জনপদগুলি স্থানে স্থিতু, কালে চঞ্চল। চারটে দশের ঘন্টায় দ্রুতপরিবর্তনশীল পারিপার্শ্বিকের দৃশ্যপটে 'লাজুক' মফস্বলের শান্ত ছবি এঁকেছেন কৌশিক ঘোষ। প্রথম পাঠে প্রতিভা সরকার।
মফস্বল তখন “লাজুক” ছিল। এই লাজুক কথাটি অব্যর্থ শব্দভেদী বাণের মতো মর্মে গিয়ে বেঁধে। কারণ এর চেয়ে ভাল যুতসই বিশেষণ আর হয় না। গ্রামে গঞ্জে তখন হ্যাপি বাড্ডেতে কেক কাটা আর মদ খাওয়ার চল ছিল না, মায়ের হাতের লুচি পায়েস পেলেই বর্তে যাই। প্রেমে পড়লে বড়জোর কারও হাত দিয়ে চিঠি পাঠান, তার নিচে লেখা থাকতেও পারে “ইতি তোমার মৌমাছি।” কারণ সিনেমা হলের টিকেট তখন ৫০ পয়সা। আর নারী পুরুষের প্রেম মানে ঐ ফুলের ওপর ঘুরে বেড়ানো জোড়া মধুকর।
লেখক আমার থেকে বয়সে ছোট, কিন্তু জীবনের এক একটা ঢেউ তো আর সমুদ্রের মতো নয় যে দ্রুত এল আর গেল । বিশেষ করে মফস্বলে দূরত্ব এবং সুযোগের অভাবে সময়ের বিরাট ঢেউ পিছু হটে খুব ধীরে ধীরে, নতুনকে বরণ করে নিতে দেরি হয়। তাই সময়ের পলি মফস্বলের মানুষকে একই ছাঁচে ঢালাই না করলেও, নেমে যেতে যেতে বোধে অনেক মিল-ছাপ রেখে যায়। সে কারণে চারটে দশের ঘন্টাকে মনে হয় আমার নিজেরও কথা, বিশেষ করে যখন অনবদ্য গদ্যে পড়ি, “যে বছর মারাদোনা,সে বছরই জানুয়ারিতে প্রাথমিক ড্রাফট লেখা হয় ‘খোলা হাওয়ার’। তখন কি আর জানতাম পাঁচেক পরে আমার কমিউনিস্ট পিতার সাধের সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো টুকরো হয়ে যাবে!”
এই মারাদোনা, এই পেরেস্ত্রোইকা, আর সোভিয়েতের জাস্ট উবে যাওয়া, এ তো আমারও জীবন জুড়ে রয়েছে চাঁদের ওপর বিছানো কলঙ্কের মতো!
চারটে দশের ঘন্টা পড়তে গিয়ে তাই নিজেকেই ফিরে পড়ি। মনে হয় এ কোনো বিশেষ ব্যক্তির স্মৃতি-গাথা নয়, বরং সত্তর আশির দশকে ব্যাপ্ত মফস্বল তার সমস্ত কাহিনি নিয়ে এইখানে জ্যান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ অরহান পামুকের স্মৃতিকথা ইস্তানবুলের মতোই এতে শুধু ব্যক্তি নয়, প্রাধান্য পেয়েছে বিশেষ সময় এবং স্থান। নাই বা হলো সে কোনো বিখ্যাত শহর, কিন্তু মেদিনীপুরের কাঁসাই কী মন্ত্রবলে উত্তরবঙ্গের মানসাই নদীকে স্মৃতির জলোচ্ছ্বাসে মিলেমিশে একাকার করে দিয়েছে।
আর কে না জানে মফস্বলের চরিত্র চলন পুরোই আলাদা। সে চলে আড়ে আড়ে, সে চলে পাতায় পাতায়। নাহলে শ্রাবন্তী-স্বরের এই অলৌকিক ব্যাখ্যান সম্ভব হয় কী করে! “মাথার চুল যখন মরুভূমি হয়ে যায়-- তখন এ-ই মরু- বেদনার একমাত্র উপশম শ্রাবন্তী মজুমদারের আলহাদিত ওয়েসিস- মায়াধ্বনি।...ওয়েসিস আদতে শ্রাবন্তীর তুরীয় ন্যাকামি, আবদারে তিনি হয়ত অপর্ণা সেনকেও টেক্কা মারতে পারতেন। শুষ্কতায়, রুক্ষতায়,ত্বক যদি ছড়ে যায়, বার মাস সারা অঙ্গে মেখে নিন...বারোমাসের সেই সুরভিত এন্টিসেপটিকের আসল নাম কি বোরোলিন? নাকি শ্রাবন্তী? যাকে আমরা চোখে কখনও দেখিনি, শুধু বাঁশির মতো শুনেছি?”
এক শ্যামল কিশোরের আশ্চর্য বড় হয়ে ওঠার গল্প এই উপন্যাস। তার নিষিদ্ধ আস্বাদের গ্রহণ, তার নিজের সঙ্গে লুকোচুরি, জগত সংসারকে ক্রমশ বুঝে ওঠা, সবই এসেছে অনন্য মায়াময় এবং একই সঙ্গে তির্যক ভাষায়। কৌশিক ঘোষের বোড়ের চাল এই ভাষা, ঝরঝরে, বুদ্ধিদীপ্ত শ্লেষাত্মক, আবার শেষ বিচারে দূর বাতাসে ভেসে আসা বাঁশির সুরে আলতো চোবানো। বন্ধু টাইগার মিথ্যে বলায় অতি পারদর্শী, তাকে নাকি সুদূর দক্ষিণ দেশ থেকে শিশু অবস্থায় আনা হয়েছিল, তার হাতের “তক্তি”তে এর প্রমাণ আছে, আর ঠাকুমার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি। বন্ধুদের সবটুকু সহানুভূতিতে ধন্য হয়েও সে তো মুছে ফেলতে পারে না বাবার সঙ্গে চেহারার হুবহু সাদৃশ্য, তবু ডায়েরিতে লেখা হয় অচেনা কিশোরীকে তিন পাপাত্মার হাত থেকে উদ্ধার করবার সমীহ জাগানো কাহিনি, কংসাবতীতে ভেসে আসা কাঠ তার কল্পনায় হয়ে ওঠে হয়ত প্রাগৈতিহাসিক দারুখন্ড আর নাচার বন্ধুরা সারা জীবন বুকের মধ্যে বয়ে বেড়ায় এই অতি কল্পনাপ্রবণ ছেলেটিকে, " এখনও কোথাও যখন ট্রেন লাইনে মরচে রঙের মালগাড়ি চলে যাওয়া দেখতে পাই, টাইগারের কথা অনিবার্য মনে পড়ে। আমার তার কাছে কিছু ঋণ থেকে যাবে। অনেক কিছুর সঙ্গে সে আমাকে ওই তৎকালীন গোপটিলার চূড়া থেকে একদিন সূর্যাস্ত ও অনেক দূরের অন্যরকম কাঁসাই দেখিয়েছিল।"
বড়বেলার গল্প বলে না চারটে দশের ঘন্টা, কেবল বাল্য কৈশোরের কাহিনি আসে খন্ড খন্ড মেঘের মতো, তবু ছায়া ঘনিয়ে ওঠে, যেন বর্ষণের আভাস আসে হঠাত। শহিদ বেদি অংশটি বা বিয়ে বাড়িতে অনেক দেরিতে আসা লম্বা কালো মানুষটি, যিনি পার্টি মিটিং সেরে সামাজিকতা রক্ষায় আসতে পারেন, নাও পারেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে গর্বে বুক ভরে ওঠা আত্মজের একান্ত উপলব্ধি, আমাদের জানান দেয় ছায়া ঘনাইছে, অপ্রতিরোধ্য জীবন বৃক্ষটি তার সমস্ত ভার নিয়ে ঝুঁকে পড়েছে বালকটির দিকে, তার যাত্রাকে পরিণতি দেবে বলে। একটু উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না৷ “একদিন ছয় বছরের বালক বয়সে একটা অচেনা মেয়ে না-চিনেই নির্দোষ হাত ধরেছিল...আরও বছর পনের পরে অন্য কোনো আধচেনা মেয়ে এসে আবার তার হাত ধরবে… সেই গল্প অন্য জায়গার, অন্য সময়ের। এবং শেষ অব্দি ব্যর্থতার...কিন্তু তারও অনেক অনেক বছর পরে যখন তার কোলেস্টেরল ও ব্লাড প্রেসারের ওষুধ নিত্যসঙ্গী,... এক একদিন ভোরে সে শুনতে পায় রিনরিনে একটা অচেনা কমলা টিউনিকের গলার পাখিডাক…
একদিন সমস্ত টুকরো ও অবান্তর গল্পগুলোকে ঢেকে দেয় সময়ের পলি। কিন্তু কোথাও পড়ে থাকে এলোমেলো নুড়ি বিছানো একটা শান্ত পথ,বেজে ওঠে একটা মন্ত্রের মতো সুর, ঘন্টার ধ্বনির আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে একটা একলা নাগকেশর।”
চারটে দশের ঘন্টা উপহার দিয়েছে অসাধারণ একটি পাঠ-অভিজ্ঞতা। প্রকাশককে ধন্যবাদ। ছাপা প্রচ্ছদ যথাযথ। টাইপো নেই বললেই চলে। তবে মনে হয়েছে শেষাংশ আরও এডিট করবার দরকার ছিল। তাহলে কাহিনি-সূত্র আরও আঁটোসাটো হতে পারত।
মুখ চেনাচিনির সূত্রে অনেক বই কিনি আমরা। সেটা খারাপ আমি বলছি না। নিছক কৌতূহলেও অনেক ভালো বই এসেছে হাতে। তবে মুখ না চিনেও এই বই কিনলে ঠকতে হবে না। বরং একটা ভরন্ত অনুভূতি মনে ছেয়ে থাকবে অনেকক্ষণ। পড়তে পড়তে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটতেও পারে। আমার বই, আমিই পড়ছি, আমার থেকে আমাকে নিলে আমিই পড়ে থাকে !