দণ্ডীরহাট থেকে পালিয়ে আসার পর আবার ফিরে যেতে হয়েছিল। ডিসেম্বরে অ্যানুয়াল পরীক্ষা দিতে হবে তো। ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠতে হবে তো। অ্যানুয়াল পরীক্ষায় বাংলা রচনা এসেছিল, তোমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা। আমি লিখেছিলাম বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সেই বৃত্তান্ত। তখন মনে হয় শিবরাম চক্রবর্তীর ওই নামের বইটি আমি পড়েছিলাম। সেই বইও হয়ত সাহস জুগিয়েছিল। দণ্ডীরহাট ইস্কুলের দুই বছর ছিল মধুর। সপ্তাহে একদিন না পনের দিনে একদিন হত বিতর্ক সভা। কত রকম তার বিষয়, লেখাপড়া না খেলাধুলা--পক্ষে বিপক্ষে। আমি তো লেখাপড়ার পক্ষে খুব সওয়াল করছি, আমার পরের বক্তা রক্তিম খেলাধুলো নিয়ে বলতে গিয়ে বলল, আগের বক্তা যে খেলাধুলোর বিপক্ষে এত বলল, তার স্কুল ব্যাগ খুলে দেখা হোক, খেলোয়াড়ের ছবি আঁটা খাতা যা তৈরি করেছে ও, আর কারো অমন নেই। তাইই বটে, খেলোয়াড়রা ছিলেন বালকের হিরো। খবরের কাগজ হোক, খেলার পত্রিকা হোক, তাদের ছবি কেটে খাতায় সেঁটে একটি অ্যালবাম বানাতাম।
তখন স্কুলে এক রীতি ছিল, গরমের ছুটি যেদিন পড়বে, সেদিন শিক্ষকদের খাওয়াত ছাত্ররা। দণ্ডীরহাট স্কুলে তা ছিল। কলকাতার মনোহর একাডেমিতে ছিল না মনে হয়। আমরা ছাত্র-ছাত্ররা চাঁদা তুলে নানা রকম মিষ্টান্ন, শরবৎ দিয়ে শিক্ষকদের আপ্যায়ন করতাম। দণ্ডীরহাট আমতলা থেকে বসিরহাট যাওয়ার সরাসরি এক রাস্তা আছে। পরিত্যক্ত মারটিন কোম্পানির রেলপথের সেই রাস্তা দিয়ে বসিরহাট যেতাম মিষ্টান্ন কিনতে। ইছামতীর তীরে বসিরহাট শহর বড় সুন্দর। বসিরহাট হল মিষ্টান্নর শহর। কাঁচা গোল্লা সন্দেশ এবং জোড়া সন্দেশ যে একবার মুখে দিয়েছে, ভুলবে না। দেশভাগের পর সাতক্ষীরের ঘোষেরা বসিরহাট চলে আসেন অনেকে। তাঁদের হাতের পাকে কাঁচা গোল্লা বা মাখা সন্দেশের স্বাদ অপূর্ব। গত বছর, ২০১৯-এর জুন মাসে সৌমিত্র বসু ও দাদাকে নিয়ে আমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। সাতক্ষীরে হয়ে যাওয়া। সাতক্ষীরে হয়ে ফেরা। ফেরার সময় সাতক্ষীরের সাগর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে জোড়া সন্দেশ এনেছিলাম বাড়ির জন্য। আমাদের বাড়ির সব বিবাহ অনুষ্ঠানে কাঁচা গোল্লা আনা হয় বসিরহাট থেকে। আমার কন্যার বিবাহর সময়ও আনা হয়েছিল। এ যেন পূর্ব বঙ্গের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনা। বসিরহাট শহরের বান্ধব লাইব্রেরি এবং স্কুল লাইব্রেরি ছিল সব চেয়ে আগ্রহের জায়গা। দুই বইয়ের দোকান থেকে গল্পের বই কিনেছিলাম কয়েকবার। এখনো বসিরহাট শহরের নাম শুনলে চঞ্চল হয়ে উঠি। কেউ ডাকলে ছুটি। শৈশব বড় মায়ার। এই মায়া সমস্ত জীবনে কাটে না।
দণ্ডীরহাট স্কুলের পর আবার বেলগাছিয়া মনোহর একাডেমিতে ভর্তি হলাম। ক্লাস সেভেন। রেজাল্ট কেন আগের মত হয়নি জানি না। দণ্ডীরহাট স্কুলের শিক্ষকরা ছাত্রদের সকলকে নামে, পারিবারিক ভাবে চিনতেন। মতিয়ার রহমান ফার্স্ট, আমি থার্ড হয়েছিলাম ফিরে আসার বছরে। আর প্রথম বছরে আমি হয়েছিলাম ফার্স্ট, মতিয়ার সেকেন্ড। জীবনে ফার্স্ট সেকেন্ড ওই দুবার। কলকাতায় এসে তা আর হয়নি। কারণ বাসায় অনেক লোক। আগেই বলেছি, আমাদের ইন্দ্র বিশ্বাস রোডের বাসাবাড়ি ছিল প্রায় এক মেসবাড়ি, জংশন ষ্টেশন। তখনো পূর্ব বঙ্গের লোকের আসায় বিরাম নেই। এপারে এসে আমাদের ফ্ল্যাটে সাময়িক আশ্রয় নিয়ে বাসা খুঁজে কাজ খুঁজে চলে যেতেন। অত ভীড়ে পড়ব কোথায় ? কে পড়া দেখায়? সকলেই কথা বলছে, হাসছে, গল্প করছে। ক্লাস নাইনে সায়েন্স পেলাম। নাইন থেকে টেনে উঠতে গিয়ে সেকেন্ড কলে পাস করলাম। খুব খারাপ। ভয়ে আমার বউদির ভাই গটুদা, যে দিল্লি থেকে পাস করে কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত আমাদের ফ্ল্যাটে থেকে, এক বুদ্ধি দিল। প্রগ্রেস রিপোর্টের নম্বরের কালি ব্লেড ঘষে তুলে বেশি নম্বর লিখে দেওয়ার কাজ দুজনে মিলে করলাম। এবং ধরা পড়ে গেলাম বাড়িতে। সেই যে অপমানিত হলাম, এরপর আমি মন দিলাম পড়ায়। বুঝলাম এর ভিতরেই পড়তে হবে। দু বছর মন দিয়ে হায়ার সেকেন্ডারিতে ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। স্কুলে পাঁচজন ফার্স্ট ডিভিশন। আমি ওই পাঁচে এক, যে কিনা টায়েটোয়ে নম্বর পেয়ে নাইন থেকে টেনে উঠেছিল। টেন থেকে ইলেভেনে মাঝারি রেজাল্ট। একজন প্রাইভেট টিউটর ছিলেন আমার ইলেভেন ক্লাসে। তিনি বাবার অফিসেই চাকরি করতেন। সহকর্মী। সারাদিন অফিস করে এসে ঝিমোতেন আমাকে পড়াতে বসে। আমিই স্যারকে ডেকে অঙ্কের খাতা দেখাতাম। পণ করেছিলাম যে জালিয়াতি করেছিলাম প্রগ্রেস রিপোর্টে তার শোধ নিতে হবে। নিজের উপর ঘৃণা হয়েছিল সত্য।
আমাদের বাসা বাড়িতে বই আর পত্রিকার শেষ ছিল না, কিন্তু যে ছেলেটির ফাইনাল পরীক্ষা সামনে তার জন্য বাবার কোনো ভাবনা ছিল না। পরীক্ষা ১৮-ই মার্চ, ১৪-ই মার্চ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এলেন আমাদের বাসায়। শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ করবেন। সে এক হৈ হৈ কাণ্ড। আমার দাদা খুব রাগ করলেন। বাবা কর্ণপাত করলেন না। কয়েকদিন বাদে পরীক্ষা, অথচ বাড়ি লোকারণ্য। লাউড স্পিকার লাগিয়ে বাইরের মানুষকে কথামৃত শোনান হলো। তা ছাড়া উপায় কী, ফ্ল্যাটে আর কত মানুষ ঢুকতে পারে। আমি উপরে প্রতিবেশির ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে পড়লাম সারাদিন। বাবার কোনো চিন্তাই ছিল না ছেলের পরীক্ষা কেমন হতে পারে তা নিয়ে। সংসারে উদাসীন, কিন্তু বহু মানুষের ভার বয়েছেন। দণ্ডীরহাটের বাড়ি ছেড়ে এসে আর যাননি। ভাইরা অংশ বিক্রি করে দিল, তিনি ফেলেই রাখলেন। তারপর গ্রামের এক জামাই গিয়ে ঢুকলেন তাঁর ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিরাশ্রয় হয়ে। হয়ত তাঁর শ্বশুর মশায় বুদ্ধি দিয়েছিলেন, বড়বাবুর কাছে যাও, বাড়ি তো পড়েই আছে তালা দেওয়া। তিনি আর বেরোননি। এখনো আছেন। আমরাও আর যাই না। বাবা বলেছিলেন, তোদের আশ্রয়ের অভাব হবে না, ওকে তুলে দিস না। নিরুপায় মানুষ। যখন ঠিক করলাম ভাই বোনেরা মিলে তাঁকে রেজিস্ট্রি করে দেব, করোনা মহামারী চলে এল।
বেলগাছিয়ায় আমি বড় হয়েছি। কলকাতা চিনতে চিনতে বড় হয়েছি। যাদের সঙ্গে বড় হয়েছি তারা অনেকেই কিছুই করতে পারেনি জীবনে। কিন্তু আমার বন্ধুতা যায়নি। কাশীনাথ হয়েছিল ট্রামের কন্ডাক্টর, ট্রামে উঠলে ভাড়া নিত না। ভাড়া না নেওয়াই তার ক্ষমতা। না, কন্ডাক্টরির জন্য তার কোনো হীনমন্যতা ছিল না। আমার দাদার বন্ধু দিলীপদা, যিনি আমাদের ফ্ল্যাটে এসে আড্ডা দেন দাদার সঙ্গে তাঁকে একদিন দেখলাম দোতলা বাসের দোতলার কন্ডাক্টর। আমাকে দেখে হাসলেন। ভাড়া নিলেন না। উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে। নাটক সাহিত্য ইত্যাদি ভালোবাসেন। দাদা কলেজে পড়ান। কিন্তু তাঁদের নিবিড় বন্ধুতা ছিল। আমার বাবার মাসতুতো বোন কুন্তি পিসির বর, মানে আমার পিসে মশায়কেও একদিন দেখলাম দোতলা বাসে। কন্ডাক্টর। সাদা মনের সদা হাস্য মানুষ ছিলেন। বললেন তোমার পিসি ভালো আছে, বলে দিও।
হায়ার সেকেন্ডারির পরে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হলাম। রেজাল্ট ভালো, ভর্তি হতে অসুবিধে কিছু হয়নি। স্কটিশে পড়া ছিল আমার লক্ষ্য। ওখানে আমার দাদা পড়তেন। শুনতাম স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়লে নাটক, গল্প লেখা এসবে সুবিধে হবে। আমি তো পড়ি টিউশনি করে। দুটি কিশোরকে পড়াতাম, মিঠু, রিন্টু। তারা দুই ভাই এখন বোস্টনে থাকে। খুব বড় চাকুরে হয়েছে। উচ্চ পদের প্রযুক্তিবিদ। এর মানে জীবনে সফলতা পেয়েছে। সফলতা মানে কী, তা আজও বুঝি না। ভালো থাকা, খুব ভালো থাকার মানেই সফলতা। আর্থিক সফলতাই জীবনের সফলতা। অনেক হবে। বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, পারলে উড়োজাহাজ হবে, তাইই হয়ত সফলতা। সাতপুরুষ যাতে বসে খেতে পারে তার ব্যবস্থা করতে পারাই সফলতা। এতেই সুখ। কিন্তু আমার মাথায় যে সমরেশ বসুর পাড়ি গল্পটি আসন পেতে আছে। গল্পের সেই ভরা গাঙ, শুয়োর পার করা জীবন পণ করে, তারপর পাড়ে উঠে চুলো জ্বালিয়ে রুটি করতে বসা। খাওয়া, ভালোবাসা জন্মাল নারী আর পুরুষের ভিতর। এও তো এক সফলতা। কিন্তু আমরা এই জীবনের ধারে কাছে পৌঁছতে পারব না। তবে এও সত্য জীবনটা আর্থিক টানাটানি নিয়ে বয়েছি। বড় চাকরি করিনি। গ্রাম-ভারতবর্ষ চেনা যেন নেশা হয়ে গিয়েছিল। লেখা লেখা আর লেখা। খুঁজতে চেয়েছিলাম, যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের সেই জীবনে লোভ ছিল। কিন্তু তার সাথে মানুষের হয় নাকো দেখা।
কিন্তু না, জীবন বিমর্ষতায় ভরে যায়নি। আসলে জীবন অতি দুর্জ্ঞেয়। জীবন কাকে কতটা দেবে কেউ জানে না। ব্যর্থতায় ভরা বিমর্ষ জীবনকে শেষ পর্যন্ত জীবন যে একেবারে ফেরায় না তাও দেখেছি। জীবনানন্দকে নিয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি গল্প আছে, ‘মাছের কাঁটার সফলতা’। তাঁর অকাল প্রয়াণ ( দুর্ঘটনা কিংবা আত্মহত্যা ) ৫৪ বছর বয়সে। তাঁর সময়ের অনুজপ্রতিম কিন্তু সফল কবি, লেখক এসেছেন তাঁর শতবর্ষ পালন অনুষ্ঠানে। তাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁদের সামনে সেই প্রত্যাখ্যাত, বিমর্ষ জীবনের অধিকারী কবি হিমালয় হয়ে উঠেছেন। তাঁরা জীবদ্দশায় বিস্মৃত হচ্ছেন।
মিঠু, রিন্টুর সঙ্গে কিছুদিন আগে যোগাযোগ হয়েছিল। ওদের পড়িয়ে পেতাম নব্বই টাকা। সে অনেক টাকা। তা দিয়ে কলেজের মাইনে এবং হাত খরচ। বাসের ভাড়া বাঁচাতে কতদিন হেঁটে ফিরেছি হেঁদুয়া থেকে বেলগাছিয়া। ভাড়া কত ছিল। দশ নয়া পয়সা হয়ত। কিংবা তারও কম। আট হতে পারে। মনে নেই। সকালে একটি জিরো পিরিয়ড ছিল। নটায় বসত সেই ক্লাস। অনার্স পড়ছি অথচ মন পড়ে আছে সাহিত্যে। অধ্যাপকের কাছে পড়তে যে খরচ তা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না বাবার। চাকরি খারাপ করতেন না, কিন্তু লোন শোধ করতে বেতনের অনেকটা কাটা যেত। লোন হয়েছিল দণ্ডীরহাটের বাড়ির জন্য। কলেজ বা স্কুলের বাইরে যে টিচার লাগে, এই কথাটা বিশ্বাসই করতেন না তিনি। ক্লাস নোটে যে অনার্স পড়া হয় না, তা বুঝতেন না তিনি। বুঝেও কিছু করার ছিল না তাইই বোঝা হত না।
১৯৬৮ সালে আমি স্কটিশ চার্চ কলেজে যখন ভর্তি হই, তখন কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল ও নিশীথ ভড় বিখ্যাত। ওঁরা দু’জন বোধ হয় থার্ড ইয়ার হবেন। আমি ওঁদের নামে চিনি। কবিতা পড়েছি। দূর থেকে দেখতাম এই প্রিয় কবিকে। আর দেখলাম রোমি চৌধুরীকে। তিনি তখন অরুন্ধতী দেবীর প্রথম ছবি ‘ছুটি’ তে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছেন। এইই তো স্কটিশ চার্চ কলেজ। নিশীথ ভড় চলে গেছেন, পার্থপ্রতিম চলে গেলেন এই ক’দিন আগে। স্কটিশে দেখতাম কেয়া চক্রবর্তীকে। দেখতাম কবি তরুণ সান্যালকে। মুগ্ধ চোখে এঁদের দেখছি আমি সাহিত্য শিল্প পিপাসু রসায়নের ছাত্র। গল্প লেখার খুব ইচ্ছে। আলাপ করব, কী বলব কবিকে? কলেজ ম্যাগাজিনে গল্প দিলাম, ছাপা হলো না। কলেজ সোস্যালে ছাত্ররা থিয়েটার করে। ঋত্বিক ঘটকের জ্বালা নাটক হবে। ছাত্রদের ডাকা হয়েছে, অডিশন নেবেন সদ্য কলেজ প্রাক্তনী। তিনি বেতারে আছেন। আমি বাদ গেলাম। অথচ আমি তো থিয়েটার করে করে বড় হয়েছি। মিনারভা থিয়েটারে অভিনয় করেছি। থিয়েটার সেন্টারে অভিনয় করেছি ঋতায়ন নাট্যদলের হয়ে। না, স্কটিশ আমাকে কিছুই দেয়নি। বেশ ক’বছর আগে প্রাক্তনীদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল বড় এক পুনর্মিলন উৎসবে। আমার ডাক ছিল না। অনার্সের রেজাল্ট ভালো হলো না। এম এস সি পড়তে পারলাম না সামান্য ক’নম্বরের জন্য। পার্ট ওয়ান পরীক্ষার কথা মনে আছে, বই খুলে লিখছে বেশ কিছু ছাত্র। আমি যা পড়ে গিয়েছিলাম, সব ভুলে গেছি ওই কাণ্ড দেখে। গণ টোকাটুকিও রেজাল্ট খারাপের বড় কারণ। প্রাক্টিকাল পরীক্ষায় পার্ট ওয়ান, পারট-টু দুবারেই ভালো করেছিলাম। ল্যাবরেটরির ভিতরে গণ টোকাটুকি ছিল না তো। তবে হ্যাঁ, স্কটিশ চার্চ কলেজকে ভুলিনি। ওই যে দীর্ঘ সিঁড়ি, উঠেই বড় হল ঘর, চমৎকার এক উদ্যান, ক্যান্টিন, রসায়নের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট স্নেহময় অধ্যাপক অপরেশ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক এস, পি, এন-- শঙ্করপ্রসাদ নাগ, নিত্যানন্দ সাহা--বিস্মৃত হচ্ছি ক্রমশ। কম দিনের কথা তো নয়।
আমাদের সেই ১৯৬৮-র ব্যাচ, সেই ব্যাচেই ছিল গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী। দর্জি পাড়ার ছেলে। মনে হয় সায়েন্স পাস কোর্সে পড়ত। সে-ই পরে ভারতখ্যাত অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী হয়। দুর্গাদাস আচার্য নামে আমার এক সহপাঠী আছেন। তিনি সব খোঁজ রাখেন। তার সঙ্গে মিঠুনের যোগাযোগ হয়েছিল কলেজের জন্য একটি আর্থিক সাহায্যের প্রয়োজনে। তিনি দিয়েছিলেন। এসব দুর্গার মুখেই শোনা। তার সঙ্গে নিয়ত ফোনে কথা হয় আমার। সে কত খবর দেয়। কলেজের প্রিয় সহপাঠী কৃষ্ণপদ ঘোষ, কে পি, যে ছিল আমাদের লালু, শচীন দেব বর্মণে মুগ্ধ, থাকত দক্ষিণ কলকাতার চণ্ডীতলা, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সুইসাইড করেছিল। লালু ভালো রেজাল্ট করেছিল অনার্স-এ। বেঙ্গল ইমিউনিটিতে ভালো চাকরি করত। ্কলেজ থেকে বেরিয়ে এম এস সি না পড়তে পারার কারণে সকলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এখন দুর্গা কতজনের কথা বলে। অরবিন্দ সাহার মুখখানি আমার মনে ছিল, নামটি নয়। শোভাবাজারের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পুত্র। প্রায় ছ’ফুট লম্বা, চোখ ছিল কটা। তার বাড়ি কয়েকবার গেছি। উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়িই বলা যায়। প্রবীর বোস, ডাবু আসত বিডন স্ট্রিট থেকে একটি হিলম্যান গাড়ি চেপে। তাদের পরিবারে ছিল আইন ব্যবসা। পড়ল কেমিস্ট্রি, হলো সলিসিটর, থাকে এখন দক্ষিণ কলকাতা। আমাদের সহপাঠিনী একজনের কথা খুব মনে আছে। জনা গুপ্তভায়া। সে উদয় শঙ্করের দলে নৃত্যশিল্পী ছিল। গেল আমেরিকায় শো করতে। হ্যাঁ আমেরিকার কয়েকটি শহরে তাদের শো হয়েছিল। সেই সময় আমেরিকা! ভাবতেই পারতাম না। দুর্গার সঙ্গে তারও যোগাযোগ আছে। জনা থাকে মুদিয়ালি। তার জীবন এখন বিপর্যস্ত হয়েছে। একা থাকে। এমনি কত সহপাঠী বন্ধুদের খবর দেয় দুর্গা। মানস, সন্তোষ, মনোতোষ, নীলাঞ্জন---এঁরা কে কেমন আছে। জীবন কেমন গেছে এদের। কে কতটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জগত শেঠের বংশধর ছিল মণিকা শেঠ, শুনতাম তাই। সেও ছিল বিস্ময়ের। মণিকার খবরও জানে দুর্গা। গোটা স্কটিশ চার্চ কলেজকেই সামনে এনে দেয় সে। সেই যে ছাত্র পরিষদ করত একটি মস্তান ছেলে, জুনিয়র আমাদের, সকলের সামনে কলেজের এক নিরীহ অশিক্ষক কর্মচারীর গালে চড় মারল, সেই নব যুবক কর্পোরেশনে চাকরিতে ঢুকেছিল। পরে আর রাজনীতিতে বেশি উঁচুতে উঠতে পারেনি। নামটি না হয় বাদই থাক। তাকে ভয় লাগত। কী ভয়ানক সেই মস্তান ছাত্রর মুখ। দুর্গার সঙ্গে কলেজের সহপাঠীদের নিয়ে কথা বলতে এত ভালো লাগে। এক একজন এক রকম ভবিষ্যৎ নিয়ে আসি আমরা। অদ্ভুত সেই গৌরাঙ্গ, নিজেকে অকুল সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে একটি আস্ত জাহাজ পেয়ে গেল সাগর পাড়ি দিতে। মৃগয়া ছবি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, চেনা মুখ।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অশোক হয়ে গেল বিপ্লবী। আমারই উচ্চতার, ৫ ফুট ২ ইঞ্চি, ছোটখাট, মেধাবী ছাত্র। আচমকা কলেজে আসা বন্ধ করল। তারপর এক ছুটির দিনে দুপুরে আমাদের ফ্ল্যাটের জানালায় এসে চাপা গলায় ডাক দিল, অমর অমর অমর। আমি বেরলাম। পার্কে বসলাম গাছের ছায়ায়। সে বলল, এই শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষের মুক্তি আনবে না, তাই সে আর পড়বে না। শীঘ্রই গ্রামে চলে যাবে। বিপ্লব সমুখে। তার চোখে মুক্তির স্বপ্ন। আমি ভীরু। কিন্তু আমি লিখতে চাই। লিখে নিজের ভয় কাটাতে চাই। যা লিখি তা ওকে কয়েকবার শুনিয়েছি। ওই সময়ে ১৯৭০ নাগাদ ‘প্রতিশ্রুতি’ পত্রিকায় আমার গল্প ছাপা হয়েছিল পরপর দুটি। দিগভ্রান্ত এবং বিল্লুর জন্য কিছুক্ষণ। সে পড়েছিল। আমাকে সারা দুপুর ধরে বোঝাল, বিপ্লবী সাহিত্যের কথা। বিপ্লবে লেখকের ভূমিকা। রুশ ঔপন্যাসিক নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির উপন্যাস ‘ইস্পাত’ পড়তে বলল। বিপ্লবের গান পড়তে বলল। বিপ্লবের গান ছিল চৈনিক উপন্যাস সং অফ ওয়াং হাই-এর বাংলা অনুবাদ। অনুবাদ করেছিলেন অনীক পত্রিকার সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী। বলল কত স্বপ্নের কথা। বেলা পড়লে অশোক চলে গেল একা একা। ইন্দ্র বিশ্বাস রোড ধরে বেলগাছিয়া রোডে পা দিল। ট্রামের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। ট্রাম এল, সারাজীবনের মতো নিয়ে গেল তাকে। এর ছায়া বহ্নিলতা উপন্যাসে আছে। আমাদের আর দেখা হয়নি। কলেজের কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরি এর কয়েকদিন বাদেই ভাঙা হয়। শুনেছিলাম সেই কাজে অশোকও ছিল। এই বুর্জোয়া শিক্ষার অবসান হোক। অপরেশবাবু সব জানতেন। কার নেতৃত্বে ঘটেছে সেই কাজ জেনেও কিন্তু স্নেহময় মানুষটি পুলিশের কাছে মুখ খোলেননি। অনেক রাত অবধি অপরেশবাবু ল্যাবরেটরিতে থাকতেন শুনেছি। বাসস্থান নিকটেই। তাঁর সামনেই ঘটেছিল সব। তবু তিনি চেয়েছিলেন অশোক ফিরে আসুক। অশোক ফেরেনি। অশোকের কথাই যখন উঠল হিরন্ময়ের কথা বলি। স্কুলে সহপাঠী। অসাধারণ স্পিন বল করত। লেগ ব্রেক। ১৫ বছর বয়সেই বেলগাছিয়া ইউনাইটেড ক্লাবের হয়ে সি এ বি প্রথম ডিভিশনে খেলেছে। উইকেট পেয়েছে নিয়মিত। বলে ঘূর্ণি হয়। সে বিপ্লবী হয়ে ঘর ছাড়ল। আর ফেরেনি। বেঁচে আছে কি না জানি না। আমাদের মনোহর একাডেমির জয়দেবের কথা বলেছি আগেই। তবে সে জেল খেটে ফিরে এসেছিল। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৬ গেছে নানা উদ্বেগে। আমি লিখতে চেষ্টা করি। টিউশনির টাকায় পত্রিকা কিনি। অনীক, অনুষ্টুপ, নক্ষত্রের রোদ, ধ্বনি--সবই বিপ্লবী পত্রিকা। অনুষ্টুপ পত্রিকায় একটি গল্প পাঠিয়ে দিলাম। সম্পাদক অনিল আচার্য, যিনি আমার থেকে বয়সে বড় হলেও এখন নিকটজন, তিনি একটি চিঠি দিয়েছিলেন পোস্ট কার্ডে। বলেছিলেন সেই গল্পটি ছাপতে পারছেন না, কিন্তু আবার যেন আমি গল্প দিই। চিঠিটি খুব অনুপ্রাণিত করেছিল।
১৯৭১-এর রেজাল্ট ১৯৭২-এ প্রকাশিত হয়েছিল। পরীক্ষা পিছিয়ে পিছিয়ে এই অবস্থা। এম এস সি চান্স পেলাম না। বেকার বেকার। একা একা কেঁদেছিলাম। পড়া শেষ। আর পড়তে পারব না ? বন্ধুরা সব ঢুকে গেল এম এস সি পড়তে। সায়েন্স কলেজে নির্বাচিত ছাত্রদের তালিকা দেখে ফিরে এলাম। বাবা রিটায়ার করেছেন। বললেন ডব্লিউ বি সি এস দে। চাকরি খোঁজ। কলেজের বন্ধুরা মুছে গেল জীবন থেকে। পাড়ার বন্ধুরা থাকল। বিপুল সোম, আশিস দাস, নিমাই, পরিতোষ বসাক, বুল্টু...তাদের সঙ্গে বিকেলে সকালে ঘুরি। চাকরির আবেদন করি। ইন্দিরা গান্ধী ব্যাঙ্ক জাতীয় করণ করেছেন। গ্রামে গ্রামে ব্যাঙ্ক যাচ্ছে। কারো চাকরি হচ্ছে, কারো হচ্ছে না। কেউ ইন্টারভিউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না। কিছুই ভালো লাগে না। বিপুলের দাদা বিখ্যাত প্রযুক্তিবিদ, সদ্য প্রয়াত নীতিন সোম আমার দুটি গল্প প্রতিশ্রুতি পত্রিকার সম্পাদককে দিয়েছিলেন। সম্পাদক ব্রজেন ভট্টাচার্য পছন্দ করেছিলেন সেই গল্প। নীতিন সোম আমাকে বলতেন, তুমি কিন্তু লিখে যেও। ছাড়বে না। তখন বিপুলদের প্রেসে ভোটার তালিকা ছাপা হত। সেই কাজ করলাম কিছুদিন। কিছু টাকা পেলাম। জীবন কোনদিকে যাবে ধরতে পারছিলাম না। বন্ধু নিমাইয়ের বাবা একটি কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির চাকরির প্রস্তাব দিলেন। হলদিয়া যেতে হবে। মাড়োয়াড়ি কোম্পানি, ৩০০ টাকা মাইনে দেবে। সাক্ষাৎকার হল বড়বাজারে কোম্পানির গদিতে। জিজ্ঞেস করল আমি এখন কী করি? গল্প লিখি শুনে বরবাদ। যে সন্টু বাবু সেই মাড়োয়াড়ি গদিতে নিয়ে গিয়েছিলেন নিমাইয়ের বাবার কথা শুনে তাঁর কাছে চাকরির খবর শুনতে কতবার গেছি। তিনি আর দেখা করতেন না। বাড়িতে থাকলেও বলে দেওয়া হত, নেই। বোকার মত গল্প লিখি বলে নেশল কোম্পানিতে ইন্টারভিউ পেয়ে চাকরি হয়নি। কী করব জানি না। তাহলে গল্প লেখার কথা বলব না ? আমি তো ওইটা করি। বলব কী? কিছুই করি না স্যার, পড়ি। কী পড়, আন্তন চেখবের গল্প। আরে আমি তো কেমিস্ট্রি পড়েছি। কেন পড়ব আন্তন চেখব বা তারাশঙ্কর ? কোম্পানি কি ওই জন্য চাকরি দেবে ? বলতে হবে সায়েন্স টু ডে পড়ি। কেমিস্ট্রিই পড়ি। পড়ে নম্বর না পেয়ে এম এস সি না ভর্তি হতে পেরে আমাকে ওইসবই পড়ার কথা বলতে হবে। ময়লারের ইনঅরগানিক কেমিস্ট্রি, ফিনারের অরগানিক কেমিস্ট্রি, জে এন মুখারজির ফিজিকাল কেমিস্ট্রি পড়ি স্যার। আগেও পড়েছিলাম। নম্বর পাইনি মনের মতো। কী যে হবে আমার ? সামনে কী আছে ? জীবন এক অনিশ্চিত যাত্রা।
সুন্দর ।
'শৈশব বড় মায়ার।এই মায়ায় জীবন কাটে না'।.. সত্যিই...
ব্যক্তি লেখককে জানার আগ্রহ চিরকালই দুনির্বার। অকপট এই লেখা তৃপ্ত করছে। এগিয়ে চলুক।
খুব ভালো লাগছে। লেখকের অনেক অজানা কথা।এগিয়ে চলুক।
এই যে বড়ো লোক কাকে বলে ....এটা আমিও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি !! সব আছে ।..বাড়ি , গাড়ি , দামি চাকরি ।..মোটা পয়সা ।..কিন্তু মন টা বড়ো না। দারিদ্র ভোগ করেও দারিদ্র কে ঘৃণা করে ।..সব কিছু তে একটা উন্নাসিকতা ।..তার পর .....ছিল সন্ন্যাস জীবন ( এই অর্থে যে সমাজের মুক্তির কথা বলতো এক সময় ।..সাম্য বাদের কথা বলতো , ধর্মীয় গোড়ামি কে ঘৃণা করতো ) ।..পরে এরাই হলো কর্পোরেট জগতের লোক ।..এই দৃশ্য সমানে দেখে যাচ্ছি দাদা !! আমার বাড়িতে কাজ করে যে বউ টা ।..সে যখন তার দেশ বাড়িতে যায় ।..আসার সময় হাতে করে নিয়ে আসে তাদের ক্ষেতের তৈরি জিনিস ।..আমাকে বলতেও হয় না ।..কি অফুরন্ত ভালো বাসা ।..কি উদার এরা ।..মাথানত হয়ে যায় এদের কাছে ।..আর নিজের লোক ???খবর রাখবে তার সময় নেই !!কে বড় লোক ???
চমত্কার সাবলীল মনোগ্রাহী লেখা।