আজারবাইজানের বাকুতে নন্দানো একটা ন-তলা বাড়ির সাত তলায় পুবমুখো ফ্ল্যাটে থাকত। আর ঠিক তার দুটো তলা নীচে থাকত আমার আর-এক বন্ধু ফারিদা। অবশ্য ফারিদা আমাকে মাঝে মাঝেই মুচকি হেসে বলত যেমন তুমি সবজি sauté করো, আমার নামটাও কিন্তু তেমনি, ফারিদে। বাড়ি ছেড়ে আসা ইস্তক নন্দানো বেশ মনমরা হয়ে থাকত, আমিই ফারিদার সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিই। ফারিদাদের ওই ন-তলার বাড়ির সামনে প্রত্যেক শনিবার একটা হুলুস্থুল লেগে যেত। একটা টালটোল খাওয়া সোভিয়েত রাশিয়ার বানানো জিগুলি, অনেকটা আমাদের দেশের ফিয়াটের মতো, এসে হাজির হত।
আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতেন এক মহিলা, বয়স ষাট পেরিয়েছে। কিন্তু খুব চনমনে। তিনি ঘটাং করে গাড়ির ডিকি খুলে দড়াম করে একটা বড়ো ট্রাংক মাটিতে নামাতেন। নিজেই। তারপর খটাং করে ট্রাংকের ঢাকা খুলে ছাড়তেন একখানা ফলসেটো “সুদ ভার, গাটিইইইইইইইগ” (দুধ, দইইইইইইই)। দই দই ভালো দই।
ফারিদারা ওনাকে আদর করে দইওয়ালি না বলে , সুদ সাতান খালা (দই-বেচা মাসি) বলে ডাকত।
আজেরি তুর্ক ভাষায় গাতিগ মানে দই, সুদ মানে দুধ, আর তুর্কি ভাষায় সু মানে জল। মানে ওই দুধে জল মেশানোর ব্যাপারটা ভাষাগত ভাবেই জড়িয়ে সাপটে আছে। তা, দইমাসির হাঁক শুনে ফ্ল্যাটবাড়ির সব লোকজন নানান সাইজের পাত্র নিয়ে টাটকা দই নিতে আসত। ফারিদাও আসত। তারপর আবার দরদস্তুর চলত। বড্ড বেশি বলছ, আর-একটু দাম কমাও। এইসব যখন শুরু হত তখন দইমাসি রুটির দিব্যি (আজারবাইজানিরা ঠাকুর-দেবতা বাপ-মা নয়, রুটির দিব্যি দেয়) দিয়ে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলত “আমার দই এক্কেবারে নিজের হাতে বাড়িতে বানানো, কোনো রকমের বাইরের জিনিস মেশানো হয় না। দাম মোটেই বেশি নিচ্ছি না, বাপু।” তারপর দাম-টাম চুকিয়ে ফরিদারা সবাই সেই ঘন জমাট দই নিয়ে যে যার বাড়ি ঢুকে যেত। সেই দই-এরও তেল চুকচুকে ক্রিমের মতো ফুটিফুটি একটা মাথা থাকত, দই-এর মাথা। ফারিদা আবার সেটা খেতে খুব ভালোবাসত।
দোভঘা আর আইরান না হলে আজেরিদের ভাত হজম হবে না। এবং তা বানাতে দই লাগবেই।
নন্দানো প্রথমটায় অত দই ভালোবাসত না। বিশেষ করে টক দই। কিন্তু ফারিদার সঙ্গে মিশে মিশে ও আস্তে আস্তে দই মাহাত্ম্য বুঝতে শিখল।
এতক্ষণ ধরে দই দই করছি কেন তাই বলছি ধীরে ধীরে। সেবারে আমি আর নন্দানো ইন্টারলাকেনে গেছি। কার যেন একটা চিলেকোঠার ঘরে আমাদের দয়া করে থাকতে দেওয়া হয়েছে। ভেতরটা বাপু ভালোই, গরম-টরমের ব্যাবস্থা আছে। খাওয়াদাওয়া নিজেদের। ঘরটা যে পাওয়া গেছে, সেই বা কম কী! কিন্তু সকাল থেকে বরফ পড়ছে। আমাদের সে কী মন খারাপ!
বাইরে বেরোতে পাচ্ছি না। রোদ ওঠেনি মোটে। নন্দানো বলল, সোপ্রানো ঘরে শুধু দই, বেগুন আর চিকেন কিমা পড়ে আছে। আরে দুচ্ছাই! রোদের দেখা মিলছে না। স্লেটের মতো ছাই ছাই আকাশ। হলই বা সুইটজারল্যান্ড। দই-এর নিকুচি করেছে। বললে বিশ্বাস করবেন না। এরপর একটা ঘটনা ঘটল। এই ইন্টারলাকেনের আশেপাশেই দিলওয়ালে দুলহানিয়ার শুটিং হয়েছিল। আর সেই ফিলমে, মানে সব সুপারহিট সিনেমার মতো কিছু তোলপাড় করা ডায়ালগ ছিল।
“অগর ইয়ে তুঝে পেয়ার করতি হ্যায় তো ইয়ে পলট কর দেখেগি... পলট... পলট”, আর সিমরনও ট্রেনে ওঠার আগে পলট... পলট। ঠিক সেইভাবে বিবস্বান বসু পলট করে আলো খেলিয়ে দিলেন। বরফের ওপর ঝিকঝিকিয়ে উঠল ভালোবাসার আলো। আর নন্দানো, চল সোপ্রানো বেরিয়ে পড়ি, বলেই চশমা মুছতে লাগল।
নন্দানো, বাইরে খাওয়া যাবে না কিন্তু। রেস্ত নেই। কী করা যায়?
খুব চটপট আমরা বেগুনগুলোকে ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করে ভেজে হালকা পিটিয়ে দিলাম। ঘন থকথকে দই-এ মিশিয়ে দিলাম রসুন কুচি ভাজা আর কিমাটাকেও একটু ফারিদের মতো করে sauté করে টিপিনকারিতে পুরে “যা সিমরন যা, জি লে অপনি জিন্দাগি”, ওই সিনিমাটার আর-একটা ডায়ালগ হয়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে গেলুম মাউন্ট টিটলিস।
আমরা কেবল কারে করে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছি। বাড়িগুলো ছোট্ট ছোট্ট খেলনার মতো দেখাচ্ছে। টিটলিসের ওপরে কী ঠান্ডা। শনশন করে হাওয়া। মাথার টুপি প্রায় উড়ে যায়। এর হাইট দশ হাজার ফিটেরও বেশি। কিন্তু আমাদের তখন দারুণ ফুর্তি। চারদিকে আল্পসের ভ্যানিলা আইসক্রিমের ফ্যাক্টরি। একটু চকোলেট সস হলেই হয়।
জরা সা ঝুম লু ম্যায়/ আরে নারে নারে না/ জরা সা ঘুম লু ম্যায়/ আরে নারে নারে না।/ ম্যায় চলি বনকে হাওয়া... ” আমরা তখন হাওয়া হয়ে গেছি ।
বাতাসে ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে এসে পড়েছি থুন লেকের ধারে। এবারে আমরা খাব। বাড়িতে বানানো সেই স্ম্যাশড এগপ্ল্যান্ট উইথ চিকেন কিমা অ্যান্ড গারলিক ইয়োগারট। দই কিমা বেগুনের ঘ্যাঁট বললে চলবে না বস!
থুন লেক!
নীল কপোতাক্ষ। টলটলে। আলপাইন বন। সুইশ আল্পসের মাথায় বরফ জমে আছে। নির্ভেজাল সুন্দরী। সে সুন্দরী বসেছিল নন্দানো সোপ্রানোর জন্য। আমরা ব্যাগ মাটিতে ফেলে দৌড়ে তার কাছে চলে গেলাম। ছবিতে দুটো ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। ধুমসোটা আমার, ওর মধ্যে ওই ঘ্যাঁট থুড়ি স্ম্যাশড ইত্যাদি আছে। আমরা চুপ করে বসে থাকলাম। ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ উঠছে জলে। মৃদু বাতাসে তিরতির করে সেই জল কাঁপছে। স্বর্গের হাঁসেরা মা সরস্বতীর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে দু-দণ্ড খেলে বেড়াচ্ছে। আমরা কথা ভুলে গেছি। খাওয়া ভুলে গেছি।
নন্দানো স্প্যানিশ ভাষায় কী ভাবছে জানি না। আমার ভেতর ছেঁচে উঠে আসছে “তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি, আমি ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি... ”
২
একবার আমি আর নন্দানো হায়দ্রাবাদে ঘুরছিলাম। না, না শশধরবাবুকে সেদিন আর ডাকিনি। নন্দানো বার বার বলছিল, সোপ্রানো, আমি এখানে আইসক্রিম খেয়েছিলাম, ওপরটা মুচমুচে ক্রিস্পি আর ঠোকা মারলেই ঠান্ডা আইসক্রিম বেরিয়ে আসছে। চল সেটা খাই। কিন্তু নিজামদের শহর ছাপ্পা ছাপ্পা ঘুরেও সে আইস্ক্রিম দেখতে পেলুম না। কিন্তু একটা অদ্ভুত আইসক্রিম আমাদের জন্য অপেক্ষা করে বসেছিল। ম্যাসকটি আইসক্রিম। ম্যাসকটে এই আইসক্রিম পাওয়া যায় কি না, জানি না বাপু। দু-ধরনের আইসক্রিম নিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে, আজ্ঞে হ্যাঁ, পিটিয়ে পিটিয়ে একটা মিশ্রণ বানিয়ে বেশ একখানা ছড়ানো ফুলের মতো বিস্কুটের কাপে ঢেলে খেতে দেয়। এই পিটিয়ে বানানোর রহস্যটা সত্যি এখনও ধরতে পারিনি। তবে আমার ওই বুদাপেস্টের সোপ্রানি কফিশপে চিমনি কেক আইসক্রিম রাখছি আজকাল। খোলটা গরম মুচমুচে গুঁড়ো চিনিলাগানো রুটি, পাতলা পাতলা, আর ভেতরে উমমমম আইসক্রিম। দেখুন দেখুন ছবি দেখুন। কফিশপ থেকে বুদাপেস্টের ছবি। আর ছবি দেখতে দেখতে চিমনি আইসক্রিম। বুদাপেস্ট গেলে আমার দোকানে যাবেন কিন্তু।
এই প্যাঁচালো রাস্তাটা আরও দু-বার পাক খেয়ে যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে নন্দানোর বাড়ি। নন্দানো আগে স্প্যানিশ ছাড়া কোনো ভাষাই ভালো করে বলতে পারত না। এখন ইংরেজি আর একটু একটু বাংলা বলে। তা ছাড়া ও নাইরোবিতে জন্মেছিল আর সোয়াহিলি আয়ার কাছে মানুষ। সোয়াহিলি ভাষায় বাবাকে বলে বাবা, তুর্কিদের মতোই, কী আশ্চর্য! মা-কে মামা আর ফুলকে উয়া। নন্দানো সেগুলো আগেই শিখেছিল। তারপর অবিশ্যি রিকি মারটিনের মারিয়ার ভাষা উন দোস ত্রেস, ওটাই ওর প্রধান ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই কারণেই আমাকে প্রথম থেকেই ও সোপ্রানো বলেই ডাকে, মানে ওতে ওর উচ্চারণের সুবিধে হয় আর কি! সোপ্রানোর সঙ্গে গানের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। তাই আমার ভালোই লাগে। নইলে নিজের নামকে বিকৃত করতে কেই বা চায়!
যা বলছিলাম, ওই রাস্তাটা শেষ হয়েছে জঙ্গলের ধারে, সেখানে দূর থেকে নীল পাহাড় দেখা যায়। প্রচুর সাদা কাকাতুয়া গাছে গাছে বসে থাকে। সব চেয়ে বড়ো কথা ওখানে নন্দানোর অনেক প্রতিবেশী থাকে। তারা মাঠে বাস্কেট বল খেলে, ফ্যামিলি নিয়ে ঘোরাঘুরি করে, লুকিয়ে প্রেম-ট্রেম করে, উদাসীন ভাবে বসে পদ্য-টদ্যও লেখে কেউ কেউ। রেগে গেলে তক্কাতক্কি তো বটেই হাতাহাতিও হয়। মানুষকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। মানুষরাই বরং একটু সমঝে চলে ওদের। সেবারে ওর বাড়িতে গেছিলাম। ঝিলের ধারে বসে লাঞ্চ করেছিলাম। আর হেমন্তের অরণ্যে প্রচুর ক্যাঙারু দেখেছিলাম। নন্দানো বানিয়েছিল চিকেন পেরিপেরি। বেশ ঝালঝাল। নন্দর (Nando) রেসিপি। নন্দর টাইটেল ঘোষ কি না জানি না তবে এদেশেও তার দোকান খুলেছে। কনট প্লেসে দিল্লিতে। তবে ওই পিরিপিরি, বিটকেল ঝাল আফ্রিকান লঙ্কার সস দিয়ে ঝলসানো চিকেন, রসুন মাখন টোস্ট আর ব্ল্যাক ফরেস্ট পেস্ট্রি আমরা সেদিন ব্লু মাউন্টেনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খেলুম। সব বাড়িতে বানানো। আর চারধারে ক্যাঙারুরা খেলা করছিল। আমাদের খাওয়াও শেষ হল আর বাপ-মা বাচ্চার একটা ছোট্ট সুখী পরিবার রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলে চলে গেল।
৪
রোমের চারদিকে গিজগিজে বাঙালি। আরে বাঙাল, কাঠ বাঙাল। আমি আর নন্দানো দুজনেই বরিশালের। কিন্তু নন্দানো তো জন্মেছে আফ্রিকায়, বাংলার বদলে সোয়াহিলি ভাষায় ওর কথা বলা শুরু। প্রথমে বলতে শিখেছিল মাজি। মা নয়, মাইজি নয়। মাজি মানে জল। তারপর স্প্যানিশ ভাষা, যেটাতে ও সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ। এই হালে একটু বাংলা বলতে পারে।
আমরা এত বাংলা শুনছি রোমে যে আর বলার নয়। রোম থেকে আড়াই ঘণ্টার পথ পম্পেইতে গিয়ে আমরা সেই লাভায় পুড়ে যাওয়া মৃত শহরে খানিকটা বেবাকের মতো ঘুরছিলাম। নন্দানো বলল সোপ্রানো , দ্যাখো দ্যাখো চারদিকে কত কিছু লেখা । আগুনে পুড়ে গেছে সব, অক্ষর পোড়েনি।
অক্ষর ব্রহ্ম। চারদিকে লাটিন ভাষায় লেখা গ্রাফিতি। শ্লীল অশ্লীল, চুটকি, মজাদার কৌতুক, রাজনীতি কী নেই। কে বলবে মৃত নগরী। হাজার হাজার সাধারণ মানুষের গলাকে ভিসুভিয়াসের গলন্ত লাভা গিলতে পারেনি। নন্দানো বলে, কলকাতার পাড়াগুলোর মতন না ? চারদিকে খালি লেখা আর লেখা।
পম্পেইতে সর্বত্র গ্রাফিতি। একটা গ্রাফিতির সামনে আমরা নীরবতা পালনের মতো দাঁড়িয়ে গেলাম।
“দেয়াল, আমি আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে এই বোকা বুদ্ধুদের লেখার ভারে তুমি এখনও কেন ভেঙে পড়ছ না?”
৫
দেয়ালের রং ঘন নীল। তার সামনে কমলালেবুর ঢিপি। সেই লেবু থেকে টাটকা কটকটে কমলা রস বড়ো একটা কাচের জারে জমা হচ্ছে আর সেখান থেকে উঁচু করে ঢালা হচ্ছে দুটো বড়ো গেলাসে। আমাদের সামনে দুটো জমাট রং, ঘন নীল আর ঘন কমলা। পায়ের ফাঁকে ঘুরঘুর করছে দু-তিনটে সাদা কালো পাঁশুটে বেড়াল। নীল আকাশে গোলাপি ছোপ। বিকেল গড়াচ্ছে। পাশেই মাটির চুলায় গনগনে আগুন। পোড়া মাটির টাজিনে চিড়বিড় করে ফুটছে কুমড়ো বিচি। বাদাম পোড়া গন্ধ। মাঝে মাঝে ফটাস ফটাস করে ফেটে উঠছে। আজ নীল মুক্তোর দেশে আমাদের শেষ দিন। নন্দানোর ঝুরো চুলে হালকা রোদ্দুর। মুখে হালকা চিন্তা। কমলালেবুর রসে চুমুক দিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলল, “আচ্ছা সোপ্রানো, আমি কি সত্যি সত্যি যাব?”
“হ্যাঁ, যাবি না কেন? বারবার তো এখানে আসা হবে না?”
“না, তা হবে না। কিন্তু...”
যারা নন্দানোকে জানে তারা বেশক জানে সে কতটা ভালো! এত ভালো বোধহয় হতে নেই। সেবারে কী একটা কাজে আমি আর নন্দানো হায়দ্রাবাদ গেছিলাম। ওমা! দেখি কী বিপদ! শশধরবাবুও ঝোলাঝুলি খাতা কলম নিয়ে হাজির! তা আমরা তিনজনেই সকালবেলা খাবারঘরে যাচ্ছি। শশধরবাবুর যা স্বভাব, তিনি ঘোষণা করতে করতে চললেন, “আমি বাটার টোস্ট খাব, হালকা খাওয়াই ভালো, বাটার টোস্ট, ডিমের কুসুমটা খাব না। সাদাটা খাব।” খাবি তো খাবি, এত ঘোষণা করার কী-ই বা দরকার। আমারও রোখ চেপে গেল, বললুম আমি ইডলি খাব। ওটাও হালকা।
অমনি শশধরবাবু কী একটা কমেন্ট করে বসলেন। ঝগড়া প্রায় লাগে লাগে। নারদ নারদ। কিন্তু ডাইনিং হল এসে গেল। আর ঝগড়া করা হল না। আমরা তিনজনে একসঙ্গেই খেতে বসলাম। নন্দানো কিন্তু কোনো কথা বলেনি এতক্ষণ। আমি ওর প্লেটের দিকে তাকালাম, দেখলাম একটা বাটার টোস্ট আর একটা ইডলি। আমার তো খাওয়া প্রায় বন্ধ। সমঝোতার এমন নীরব অথচ ভয়ানক সরব প্রমাণ দেখে শশধর বাবুও কিঞ্চিত লজ্জিত।
সেই ভালোমানুষ নন্দানো ফিসফিস করে বলে উঠল, “এসে গেছে, দ্যাখ।” আমরা তো একটু উঁচু জায়গায় বসেছিলুম, দেখলাম টুকটুক করে দুজন মহিলা জোব্বাজাব্বা পরে ওপরে উঠে আসছে। আসলে আমরা মাত্র দুদিন আগে ট্যাঞ্জিয়ের থেকে শেফশাউহেন এসেছি। কালকেই আমরা মরক্কো ছাড়ছি।
শেফশাউহেন শহরটাকে যেন কেউ রবিন ব্লু-এ ডুবিয়ে দিয়েছে। আকাশের নীল সমুদ্রের নীল আর নীলরঙা শহর একেবারে মস্ত কলন্দর করে মারছে আমাদের। নীলের আবার কতরকম শেড। পুরোনো শহর বা মেদিনা, আর তার গলিঘুঁজি, নকশা কাটা টাইলস। আমাদের চারদিকে আয়েসের আরব্য রজনী। মুর, আরব আর স্পেন থেকে পালিয়ে আসা ইহুদি এখানে আস্তানা গেড়ে বসেছিল। শহরের এই ঘোরতর নীলিমাপ্রীতির সঠিক কারণ কেউই বলতে পারে না। কেউ বলে মশা তাড়াবার জন্য নীল রং খুব জুতসই। আমাদের দেশে এখনও অনেক বাড়ির দরজায় নীল রঙের বোতল ঝুলিয়ে রাখে রাস্তার কুকুর তাড়াবার জন্য!
এত খাস খবরে সময় নষ্ট না করে আমরা এখানকার খাস খাবারে খোশ মেজাজে কবজি ডুবিয়েছিলাম। চিজ স্যালাড। ছাগলের দুধের চিজ তাতে কিশমিশ আর আমন্ড বাদাম। সব মেদিনা-গুলোতে কয়েকটা কমন ব্যাপার থাকবেই, যেমন একটা বাজার বা সুক, মাদ্রাসা, মসজিদ, কমিউনিটি তন্দুর, পাঞ্জাবে যাকে বলে সাঞ্ঝা চুলা, মেয়েরা এই সাঁঝ বিকেলবেলা বেশ খানিকটা আটা ময়দা বাজরা রাগি জোয়ার, দই মিশিয়ে পুদিনা কুচি কালো সাদা তিল দিয়ে ঠেসে মেখে লেচি বানিয়ে দুই হাতে চেপেচুপে রুটি গড়ে তন্দুরের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে গাল গল্প করে, মাথার ওপর ঘন নীল আকাশে হিরের কুচির মতো তারা ফোটে তখন। আর যে ব্যাপারটা প্রতিটি জায়গায় থাকে তাকে বলে হাম্মাম।
কমিউনিটি হাম্মাম। মেয়ে পুরুষদের আলাদা সময়। এই হাম্মাম আর সাঞ্ঝা চুলা হল পাক্কা গসিপ করার জায়গা।
কাল আমি হাম্মামে গেছিলাম আর নন্দানো তখন একটা নীল রঙা সিঁড়ির ওপর তিনটে পাঁশুটে বেড়ালের সঙ্গে বসেছিল। কিছুতেই ভেতরে ঢুকল না। পরে আমি বললাম, বারবার তো আমরা শেফশাউহানে আসব না, নন্দানো। একবার ঘুরেই আসিস বরং। যে কথাটা চেপে গেলাম সেটা হল হাম্মামের ওই জোব্বা মহিলাদের আড়ং ধোলাই। আমি যেন ওদের হাতে একটা ময়লা কার্পেট। দুরমুশ দুরমুশ দুরমুশ। না, নন্দানোকে ধরে পেটানো হোক সেটা আমি কখনোই চাইনি। এর মধ্যে ওই দুই জোব্বা আমাদের কাছে এসে গেছে, থলের ভেতর হাত বের করে আনছে আইসক্রিমের স্কুপের মতো অলিভ ওয়েলে তুপতুপে সাভোন বেলদি, গায়ে মাখার বদলে মুখে পুরে দিতে ইচ্ছে করে, থলে থেকে আরও বেরুল লাভা মেশানো ধুনোর টুকরোর মতো ঘাসুল। ওটা আসলে শ্যাম্পু। ঘাসুলের চেহারা দেখে নন্দানো একটু ঘাবড়ে গেল। জোব্বা রমণীরা স্প্যানিশ ফ্রেঞ্চ আরাবিকের একটা চ্যবনপ্রাশ তৈরি করে হেসে হেসে নন্দানোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেল। স্প্যানিশ বললে নন্দানোর সুবিধেই হয়। আমি সন্ধে নামা পাহাড়টিলায় কুমড়োর বিচি ভাজা খেতে লাগলুম। নন্দানো বেশ কিছুক্ষণ পরে হাসি হাসি মুখে একটা সাদাকালো বেড়ালকে ঘাড়ে ঝুলিয়ে এসে পাশে বসল।
“বুঝলি সোপ্রানো, গিয়ে বেশ ভালোই লাগল, যত খিটকেল ব্যথা ছিল এখন আর বুঝতেই পারছি না যে সেগুলো কোনোদিন ছিল। আর ঘাসুলটা মোটেই ইটের টুকরো মতো নয় রে, বেশ মোলায়েম হয়ে যায়, দ্যাখ চুলগুলো কীরকম ফুরফুরে হয়ে গেছে।”
আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করে উঠতে পারলাম না ওকে কার্পেট না বেড কভারের না চাদরের মতো কেচেছিল।
শুধু হাঁফ ছেড়ে বললাম, যাক।
৬
আমাদের গাড়ি চালাচ্ছিল নিক। ভালোই বয়স হয়েছে। গ্রিসের লোক। মোটা সোটা। আমুদে।
নিজের দেশ ছেড়ে এত দূরে ? কবে এসেছ এখানে?
বৃষ্টি আর আর ভিজে হাওয়া আছড়ে পড়ছে গাড়ির কাচে। ওয়াইপার চলছে ঘনঘন। পেরিয়ে যাচ্ছি এক একটা স্বপ্নের মতো বাঁক। পাশে পাশে কোঁকড়া চুলের দামাল জলরাশি উড়িয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে এক স্বর্গীয় সুপুরুষ। কখনও তার কাঁধ থেকে পিছলে পড়ছে মেঘ-ছেঁড়া মাখন নরম রোদ্দুর। আমাদের থেকে দ্রুত তার গতি। আমাদের থেকে আগে পৌঁছানো তার জেদ। তার পেশল বাহু আর লম্বা আঙুল। মধ্যমায় ফিরোজা রঙের আংটি।
“ডিপ্রেশন”
“হ্যাঁ ডিপ্রেশন তো বটেই। এই মেঘ বৃষ্টি আর এবেলা ছাড়বে না।”
“নো, আয়াম টকিং অ্যা বাউট দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন অফ ইওরোপ, যা আমাকে ঘরছাড়া করেছিলো। তিরিশের মন্দা। অর্থনীতি ধসে পড়েছিল। কাজ ছিল না। খাবার ছিল না। কতই বা বয়স আমার তখন, আঠেরো হবে। কাজের খোঁজে ঘর ছাড়তে হল। দলে দলে লোক ইওরোপ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। আমিও সেই দলে ছিলুম। সেই থেকে অস্ট্রেলিয়ায়, এই মেলবোর্নে।”
তিরিশের মন্দাতে ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতিও বেজায় মার খেয়েছিল। মুনাফা লোটার জন্য দেশের চাষিদের দিয়ে ক্যাশ ক্রপ ফলানো হত, খাদ্যশস্য নয়। বাজার অর্থনীতি ভেঙে পড়লে সেই বাণিজ্যশস্য মুখ থুবড়ে পড়েছিল, দেশে সেইসব কেনার লোক ছিল না অথচ খাবার নেই।
কোথায় ছিল তোমার বাড়ি, নিক?
একটা বড়ো পাহাড় ঘুরে নিক তেরছা করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল, এখানে নামতে পার। খুব ভালো ভিউ পাবে।
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। নেমে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সমুদ্র ফেনার মতো চুলগুলো ঝুঁটি করে বেঁধে সেই স্বর্গীয় সুপুরুষ সাঁ করে বেরিয়ে গেল, যাবার আগে একটা তেরছা চোরা চাউনি দিতে ভুলল না, দেখলাম।
গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করেতে নিক বলল, “আমার বাড়ি লেসবস দ্বীপে, ভারী সুন্দর জায়গা। ওহ তুমি ভাবতে পারবে না। এত সুন্দর! প্রেমের দেবতা অ্যাফ্রোদিতির দেশ। ইজিয়ন সমুদ্রের ধারে।”
এই বলে নিক একটু মুচকি হাসল। বলল, “লেসবিয়ান কথাটা ওই লেসবস দ্বীপ থেকেই এসেছে। জান তো!”
আমিও হাবুলচন্দ্রের মতো বলে উঠলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ ওই বোহেমিয়া থেকে যেমন বোহেমিয়ান এসেছে। সেরকম, তাই তো? এই আমি যেমন বোহেমিয়ান। আমাদের স্টাইলকে বলে বোহো স্টাইল। হি হি হি।
আমরা তো সেই সকালে মেলবোর্ন থেকে গ্রেট ওশন রোড ধরে চলেছি। প্রায় ২৮০ কিলোমিটার। চার ঘণ্টা তো লাগবেই গন্তব্যে পৌঁছাতে। তবে মুসাফিরদের তো পথেই আনন্দ। রাহ গুজর। রাস্তায় এক জায়গায় কফি খেয়েছি। ফিশ অ্যান্ড চিপস খেয়েছি। ভদ্রতা করে নিকই আমাদের কফি খাইয়েছে। সেখানে বড়ো বড়ো সাদা কাকাতুয়া নন্দানোর হাতে বসেছিল। বৃষ্টি মাখা বাতাসে নন্দানোর নাক সুড়সুড় করছিল, চোখ ছলছল করছিল। ধরা গলায় নন্দানো আস্তে আস্তে বলল, “সোপ্রানো তুই যে অর্থে বোহেমিয়ান বলছিস সেটা কিন্তু ফ্রেঞ্চ শব্দ ।”
যাক, নিক কিছু বুঝতে পারেনি। কারণ নন্দানো বাংলায় বলেছিল। ও এখন ভালোই বাংলা বলে।
নিক বলল, “স্যাপফো আমাদের দেশের কবি। স্যাপফো একজন মেয়ে, জান তো? প্রেমের কবি। দুই নারীর মধ্যে যে ভালোবাসা হয়, তার কবি। সে অনেককাল আগের কথা । ক্রাইস্টেরও আগে।”
আমি হাঁ করে কথাগুলো শুনি। ঝোড়ো বাতাসে এলোমেলো উড়ছে লেসবস, স্যাপফো, আফ্রোদিতি, দুই নারীর প্রেম।
নিক বলে চলে “দেশছাড়া তো বহুদিন। তোমরা নতুন করে সব মনে পড়িয়ে দিলে। এই স্যাপফো মেয়েদের নিয়ে তাদের সৌন্দর্য নিয়ে তাদের প্রেম নিয়ে, ব্যথা নিয়ে লিখে গেছেন। খুব বেশি লেখা উদ্ধার করা যায়নি। মেয়েদের ভালোবাসতেন তিনি। ”
ঘন সবুজ রেইন ফরেস্ট। পাতা থেকে মুক্তোর মতো ঝুলে আছে জলবিন্দু। পথের পাশে ফুলগাছের নীচে নিঃসঙ্গ সমাধি, একাকী লাইটহাউস। স্যাপফো কি এরকম একাকী ছিলেন?
নিক বলল, “একটু পরেই আমরা নামব। রেডি হয়ে নাও।”
আমরা নামলাম। হু হু করে বাতাস উড়িয়ে নিচ্ছে চুল। প্রায় দাঁড়াতেই পারছিলাম না।
দিগন্ত বিস্তারি নিঃসীম জলরাশির মধ্যে ধ্যানমগ্ন বারো সন্তের পাথর। টুয়েলভ আপোস্টলস অফ ক্রাইস্ট। স্থবির প্রার্থনা। লাইমস্টোনে অবিরাম বাতাস ঘর্ষণে বারোটি প্রাকৃতিক ভাস্কর্য। এ দৃশ্য অপার্থিব। উত্তাল জলরাশি কেবল উথালপাথাল। জানা গেল দু-তিনটে ভক্তর সলিলসমাধি হয়েছে।
সমুদ্রফেনার মতো উদ্দাম চুলগুলো বাঁ হাত দিয়ে মুঠি করে ধরে আয়ত নীল চোখ তুলে সেই স্বর্গীয় সুপুরুষ, সারা রাস্তা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসা সেই পেশল প্রশান্ত মহাসাগর ডান হাত দিয়ে আমার হাতের তালুতে এক মুঠি বরফকুচি রাখল। আর শনশন করে বয়ে চলে গেল মুহূর্তের মধ্যে, কাঁধ থেকে পিছলে পড়ছে মাখন রঙা রোদ। তবে যাবার আগে সেই তেরছা চোরা চাউনি দিতে ভুলল না।
আমার হৃৎপিণ্ড যেন বন্ধ হয়ে আসবে। আমি নন্দানোর হাতে সেই বরফকুচি তুলে দিই, নন্দানোর হাতে সেই বিন্দু বিন্দু জলে মেঘ কাটা রোদ্দুরের সাত রং ঝিলকিয়ে ওঠে। সেই রং মাখা জলবিন্দু থেকে উড়ে গেলো স্যাপফোর কবিতা বারো সন্তের মাথা ছুঁয়ে দিগন্তরেখায় বিলীন। আমাদের জন্য সেই স্বর্গীয় প্রেমিকের উপহার।
O soft and dainty maiden, from afar
I watch you, as amidst the flowers you move,
And pluck them, singing.
More golden than all gold your tresses are:
Never was harp-note like your voice, my love,
Your voice sweet-ringing.
কবিতা: স্যাপফো
ছবি: লেখক ।
মরক্কোর ছবি – গুগল
মজে গিয়েছিলাম।
অনেক দিন পর এত ভালো লাগা নো, মন খুশ করা লেখা পড়লাম । সো প্রানো অর্থাৎ সুপর্ণা কে কুর্নিশ । মুজতবা আলী ফিরে এলেন ওঁর হাত ধরে মনে হচ্ছে ।
দিব্য লেখাটি তো... অনেকদিন পর এমন স্বাদের লেখা পড়লাম... শৈলী টা সোভিয়েত সাহিত্যের কথা মনে পড়িয়ে দিলো!!
এক নিঃশ্বাসে পড়লাম!
এক কুড়মুড়ে আখ্যান! অপূর্ব। মুজতবা আলির ঘরানার ম।।
সব কনটেক্সট বুঝতে না পারলেও লেখাটা পড়তে খুবই ভাল লাগল।
ভুলে যাচ্ছিলাম যে ট্রাভেলগ পড়ছিলাম ।খুব ভালো লাগল।
ইস্পেশাল আর রুহানি এই দুটো বাদে, আর একটা বলা যায় নীলিমা! লেখাটা তাই
ইস্পেশাল আর রুহানি এই দুটো বাদে, আর একটা বলা যায় নীলিমা! লেখাটা তাই
সুন্দর লেখা। খুব ভালো লাগলো পড়ে।
শ্বাস ফেলতে ভুলে গেছিলাম ,এক নিঃশ্বাসে শেষ