অনেকদিন আগের কথা। যে সময় কবির লড়াই ছিল এক বড়সড় বিনোদন। কবিতে কবিতে লড়াই হয় – অল্প সুরে বাঁধা ছড়ায়, কবিদের সঙ্গে থাকেন তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গ – বাজনদার, দোহার। আমাদের গল্পের কবির খুব নামডাক, নানা জায়গা থেকে ডাক আসে। রামায়ণ তাঁর বিশেষত্ব। ব্যস্ততার সঙ্গেই, আয়ও ঊর্ধ্বমুখী। সমস্যা একটাই – কবি আমাদের বেজায় কিপটে। যা আয় হয়, তার একটা নির্দিষ্ট অংশ দোহার-দলকে দেওয়ার কথা থাকলেও, প্রায় পুরোটাই পকেটস্থ করেন কবিবাবু। স্বভাবতই, অসন্তোষের পারদে থার্মোমিটার ভাঙার উপক্রম।
জমিয়ে লড়াই চলছে এক রাতে। উত্তেজনা তুঙ্গে। কবি হেঁকে উঠেছেন – “লঙ্কাদহন করেছিলেন কোন মহাজন?” (গিজদা গিজাং ছন্দে, পছন্দমতো সুরে)। ঠিক করাই আছে, দোহার বার দুয়েক “কোন মহাজন?” রিপিট করে, তার পরের বারে উত্তর দেবে। কিন্তু কোথায় কী? তিনবার রিপিট করার পরও যখন উত্তর এল না, কবি বিরক্ত হয়ে আবার হাঁকলেন, “লঙ্কাদহন করেছিলেন কোন মহাজন?” আশা – লোকে ভাববে, এই জায়গায় জোর দেওয়া উচিত ছিল বুঝি। কিন্তু এবারও, “কোন মহাজন?”-এরই প্রতিধ্বনি ভেসে এল নিজের দলের থেকে। রক্তচক্ষু কবি ঘুরে দাঁড়ালেন নিজের দলের দিকে। এরপর তো ছিছিক্কার পড়ে যাবে!
হঠাৎ, দ্বিতীয়বারের রিপিটেশনের পর ধীরে একটু অন্য সুর ভেসে এল এবার, “… ভাগের বেলায় কম-বেশি, বলিব কেমন?”
তাল ধরে রাখা খোলের আওয়াজ ভিন্ন টুঁ-শব্দটি নেই ঘরে কোথাও। কবির সঙ্গে বাজনদলের পান্ডার চোখাচোখি হল। অন্য ওয়েভলেংথে কথা হয়ে গেল দুই পুরোনো সঙ্গীর মধ্যে, কেউ বুঝলো না। কবি ঘুরে দাঁড়িয়ে, এক গাল হেসে, ছড়িয়ে, গলা ছেড়ে গাইলেন, “এবার থেকে হবে ভা-আ-আ-আই, সমানে সমা-আ-আ-আ-ন……!”
যন্ত্রের মতো, পরের তালের ঘেরে উত্তর মিললো,
কবিয়াল ভালোই ছিলেন এরপর আশা করি। কিন্তু তা নিয়ে আসলে বকতে বসিনি আজ (ধান ভানতে একটু হনুর গীত গাইলাম আর কি)।
হনুমানের লঙ্কাদহনের গল্পটা জানেন তো আপনারা? নিশ্চয়ই জানেন, পণ্ডিত ব্যক্তি আপনারা সব। আসলে কী জানেন তো, এদ্দিন ধরে এত লোকে আমাদের ইতিহাস আর পুরাণ লিখে চলেছে, যে সব ঘেঁটে চচ্চড়ি হয়ে গেছে। সে চচ্চড়ি খেতে ভালো, তাই বিশেষ কেউ আপত্তিও করে না। আসুন এই সুযোগে, খুব ছোট করে, আপনাদের লঙ্কাদহনের গল্পটা শোনাই।
এক ছিল হনুমান। সে ছিল খুব রামভক্ত।
মানে, প্রথম থেকে কি আর ছিল? এক সময় অবধি হনুমান দিব্যি জঙ্গুলে জীবন কাটাতো, হনুমতীদের সঙ্গে খুব ফস্টিনস্টি করতো, হনুমানোচিত নানারকম কাজ এমন দক্ষতার সঙ্গে করতো, যে গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল হনুর কীর্তিকলাপের। বাপ পবনদেবের অর্থ আর প্রতিপত্তির সাহায্য নিয়ে অনেক গ্যাঁড়াকল থেকে বেঁচেও ছিল অবশ্য ছোকরা। প্রতিপত্তি না থাকলে কি আর সূর্য নিজে প্রাইভেট ট্যুশন পড়ায় কাউকে? বেয়াদপ হনু সেখানে আপেল-ফাপেল নিয়ে কী একটা কেত্তন করেছিল, পবনদেব নিজের উদ্যোগে সে খবর ধামাচাপা দেন।
যাই হোক, সদ্য সদ্য এক সুদৃশ্য লেজ গজিয়েছে, উঁচু লাফও দিতে পারতো অন্যদের থেকে বেশি – হনুর কনফিডেন্স তখন তুঙ্গে। কখনো নিজের উৎসাহে, কখনো হনুমতীদের ইম্প্রেস করতে – হনু তখন র্যাডিকাল। বেদজ্ঞ হয়ে উঠলো (লোকে ভুল করে গীতা বলে)। এমতাবস্থায় মার্কেটে এলেন শ্রীরাম (রামদেব না; সে লোক অন্য। আসল শ্রীরামের সঙ্গে হনুর চেহারার মিল প্রায় নেই বললেই চলে)।
তা, তিনি এসেই বললেন, “সীতা বিনা আমি যেন মণিহারা ফণী”। হনুর জীবনেও তখন নারীঘটিত গোলমাল চলছিল, রামের দুঃখটা বুঝেই সে যোগ দিলো রামের দলে। দলের বাকি সবই ভালো, কেবল কথায় কথায় যে কেউ রামভক্তির মাপজোক করতে বসে পড়ে। কে কত বড় রামভক্ত – এ নিয়ে এক্কেরে কম্পিটিশনই শুরু হয়ে গেছে। হনু দেখলো, নিজের লাফ দেওয়ার ক্ষমতা আর রামভক্তির অ্যাড যদি একসঙ্গে দিতে হয়, তবে লঙ্কাদহন ছাড়া আর গতি নেই।
মাঝে অনেক কিছু হল – কী করে হনু সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কা গেছিল, কী করেই বা ঢুকে পড়েছিল অশোকবনে – সে সব কিসসা নিয়ে অনেক সিনেমা-টিনেমা হয়েছে। আমরা আর হ্যাজাচ্ছি না। মোদ্দা কথা, হনু – নিজের দায়িত্বে (পড়ুন নিজের লেজে) – লঙ্কায় আগুন দিয়েছিল। আগেই বলেছি, রামের বানর-সেনাদলে তখন ভক্তির ঢেউ খেলছে। সেজন্যেই কেউ বিশেষ জিজ্ঞেস করেনি, “বাপু হে, আগুন যে লাগালে, ঠিক কেন?” উত্তর সকলে ধরেই নিয়েছিল, কেন আবার? রামভক্তি! শুধু কয়েকজন ত্যাঁদোড় বানর ছিল (যেমন সেনাপতি অঙ্গদ; তার বয়স কম হলে কী হবে, জাঁদরেল সেনাপতি ছিল। অথবা জাম্বুবান, জ্ঞানের বাটখারা), যারা এককথায় হনুর এই আচরণ সমর্থন করেনি। হনু তাদের সকলকে একটাই যুক্তি দেখিয়েছিল, “লঙ্কা এমন ধ্বংস হবে, যে আর কেউ কখনো ধর্মের নামে যুদ্ধ করার সাহস পাবে না।” অনেকেই গিলেছিল যুক্তিটা। অনেকে গেলেনি। কোনো যুক্তিতেই কি এত নির্দোষ প্রাণের পরিকল্পিত হত্যা মেনে নেওয়া যায়?
লঙ্কাদহনের আগে হনুর বিশেষ ছবিছাবা নেই। পরবর্তীকালে, হনুর বেশি বয়সের ছবি দেখলে দেখা যায়, হনুর মুখ পুরো মিশি-কালো। এর আসল কারণ কারুরই জানা নেই। তবে নানা লোকে নানা কথা বলে। কেউ কেউ (যেমন আবাপ) বলে, ছোটবেলায় গুরু সূর্যের কাছে পড়াশুনো করার সময়ই মুখটা কালো হয়ে যায়: “…সূর্যদেবকে প্রণাম করে জানালেন, তাঁর কাছে তিনি বেদবেদান্ত, ব্যাকরণ শিখতে এসেছেন। সূর্য বললেন, ‘‘আমাকে তো দিবারাত্র কাজ করতে হয়। তোমাকে পড়ানোর সময় কোথায় পাব?’’ হনুমান গুরুর মুশকিল আসান করে দিলেন। ঠিক হল, তিনি সূর্যের রথের আগে আগে ছুটবেন, কিন্তু মুখ থাকবে রথের দিকে, সূর্যের থেকে যা কিছু শোনার শুনতে শুনতে রথের সমান বেগে পিছন দিকে ছুটবেন। সূর্যের রথ বাধা পাবে না। স্মৃতিধর হনুমান, এক বার শুনলেই তাঁর সব কিছু মনে থাকে। কিন্তু সূর্যের দিকে মুখ করে ব্যাক গিয়ারে ছুটছিলেন বলেই তো মুখটা পুড়ে কালো হয়ে গেল।…” (লিঙ্ক)
কিন্তু নিন্দুকদের মতে, লঙ্কাদহনের পরবর্তীকালেই হনুর মুখ কালো হয়েছিল। নিজেরই লেজের আগুন নাকি নেভাতে পারেনি হনু। সমুদ্রের জলে চুবিয়েও না। শেষে নিজেরই মুখে পুরতে হয়েছিল সেই বিষম প্রাণঘাতী লেজ। লেজ নিভেছিল, কিন্তু মুখ পুড়ে ঝামা।
সময় পেরিয়েছে, যুগ বদলেছে। এখন আর শুধু রামভক্তির দোহাই দিয়ে লঙ্কাদহনের গপ্পো মেনে নেয় না কেউ। ধর্মের নামে যুদ্ধ থামেনি। লঙ্কার সেই নরমেধ যজ্ঞের গল্পও জানতে পেরেছে লোকে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণেও। অনেক সিনেমা, লেখা, বই হয়েছে সেই নিয়ে।
কেবল এই এতদিন পরে আবার, হনুমানকে নিয়ে একখান সিনেমা হওয়ায় (‘আদিপুরুষ’ না ‘ওপেনহাইমার’ – কী একটা নাম) পুরোনো গোলমাল মাথাচাড়া দিয়েছে – লোকজন ক্ষেপে উঠে বলছে, এ সিনেমায় নাকি হনুকে গ্লোরিফাই করা হয়েছে, লঙ্কার তরফের কোনো দৃশ্য অবধি রাখা হয়নি। লঙ্কা-এপিসোডের পর হনু যে কতবড় ঋষির জীবন যাপন করেছিল, তা নিয়েই ত্যানা প্যাঁচানো হয়েছে নাকি। কোনো একসময়, হনুর মতো সেলেব্রিটি রামভক্তের বিরুদ্ধেও ‘ভক্তির অভাব’-এর অভিযোগ আসে। এক গোপন কমিটির কোঁৎকায় নাকি তখন হনুমানকে নিজের বুক চিরে দেখাতে হয়েছিল, আসলে সে কত বড় ভক্ত।
উলটোদিকে কেউ কেউ বলছে বটে, যে, হিংসার প্রদর্শনই যেমন হিংসার সমর্থন নয়, তেমন অদর্শনও ঔদাসীন্য নয়। হনুর মুখ কী করে ধীরে ধীরে কালো হয়ে গেছিল, তার ডিটেলের মাধ্যমেই নাকি পরিচালক লঙ্কাদহনের প্রতীকী খতিয়ান রেখেছেন। কী করে সিস্টেমিক রামভক্তির জোয়াল কাঁধে তুললে সে জোয়াল কাঁধে রক্তাক্ত দাগ ফেলতে বাধ্য, ভক্তি-মাপা ছুরি থেকে কেমন করে হনুমানের সিনা-ও বাঁচতে পারে না – এ সবই নাকি পরিচালকের দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল। জাম্বুবানের সঙ্গে কথোপকথনের দৃশ্য নাকি ‘উইথ গ্রেট লেজ, কামস গ্রেট রেস্পন্সিবিলিটি’-এই বাণীরই জয়গান।
কিন্তু সেসব গভীর কথা। আমরা কি আর অত বুঝি? আপাতত, গান গাই চলুন প্রাণভরে,
- লঙ্কাদহন করেছিলেন কোন মহাজন?
- বানর-সেনা সবাই ছিল, বলিব কেমন?
- কার পোড়া মুখে আছে দহনের প্রমাণ?
- লঙ্কাদহন করেছিলেন বীর হনুমান!