করোনার দিনগুলি #৭
স্পিরিট
মনটা খিঁচড়ে ছিল। সকালে ডাঃ কৌস্তভ রায়ের ফোনটা পেয়ে ভালো হয়ে গেল।
ওনাকে কোনোদিন মুখোমুখি দেখিনি। বালিতে ওনার চেম্বারে বসে ফোন করছেন।
সাইক্রিয়াট্রির ডাক্তারবাবু। এই মহামারীর সময় দিব্যি ঘরে থাকতে পারতেন। তা না করে চেম্বার খুলে বসে আছেন। জ্বরের রোগী দেখছেন। বললেন, 'সকাল থেকে দুজন রোগী দেখেছি। কেউই পয়সা দিতে পারেনি। এখন বসে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজছি।'
তারপরেই পীযূষদার ফোন পেলাম, 'কিরে, বেঁচে আছিস? আমি এই চেম্বারে চললুম।'
বিষন্নতা পুরোপুরি কেটে গেল। আমার অনেক সিনিয়ার রা রোগী দেখে চলেছেন। অনেকেই নানা রকম স্পেশালিষ্ট। ডিগ্রী- টিগ্রী চুলোয় দিয়ে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জ্বরের রোগী দেখছেন। অথচ এ সময় একমাস বাড়িতে বসে থাকলে তাদের তেমন কোনো অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো না।
কাল থেকে বড়ো একা একা লাগছিল। দুই সিনিয়ারের সাথে কথা বলে একাকিত্ব পুরোপুরি কেটে গেল। তারপর আরও একটা ভালো করা খবর পেলাম, গত চব্বিশ ঘণ্টায় নতুন কোনো করোনার কেস ধরা পড়েনি।
মনটা যখন ভালোই হল, তখন একটা মন ভালো করা গল্পই শোনাই। গতকালই আমার অন্তিম হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতলটি শেষ হয়ে গেছে। স্যানিটাইজারের অভাবে বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছি। একটা বড় বোতল স্পিরিট জোগাড় করেছি। তাই দিয়ে মাঝে মাঝে স্টেথো, বি পি মেশিনের হ্যাণ্ডেল মু্ঁছছি।
অনেক দিন বাদে স্পিরিট ব্যবহার করছি। এই জিনিসটাকে আমি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলি। কারণ আমার জীবনের প্রথম এমারজেন্সি নাইটে স্পিরিটের জন্য আমি প্রায় মরতে বসেছিলাম।
কি ভাবছেন, স্পিরিটে আগুন লেগে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল? সেসব কিছু নয়। তার থেকেও মারাত্মক। জীবনের প্রথম এমারজেন্সি নাইটেই আমি বুঝেছিলাম, ডাক্তার হওয়া মানেই রোজ আজব আজব ঘটনার সম্মুখীন হওয়া।
বরাবরই আমার উৎসাহ একটু বেশি। তার উপর সবে মাত্র ডাক্তার হয়েছি। এমারজেন্সিতে দৌড়াদৌড়ি করে কাজ করছি। এই শ্বাসকষ্টের রোগীকে নেবুলাইজেশন দিচ্ছি, পরক্ষণেই পেটে ব্যথার রোগীকে ইনজেকশন দিতে ছুটছি। প্রস্রাব আটকে গেছে, আঠারো সাইজের ক্যাথেটার পরিয়ে দিচ্ছি। আটটা থেকে রাত সাড়ে বারোটা অব্ধি দৌড়ে একটু নিশ্বাস ফেলার সময় পেলাম। সহযোগী কো-ইনটার্ন মেয়েটি আমার জন্য লুচি তরকারি বানিয়ে এনেছে। এর মধ্যে অনেকবার বলেছে, 'ঐন্দ্রিল খেয়ে নে।'
খাওয়ার আগে হাত ধোয়া জরুরি। হাত ধুতে গিয়ে দেখলাম সাবান নেই। সিস্টার দিদি বললেন, 'আগে স্পিরিট ঢেলে ভালো করে হাতের কনুই অবধি লাগিয়ে নিন। তারপর জল দিয়ে হাত ধোবেন।' জামার দু-তিন জায়গায় রক্ত লেগে গেছিল। স্পিরিটে তুলো ভিজিয়ে সেগুলো মুছলাম। জামার নিচের দিকটা স্পিরিটে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। যাকগে, স্পিরিট উদ্বায়ী পদার্থ। কিছুক্ষণ বাদে উবে যাবে।
আমি খাওয়া শেষ করার পর সিনিয়র মেডিকেল অফিসার বললেন, 'আমি একটু রেস্ট রুমে যাচ্ছি। খারাপ পেশেন্ট এলেই ডাক দিস।'
কো-ইনটার্ন মেয়েটি বলল, 'আমি দশ মিনিটের মধ্যে স্বর্ণময়ীতে আমার ঘর থেকে ঘুরে আসছি। বাসন-পত্র গুলো রেখে আসি।'
আমি একা এমারজেন্সিতে। হঠাৎ একদল লোক হইহই করতে করতে ঢুকল। ‘ডাক্তার কই, ডাক্তার কোথায় গেল। শিগগিরী আসুন, খুব সিরিয়াস পেশেন্ট।'
একজন বছর পঁচিশের যুবতী ট্রলির উপর দা্ঁতে দাঁত আটকে হাত-পা টান টান করে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে চোখের পাতা কাঁপছে। আনার আগে জল চিকিৎসা চলেছে। যুবতীর জামা-কাপড় ভিজে চুপচুপে।
আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। পেশেন্ট আমার সিলেবাসের মধ্যে পরে গেছে। কনভার্সন রিয়াকশনের টিপিক্যাল কেস। সাধারণত ঝগড়াঝাটি করার মাঝখানে কমবয়সী মেয়েরা এরকম চোখ টোখ উল্টে অজ্ঞান হয়ে যায়। তাকে নিয়ে আসে একদল স্বঘোষিত ঠাকুরপো। এইসব ঠাকুরপোদের মেজাজ অত্যন্ত উচ্চগ্রামে বাঁধা থাকে। আমি একটু আগেই এরকম একটি কেস দেখেছি ও নিজ হাতে চিকিৎসা করেছি। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের চাল চলনে একটুও কনফিডেন্সের অভাব দেখলেই ঠাকুরপোরা মাথায় চড়ে বসবে।
হেলতে দুলতে ট্রলির পাশে দাঁড়ালাম। প্রথমে স্টারনাম অর্থাৎ বুকের একদম উপরের হাড়ের উপর চাপ দিয়ে দেখি। না হলে এমোনিয়াম ক্লোরাইড শোঁকাব।
স্টারনামে জোরে চাপ দিতেই যুবতীটি লাফিয়ে উঠলো। আমি আবার হেলতে দুলতে চেয়ারে এসে বসলাম। বউদিকে উঠে বসতে দেখে দেওররা হতভম্ব হয়ে গেছে। একজন এগিয়ে এসে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, একটু অক্সিজেন দিলে হয় না?'
আমি গম্ভীর মুখে বললাম, 'অক্সিজেন দেওয়া যাবে না। তাহলে অক্সিজেন ওভার স্যাচুরেশন সিন্ড্রোম হয়ে যাবে।'
দেওরটি মাথা নেড়ে আবার বৌদির পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেছে। ওরা বিদায় নিচ্ছে না কেন? বউদি তার দেওরদের কিছু বলছে। তারা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে।
একজন ষণ্ডামার্কা দেওর এগিয়ে এলো। বলল, 'ছি, ছি, আপনার লজ্জা করেনা?'
আমি অবাক ভাবে বললাম, 'লজ্জা পাওয়ার কি আছে? এই রোগে এভাবেই... '
'রাখুন মশাই। আপনি কি আদৌ ডাক্তার? মেডিকেল কলেজের এমারজেন্সিতে মদ খেয়ে ডিউটি করছেন?'
মদ? আমি আকাশ থেকে পড়লাম। লুচি তরকারি খেয়েছি। মদ আবার কোত্থেকে এল?
দেওরপো এবার সরাসরি তুইতে নেমে এলো। বলল, 'জবা বউদি বললো তোর গা থেকে ভুর ভুর করে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। শালা দুনম্বরী ডাক্তার, মদ খেয়ে তুই মেয়েছেলের গায়ে হাত দিয়েছিস। পিটিয়ে তোর ছাল ছাড়িয়ে দেব গাণ্ডু।'
চিতকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম চোখে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার উঠে এসেছেন। আমাকে প্রায় দশজন মারমুখী দেওর ঘিরে ধরেছে। তিনি পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে টাকে হাত বোলাচ্ছেন।
গোলমাল শুনে বয়স্ক সিস্টার দিদিমণি এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, 'তোমাদের মতো মাথামোটা গর্দভ খুব কমই দেখা যায়। মদ নয়রে হতভাগারা, ওটা স্পিরিটের গন্ধ। এই নে স্পিরিটের বোতল, শুঁকে দেখ।'
সেই থেকে স্পিরিট ব্যবহার করতে ভয় পেতাম। ওয়ার্ডে স্যাভলন ব্যবহার করতাম। করোনার কল্যাণে এতদিন বাদে আবার স্পিরিট ব্যবহার করছি।
করোনার দিনগুলি #৮
আত্মঘাতী চিকিৎসক
দিনের আলোয় এতটা অসহায় লাগে না। কিন্তু রাতে চেম্বার থেকে ফেরার সময় ধূ ধূ ফাঁকা রাস্তায় কান্না পায়।
রাত দশটায় মধ্যমগ্রাম ওভারব্রিজ পার হচ্ছি। পুরো ওভারব্রিজে আমি একা। ঠিক মাঝখানে পৌঁছে স্কুটার থামালাম। রেললাইনের দু’ধারে সার সার আলো জ্বলছে। সিগনালের আলো লাল। মনে হচ্ছে হলিউডি হরর ফিল্ম। মৃতের শহরে আমি একা বেঁচে আছি।
আমি গলা ফাটিয়ে চিতকার করলেও কেউ শুনবে না। আমি হাউমাউ করে কাঁদলেও কেউ ফিরে তাকাবে না।
বড় অসহায় লাগছিলো। কতটা অসহায়? অনেকটা গ্রামীণ হাসপাতালের সেই দিনটার মতো।
২১৮ জন কুকুরে কামড়ানো রোগীর ইনজেকশন পেন্ডিং। ড্রিস্টিক থেকে সাপ্লাই এসেছে ৩০ জনের।
আমি ফোনে আর্তনাদ করছি, 'স্যার, এর থেকে সাপ্লাই দিতেন না। কাকে ছেড়ে কাকে দেব? সকলে ছিঁড়ে খাবে।'
ওপাশ থেকে ঠান্ডা ঘরে বসে বড়কর্তা বলছেন, 'প্রায়োরিটি অনুযায়ী দাও। প্রায়োরিটি ঠিক করার জ্ঞান টুকু নিশ্চয়ই আছে?’
৩০ টা ইনজেকশনের জন্য ৩৩ টা রেকমেন্ডেশন লেটার। এম এল এ, পঞ্চয়েত প্রধান, বিডিও, পঞ্চায়েত সদস্য সকলেই চিঠি লিখেছেন। এই রেকমেন্ডেশনের বাইরে যে ভারতবর্ষ আছে তারা আধপেটা খায়, সন্তান উৎপাদন করে আর লাইন দিয়ে সব জায়গা থেকেই ব্যর্থ হলে ফেরে। যাওয়ার সময় অভিশাপ দিয়ে যায়। 'এটা ঠিক করলা না ডাক্তার। ছুঁইয়ের টাকা ঠিকই এয়েচে। তুরাই টাকা মারি দিছিস। আমার ছাওয়ালের যদি কিছু হয়, তোরটাও বাঁচবে নারে।'
প্রায়োরিটি বস্তুটা কি? এদেশে যার বেশি অর্থ আছে, তার ইচ্ছাটাই হলো প্রায়োরিটি। বেশি পরিমাণে অর্থ উপার্জনের কৌশল শেখাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সেই প্রায়োরিটির চাপেই N95 মাস্ক বাজার থেকে রাতারাতি হাওয়া হয়ে যায়। তরুণ চিকিৎসকেরা সার্জিক্যাল মাস্ক পরেই অভিমূন্যের মতো চক্রব্যূহে ঢুকতে বাধ্য হয়।
এদেশের প্রায়োরিটি কি? ২০২০ সালের বাজেট অনুযায়ী স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। আর শুধু আর্ম ফোর্সের জন্যই বরাদ্দ ৪ লক্ষ ৭১ হাজার কোটি টাকা। অতএব পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ যে দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের চেয়ে বেশি প্রায়োরিটির, সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ প্রকাশের জায়গা নেই।
চিকিৎসকদের সাথে দয়া করে সৈন্যবাহিনীর তুলনা করবেন না। এতে সেনাদের অপমান করা হয়। কোনো সেনাই প্লাস্টিকের বন্দুক নিয়ে আসল লড়াইয়ের মাঠে নামেনা। আর বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতাল ও করোনা সেণ্টার কলকাতা মেডিকেল কলেজে আমার ভাইবোনদের PPE এর নামে দেওয়া হচ্ছে ছেঁড়া কমদামি রেনকোট। N95 মাস্কের বদলে দেওয়া হচ্ছে সার্জিক্যাল মাস্ক।
তবু ভাইবোনগুলি মৃত্যুপুরীতে হাসিমুখে ঢুকছে। দিনের পর দিন বাড়ি ঘর থেকে নিজেকে হাসপাতালেই কোয়ারান্টাইন করে রাখছে।
যে সব উপরতলার চিকিৎসক নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁরা কি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে থাকতে চিকিৎসা শাস্ত্রের গোড়ার কথা গুলো, ইনফেকশন প্রিভেনশনের বেসিক তথ্যগুলো ভুলে গেছেন?
স্কুটারে স্টার্ট দিলাম। বাড়ি ফিরে স্নান করতে হবে। সারাদিনের পরা জামাকাপড় কেচে ফেলতে হবে।
বাড়িতে পৌঁছে দেখি বাবা স্কুটার বার করছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছ?
একটা লেবার পেশেন্ট ভালো পোগ্রেস করছে না। এমারজেন্সি সিজার হতে পারে। আমি রাতে ফিরব না। নার্সিং হোমেই থেকে যাব। রাতের আর এম ও আসতে পারেনি।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাবা স্কুটার নিয়ে বেড়িয়ে গেল। বাঙালি আত্মঘাতী জাতি কিনা জানিনা, তবে বাঙালি চিকিৎসক নিঃসন্দেহে একটি আত্মঘাতী জাতি।
করোনার দিনগুলি #৯
আমি মানসিক রোগের চিকিৎসক নই। তবু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, এই দুঃসময়েও যারা বাধ্য হয়ে ডাক্তার দেখাতে আসছেন, তাঁরা অনেকেই আতংক, হতাশা ইত্যাদি নানারকম মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।
দু’দিনের সামান্য সর্দি-জ্বর। একটু গরম জলের ভাপ নিলে আর প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেলে দু-তিনদিন বাদে কমে যায়, তাই নিয়েও লোকে আতংকে ডাক্তার দেখাচ্ছেন।।
আরেকদল রোগী আসছেন প্যানিক এটাকে আক্রান্ত হয়ে। বুক ধড়ফড়, বুকে চাপ চাপ ব্যথা, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই রোগীদের মধ্যে অনেকই ফুটপাতের বস্ত্র ব্যবসায়ী। এনারা সারা বছরে চৈত্র সেলের সময়ই দুটো পয়সার মুখ দেখেন। সেই আশায় ধার দেনা করে অনেক মাল তুলেছিলেন।
আরও একরকম রোগী পাচ্ছি। এলকোহল উইথড্রয়াল সিন্ড্রোমের। এনারা সাধারণত নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। লকডাউনের সময় অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে মদ জোগাড় করতে পারছেন না। হাত-পা কাঁপছে, ঘুম হচ্ছে না, বমি হচ্ছে, ভুল বকছেন। দু-এক জনকে হাসপাতালেও ভর্তি করতে বললাম। লকডাউনের চক্করে দু-চারজন মাতাল যদি মদ্যপান ছেড়ে দেন, সেটুকুই লাভ।
তবে মহামারীর মধ্যেও অন্যান্য এমারজেন্সি কিন্তু থেমে নেই। এনারাই পড়েছেন সবচেয়ে সমস্যায়। আজকে একজন বয়স্ক মহিলা এসেছিলেন তার স্বামীর কোলোনোস্কোপি রিপোর্ট নিয়ে। রিপোর্টে ক্যন্সারাস গ্রোথ ধরা পড়েছে। বায়োপ্সি রিপোর্ট এখনো পেন্ডিং। রেক্টাম থেকে ব্লিডিং হয়েই যাচ্ছে। যাকে দেখাচ্ছিলেন তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। নার্সিংহোমে ফোন করেছিলেন, তারা লকডাউনের পরে যোগাযোগ করতে বলেছেন। ওই মহিলা আব্দালপুর থেকে চার কিলোমিটার হেঁটে আমার বাড়িতে এসেছেন। কোনো ভ্যান, রিকশা পাননি। ওনার একমাত্র ছেলে পুনেতে আটকে আছেন, আসতে পারছেন না। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, 'ডাক্তারবাবু, আপনি শুধু ওষুধ দিয়ে এই লকডাউন শেষ হওয়া পর্যন্ত ব্লিডিংটা বন্ধ করে দিন।'
হার্ট এটাক, স্ট্রোক এসব রোগও অন্যান্য সময়ে যেরকম হয়, লক ডাউনের সময়ও তেমনই হচ্ছে। যানবাহনের ব্যবস্থা করতে গিয়ে বাড়ির লোকের নাভিশ্বাস উঠছে। অনেক ছোটো নার্সিং হোম আর রোগী ভর্তি করতে চাইছে না। সরকারি হাসপাতালেও অনেক সময় ভোগান্তি হচ্ছে। থ্যালাসেমিয়া, এপ্লাস্টিক এনিমিয়া, লিউকেমিয়ার রোগী যাদের বেঁচে থাকার জন্য ঘন ঘন রক্ত লাগে, রক্তের অভাবে তাঁরা প্রায় মরতে বসেছেন।
যাইহোক, মহামারীকে ঠেকানোর স্বার্থে এটুকু অসুবিধা আমাদের মেনে নিতেই হবে। এমনিতেই ভারতে বাজেটে সব খাতে ব্যায় ট্যায় হয়ে যাওয়ার পরে যে টুকু খুঁদ কুড়ো পড়ে থাকে, স্বাস্থ্য খাতে সেটুকু বরাদ্দ করা হয়। সেই ভিক্ষার টাকায় সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনো যে মহামারীকে একটা পাল্টা লড়াই দিয়ে যাচ্ছে তাই যথেষ্ট।
হাসপাতালে PPE'র নামে রেনকোট দেওয়া হচ্ছে। ওই রেনকোট পরে ভ্যাপসা গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিড়ে ভিড়াক্কার সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে হবে। কপালে ঘাম গড়ালেও হাত দিয়ে মোছা যাবেনা। N 95 মাস্ক এখনো কারো জোটেনি। কতজন ভাইবোনের মৃত্যুর পর সেটা এসে পৌঁছাবে এখনই বলা যাচ্ছে না।
দু-চারটে কমিশন খোর, কশাই, গণশত্রু ডাক্তার মরলে ভালই হয়! কিন্তু মুশকিল হল মরার আগে তাঁরা অন্তত কয়েকশো রোগীর মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে মরবেন। সেই অসহায় রোগীদের কথা ভেবে অন্তত এই তরুণ হতভাগ্য চিকিৎসকদের জন্য উপযুক্ত PPE দেওয়ার দাবী উঠুক।
তবে এর মধ্যেই আশার আলো, অনেকেই দরিদ্র, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। আজ মধ্যমগ্রাম তোমার আমার নামের একটি ফেসবুক গ্রুপের দুই যুবক আমার বাড়ির চেম্বারে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে গেলেন, দরিদ্র রোগীদের দেওয়ার জন্য। বলে গেলেন, আরও ওষুধ জোগাড়ের চেষ্টা করছেন। দু-একদিনের মধ্যেই পৌঁছে দেবেন। গৌড় সেখান থেকে ওষুধ বেছে আজই দোহাড়িয়ায় দু'জন দুস্থ রোগীকে কিছু ওষুধ পৌঁছে দিয়েছে।
মারাত্মক লেখা, আপনাদের মতো যোদ্ধারাই মহামারী ঠেকাবে। ঢাকা থেকে অভিনন্দন। উড়ুক
#
আগেভাগেই ইট ফেলে রাখি, করোনা বিদায়ের পর এই অমূল্য লেখাগুলো গুরুচণ্ডা৯ থেকে বই আকারে প্রকাশিত হোক।