ঐ মহিলা যদি সন্ধের পর একা না বেরোত,তাহলে কি...
যদি মেয়েকে ঠিক মতো ওড়না পরতে শেখাতেন, তাহলে কি আজ...
তুমি যদি বাপ-দাদার কথা শুনতে, তাহলে তো...
এইরকম বহু 'যদি' ভিড় করে থাকে মেয়েদের জীবনে, চরম লাঞ্ছনার কথাও যাদের গিলে ফেলতে হয় সামাজিক লজ্জার ভয়ে। পিতৃতন্ত্র এমনই বিশাল আর বলশালী যে তার পক্ষপুটে সে অনায়াসে ঢুকিয়ে নেয় অন্যান্যদের সঙ্গে অজস্র নারীকেও, লিঙ্গ নির্বিশেষে তাদের করে তোলে নারীর ওপর নির্যাতনের হাতিয়ার।
এই 'যদি'গুলোকে সব নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেবার সময় এসেছে। কারণ এইগুলিই এদেশের ধর্ষণ সংস্কৃতির শক্ত খুঁটি। গলা তুলে বলতে হবে কোনও যদি নয় আর, সে মধ্যরাত হোক কী ভোরের আবছা, প্রয়োজনে নারী যখন খুশি তখন বাইরে যেতে পারবে। বা ঘরে ফিরতে পারবে। ওড়না নিক না নিক, নারীর পোশাকের কারণে তাকে ধর্ষিতা হতে হয় বলে যারা মনে করে, তারা একান্তই মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। দাদু-ঠাকুর্দারা যদি নারীর মোবাইল ফোন ব্যবহারের অধিকার কেড়ে নিতে চায়, তাহলে তারা পরিবারের মহিলা সদস্যের মুখের ওপর বন্ধ করে দেয় আধুনিকতা এবং বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের নতুন পৃথিবীর দরজা। এই যদিগুলি আছে বলেই ঘটে চলেছে আজ উন্নাও, কাল হাথরাস, পরদিন বঁদায়ু।
বছর পঞ্চাশের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীটির অপরাধ ছিল রোজ সন্ধ্যায় মন্দিরে গিয়ে পুজো করা। সেই অপরাধে মহান্ত'জি'টি চ্যালাচামুণ্ডা নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে, যোনিতে রড ঢুকিয়ে দেয় এবং পা ভেঙে দেয়। তাতেও মরেনি দেখে হয়ত ভয় পেয়েই গাড়িতে করে তড়িঘড়ি মহিলার বাড়ির দাওয়ায় দেহটি ফেলে চম্পট দেয়। পাঁচ সন্তানের জননী যোনি থেকে অত্যধিক রক্তক্ষরণ এবং 'শকে' হাসপাতালে পৌঁছবার আগেই মারা যায়।
একের পর এক মেয়েদের ওপর অমানবিক অত্যাচার, এবং প্রশাসনিক গাফিলতি একেবারে চেনা ছক হয়ে উঠেছে। হাথরাসে নিপীড়িতার বাবা এবং পরিজনদের হাড়হিম গলায় ভয়-দেখানো ডিএম বদলি হতে না হতেই উঠে এল বদায়ুঁর প্রশাসনিক গাফিলতি। এফ আই আর নেওয়া বা পোস্ট মর্টেম, দুজায়গাতেই অকারণ বিলম্ব করা হয়েছে। দুই সাকরেদ ধরা পড়লেও কুকাজের পাণ্ডা মহান্ত গ্রেফতার হয়েছে গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গল থেকে। সেখানে সে নাকি চারদিন ধরে লুকিয়ে ছিল !
এই চেনা ছকে দু/একটি চেনা 'যদি' যোগ করে অমরত্বের দাবিদার হলেন জাতীয় মহিলা কমিশনের একজন সিনিয়র সদস্য চন্দ্রমুখী দেবী। খবরের কাগজ লিখেছে, তিনি বলেছেন, যদি মহিলা সন্ধেয় বাড়ির বাইরে না যেতেন, যদি তার সঙ্গে এমনকি একটা বাচ্চাও থাকতো, তাহলে এই ঘটনা ঘটতো না। জাতীয় মহিলা কমিশন কি কাঠুয়ায় শিশুকন্যা রেপ বা উত্তর প্রদেশেই দুই দলিত নাবালিকাকে ধর্ষণ ও হত্যা করে গাছের ডাল থেকে ঝুলিয়ে দেবার ঘটনা জানে না? শিশুরাও সুরক্ষা দিতে পারে নারী তবে এমনই অসহায়! কিন্তু সেই শিশুর সুরক্ষার কী হবে! ধর্ষকদের তো শিশুমাংসে বিন্দুমাত্র অরুচি নেই!
চন্দ্রমুখী আরও বলেছেন, তিনি সব নারীদের প্রায়ই সাবধান করে থাকেন, যাতে তারা যেন কারও কথায় অসময়ে ঘরের বাইরে না যায়। তাঁর কথায় স্পষ্ট, নারী ব্যক্তিত্বহীন, তাই সে সহজেই অন্যের প্রভাবের বশবর্তী হয়ে পড়ে। এমনকী ঘরও ছাড়ে। তাই বোধহয় স্বয়ংসিদ্ধা নারীর জন্য হিন্দুত্ববাদীদের নিদান লাভ জিহাদ আইন। নিজের পছন্দে বিয়ে করার সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়ে বিবাহ ব্যাপারটিকে একেবারেই পিতৃতান্ত্রিক মুরুব্বিদের কুক্ষিগত ক'রে দেওয়া।
চন্দ্রমুখীদের এই যদিগুলি যাঁরা ভয়ংকর প্রতিকূল পরিবেশে নিরন্তর সামাজিক এবং লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছেন, তাঁদের জন্য এক একটি শক্তিশেল। কোথায় জাতীয় মহিলা কমিশন নারীর স্বার্থ এবং অধিকার অটুট রাখবে, তা না, তার সদস্যের কণ্ঠেও শোনা যাচ্ছে পিতৃতন্ত্রের চেনা সুর, রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে বিপর্যয়ের জন্য মেয়েদের নিজেদেরকেই দায়ী করবার পুরনো ফাটা রেকর্ড বাজানো।
নিরাপত্তার কারণেই মেয়েরা সূর্যাস্তের পর ঘরের বাইরে থাকবে না, এই অন্ধকার মনোভাবকে শিরোধার্য করেই কি অতি দীর্ঘ সময় ধরে প্রবল পরিশ্রমের পর সাহিত্য, বিজ্ঞান, কারিগরিতে মেয়েদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে? এইরকম অসংবেদী মন্তব্যে কি তাদের সেই অমানুষিক পরিশ্রম ও অর্জিত কৃতিত্বকে ছোট করা হয় না? সমানাধিকারের লড়াই লড়ছেন যাঁরা, তাঁদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে এ সব মন্তব্যের মাধ্যমে হাস্যকর করে তোলা হয় না? যা মহাপ্রতাপশালী রাষ্ট্র এবং প্রশাসনের দায়িত্ব সেই সুরক্ষা ও নিরাপত্তা কবে থেকে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে নারীর ব্যক্তিগত দায়িত্ব হয়ে উঠল?
এই 'যদি'র কাঁটাগাছগুলোকে সারজল দেবার নিরন্তর চেষ্টা, নিরাপত্তার প্রশ্নে পিতৃতন্ত্র ও রাষ্ট্রের নারীকে সুচতুর ভাবে ব্যবহার করার প্রবণতা আছে বলেই এই ভয়ংকরতার শেষ দূরস্থান, একটু কমে যাবার প্রবণতাও দেখা যায় না। আরও অবাধ হয় ধর্ষণ সংস্কৃতি। ২০১৯ সালে তাই ভারতে প্রতিদিন ৮৮টি ধর্ষণের কেস নথিভুক্ত হয়(এনসিআরবি)। উত্তর প্রদেশে বদায়ুঁর পরও ঘটে চলে একদিনে তিনটি ধর্ষণের মতো ঘটনা - মোরাদাবাদ, মুজফফর নগর ও শাহজাহানপুরে। দুটি ক্ষেত্রে শিকার নাবালিকা, একটি ঘটনা উনিশ বছরের তরুণী। নির্ভয়ার ঘটনার পর ধর্ষকের কঠিন শাস্তির ব্যবস্থায় ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট সমেত এক গুচ্ছ আইন সংস্কার করা হয়েছিল। ধর্ষণ কিন্তু কমেনি। অনেকেই নাকি হায়দ্রাবাদি স্টাইলে অপরাধীকে বন্দুকের নল দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ায় আস্থা রাখেন। সেরকমও তো কয়েকটি হল, কিছু লাভ হল কী! তাহলে বোঝা যাচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক গাফিলতির মতো অন্য বিষয়গুলো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। লৈঙ্গিক সমানাধিকার অর্জন করতে হলে মেয়েদের বেশি বেশি করে বাইরের কাজে অংশগ্রহণ করতে হবে, দেরীতে ঘরের ফেরার ঝুঁকি নিতে হবে, কারণ এদেশের মোট শ্রমশক্তির মাত্র ১০.৭% হলো নারী।
চন্দ্রমুখী দেবীর ঘোর লজ্জা ও অপমানসূচক কথা তাই খুবই প্রতিবাদযোগ্য। ২০২৫-এ মেয়েরা চাঁদে যাচ্ছে, নাসায় ট্রেনিং চলছে, আর বাড়ির পাশের মন্দিরে সে সন্ধের পর একা পুজো দিতে যেতে পারবে না!
এই চন্দ্রমুখীরাও আসলে ধর্ষণ করেই চলেছে আমাদের দেশকে, নিরন্তর।
পিতৃতান্ত্রিকতার শিকল ভেঙে বের হওয়র জন্য,মেয়েদের আত্মবিশ্বাস, সচেতনতা, কথা বলার সাহস প্রথম জরুরী।