গরমকাল। ভোর চারটের সময় কোটা দেহরাদুন নন্দা দেবী এক্সপ্রেসে হরিদ্বার স্টেশনে নামলাম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখলাম অত ভোরেও অনেকে হেঁটে যাচ্ছেন ঘাটের দিকে। আলোআঁধারি মোটামুটি ফাঁকা রাস্তায় আমিও হাঁটতে থাকি। কুড়ি মিনিটে পৌঁছে গেলাম হরিদ্বারের প্রধান ঘাট হর কি পৌড়িতে ।
এই ভোরবেলা অন্ধকার কেটে একটু একটু আলো ফুটছে। হরিদ্বার আর ঋষিকেশের মাঝে একটা জায়গায় বাঁধ দিয়ে একটা খালের মত করে টেনে আনা হয়েছে হরিদ্বারের দিকে। আর আসল গঙ্গা বাঁধ দিয়ে ঘুরে গেছে অন্যদিকে। খালের শুরুতে বেশ কিছুটা জায়গা ঘিরে তৈরী করে দেওয়া হয়েছে হর কি পৌরি। আর বাকি পুরো খালটারই দুপাশে একদম টানা বাঁধানো ঘাট।
খালের ওপর কম করে তিন চারটে সেতু। আর বাঁধের দিকে একগাদা লম্বা লম্বা সেতুর মত স্ট্রাকচার যেগুলোর গেট তালাবন্ধ করে রাখা যাতে কেউ হেঁটে গিয়ে জলে না লাফাতে পারে। হর কি পৌড়ি থেকে উল্টোদিকে দেখা যায় রুরকী থেকে ঋষিকেশ যাবার সড়কের বাস লরি আর গাড়িদের হেডলাইট। দূরে সেই রাস্তার পাশে শিবমূর্তি।
মাঝে মাঝে মন্দিরের ঘন্টা বাজাচ্ছে কেউ। লোকজন ঘাটের রেলিংয়ের সঙ্গে লাগানো শিকল ধরে ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আধবুক জলে নেমে গঙ্গাস্নান করে নিচ্ছে। হর কি পৌড়িতে ঢুকতে গেলে জুতো বাইরে ছেড়ে আসতে হয়। ভেজা জামাকাপড় বদলাবার ছোট ছোট বুথ করা আছে।
সকাল পাঁচটায় ঘাটে দাঁড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে দুকাপ চা খেলাম ।
পাতা মুড়ে শঙ্কু আকৃতির ঠোঙা। তাতে গাঁদা ইত্যাদি পাঁচরকম ফুল সাজানো। একটা ধূপকাঠি গুঁজে দেওয়া আছে। কিনবেন আর ধূপকাঠি জ্বালিয়ে ছেড়ে দেবেন গঙ্গার জলে। এছাড়াও বড় বড় লাল প্লাস্টিকের কলসী সাজিয়ে বসেছে লোকজন। ওতে ভরে গঙ্গাজল নিয়ে যাবার জন্য।
একটু বাদেই বোঝা গেল ভোরবেলার গঙ্গা আরতি শুরু হবে। ঘোষণা শুরু হতে অনেকে ঘাটের ওপর বসে পড়ল আরতি শোনার জন্য। আর জোরে জোরে লাউডস্পিকারে আরতি শুরু হতেই আমি হর কি পৌরি থেকে বেরিয়ে এসে পুরো গঙ্গার চারপাশে চরকি পাক মারতে লাগলাম। কিছু মানুষ চাদর পেতে ঘুমোচ্ছে গাছতলায়। ঠান্ডা হাওয়া পাহাড় থেকে নেমে জলের ওপর দিয়ে বয়ে আসছে। ঘাটের সিঁড়িগুলোর ওপর সামাজিক দূরত্ত্ব মেনে কোভিডকালে আঁকা সাদা সাদা বৃত্তগুলো থেকে গেছে।
হর কি পৌরি থেকে বেরিয়ে এলে একটু দূরে যেতেই আর আরতি শোনা যাচ্ছে না। একটা সেতু দিয়ে গঙ্গা পেরিয়ে গিয়ে হাঁটি আবার সামনে গিয়ে আরেকটা সেতু পেরিয়ে এদিকে চলে আসি। এরকম এক ঘন্টা হাঁটাহাঁটি করতে করতে সূর্যোদয় দেখে ফেললাম।
ঠাণ্ডা জোলো হাওয়া
হরিদ্বারে সূর্যোদয়
তেত্রিশ কোটির মধ্যে কেউ?
খালের একদম শেষের দিকে আছে ওঁ আকৃতির একটা ফুট ব্রিজ। সেখানে একদল শহুরে লোকজন যোগাভ্যাস করছেন।
ঠান্ডা হাওয়া আস্তে আস্তে কমছিল বলে হাঁটা লাগালাম হরিদ্বারের একটা উঁচু জায়গার দিকে ওপর থেকে হরিদ্বার দেখার জন্য। ওখানে মনসা দেবীর একটা মন্দির আছে আর উড়ন খাটোলা রোপওয়ে চলে পাহাড়ের ওপরে মন্দির পর্যন্ত।
নদী পেরিয়ে যেতে হবে ওই পাহাড়ের দিকে
পায়ে হেঁটে পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে উঠতে থাকলাম। শুরুতেই একপাল স্কুটিওলা দাঁড়িয়ে ছিল। বলল রাস্তা উঁচু বলে ওরা টাকা দিলেই স্কুটিতে করে মন্দিরের কাছে ছেড়ে দেবে। তারপর রাস্তার দুধারে পুজোর নৈবেদ্য মুড়ি ইত্যাদির প্যাকেট নিয়ে লোকজন বসে ছিল। আর তারা সবাই বলছে জুতো ছেড়ে রেখে যান। সেবার টাকা লাগবে না। সেবা অর্থে জুতো যাতে চুরি না যায় সেজন্য ওদের পাঁচ দশটাকা দিতে হয়। রাস্তা থেকে কয়েকটা ছবি নিয়ে নেমে আসা গেল।
পাখির চোখে হরিদ্বার। দূরে গঙ্গার মূল ধারা দেখা যাচ্ছে।
একটু বেলা বাড়তেই সকাল নটার সময় দূর থেকে দেখা গেল ঘাটে এখন তিলধারণের জায়গা নেই। শুধু মাথার সারি। ভিড়ের মাঝে সেদিকে আর যাওয়া নিষ্প্রয়োজন বুঝে স্টেশনের দিকে পালিয়ে আসতে আসতে একটা জায়গায় কচুরী তরকারি। তারপর স্টেশনে এসে ঋষিকেশের একটা ট্রেন ধরা। ট্রেনে হরিদ্বার থেকে ঋষিকেশ কুড়ি মিনিট লাগে। আসলে ট্রেন নেবার দরকার ছিল না। সবসময় গাদা গাদা শেয়ার অটো, বাস যায়। তখন জানতাম না। এই ট্রেনের টিকিট আগে কাটা ছিল।
যোগ নগরী ঋষিকেশ ট্রেন স্টেশন
সম্প্রতি ঋষিকেশের নতুন ট্রেন স্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে 'যোগ নগরী ঋষিকেশ' এবং একে সেভাবেই পর্যটকদের কাছে প্যাকেজ করা হচ্ছে। অলিগলিতে যোগ শেখার কেন্দ্র, একগাদা আশ্রম আর 'মোক্ষে'র সন্ধানরত বিদেশীদের ভিড়। ঋষিকেশের গঙ্গার সৈকত গুলোতেও অনেকে গঙ্গাস্নান করেন।
ঋষিকেশকে বিদেশীদের মধ্যে আরো জনপ্রিয় করেছে ষাটের দশকের শেষদিকে বিটলসদের এখানে আগমন। বিটলসরা এসেছিলেন মহেশ যোগীর কাছে 'ট্রান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন' শিখতে। আশ্রমটা ছিল সরকারের থেকে লিজে নেওয়া জায়গা। লিজ শেষ হয়ে যাবার পর পুরো আশ্রম পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং প্যান ট্রিনিটি দাসের মত হিপি শিল্পীরা ঢুকে ভাঙা বাড়িগুলোর সর্বত্র গ্রাফিত্তি করে যেতে থাকে। এতদিন রাজাজী জাতীয় উদ্যানের জঙ্গল ধীরে ধীরে খেয়ে নিচ্ছিল আশ্রমের ভাঙা ঘরবাড়ি। সরকার জায়গাটা ঘিরে দিয়েছে যাতে বন্য জন্তু না ঢুকে পড়ে। কিছু কিছু বাড়ি সারানো হয়েছে।
ঋষিকেশে এই সকাল এগারোটায় যথেষ্ট গরম। হেঁটে হেঁটে এগোলাম জানকী ঝুলার দিকে। কাঁটাতেলে চলা বড় অটোগুলো বীভৎস ঘটঘট আওয়াজ করে রাস্তায় যাচ্ছে। এদেশী বিদেশী সবাই স্কুটি আর বাইক ভাড়া করে ঘুরছে। হর্ণের চিলচিৎকার আর যানজটে শান্তির দফারফা।
জানকী ঝুলা জানকী ঝুলা পেরিয়ে উল্টোদিকে কিছুটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটলে মহেশ যোগীর আশ্রম। পরিচয়পত্র দেখিয়ে বনকর্মীদের থেকে টিকিট নিতে হয়।
নদীর বুক থেকে কুড়িয়ে আনা হিমালয়ের গোল গোল পাথর দিয়ে এইসব ধ্যানকক্ষগুলো তৈরী। এক একটা কক্ষের ভেতর একা একা ধ্যান করতে হত। আশ্রম জুড়ে মোট আশিটার মত এরকম কক্ষ আছে।
এক ধ্যানকক্ষের ভেতর কিম্ভূত গ্রাফিত্তি
সবথেকে সুস্থ বাড়িটার একতলায় একটা সংগ্রহশালা করে বিটলসদের আশ্রমবাসের সময়ের অনেক ছবি আর লেখা গানের লিরিক টাঙানো। সেখানেই একপাশে একটা ছোট ক্যাফেটেরিয়াও আছে ।
ছত্রাক এবং তেলেনাপোতা
দিদগেরিদু - ঋষিকেশের আশ্রমের ভাঙা দেয়ালে অস্ট্রেলিয়ার এবোরিজিন্যালদের বাদ্যযন্ত্রের গ্রাফিত্তি
প্যান ট্রিনিটি দাসের আঁকা।
আশ্রমিকদের প্রধান হলঘর
ছাদের মাথাতেও উল্টোনো ডিমের মত ধ্যানকক্ষ
মহেশ যোগীর বাসস্থান
মহেশ যোগীর দোতলা বাড়ির উঠোনের পিছন দিকে দেখা যায় নীচে বয়ে যাচ্ছে সবুজ গঙ্গা। এখানে এসে চারপাশে নৈঃশব্দের মধ্যে গঙ্গার কুলুকুলু আওয়াজটা মনে রাখার মত।
আশ্রম থেকে বেরিয়ে নদীর সেই পার ধরেই হাঁটতে হাঁটতে রামঝুলা পর্যন্ত গেলাম। এদিকের রাস্তাটা একটু নির্জন। গাছের ছায়া ঢাকা। রামঝুলায় গিয়ে আবার গঙ্গা পেরোলাম। উল্টোদিকে গিয়ে নীচে একটা ঘাট পর্যন্ত নামা গেল গঙ্গায় পা ভাসানোর জন্য। ঝুলাগুলোর চারপাশে বাঁদরদের ভিড়।
লক্ষণঝুলা থেকে নদীতে ৱ্যাফটিং করতে করতে সবাই আসে রামঝুলার দিকে।
রাম ঝুলা
তারপর আবার সিঁড়ি দিয়ে দিয়ে ওপরে উঠে ঋষিকেশের প্রধান রাস্তায় পৌঁছে একটা অটোতে উঠলাম লক্ষণঝুলা যাবার জন্য। ভোরবেলা থেকে হাঁটাহাঁটি করে পা দুটো ক্লান্ত। উচ্চতার দিক থেকে সবথেকে ওপরে লক্ষণঝুলা, তারপর ক্রমান্বয়ে রামঝুলা, জানকী ঝুলা এবং ত্রিবেণী ঘাট। কিন্তু হাঁটছি উল্টো পথে।
লক্ষণঝুলাকে ঘিরেই তপোবন এলাকায় ঋষিকেশের যাবতীয় নতুন থাকার , খাবার জায়গা তৈরী হয়েছে। লক্ষণঝুলা গিয়ে দেখলাম সেটা ছমাস ধরে বন্ধ। কাজ চলছে আরো বড় করবার। এটাই ঋষিকেশের সবথেকে পুরোনো ঝুলা। বাকি দুটো পরে তৈরী হয়েছে। এখানে একটা দোকানে বসে নিরামিষ মোমো, স্প্রিং রোল ইত্যাদি খাওয়া গেল। হরিদ্বার এবং ঋষিকেশ নিরামিষ এবং সুরামুক্ত 'জোনের' মধ্যে পড়ে। ঋষিকেশের ক্যাফেগুলোতে সাদা বা রঙিন চক দিয়ে সবুজ বোর্ডে মেনুর সঙ্গে এটাও লেখা থাকে - "এখানে নেশার বস্তু বা আমিষ নিয়ে ঢোকা বা খাওয়া বারণ। আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। "
ঝুলাগুলোর কাছে রাস্তাঘাট এত ঘিঞ্জি যে কাশীর কথা মনে পড়ে যাবে। প্রধান রাস্তা থেকে ঝুলার মুখ অবধি ওঠা নামার সিঁড়ির দুপাশ দোকানে ঠাসা। ঋষিকেশের সমস্ত জামাকাপড়ের দোকানে একটা জিনিস কমন। ওঁ ছাপানো হলুদ আর গেরুয়া রঙের কুর্তা। যাই হোক, বাদশাহী আংটির বনবিহারীবাবুর মত লছমনঝুলার কাছে বারো ফুট পাইথন খুঁজে পাবার চেষ্টা করবেন না। তবে এখন অতিবৃষ্টিতে রাজাজী থেকে কুমীররা ভেসে আসছে হরিদ্বারের ঘাটে।
ফেরবার সময় তপোবনের মোড় থেকে সোজা শেয়ার অটো। এত যানজট যে ত্রিবেণী ঘাটে যেতে দশমিনিটের রাস্তা লাগল চল্লিশ মিনিট। অটোওলা বলছিল এখন প্রতি সপ্তাহান্তে ঋষিকেশে এরকম যানজট লেগে যাচ্ছে। এর মধ্যে আবার অটোর বাকি আরোহীদের ত্রিবেণী ঘাটের সন্ধ্যেবেলায় গঙ্গা আরতি দেখার তাড়া আছে। হর কি পৌড়ির মত ঋষিকেশের ত্রিবেণী ঘাটেও সন্ধ্যেবেলা গঙ্গা আরতি হয়। এখানে চন্দ্রভাগা এসে গঙ্গায় মিশেছে।
ত্রিবেণী ঘাটে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বাসস্ট্যান্ডে এসে রাতের খাবার খাওয়া। ঋষিকেশের বাসস্ট্যান্ড বেশ বড়, এখান থেকে উত্তরাখণ্ডের এবং বাকি অনেক জায়গার বাস ছাড়ে। পরে গাড়োয়ালের আরো ওপরের দিকে যেতে হলে এই বাসস্ট্যান্ডে আবার আসতে হবে। খাবার পর নোনতা লস্যি খেতে খেতে ভাবছিলাম ভারকালার সমুদ্র সৈকতের ক্লিফের ওপরের পানশালায় অথবা কাসোলের রাস্তায় এরকম অনেক ইজরায়েলি এবং অন্যন্য অল্পবয়সী বিদেশীদের 'মোক্ষ' খুঁজে বেড়াতে দেখেছি। যারা পরিবার নিয়ে আগ্রা বা রাজস্থান ঘুরতে আসে তাদের সঙ্গে এদের পার্থক্য আছে। অল্পবয়সী ইজরায়েলীরা সম্ভবত তিন বছর সেনায় বাধ্যতামূলক সময় কাটানোর পর একটা বড় টাকা পায়। তারপর ছুটি নিয়ে চলে আসে এই সমস্ত জায়গায়। আর বাকি দেশের বাউন্ডুলেদের যাতায়াত তো এমনিই লেগে আছে।
ঋষিকেশকে নিয়ে বিটলদের দুটো গান দিয়ে যাই। একটা জন লেননের বানানো 'হ্যাপি ঋষিকেশ'। সেটা মুক্তি পায়নি, পরে জর্জ হ্যারিসন একটু অদল বদল করে 'ব্লো এওয়ে' বলে একটা গান ছেড়েছিলেন বাজারে।
[যারা এতদিন সিরিজটা ধৈর্য্য ধরে পড়ছিলেন এবং মন্তব্য করছিলেন সবাইকে ধন্যবাদ। সম্ভবত আবার পুজোর পরে বা শীতকালে পরিযায়ী পাখির মত ফিরে আসব নতুন এবং পুরনো ঘুমক্কড়ের গল্প এবং ছবি নিয়ে। আপাতত এখানে থামালাম।]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।