংশে শুধু আমাদের কথা শুনি। এমনকি, আমাদের যে সব রাজনৈতিক দল শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতি করেন বলে মনে করেন, দাবি করেন— সে দাবি হয়তো অনেকাংশে সত্যিও বটে— তাঁরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষকে তাঁদের কথা বলেন, শ্রমজীবী মানুষের কথা তাঁরা তুলনায় অনেক কম শোনেন। আমার মনে হয়, এই শোনার অভ্যাস এখন আমাদের অনেক বেশি তৈরি করতে হবে। যদি সেটা তৈরি করতে পারি, তা হলে দেখা যাবে, আমাদের রাজনৈতিক প্রচারের মধ্যে, আমাদের রাজনৈতিক কথোপকথনের মধ্যে প্রথমত আমরা কী নিয়ে কথা বলব এবং দ্বিতীয়ত, আমরা সেই কথাগুলো কীভাবে বলব, দুটোর ক্ষেত্রেই হয়তো আমরা আরও অনেক বেশি মানুষের কাছে অনেক বেশি করে পৌঁছতে পারব।
জনজীবনের মূল বিষয়গুলো প্রচারের মধ্যে আসা— এর একটা বড় প্রস্তুতি দরকার। নির্বাচনী প্রচার কিছু দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে, তার পরেও তো আমাদের চলতে হবে। নির্বাচনের ফল যা-ই হোক না কেন, আমাদের সামনে যে অত্যন্ত কঠিন দিন, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং, এটা কীভাবে করা যায়, সেই নিয়ে আমাদের অনেকটা ভাবা দরকার এবং আরও অনেকটাই অনুশীলন দরকার, পরিশ্রম দরকার।
"আমরা খুব কম শুনি। আমরা অনেক বেশি বলি '।
--খাঁটি কথা। গোড়ায় গলদ।