ছোটবেলায় স্কুলের ইংলিশের পাঠ্যবইতে রাসকিন বন্ডের লেখা পড়ে মুসৌরির সঙ্গে আলাপ। তাই সরেজমিনে দেখার লোভটা বড়বেলায় ছাড়া গেল না। রাসকিন বন্ড ল্যান্ডোরে থাকেন। প্যানডেমিকের আগে শনিবার বিকেলবেলা তিনি এই মুসৌরি ম্যালের বইয়ের দোকানে এসে বসতেন তিন চার ঘন্টা। বইতে সই করতেন। ভক্তদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। প্যানডেমিকের পর তিনি আর বাড়ি থেকে বেশি বেরোন না।
উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেহরাদুন দুন স্কুল, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট এইসবের জন্য বিখ্যাত। রাস্তাঘাট ঘিঞ্জি। অনেকটা শিলিগুড়ির মত জায়গা। কোনোকালে দিল্লি থেকে দেহরাদুন ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় না। বছরে বারোমাস ওয়েটিং লিস্ট। সেই দেহরাদুন থেকে একঘন্টা ওপরে উঠলে পাহাড়ের কোলে মুসৌরি এবং ল্যান্ডর। ব্রিটিশদের হাতে বানানো ম্যাল রোড এবং একগাদা বেকারি।
এছাড়াও মুসৌরিতে আছে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল একাডেমি - সিভিল সার্ভিস অফিসারদের ট্রেনিংয়ের জায়গা। আর একগাদা জলপ্রপাত আছে মুসৌরির আশেপাশে।
গাড়োয়াল হিমালয় দখল করার পর গোর্খাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের যুদ্ধ হয়েছিল এবং একসময় দেহরাদুন মুসৌরি গোর্খারা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সার্ভেয়ার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া থাকাকালীন জর্জ এভারেস্ট চেয়েছিলেন মুসৌরিতেই সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার নতুন অফিস হোক। শেষ পর্যন্ত সেটা হয় দেহরাদুনে। এছাড়াও দলাই লামাকে ভারতে প্রথমে মুসৌরিতেই আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। পরে তাকে ম্যাকলিওডগঞ্জে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
দিল্লী থেকে সবথেকে কাছের দুটো পাহাড়ী জনপদ মুসৌরি আর ঋষিকেশ। চার পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে। গরমকালে নিজেদের গাড়ি চালিয়ে সপ্তাহান্ত কাটানোর সবথেকে পছন্দের জায়গায় থাকার ফলে এই দু জায়গায় অতিমারী পরবর্তী সময়ে মারকাটারি ভিড়। তীব্র যানজট।
গরমকাল। কাশ্মীরি গেট থেকে উত্তরাখন্ড পরিবহণের এসি স্টারবাস। মিরাট , মুজফ্ফরনগর হয়ে ভোর পাঁচটার সময় নামিয়ে দিল দেহরাদুন ইন্টারস্টেট বাস স্ট্যান্ডের সামনে। এখান থেকে মুসৌরির বাস ধরতে গেলে যেতে হবে দেহরাদুন পাহাড়ি বাস স্ট্যান্ড। সেটা দেহরাদুন ট্রেন স্টেশনের পাশে। যেখান থেকে উত্তরাখণ্ডের বাকি বহু পার্বত্য জায়গায় যাবার বাস ছাড়ে। এই দুই বাস স্ট্যান্ডের দূরত্ত্ব তিন চার কিলোমিটার। হেঁটে সময় নষ্ট না করে অটোতে উঠে পড়া গেল।
ভোরবেলা দেহরাদুনে সূর্যোদয়
কুড়ি মিনিট পরে দেহরাদুন পাহাড়ি বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখা গেল মুসৌরির প্রথম বাস ছাড়বে সাতটায়। বাস স্ট্যান্ডের বাইরেই দেহরাদুন ট্যাক্সি ইউনিয়নের লোকেরা শামিয়ানা খাটিয়ে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে পড়েছে। আর তাদের মধ্যে এক একজন পালা করে মাইকে চেঁচাচ্ছে - "আজাও আজাও শেয়ার্ড ট্যাক্সি মুসুরি ওয়ালে"। খোঁজ নিয়ে জানা গেল মাথা পিছু সাড়ে তিনশো টাকা। বাস তখনো চালু হয়নি বলে অনেকেই সুড়সুড় করে এক একটা ট্যাক্সি বুক করে নিতে থাকলেন। রাতের বেলা যাত্রা করে মুসৌরিতে হোটেলে পৌঁছে ক্লান্তির আড়মোড়া ভাঙার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন মনে হল।
বাসের টিকিট এখন কাউন্টার থেকে নেবার প্রয়োজন নেই। বাসের দরজা খুললেই আগে হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠে জায়গা নিতে হবে। তারপর কন্ডাক্টর এলে টিকিট কাটা যাবে। কপালজোরে সিটটা পাওয়া গেল। মুসৌরিতে দুদিকে দুটো বাস স্ট্যান্ড - একদিকে লাইব্রেরি চক, আরেকদিকে পিকচার প্যালেস। এই দুটো বাস স্ট্যান্ড মুসৌরি ম্যালের রাস্তা দিয়ে জোড়া। এই বাস যাবে লাইব্রেরি চক। বাসে কিছু জনতা জোরে মোবাইলে গান বাজাচ্ছিল।
বাসে পাশে একটা শিলিগুড়ির ছেলে বসেছিল। সে আইআইটি খড়্গপুরে ভূতত্ববিদ্যার মাস্টার্সের ছাত্র, দেহরাদুনে এসেছে গরমকালে ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অফ হিমালয়ান জিওলজিতে ইন্টার্নশিপ করতে। কিছু ফুলগাছ, পাথর এইসবের নমুনা নিয়ে কালকে দেহরাদুন ফিরে যাবে।
দেহরাদুন পেরিয়ে অল্প এগোতেই অবাক হয়ে রাস্তার দুপাশে বহুতলের সারি দেখতে হল। এখানে নাকি দিল্লির অনেকে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন গরমকালে সময় কাটানোর জন্য। এছাড়াও দেহরাদুনের কাছাকাছি কলেজের ছেলেমেয়েরা এসব ফ্ল্যাটে ভাড়ায় থাকে। তারপর পাহাড়ে চড়তে শুরু করার সময় পড়ে ভাট্টা জলপ্রপাত। এই পাহাড়ী রাস্তায় বাঁকের সংখ্যা অনেক। এরপর সকাল আটটায় লাইব্রেরি চকে নেমে সামনেই গান্ধীজির মূর্তি দেখা গেল।
লাইব্রেরী চক থেকে নিচে দূরে দেহরাদুন
এত সকালেও কুয়াশায় মোড়া ভিউ পয়েন্টের গাজীবোতে জ্যাকেট পরে পর্যটকদের ভিড়। এদিকে আমি জ্যাকেট আনতে পুরো ভুলে মেরে দিয়েছি। মোবাইলে তাপমাত্রা দেখাচ্ছে পনেরো ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। ঠান্ডা হাওয়ার চোটে কিছুক্ষণ বাদে গলার কাছে হাফহাতা জামার সবকটা বোতাম আটকাতে হল। মাটির ভাঁড়ে বড় বড় দুকাপ চা খেয়ে ঠান্ডা কাটানো গেল একটু। তারপর ম্যাপ দেখে ম্যালের রাস্তা ধরে মুসৌরী শহরের সর্বোচ্চ জায়গা বন্দুক পাহাড়ে উঠতে থাকলাম। পাশে মাঝে মাঝে গাজিবো করা আছে। কাল রাতে গাজীবোতে বসে সুরাপানের চিন্হস্বরূপ কোথাও কোথাও ফাঁকা প্লাস্টিকের গ্লাস মাটিতে লুটোচ্ছে।
বন্দুক পাহাড়ে ওঠার রাস্তায়
সকাল নটার সময় বন্দুক পাহাড়ে একগাদা জাদু ,হাতসাফাই দেখানোর দোকান। এটা মূলত বাচ্চাদের সময় কাটানোর জায়গা বোঝা গেল। বেশিরভাগ তামাশার দোকান তখনো খোলেনি। চাঁদমারিতে সাজানো ছিল রংবেরঙের বেলুন। পাশে দু তিনটে খেলনা বন্দুক সাজিয়ে রাখা। দোকানের লোকজন সেগুলোতে ছররা ভরছে। নীচের ম্যাল থেকে বন্দুক পাহাড়ে রোপওয়ে চলে। সেটাও এখনো চালু হয়নি। কুকুরগুলো কুয়াশাঘেরা মেঝেতে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
সকালবেলা বন্দুক পাহাড়
আবার নীচে নামতে নামতে একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল একফাঁকে। ম্যালের রাস্তা ধরে ল্যান্ডর বাজারের দিকে এগোলাম।
মুসৌরির ম্যাল
ল্যান্ডর বাজারের ঘড়ি মিনার। ল্যান্ডরে পিকচার প্যালেস পেরিয়ে একটা ছোট দোকানে ঢুকে ম্যাগী খাওয়া গেল।
এর পরের গন্তব্য জর্জ এভারেস্টের বাড়ি। জর্জ এভারেস্ট মুসৌরি থেকে একটু দূরে একটা বাড়ি কিনেছিলেন থাকার জন্য। দশবছর ধরে সেটা তার অস্থায়ী অফিসও ছিল। হয়ত রাধানাথ শিকদারও আসতেন সেই বাড়িতে সার্ভে করার কাজে। লন্ডনে এভারেস্ট মারা যাবার পর এই বাড়ি ফাঁকা, ভেঙেচুরে গেছিল। সম্প্রতি সরকার এটাকে সারিয়ে সংরক্ষণের দায়িত্ত্ব নিয়েছে। তবে যখন গেছিলাম তখনও নতুন বাড়ির দরজা আমজনতার জন্য খোলা হয়নি। ওটা এখন হাইকিং করার জায়গা এবং মুসৌরীর সর্বোচ্চ বিন্দু।
ল্যান্ডর থেকে ম্যাল রোড ধরে আবার লাইব্রেরী চকে ফেরত এলাম। সেখানে এখন ভিড়ে ভিড়াক্কার। সব লোকাল সাইটসিয়িংয়ের ক্যাব ছাড়ছে। আর হামলে পড়ে স্কুটি ভাড়া দেবার এবং ভাড়া নেওয়ার জনতা। এই লাইব্রেরী চক থেকেই আরো পশ্চিমে যেতে হবে হাতিপাও জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যেতে হবে জর্জ এভারেস্টের বাড়ির জন্য। আর লাইব্রেরী চক থেকে উত্তর দিকে উঠলে কেম্পটি জলপ্রপাত।
জর্জ এভারেস্টের বাড়ির দিকে ওঠার পথে নিচে লাইব্রেরি চক এবং মুসৌরি
সুন্দর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আরো কয়েকজন পথচারীকে পাওয়া গেল। সবাই এভারেস্টের দিকেই চলেছে।
জর্জ এভারেস্টের রাস্তায় লিওপার্ড লজ
গাড়ি করে এলে একটা সময়ের পরে আর গাড়ি ওপরে উঠতে দেওয়া হয় না। গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে ওপরে এক কিলোমিটার হেঁটে উঠতে হবে। অনেকেই সুখে গাড়ি চড়ে এসে এই চড়াইটুকু উঠতে হাঁসফাঁস করছিলেন।
জর্জ এভারেস্টের বাড়ির সামনে ছোট গোল লন। বাড়ির পিছন দিকে হেলিপ্যাডও আছে।
এখান থেকে আরো ওপরের দিকে গেলে ওই দূরে জর্জ এভারেস্ট শৃঙ্গ। পাথর ফেলে ফেলে রাস্তা করা।
জর্জ এভারেস্ট শৃঙ্গে গিয়ে আবার সেই সকালের বাসের ছেলেটার সঙ্গে দেখা। সে ছোট ছোট কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে ব্যাগে পুরছিল। তিব্বতী রঙিন নিশান লাগানো আছে শৃঙ্গের ওপর। জায়গাটাতে প্লাস্টিকের বোতলের ক্যাপ , বিস্কিটের বা লজেন্সের র্যাপার ইত্যাদি যত্র তত্র ফেলে এমনভাবে নোংরা করা হয়েছে যে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাবে।
শৃঙ্গ থেকে জর্জ এভারেস্টের বাড়ি
তিব্বতী নিশান
জর্জ এভারেস্ট শৃঙ্গ জয়ের পর
লাইব্রেরি চক থেকে এই পুরো জর্জ এভারেস্ট আসা যাওয়া করতে করতে সময় লেগেছিল প্রায় পাঁচ ঘন্টা। তারপর লাইব্রেরী চকে এসে বিকেল চারটেতে বাস ধরে দেহরাদুনে ফেরত। ইন্টার স্টেট বাস স্ট্যান্ডের বাইরে দইবড়া খেয়ে দিল্লী যাবার এসি ষ্টারবাসে উঠে পড়া।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।