এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব  শরৎ ২০২০

  • প্রাংশু পুরাণ

    প্রতিভা সরকার
    ইস্পেশাল | উৎসব | ১৪ অক্টোবর ২০২০ | ৫১৮২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৭ জন)
  • কুয়াশার ছবি
    ( প্রথম অধ্যায়)


    দামোদরের দক্ষিণ ধারের এই চর দুপুরের রৌদ্রে ধু ধু করছে। রিণিরা গাড়িটা যেখানে রেখেছে সেখান থেকে নদীর মূল স্রোত দেখা যাচ্ছে না। তার জন্য অনেক এগিয়ে যেতে হবে। দেখা যাচ্ছে খানিক দূরের অর্ধ চক্রাকৃতি বালুচর। তার সঙ্গে সমান্তরাল ডানদিকের প্রচুর সর্ষেখেত, অজস্র হলুদ ফুল, রোদে যেন দূর থেকে বাতাসে তরল সোনার ঢেউ। তারই লাগোয়া বিস্তীর্ণ ফাঁকা জায়গায় সব অস্থায়ী দোকানের দড়িদড়া,কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে এখান থেকেও। মানস অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে আঙুল তুলে বলল,

    -ওই যে দিদি,ছাতা পরবের মাঠ।

    রিণির পরণে একটা পালাজোঁ আর শর্ট কুর্তা। গরম লাগছে বলে সে সোয়েটার খুলতে খুলতেই দেখল দূরে এক ধ্বজা ওড়ানো তাঁবুর তলায় পাশাপাশি দুটো পেল্লায় ছাতা। চিকিমিকি কাগজের নকশা,শোলার ফুল ,আরো কী কী দিয়ে যেন জবরজং সাজানো। কাছে গেলে দেখা গেল ফুলের মালা ঝুলছে,শ্বেত ও রক্ত চন্দন ছাতার ঘেরের ওপর গাঢ় করে লেপা। একটু উঁচু বেদির ওপর স্থাপিত ছাতা পরবের দুই বিগ্রহ,দুই বিপুলাকৃতি বাঁশনির্মিত ছত্রপতি। সত্যি তাদের ঐ নামে ডাকা যায়, এতো বড় তারা আড়ে ও বহরে। একটি নাকি স্থানীয় পঞ্চকোটের রাজার স্মরণে, আর একটি পুরীর রাজা গজপতি সিংহের স্মরণে।

    সূর্য মাথার ওপরে হলেও স্থানীয় মেয়েপুরুষ কিছু আছে বাচ্চাকাচ্চার হাত ধরে।একটা বাচ্চা মেয়ে আধ খাওয়া জিলিপি হাতে ধরে রিণির দিকে চেয়েই আছে। তার মা কনুই ধরে টানল,

    আয় কেনে।

    বাচ্চাটা যেতে যেতেও ঘাড় ঘুরিয়ে রিণিকে দেখছে। রস মাখা আঙুল তুলে তাকে দেখিয়ে মা কে কিছু জিজ্ঞাসা করছে। হয়ত রিণির ছোট চুল, তার রোদ চশমা,নাকে ঝিকিয়ে ওঠা হিরের কুচি, হাতের ঢাউস ব্যাগ, মোবাইল, সব মিলিয়ে রিণিকে তার অদ্ভুত লেগেছে। রিণি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে তারপর মানসকে ডেকে বলে,
    চল মানস, জিলিপি খাই।

    পুরুলিয়া শহরের ইয়ুথ হস্টেল থেকে রিণিরা যখন রওনা হয়েছে তখন বেলা সাড়ে এগারোটা।
    ঘন্টা দুই আড়াই লাগে, কিন্তু লোকাল ছেলে হয়েও মানস তেলকুপি যাবার রাস্তা চিনতো না।এমনকি তাদের ড্রাইভার ইয়াকুবও না। ভুল পথে চলে গিয়ে ঘোরাঘুরিতে তাদের চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট নষ্ট হয়েছে। এখন খানদুয়েক জিলিপি, প্রচুর দুধ চিনি দেওয়া এক কাপ চা খাওয়া যেতেই পারে।

    -নিজের জেলাটাকেই চিনলে না মানস। কী যে সুন্দর আর কতো যে পুরাকীর্তি !

    গরম চায়ে চুমুক দিয়ে রিণি আফশোস করে।

    মানস চোখের পাতা পিটপিট করে।গলায় খানিক আপশোস এনে বলে,
    -সে আর হল কই দিদি! কলেজ শেষ করেই এই সিভিক পুলিশগিরি। এইভাবেই কেটে যাবে।
    সে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে। রিণি পয়সা মিটিয়ে নদীর দিকে এগোয়। মানস যদি বাধ্য হয়ে সিভিক পুলিশ নাও হতো তাহলেও সে তেলকুপি চিনত না,এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। রিণির নাহয় এসব নিয়েই গবেষণা,একটা প্রাণের টান সে অনুভব করে ভাঙা দেউড়ি,ধ্বসে পড়া মন্দির দেখলে,কিন্তু বেশির ভাগ লোকেরই কিছু যায় আসে না, জাস্ট কিছু যায় আসে না। পুরাকীর্তিগুলি যেন লোকচক্ষুর আড়লে ফুটে থাকা বিচিত্র বনফুল।ঝরে যাবে, লোকে মাড়িয়ে যাবে,এইই তাদের ভবিতব্য। সরকার কখনোসখনো কিছু পয়সা ঢালবে। এএসআই লোকজন এনে মাপজোক, খোড়াখুড়ির কাজ করবে।তারপর আবার যে কে সেই। অন্ধকারে শ্যাওলা মেখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকবে মন্দির গুলো,যতদিন না ভিতের সম্পূর্ণ পাথর সরিয়ে নিয়ে যায় গ্রামবাসীরা, তারপর কোনো এক মেঘলা দুপুরে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে অভ্রংভেদী প্রাচীনতম মন্দিরের মিনার।

    দিদি, ওই দেখুন ডানে বামে দুটো মন্দির !

    মানসের গলায় কী কিছু উত্তেজনা ! তার হাতের সংকেতে মাথা ডাইনে বাঁয়ে ঘোরায় রিণি। সত্যি বাঁ দিকে বিশাল বেনাবনের কতো কিলোমিটার ভেতরে কে জানে দেখা যাচ্ছে এক ভৌতিক উচ্চতা। যেন এই রোদের আঁচে দূরবর্তী নদীর দিক থেকে ছুটে আসা উষ্ণ বাতাসে লি লি করে কাঁপছে সেই মন্দিরের চূড়ো। রিণি আর তার মাঝখানের প্রান্তর জুড়ে শক্ত মোটা বেনাঘাস। সে শুনতেই ঘাস,দেখতে সরু বাঁশের মতোই গুল্ম,শক্ত আর ছুঁচলো। ভেদ করে যাওয়া এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। ইয়াকুব বলল,বাগালরা গরু চরাবার অসুবিধের জন্য প্রায়ই নাকি শুকনো বেনাঘাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তা হলে অবশ্য অতটা দুর্ভেদ্য হবে না।

    -ক' কিলোমিটার হবে মানস?

    রিণি ঘোর লাগা গলায় শুধলো। সেই বহুশ্রুত তেলকুপির প্রাচীন জৈন মন্দির তার সামনে! স্যার সেদিন বলছিলেন স্বয়ং তীর্থংকর মহাবীর এই স্থান পরিভ্রমণ করে গেছেন। মন্দিরগাত্রের উৎকীর্ণ ভাষ্য আর ধর্মগ্রন্থের সাক্ষ্যে সে যদি সেই মহাপুরুষের পরিক্রমা পথের একটি ম্যাপ এঁকে ফেলতে পারে তাহলে একটা বিরাট কাজ হবে। এর পরের বার স্যারও আসবেন তার সঙ্গে। প্রাথমিক দেখাশোনার কাজটা রিণি সেরে ফেলতে এসেছে।

    মানসের সাড়ায় রিণির ঘোর ভাঙল।

    - বেশি না দিদি, হয়ত এক কিলোমিটারের একটু বেশি। তবে কিনা রোদ চড়া আর বেনোবনের পোড়া চটচটে রস সব কাপড়ে চোপড়ে লাগবে। আগে ঐ দিকটায় যাবেন ?

    মানস ডানদিকটা দেখায়। সর্ষেফুলের বিস্তার যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে শুরু চওড়া কাকচক্ষু জল। নদীর উপধারা। তারই ভেতরে অনেক দূরে জলে নিমজ্জিত এক মন্দির। এখান থেকে তাকে দেখায় যেন মাথায় মুকুট পরা এক মানুষের অবয়ব। কারুকার্যখচিত দ্বার যেন চক্ষু, মুখগহ্বর। রিণিকে ডাকছে আয় আয়।
    একটা নৌকোর ব্যবস্থা কর মানস। এটাতে তো যাবই, একেবারে আসল দামোদরের ভেতরটিতে যে মন্দিরটি আধোজাগা হয়ে আছে, সেখানেও।

    রিণির কথা শুনে লোকের খোঁজে মানস ছাতা উৎসবের জমায়েতটার দিকে এগিয়ে যায়।

    কিছুক্ষণ বাদে রিণিদের নৌকা তরতর বয়ে যাচ্ছিল দূরের মন্দিরটির দিকে। মানস যতীন নামে এক লোকাল জেলেকে ধরে এনেছে। টাকায় পোষালে সে এই মন্দির, দামোদরের পেটের ভেতরকার সেই মন্দির তো দেখাবেই, বেনাবনের ভেতর হাতছানি দেওয়া কুয়াশা কুয়াশা মন্দিরে যাবার সময়ও গাইডের কাজ করবে বলে সানন্দে কথা দিয়েছে। তেলকুপির স্থানীয় অধিবাসী সে। অনেক কথা উপকথা জট পাকিয়ে রয়েছে তার মাথার ভেতর। শহুরে লোক, এই ভূখণ্ড সম্বন্ধে অজ্ঞ লোক দেখলে সেগুলো ঠেলাঠেলি করে বাইরে আসতে চায়। এগুলো শোনার মতো সময় বা ধৈর্য কোনটাই স্থানীয় মানুষের নেই। তাছাড়া তারা সবাই এইসব কথা উপকথা একরকম ভাবেই জানে। তাই নৌকার গলুইতে বসে রিণি তার পায়ের পাতা জলে ডুবিয়ে বহতা ধারার বুকে দীর্ঘ রেখা তৈরি করছিল যখন, যতীন তার গল্প শোনাচ্ছিল মানস আর ইয়াকুবকে।
    বুইঝলেন বাবু,বিশকরমা (বিশ্বকর্মা) ইকথা শুইনে বইল্ল রাইত পুহাবার আগেই হামি ই মন্দির বনাই দিব। শিব দেইখলেন ইটা তো ঠিক হবেক নাই-মন্দির হল্যে তিনি তো বাজিটা জিততে লারবেক। তখন তিনি খুকড়ার রূপ ধইরলেন।তারপর দুপহর রাইতেই কোঁকর কোঁ কইরে ডাক ছাইড়লেন। বিশকরমা ভাইবলেন রাইত কাবার।তিনি কাজ ছাইড়ে স্বরগে পলাই গেলেন।

    ইয়াকুব আর মানসের মাথা নাড়ানো দেখে যতীন আরো উৎসাহিত হয়।লগি দিয়ে জল ঠেলতে ঠেলতে বলে,
    সেই তখন থাইকতে মন্দিরগুলান এমনই পড়্যে আছে।ঠাকুর দেবতার মুত্তি নাই, পুজা কইরবার লোক নাই, শুধায় ইধারে পাথর, উধারে পাথর। গটা এলাকায় চাইরদিকে এথায় উথায় কেমন সোন্দরপারা কাজ করা পাথরগুলান পড়্যে আছে।

    নৌকায় উঠেই একদিকের গলুইতে নিজের জায়গা করে নিয়েছিল রিণি। বসেই পায়ের পাতাদুটি সে ডুবিয়ে দেয় জলধারার মধ্যে। এখন যতীনের বকবকানি শুনতে শুনতে সে দেখছিল নৌকা যত এগোচ্ছে,জল ততই গভীর হচ্ছে, প্রাথমিক উষ্ণভাব হারিয়ে ক্রমশ শীতলতর। আরো দেখছিল, তার কালো নেইলপলিশ পরা ভেজা পায়ের পাতাদুটি যেন জলপদ্মের মতো উন্মুখ হয়ে জল কেটে কেটে যাচ্ছে জলের ভেতরেই।

    যেহেতু এটি উপধারা, শীতে জল অনেক শুকিয়ে যায়, নীচে জন্মায় নানা জলজ গুল্ম। এখন কাকচক্ষু জলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সেই ফ্যাকাশে অথবা ঈষৎ সবুজ লকলকে গুল্মেরা যতীনের দাঁড় মাথায় পড়তেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফণা নীচু করে নৌকাকে পথ করে দিচ্ছে। অনেকদিন পর রিণির খুব ভালো লাগলো, ছেলেবেলায় দাদুর সঙ্গে যেন স্টিমারে বেলুড়মঠ যাচ্ছে সে। পায়ের পাতা ডোবানোর সাহস সেখানে ছিল না, কিন্তু পরে তন্ময়ের সঙ্গে কাশিপুর ঘাটের সন্ধেগুলোতে সে সখ অনেকবার মিটেছে। তবু আজকের এই সফর তার একার। যদি ভালো কিছু লেগে থাকে তাও তার একার, কারো খবরদারি নেই। বিপুল এক স্বাধীনতার আস্বাদ, প্রায় মুক্তির সমতুল্য মনে হতেই, রিণি অস্ফুটে হেসে উঠল। মাঝবয়সী যতীন সেই আওয়াজে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,

    হাই দেখ গ, দিদি হামার হাইসছ কেনে! হামার কথাট মাইনতে লারছ?

    তার কথা মানতে হবে কেন, যতই বিশ্বকর্মা আর মোরগের কাহিনী ছড়িয়ে পড়ুক মুখে মুখে,আসল কাহিনী তো রিণির জানা। পাশের রাজ্যের পার্শ্বনাথ পাহাড় যেখানে জৈনধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ, সেখান থেকে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এই রাঢ় বাংলায় আগমন হয়েছিল মহাবীর বর্ধমানের। তাঁকে প্রথমে অনেক নিগ্রহ সহ্য করতে হলেও কিছু অমোচনীয় ছাপ তিনি রেখে যান। কংসাবতী নদীর ধারে ধারে বহু মন্দির গড়ে ওঠে, জৈন দেবদেবী ও চব্বিশ তীর্থংকরের অজস্র অপরূপ মূর্তি। কঠোর সংযম পালনে অভ্যস্ত জৈন ধর্মাবলম্বীদের পল্লী। তাদের বলা হত শরাক। হয়ত শ্রাবক থেকে শরাক। মনে করা হয় তারা ছিল শিল্পী সম্প্রদায়। অপূর্ব কারুকাজমন্ডিত শিল্পকীর্তিগুলির তারাই স্রষ্টা। গড়ে ওঠে দামোদর নদের দক্ষিণভাগে তৈলকম্প নামে এক মহানগরী। শিখরভূম রাজ্যের রাজধানী।

    তিনহাজার বছরের বেশি সময় কেটে গেলে সবকিছু যখন প্রায় অবলুপ্ত, কালের থাবায় সমস্ত কিছু যখন ম্রিয়মাণ, তখন ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও উন্নয়নের জোয়ার। পাঞ্চেত ড্যাম তৈরিতে দামোদরের প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। তৈলকম্প বা তেলকূপীর মানুষজন দেবালয় সহ প্রচুর গ্রাম পরিত্যাগ করে পিছিয়ে যেতে থাকে আগ্রাসী নদী থেকে অনেক দূরে। পড়ে থাকে কয়েকশ মন্দির,তার বেশিরভাগই হারিয়ে যায় দামোদরের পেটে।কেউ সারা বছর নিমজ্জিত থাকে, কেউ শীতকালে জল কমে গেলে সর্বাঙ্গ জাগিয়ে তোলে।যে কটির অবস্থান জল থেকে দূরে তাদের বিগ্রহ চুরি যায়। খিলানের অপূর্ব কারুকাজ আবছা হয়ে আসতে থাকে হাওয়া আর ধুলোর আদরে। শেষ পেরেকটি পোঁতে গ্রামবাসীরা। বাড়ির সিঁড়ি,ঘাটের ধাপ, সীমানাপাথর হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে মন্দিরের চুরি করা পাথর। এখন শুধু ভগ্নাবশেষ। রোদজলে ক্ষয়ে যাওয়া প্রাচীন মন্দিরের দু'একটি
    পড়ি পড়ি করেও মাথা তুলে আছে,রিণির মত দুএকজনের কাছে ধরা দেবে বলে।

    রিণি দেখলো সবার আগে লাফ দিয়ে মাটিতে নামলো যতীন। দুহাতে টেনে রাখলো রিণির উলটোদিকের গলুই। তার পেছনে মানস,আর ইয়াকুব,সবশেষে টলমলে নৌকায় তাল রাখতে রাখতে রিণি।

    -ধরতে হবে দিদি ?

    মানস এগিয়ে আসছিল, রিণি তাকে হাত দেখিয়ে নিবৃত্ত করল। নামার কৌশলটুকু আয়ত্ব করতে গিয়ে সে অন্যমনস্ক ছিল, এখন নামতেই দু তিন হাতের মধ্যেই সেই ঐশ্বর্য, দামোদরের গর্ভ থেকে জেগে ওঠা সেই আশ্চর্য মন্দির। এখনো ঘাড়ে গভীর ভাঁজ ফেলে দেখতে হয়,এতো উঁচু তার চূড়া। একটি মাত্র প্রবেশদ্বার,যদিও বাকি তিনদিকের দেওয়ালেই অনুরূপ ভাস্কর্য,কিন্তু যাতায়াত করবার মতো
    ফোকর নেই সেখানে। বরং দূর থেকে এবং নৌকা থেকেও তাদের লাগছিল যেন নাক চোখের মত। মন্দিরের দেওয়ালে যেন কার বিরাট মুখাবয়ব খোদাই করা।

    রিণিরা যেদিক থেকে এল সেদিকটা মন্দিরের ডানদিক। ডানদিক আর বাঁদিককে জুড়েছে যেই মধ্যবর্তী দেওয়াল, তারই গায়ে দামোদরের মূল ধারার দিকে মুখ করে মন্দিরের প্রবেশদ্বার। একটিমাত্র। ভেতরের তিনদিকের দেওয়ালে দন্ডায়মান দেবমূর্তির জন্য দেওয়ালের পাথর কেটে বিরাট কুলুঙ্গি মতো কাটা। আর প্রবেশপথের দিকে মুখ করে যে পেছনের দেওয়াল,সেটি নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট ছিল প্রধান দেবমূর্তির জন্য। এখন কিছুই নেই। খানিকটা অন্ধকার যেন জমাট বাঁধা সেইখানে। হয়ত ওপর থেকে জল পড়ে আঁকাবাঁকা কিছু রেখার উৎপত্তি হয়েছে সেইখানে। অনেক উঁচুতে খিলানে খিলানে বাসা বেঁধে আছে অজস্র বাদুড়।তাদের বিষ্ঠার তীব্র গন্ধে রিণি নাকে রুমাল চাপা দিল।
    মানস আর ইয়াকুব ভেতরে এসেছিল,কিন্তু এই দুর্গন্ধেই তিষ্ঠোতে পারেনি।এখন তাদের উত্তেজিত গলা শুনতে পেল রিণি,

    দিদি বাইরে আসুন,দেখুন কী সুন্দর নকশা।

    সত্যি, বছরের বেশিরভাগ সময় নদীর স্রোতের আঘাত সহ্য করতে করতে এই মন্দির খানিকটা হেলে পড়েছে,কিন্তু এখনো যা আছে চোখ জুড়িয়ে যায়। জটিল এবং অসাধারণ কারুকাজমন্ডিত চৌকো মোটা পাথরের স্ল্যাব থাক থাক ওপরে উঠে গেছে, প্রবেশদ্বারের কিছুটা ওপর থেকে একেবারে চূড়ো অব্দি। কিছু ভেঙে পড়ে গেছে,তবু গড়ন এখনো অক্ষত। যেখান থেকে পাথরের স্ল্যাব উঠেছে তার নীচ থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন নকশায় সজ্জিত পাথরের থাম পুরো নির্মাণকে খাড়া রাখতে পাশাপাশি চলে গেছে মাটির নীচে কোথায়। ফুল লতাপাতা,নানা জীবজন্তু, দেবদেবীর মূর্তি খোদিত সেসব থাম দেখেই ইয়াকুবের ঐ চিৎকার। রিণি ঘাড় উঁচু করে দেখতে দেখতেই মাপজোকের ফিতে,নোট নেবার খাতা পেন বার করে ফেলল ব্যাগ থেকে। আর ছবি তোলবার জন্য মোবাইল। উড়িষ্যার রেখদেউলের সঙ্গে তেলকুপির দেউলের সাদৃশ্যের অকাট্য প্রমাণ সে এইবার স্যারকে দিতে পারবেই।

    মন্দিরের ভিতের কাছে রিণি হাঁটু মুড়ে বসে মাপ নিচ্ছিল, তার মাথার ওপর দিয়ে টি টি করে ডাকতে ডাকতে একটা পাখি উড়ে গেল। কী পাখি দেখার জন্য মাথা তুললো রিণি,দেখলো আকাশ ছাই বর্ণ। বৃষ্টি আসবে নাকি ! শীতকালের বৃষ্টি ! ভিজলে অবধারিত ঠান্ডা লাগা। খানিক আগে মানস বলে গেল যতীনের সংগে ওরা দ্বীপটা এক চক্কর মেরে আসবে। ফলে কোন জনমানুষ নেই, নদীর দিক থেকে ছুটে আসা বাতাসের হু হু শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দও নয়। মাথার ওপরে ছাই ছাই মেঘভরা আকাশ, কিন্তু নদীর দিক থেকে সূর্যের অস্তকালীন রশ্মি এসে ছুঁয়েছে মন্দিরের দ্বার। বেলে পাথরের ওপর সেই সোনালী আভায় গর্ভগৃহের ভেতরে এমন শোভার সৃষ্টি হয়েছে যে বাইরে থেকে রিণি হাঁ করে সেদিকেই চেয়ে রইল। থাকতে থাকতে তার বিভ্রম হল যেন কোন বিশাল পঞ্চপ্রদীপের আলো প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে ছড়িয়ে পড়ছে ভিতর- মন্দিরের সারা গায়ে। এতো দ্রুত কমে আসছে সেই আলো, বোঝাই যাচ্ছে অগ্নিশিখা প্রাণপণ লড়াই করছে বাতাসের হুহুংকার আর আকাশের আথালপাথাল মেঘের সঙ্গে।

    রিণি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখল খুব কালো অন্ধকার গর্ভগৃহের ভেতরে। এইসময়েই দু'এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল যেন মুখ আর হাতের ওপর। কতো বড় এই কাছিমের পিঠের মতো দ্বীপ কে জানে,মানসদের তো এতোক্ষণ চলে আসা উচিত ছিল! উপায়ান্তর না দেখে রিণি ঢুকে পড়ে মন্দিরের ভেতরে। অপেক্ষা করতে করতে হঠাত তার খেয়াল হয় বাদুড়ের বিষ্ঠার সেই দুর্গন্ধ যেন অনেক কমে এসেছে। ওপরে তাকিয়ে অন্ধকারে কিছু ঠাহর হয় না। কিন্তু নজর ক্রমশ নেমে আসে পেছনের খাড়াই দেওয়ালে। হঠাৎই কী যেন দেখে ফেলে রিণি উত্তেজিত হয়। বেলেপাথরের দেওয়ালে অনেকদিন ধরে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে এমন ছাপ পড়ে যাবে কিনা রিণি জানে না কিন্তু সেইরকমই যেন এক পূর্ণাবয়ব মনুষ্যমূর্তির রূপরেখা আঁকা রয়েছে ! যেন প্রবল ধূপধুনো তেল অগুরু চন্দন, যাবতীয় পূজাসামগ্রীর প্রভাবে আঁকা হয়ে গেছে সে ঐখানে। প্রথমে যখন ঢুকেছিল খেয়াল করেনি তো! এখন আবছা কমলা রঙের আলো এসে পড়েছে,স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কার যেন দেহের বহিরঙ্গের রেখাগুলি। আলো যতো কমছে ততো স্পষ্ট হচ্ছে সে মূর্তি। আট/ন ফুট উঁচু এক তপোরত সন্ন্যাসী,পুরো নগ্ন,স্পষ্ট প্রতিভাত তার কপাট বক্ষ,শিথিল শিশ্ন। তাঁর উন্নত কপাল,গভীর নাভিদেশ। শান্ত ধ্যানমগ্ন মুখাভাস,নিমীলিত চক্ষু। দুই সবল পা বেয়ে উঠে গেছে কতো লতাপাতা। হয়ত বনভূমিতে দীর্ঘসময় তপস্যায় দণ্ডায়মান থাকবার ফল। লতাপাতাও তার পদদ্বয়কে সবল বৃক্ষকাণ্ড বিবেচনায় জড়িয়ে ধরেছে। কী আশ্চর্য,এই নবীন সন্ন্যাসীর বস্ত্রহীন দেহের রূপরেখা মনে কোনো অশ্লীল চিন্তা আনে না, কামোদ্দীপন ঘটায় না, শুধু শান্তি বর্ষণ করে, আপনা থেকে মাথা নীচু হয়ে আসে। দৃষ্টি নত হয় তার পদতলে।

    রিণি টের পেল কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। অতিপ্রাকৃত কিছু দেখে মূহুর্তে অজ্ঞান হয়ে পড়বার মত মেয়ে সে নয়। অনেক ঘাত প্রতিঘাত চড়াই উৎরাই সে পেরিয়ে এসেছে। তার যুক্তিবোধ তাকে বলতে লাগল এ আলোছায়ার খেলা। হয়ত অধুনা অদৃশ্য পাথরের মূর্তির সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘর্ষণে, গ্রামবাসীদের নিরন্তর পূজার্চনার ফলে প্রবেশদ্বারের মুখোমুখি দেওয়ালে সত্যিই অঙ্কিত হয়ে গেছে দেবমূর্তির বহির্রেখা। বাতাসের ঘনত্ব,আলোর তেরছা পতন সব মিলিয়ে কখনো কখনো দৃষ্টিসীমায় তা ধরা দেয়, কখনো দেয় না। বাদবাকি রিণির কল্পনা। যতীন তাকে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবে, সে নিশ্চিত। হয়ত সেও দেখেছে কখনো সেই অপরূপ দেবমূর্তিকে। আরো গ্রামবাসীরা অনেকেই হয়ত দেখেছে।

    ভাবতে ভাবতেই পায়ের আওয়াজ, টুকরো কথা শুনলো রিণি, এমনকি বিড়ির গন্ধও পেল। তিনমূর্তি ফিরছে।

    বৃষ্টি পড়ছে মানস এখনো?
    না দিদি, একটু মেঘ করেছিল, সে উড়ে গেছে।

    সত্যি মেঘ করে যতটা অন্ধকার লাগছিল, ততটা বেলা যে হয়নি এখন তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। মোবাইল দেখল রিণি। সাড়ে চারটে মাত্র। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। বাতাস বইছে নদীর দিক থেকে। শীতবোধ হতে রিণি সোয়েটারে হাত গলালো।

    সবাই তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে পড়ে। সন্ধে নামার আগেই তারা বেনাবনের মন্দিরটি দেখে নিতে চায়। এ তল্লাটে আর কি আসা হবে!

    নৌকা যখন মাঝনদীতে, রিণি ঝুঁকে পড়ে আঁজলায় জল নিয়ে চোখেমুখে ছেটায়। যতীনকে সে কিছু বলবে না। হয়ত অনেকেই তাঁকে দেখেছে, কিন্তু আজ দয়া করে হাজার হাজার বছরের পরপার থেকে একা তাকে দেখা দিয়েছেন যিনি, তাঁকে নিয়ে এই মূহুর্তে কোনো আলোচনা রিণি চাইছে না। তাঁকে খুঁজতেই, তাঁর যাত্রাপথের হদিশ পেতেই তো এখানে আসা। আজকের দর্শনের পর রিণির মনে হল তার এই খোঁজ বৃথা যাবে না। এবারের আসা তার ফুলে ফলে নৈবেদ্যে ভরে উঠবে।



    ~~~~

    প্রাংশু পুরাণ
    (দ্বিতীয় অধ্যায়)


    আঃ মাহা, বড় কষ্ট !

    শয্যায় পাশ ফিরতে গিয়ে অর্ধস্ফুট স্বরে কাতরোক্তি ক'রে ওঠে নবীন শ্রমণ ন্যায়াপুত্ত। তার শরীরের রক্তমুখী স্ফোটকগুলি বেদনায় বিষিয়ে ওঠে। অবচেতনে বোধহয় তার মনে ফিরে আসে তার স্নে্হস্বরূপা মাতামহীর কথা, যার কাছে জীবনের চতুর্দশ বৎসর সে আনন্দবেদনা হাসিখেলায় অতিবাহিত করেছে। যাকে সে মাহা বলে ডেকে এসেছে জন্মাবধি। মাতার অপভ্রংশ কি এই মাহা ? কে জানে ! উত্তরে সে নিজে সম্ভাষিত হয়েছে আদরের ‘মহা’ নামে। মহা অর্থ বড়, প্রকান্ড, প্রচুর, উৎকৃষ্ট। ক্ষত্রিয় মাতামহী,স্বহস্তে অসিচালনা,অশ্বচালনায় পারদর্শী মাতামহী তার জন্য কী স্বপ্নসম্ভব ভবিষ্যত জীবনরেখা অঙ্কিত করেছিলেন তা মূর্খেও বোঝে।

    মাতামহীর কথা মনে এলে দূরে থাকেনা বাল্য ও কৈশোরের সেই মধুর দিনগুলির কথা । মাতা ত্রিশলার সেই মধুর মুখমন্ডল। মাহার বিপরীতে মায়ের সেই কোমল নারীসুলভ ব্যবহার। মহা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পড়ে যেতেই তার সেই বাছা ,খুব কি লেগেছে বলে অকুন্ঠ রোদন, যতক্ষণ না পৃথুলা মাতামহী সদর্পে ঘোড়াটির লাগাম আকর্ষণ করে সজোরে হাঁক পাড়েন,

    কোথায় লুকালি মহা ? এই বেগবান অশ্বকে বশে আনতে না পারলে আমি তোর মস্তকে এই ধূলা নিক্ষেপ করব।

    বলতে বলতে সত্যিই তিনি বটবৃক্ষের মূল থেকে একমুঠো ধুলো কুড়িয়ে নেন। এবং পুনরায় মহাকে ভূপাতিত হতে দেখে উৎকট উচ্চহাস্যে ভেঙে পড়েন।

    শাস্ত্রে তাকেই শ্রমণ বলা হয়েছে যার মনে কারো প্রতি কোনো দ্বেষ কিম্বা ভালবাসা নাই। বিশ্বব্রহ্মান্ডে, নরলোকে ,দেবালোকে, পিশাচ বা জিনলোকে কারো প্রতি দ্বেষ নাই তার। তাই সে ন্যায়াপুত্ত নামে খ্যাত। কিন্তু মনের কোন চোরাকুঠুরিতে মাতা এবং মাতামহীর প্রতি এক মধুর চোরাটান আজও রয়ে গেছে,এ কথা ভাবতেই এই অসুস্থ অবস্থাতেও ন্যায়াপুত্তের কর্ণমূল উষ্ণ হয়ে ওঠে। সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীর পক্ষে এ অতি গুরুতর স্খলন !

    শয্যা বলতে তো গৃহীর সযত্নলালিত শয্যা নয়, সম্মেতশিখর পর্বতের ওপর মহাপুরুষদের সমাধিগুলিকে অর্ধগোলাকৃতি বেষ্টন করে আছে যে আধো অন্ধকার গুহামালা, তারই একটিতে বিরাট পাথরের সমতলবৎ চট্টানে কুশের উপর শায়িত মহার নগ্ন শরীর। সুন্দর,যৌবনের পেশি-উচ্ছাসে পরিপূর্ণ, কিন্তু রোগক্লিষ্ট।

    প্রায় তিনহাজার বছরের পুরনো পৃথিবী। বিশুদ্ধ বায়ু, সুপেয় জল ও পর্জন্যদেবের কল্যাণে সসাগরা বসুন্ধরা ছায়াময়, বিশাল মহীরুহের প্রাবল্যে শীতল ও স্নেহশালিনী। ব্যাধির প্রকোপ স্বাভাবিক কারণেই কম ছিল। কিন্তু হঠাৎই মারীর পূতিগন্ধে গ্রাম জনপদ পূর্ণ হয়ে গেছে। এমন অবস্থা, শবদেহ দাহ করার মানুষ নাই। জঙ্গল পরিকীর্ণ ভূমিতে অর্ধভক্ষিত মৃতদেহের পাশে দিবালোকেও বন্যজন্তুর অবাধ পদচারণা।

    এ রোগের লক্ষণ অতি সামান্য। মস্তকঘুর্ণন ও প্রবল স্বেদধারা শরীরকে ধৌত করার পর বাসরকক্ষে নববধূর নিঃশব্দ, লজ্জাতুর আগমনের মতো শরীরের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে, কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মতো চূড়ান্ত যন্ত্রণা ও অস্থিরতা রক্তমাংস বিদীর্ণ করে বাইরে আসতে চায়। জ্বর কমে না, শয্যাতেই রোগীর মৃত্যু হয়। সময় নেয় বড়জোর একদিন। তার মধ্যেই শরীর ছেয়ে যায় রক্তমুখী স্ফোটকে। আয়ুর্বেদাচার্যরা গম্ভীরমুখে মাথা নাড়েন, পরিচিত বসন্তরোগ এ নয়। প্রকৃতিদেবীর নতুন কোনো মারণলীলা শুরু হয়েছে। নিম ও চন্দনচূর্ণ লেপন এবং তুলসী ও মধু একত্রে পান ছাড়া যন্ত্রণা প্রশমনের অন্য কোনো নিদান তাদেরও অজানা।

    বাইরে ঝড়ের দাপটে চারিদিক ছত্রখান হয়ে পড়ছে তা গুহাভ্যন্তর থেকেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। শাখায় শাখায় ঠোকাঠুকির আধিভৌতিক শব্দ, বজ্রের বধির করে দেওয়া আওয়াজ, হাওয়ার প্রবল শব্দ,বিদ্যুতের চিকণ আলো গুহাদ্বার দিয়ে অহরহ ভেতরে প্রবেশ করছে। ন্যায়াপুত্তের শয্যা যে প্রস্তরের উপর প্রলম্বিত,তার থেকে প্রায় সাতহাত নীচে গুহামৃত্তিকায় আর একটি কুশখন্ড মেলে শায়িত আছে প্রিয় সাথী ইন্দ্রভূতি গৌতম। এই দিগবিদিক চূর্ণ করে দেওয়া ঝড়ও তার ক্লান্ত, অতিক্লান্ত নিদ্রার ব্যঘাত ঘটাতে পারেনি। বরং হাওয়ার বেগ কিছুটা কমে এলেই ন্যায়াপুত্ত অতো উঁচু থেকেও গৌতমের নাসিকাধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। জলহাওয়া শীতল হওয়াই বোধহয় এই গভীর নিদ্রার কারণ।

    -আঃ!

    আবার অস্ফুট কাতর শব্দ করে ওঠে ন্যায়াপুত্ত। জলপানের ইচ্ছায় সে বাঁদিকে শরীর ঘোরায়। কুশাগ্রে কয়েকটি স্ফোটক ফেটে যায়, ভেতরের রস ন্যায়াপুত্তের নিজের অঙ্গেই লিপ্ত হয়। হাতখানেক দূরেই মৃত্তিকাপাত্রে জল রক্ষিত। বিশালাকায় বৃক্ষপত্র চাপা দেওয়া। যদিও বাতাসের তোড়ে তা কাত হয়ে পড়েছে। কিন্তু জরা তার সমস্ত দেহকে প্রস্তরবৎ করে ফেলেছে, অসহনীয় ভারী, যেন নিজেও সে একটি পাথরের চট্টান। অতিকষ্টে আঙুলগুলি প্রসারিত করে সে, তবু জলপাত্র আর ওষ্ঠের দূরত্ব মনে হয় কয়েক যোজন।

    হঠাৎ এইসময় ঝড়ের গতি অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বাতাসের গর্জনে কান পাতা দায়। যেন মহাপ্রলয়ের মুখোমুখি পৃথিবী। সাদা জলকণা সমুদ্রোত্থিত ফেনারাশির মতো হু হু ছুটে আসে। গুহার দেওয়ালে বাধা পেয়ে শ্রমণের শরীরকে ভেজায়। যে কোনো বৈদ্যের কল্পনারও অতীত, প্রকৃতির নিজহস্তের এই মমতাময় উপশম। শীতল জলকণায় প্লাবিত ন্যায়াপুত্তের চোখ আরামে বুজে আসে। মনে হয়, নীচ থেকে উঠে আসবে গৌতম, বলবে

    -প্রভু কি তৃষ্ণার্ত ?

    এবার সজ্ঞানে সচেতন ভাবে মাহা বা জননীকে স্মরণ করা থেকে বিরত থাকে শ্রমণ। কিঞ্চিত জলপান করতে পারলেই শান্তি। তার বহিরঙ্গ শীতল হয়েছে, এবার অত্মরাত্মা তৃপ্ত হলেই হয়তো সে ঘুমিয়ে পড়তে পারবে।

    কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। বরং কর্ণপটহ ভেদ করে এক প্রকান্ড বজ্রপাত হয়। এক মূহুর্তের নীল আলো, তারপরেই নিকষ অন্ধকার ! কিন্তু সেই প্রবল বিস্ফোরণ, যা দেব দানবের অকল্পনীয় যুদ্ধ ব্যতীত আর কোথাও উৎপাদিত হওয়া সম্ভব বোধ হয় না, ন্যায়াপুত্তের মনে কী এক প্রত্যাশার সঞ্চার করে। যেন বহুদূরে কোথাও গর্ভিণী মেঘ বিস্ফারিত হয়ে এইমাত্র জন্ম নিল এক অমিত শক্তিপুঞ্জ। হয়তো দূর দেবলোক থেকে তার প্রতি ধেয়ে আসছে কোনো অলৌকিক বার্তা। অসুস্থ ন্যায়াপুত্ত কোটরাগত চক্ষু টান টান করে অন্ধকারে কী দেখার চেষ্টা করে। পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না।

    হঠাৎ ন্যায়াপুত্তের কর্ণে কোথা থেকে এক সুমধুর বংশীধ্বনি প্রবেশ করে। দূর গ্রহান্তর থেকে ঝরে পড়া সেই সুর যেন ক্রমশ নিকটবর্তী হয়, স্পষ্ট হয় সঙ্গে মৃদঙ্গ করতালের আওয়াজ। সহসা স্নিগ্ধ এক মৃদু আলোয় গুহার ভিতর উদ্ভাসিত হয়। আর নাম না জানা কোন বুনো ফুলের আচ্ছন্ন করা সৌরভে প্রাণমন ডুবে যায়। সে শুয়ে আছে যার ওপর সেই বিশাল পাথরের দৈর্ঘ ছাড়িয়ে ধীরে জাগে কার বস্ত্রবিরহিত অতিদীর্ঘ দেহ, বিশাল স্কন্ধ, তীক্ষ্ণ নাসা, আয়ত চক্ষু ! কুঞ্চিত কেশ চুড়ো করে বাঁধা আর সেই উন্নত মস্তককে বেড় দিয়ে আছে সপ্ত ফণাযুক্ত এক মহাসর্প ! অন্ধকারেও যেন তার চতুর্দশটি চক্ষু পরম মায়াভরে শ্রমণকে অবলোকন করতে থাকে।

    আধো নিদ্রায়,আধো জাগরণে ন্যায়াপুত্তের একবার সন্দেহ জাগে সে কি সত্যি জাগ্রত না নিদ্রামগ্ন। তবুও অবশ শরীরের রোমরাজি বর্ষার জল পাওয়া কদম্বপুষ্পের মতো শিহরিত হতে থাকলে আপনা থেকে স্খলিত কন্ঠে সে ডেকে ওঠে,

    -প্রভু!

    যদিও সে দেবমুখ গুহার অতি মৃদু অপার্থিব নীলাভ আলো এবং বিদ্যুতের আলোছায়ায় ভালোমতো দর্শনীয় নয়, তবু ন্যায়াপুত্ত সপ্তফণার লাঞ্ছনচিনহ দেখেই বোঝে তাকে দেখা দিতে সম্মেত শিখরের সমাধি বিদীর্ণ করে আজ ঘোরা নিশীথে উঠে এসেছেন স্বয়ং গুরু পার্শ্বনাথ। হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ আছে তার প্রতি। কী ভাগ্য ! করজোড়ে প্রণাম জানাতে যায়,কিন্তু তার শিথিল বাহু শয্যাতেই এলিয়ে থাকে। কঠোর তপস্যার কারণে তার শরীর অতি দুর্বল হয়েছিল, এই মারী তাকে আরো দুর্বল করেছে।

    শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা। আশ মিটিয়ে তাই তাকিয়েই থাকে ন্যায়াপুত্ত। কখন বিদ্যুতের প্রভায় সে ইষ্টমুখ স্পষ্ট দেখা যাবে !

    সে সৌভাগ্য হবার আগেই তার ওষ্ঠে শীতল জলধারা ঢেলে দেয় কে!
    গুরু স্বয়ং ? জানলেন কী করে তার সমস্ত সত্ত্বা উন্মুখ হয়ে আছে একটি গন্ডুষ জলের জন্য ! এই আলোআঁধারে পরিষ্কার কিছু ঠাহর হয় না, কিন্তু প্রাণ ভরে পান করে ন্যায়াপুত্ত। যেন বহুযুগ ধরে তার কন্ঠে মরুভূমির বালি ভরাট হয়ে ছিল। আজ এই মাহেন্দ্রক্ষণে যেন ওষধির মতো এই জলধারা তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং সজল করে তুলবে।

    জল শেষ হয়ে যায়, তবু বিচ্ছিন্ন ওষ্ঠাধর নিয়ে আচ্ছন্ন অবস্থায় শয্যাগত থাকে ন্যায়াপুত্ত। নীচে নিদ্রিত ইন্দ্রভূতি গৌতম এসবের কিছুই টের পায়না।

    পরদিন অতি প্রত্যুষে ন্যায়াপুত্ত চোখ মেলে গুহার বাইরে চাকভাঙা মধুর মতো সোনালী তরল স্বচ্ছ আলোর রেখা দেখতে পায়। গুহার অন্ধকার দূরীভূত হচ্ছে। সূর্যদেব উদিত হচ্ছেন। পাখির গীতে আস্তে আস্তে বনভূমি পূর্ণ হয়ে উঠছে।

    ন্যায়াপুত্তের শরীরে দুর্বলতা থাকলেও তেমন ক্লান্তি নাই। ভয়ঙ্কর অতিমারি মুখব্যাদান করে তাকে প্রায় গিলে ফেলেছিল এইরকম অনুভূতির অভাবে সে নিজেই বড় আশ্চর্য। কিন্তু আবছা মনে আছে সর্পবেষ্টিত গুরুর অস্পষ্ট মুখমন্ডলের কথা। চোখ দেখতে পায়নি অন্ধকারে, তাই কোন পথে তাঁর করুণাধারা ন্যায়াপুত্তের মস্তকে ঝরে পড়ছিলো সে নিজেও ঠিক জানে না। শুধু অনুভব করছিল এক পরম শান্তি। সমস্ত জরার পরপারে, দ্বেষ হিংসা অশান্তি, আকর্ষণ, তথাকথিত ভালবাসার ঊর্ধ্বে উপনীত হলে বোধহয় জিনজ্ঞানীর মনোভাব এইরকমই হয়। না, পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে নেয় ন্যায়াপুত্ত। এর থেকে শতগুণ, হাজারগুণ প্রগাঢ় হয়। সে মনোভাবের ধারেকাছে পৌঁছতে পেরেই সে এতো বিহবল!

    --গৌতম!

    প্রিয় সাথীকে মৃদুস্বরে আহবান করে ন্যায়াপুত্ত। সমস্ত রাত্রির অলৌকিক গভীর ঘুমের পর ইন্দ্রভূতির সজাগ কর্ণে সেই ডাক একবারেই পৌঁছে যায়। সে কুশশয্যার ওপর ধড়মড়িয়ে উঠে বসে।

    -- ন্যায়াপুত্ত, তুমি উঠে বসতে পেরেছ ! আমাকে ডাকোনি কেন ? তুমি, তুমি ঠিক আছো তো ?

    সখার ব্যাকুলতা প্রশমনে ডানহাত উত্তোলন করে ন্যায়াপুত্ত। আজ কিন্তু সেই পাথরের মতো ভার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে অন্তর্হিত হয়েছে। মনে পড়ে যায় যতক্ষণ তার জিহবায় জলধারা ঝরে পড়ছিল ততক্ষণ নির্ণিমেষে তাকিয়ে থাকা বাসুকির চোদ্দজোড়া অগ্নিখন্ডবৎ চক্ষু। কী আশ্চর্য, তাদের মধ্যে একটুও হিংসা ছিল না। অসূয়া ছিল না। মরকত মণির মতো দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, আর ন্যায়াপুত্তের শরীরে রোগের কামড় শিথিল হয়ে আসছিলো।

    --আমাকে বেরোতে হবে গৌতম।

    -বেরোতে হবে !

    গৌতম জলপাত্রটি হাতে তুলে নিয়েছিল প্রস্রবণে পুনরায় ভরে নিয়ে আসবে বলে। উত্তেজনায় ঠক করে সেটিকে আবার পাথরের ওপরেই রেখে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,

    -প্রভু পার্শ্বনাথের দোহাই, তুমি এমন পাগলের মতো কথা বলো না, মহা। কাল রাত অব্দি তোমার ধুম জ্বর ছিল। দ্যাখো দ্যাখো বিস্ফোটকের রসে তোমার অতি তপ্তকাঞ্চন গাত্রবর্ণের কী অবস্থা হয়েছে !

    বারণ করা সত্বেও উত্তেজনায় তাকে পূর্বাশ্রমের নামে ডেকে ফেলে ইন্দ্রভূতি গৌতম জিভ কাটে। ন্যায়াপুত্ত যেন তা খেয়ালই করেনি এইভাবে বলে,

    -ঝরণায় একটিমাত্র অবগাহন। তাহলেই এইসবের থেকে মুক্তি পাব আমি। তারপর থাকবে শুধু পথ আর ন্যায়াপুত্ত। তুমি এইখানেই অবস্থান কর গৌতম। আমার ডাক এসেছে।

    -মহা মহা, এমন কথা বলো না সখা।

    সব ভুলে ইন্দ্রভূতি হাহাকার করে ওঠে। যে রাতে মাতা ত্রিশলাকে ঘুমন্ত রেখে চিরকুমার মহা গৃহত্যাগ করে, সেই ক্ষণ থেকে নিশ্চুপে তাকে অনুসরণ করে সম্মেতশিখরের পাদদেশ অব্দি এসেছে সে। ছায়ার মতো লেপ্টে থেকেছে বাল্যসখার গায়ে। তার প্রতিজ্ঞা আর ইচ্ছার জোর দেখে ন্যায়াপুত্ত আর জোর করেনি। অপ্রকাশ্য অনিচ্ছায় মেনে নিয়েছে তাকে আগলে রাখবার এই দুর্মর ইচ্ছা। বন্যজন্তু, দস্যু, ব্যাধি, মারি, সর্বত্র ন্যায়াপুত্তের পাশে ইন্দ্রভূতি গৌতম। আজ অসুস্থ সন্ন্যাসী তার শেষ পিছুটানকে নির্মম ভাবে কর্তন করতে চাইছে !

    -আমি আর অসুস্থ নই গৌতম। এই সাময়িক বিচ্ছেদ আমাদের দুজনেরই ভাল করবে। যদি অচেনা প্রান্তরে, বিজন অরণ্যে, দস্যু তস্কর অথবা বন্য জন্তু দ্বারা হত না হই, এই সম্মেতশিখরেই আবার ফিরে আসব জিনলাভের পর। কথা দিচ্ছি, তুমিই হবে আমার প্রথম শিষ্য।

    -শিষ্য কর বা নাইই কর, আমার কিছু যায় আসে না, ন্যায়াপুত্ত। মারের মতো প্রলোভন আমাকে তুমি দেখিও না। সে সাধনায় আমার তোমার আগেই সিদ্ধিলাভ হয়েছে। তুমি যেখানেই যাবে, আমি তোমার ছায়ানুগামী হব। এই আমার শেষ কথা।

    জলপাত্র হাতে নিয়ে সবেগে ইন্দ্রভূতি গুহার বাইরে চলে যায়। ধীরে ধীরে চট্টান থেকে নেমে ন্যায়াপুত্ত তার অনুগামী হয়। দুজনের অভিমুখ এক - পাহাড়ের গা ফুঁড়ে বেরনো প্রস্রবণ।

    কিছুক্ষণ পরে সূর্যের আলোয় প্রস্রবণের জলকে যখন মনে হচ্ছে উচ্ছল গলিত স্বর্ণের ধারা, তখন ধীরে তার ভিতর থেকে উত্থিত হল এক অতি দীর্ঘ স্বর্ণকান্তি যুবাপুরুষ। এতো দীর্ঘকায় তিনি, পাখিরা ভুল করে তার মস্তকে উপবিষ্ট হচ্ছে, আবার পরক্ষণেই উড়ে পালাচ্ছে। বৃক্ষশাখায় বসে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে এই বিশালাকায় অনিন্দ্যকান্তিকে।

    নিগগন্থ ন্যায়াপুত্তের দেহ থেকে পতিত জলধারায় পাথর সিক্ত হচ্ছে। তার দৃষ্টি সম্মুখে নিবদ্ধ। প্রস্রবণের তীরে খানিক গিয়ে ঘন অরণ্য। ব্যাধের কপালের ওপর পালকসজ্জিত বস্ত্রখন্ডের মতো সে অরণ্য ভেদ করে চলে যাওয়া একফালি পথই তার গন্তব্য।

    গতরাত্রে সে আধো জাগরণে প্রভু পার্শ্বনাথের কন্ঠস্বর প্রত্যক্ষ শোনেনি। শুধু ছায়ার মতো তাকে ওষ্ঠে জল ঢেলে দিতে দেখেছে। অথচ কী অলৌকিক উপায়ে তার চেতনায় চারিয়ে গেছে গুরুর প্রত্যেকটি আদেশ, যেমন কর্দমাক্ত গ্রাম্যপথে গেঁথে যায় প্রস্তরখন্ড!

    তাকে এখন যেতে হবে নদী কংসাবতীর উৎসে। তার ধারা অনুসরণ করে অর্ধেক রাঢ়ভূমিতে হবে তার পদচারণা। বাকী অর্ধেক লোকের মুখে শুনে। জানা গেছে সেখানে মানুষ হিংসার বশ, কিন্তু অতিমারীর আক্রমণে আকুল। পতঙ্গের মতো মরছে রাঢ়বাসী। প্রভুর কৃপায় এই দুইয়েরই শোধন তার আয়ত্বে। তাই ঐ স্থানে তার উপস্থিতি অতি প্রয়োজনীয়।

    দ্রুত পা চালায় ন্যায়াপুত্ত। দুর্গমকে জয়, অভিলাষের ওপর নিয়ন্ত্রণ, মানবের কল্যাণ, তাকে ভবিষ্যতে জিন- জয়ের নিকটবর্তী করবে গুরু পার্শ্বনাথের কথায় এইরকমই সংকেত গুপ্ত ছিল।

    কিন্তু এসব তো সে গৌতমকে খুলে বলতে পারে না। সর্বসুখে বীতস্পৃহ সন্ন্যা্সী বাল্যবন্ধুকে সরোষে বলতে পারে না, তোমাকে আমি চাই না। পার্থিব সুখের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নাই।

    বাল্যবন্ধুর কথা মনে আসতেই ন্যায়াপুত্ত জোরে পা চালায়। দৃষ্টি সম্মুখে নিবদ্ধ, তাই দেখে না আর এক জলে ভেজা শরীর নিশব্দে অতিকায় মৎস্যের মতো তাকে অনুসরণ করে সাঁতার কাটছে সমতলে নেমে আসা উচ্ছল প্রস্রবণের গহন ধারায়। যেখানে এই ধারা বেঁকে যাবে, সেখানে সে আত্মগোপন করবে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। তারপর বৃক্ষের পশ্চাতে।

    বন্ধুপ্রাণ ইন্দ্রভূতি গৌতম। ন্যায়াপুত্তের ছায়াসঙ্গী।



    ~~~~

    অতিমারী ও অমৃত
    (তৃতীয় অধ্যায়)


    আজ প্রায় বৎসরান্ত হতে চলল, ন্যায়াপুত্ত কংসাবতী নদীর অববাহিকায় ভ্রমণরত। একটিই মূল কর্মে ব্যস্ত ছিল সে। অতিমারির চিকিৎসান্তে প্রভু পার্শ্বনাথের শিক্ষাপ্রচার। অনেক মৃত্যু দেখেছে দুইজনে, কিন্তু মানুষের শোকসন্তপ্ত চিত্তে সম্মেতশিখর থেকে বয়ে আনা বাণী কিভাবে শীতল প্রলেপের কাজ করে তাও তাদের দেখা। মানুষ হাহাকার করতে করতেও চোখের জল মুছে "উবসগগা" বা কষ্টকে জয় করায় ব্রতী হয়েছে। জিন লাভের চেষ্টায় ব্রতী হয়েছে। সম্প্রতি ন্যায়াপুত্তের কর্ণগোচর হয়েছে আর এক গৃহত্যাগী রাজনন্দনের ধর্মপ্রচারের কথা। এই ভূখন্ডে এখনো তিনি অচেনাই। তাঁর সঙ্গে জিনজয়ীর প্রধান পার্থক্য মুক্তির সংজ্ঞায়। ভগবান বুদ্ধ নির্বাণলাভ বা চিরমুক্তির কথা বলেন,তার পরে আর কোনো জন্ম নাই, কিন্তু ন্যায়াপুত্তের নিকট, মুক্তি বার বার, জন্মের পর জন্ম নিরবিচ্ছিন্নভাবে অর্জন করবার বস্তু। কামনা বাসনা তো বটেই, পার্থিব সমস্তকিছু, এমনকি বস্ত্রখণ্ডও পরিত্যাগের মধ্য দিয়ে এই কঠিন কঠোর পথচলার সূচনা।

    এই দেশে বৃক্ষপূজন ছাড়া আর কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্ম না থাকায় লোকে নতুন বাণী, নতুন রীতিতে সহজেই আকৃষ্ট হয়েছে। মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখে তাদের মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা আরো গভীর হয়েছে। বলতে গেলে সেইদিক থেকে অতিমারি ন্যায়াপুত্তের সহায়ক হয়েছে। পুরো লাঢ় দেশে ধর্ম প্রচারের পর ন্যায়াপুত্ত যাবে পৌন্ড্র দেশে, সেখান থেকে কলিঙ্গ। নিজের হৃদয়ের গহনে সে টের পাচ্ছিল সময় শেষ হয়ে আসছে। নতুন মানুষ, নতুন ভূখন্ড তাকে ডাকছে। প্রভু পার্শ্বনাথের ইচ্ছাই ফলবতী হোক, জিনজয়ী হবার পূর্ব মূহুর্ত অব্দি মানবচরিত্রকেই
    ধর্মগ্রন্থের মতো উলটেপালটে দেখতে থাকুক সে।

    আজ তারা দুইজন যেইখানে অধিষ্ঠান করছে, নদীবক্ষ সেখানে অজস্র নুড়িপাথর এবং বৃহৎ প্রস্তরখন্ডে আচ্ছাদিত। তাদের ফাঁকে ফাঁকে ছুটন্ত জলধারা ফেনায় ফেনায় ফেনিল। কোথাও কাশপুষ্পের ঝাড়, কোথাও অন্য জলজ উদ্ভিদ। স্থানটি মনোরম, ন্যায়াপুত্ত দীর্ঘ পথশ্রমে ক্লান্ত পা দুটিকে ঝুলিয়ে এমন ভাবে একটি প্রস্তর খন্ডে উপবেশন করল যাতে তার গোড়ালির উপরেও কিছু অংশ জলে ডুবে থাকে। বারিধারার স্পর্শে তার খুব আরাম হচ্ছিল,নয়ন যুগল মুদ্রিত করে অনেক কথাই সে ভাবছিল।

    বাল্যসখা গৌতমকে মাঝপথে হঠাৎ আবিষ্কার করে তার রাগ দ্বেষ কিছুই অনুভূত হয়নি,সবটাই ললাটলিখন বলে নির্বিকার চিত্তে পথ চলা শুধু। ভর্ৎসিত না হয়ে গৌতমও আলহাদে আটখানা হয়,কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে না। তার সতর্ক দৃষ্টি শুধু পথিপার্শ্বস্থ অরণ্যভূমির দিকে। অনেক পথ হাঁটার পর যদিও বা কোনো গ্রাম মেলে সেখানে সন্ন্যাসীদ্বয়ের বসনবিমুক্ত দেহ, অশ্রুত ভাষা, বিচিত্র উপাসনাপদ্ধতি ,শুধু কৌতূহল নয়,বিদ্বেষও জাগিয়ে তুলেছে কখনো কখনো। এখন গৌতমের দৃঢ় বিশ্বাস সে সঙ্গে না থাকলে ন্যায়াপুত্তের কোনো বড় ধরনের বিপদও হতে পারত। মানুষ মাঝে মাঝে বিরূপ হলেও,প্রকৃতি তেমন কোন বিরূপতা দেখায়নি, বড় ধরনের কোন বন্য জন্তুও আক্রমণ করেনি তাদের। গৌতমের বিশ্বাস তার নিজের উপস্থিতি ছাড়াও পূর্বতন ত্রয়োবিংশ তীর্থংকরেরা ন্যায়াপুত্তের খেয়াল রাখছেন। তাই বড় কোনো বিপদ ঘটেনি।

    আজ যখন তারা পদব্রজে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেবার আসুরিক পরিশ্রমের পর কংসাবতীর উৎসে দন্ডায়মান,সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসছিল চরাচরে।

    -পাহাড়ি অঞ্চল শ্বাপদসংকুল,কিছু কাঠকুটো কুড়িয়ে অগ্নিসংযোগ করলে তারা অন্তত এ পথ মাড়াবে না।

    গৌতম যেন ন্যায়াপুত্তের গম্ভীর কন্ঠ নিঃসৃত কথা ক'টির অপেক্ষায় ছিল। সে লাফ দিয়ে উঠল,

    -তুমি পথশ্রমে ক্লান্ত । এই পাথরের উপর উপবিষ্ট রও। আমি চারপাশ থেকে কাঠ কুড়িয়ে নিয়ে আসছি।

    তার হাতের লাঠিখানি নিয়ে সে সদা প্রস্তুত।

    নদীর স্রোতে জানু ডুবিয়ে কিছুদূর যাবার পর বিশাল বিশাল বৃক্ষের আড়ালে গৌতমের শরীর অন্তর্হিত হয়। সেইদিকে তাকিয়ে উদগত একটি দীর্ঘশ্বাস নিজের ভেতরেই ধারণ করে ন্যায়াপুত্ত। পৃথিবীতে কিছু ঘটনা,কিছু কার্যক্রম, কিছু সম্পর্ক কার্যকারণরহিত। অব্যাখ্যাত। রোগতপ্ত শরীরে মহাগুরুর আবির্ভাব যেমন। তারই অশ্রুত আদেশে অনির্দেশ্য বেরিয়ে পড়াও তেমন। এই পরিক্রমা শেষে জিনজয়ী হবে সে, তার জীবন ও সাধনার অভীষ্ট প্রাপ্তি হবে। হয়ত সেই অভীষ্ট মানবচরিত্রে গভীর জ্ঞান, যা মানবমুক্তির প্রথম পাঠ। অথবা তা হয়ত এই জল জঙ্গল পাহাড় প্রকৃতির ওতোপ্রোতো আত্মীকরণ, যা মানুষকে স্বমহিমায় উন্নীত করে। পথ যাই হোক, গন্তব্য এক -প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে মানুষকে বোঝা, মানুষকে জানা।

    আর এই ইন্দ্রভূতি গৌতম। সেও এক মানুষ। অতি অল্প বয়স থেকে কী স্নেহের ডোরে সে যে বেঁধেছে ন্যায়াপুত্তকে ! যেন প্রাণখানিও সখার জন্য অবহেলায় দান করতে পারে। মাটির সিংহাসনে বসে ন্যায়াপুত্ত যখন কোন্দলরত বাল্যসাথীদের মধ্যে বিবাদের কারণ অনুধাবন করে খেলাচ্ছলে ন্যায়বিধান দিত,সেই তখন থেকে গৌতম তার আজ্ঞাবাহী ছায়ানুচর। তাকে সে প্রভু পার্শ্বনাথের প্রেরিত বলেই ধরে নিয়েছে, সত্যিই এত পথ পার হয়ে লাঢ়দেশ বা বজ্রভূমিতে এত অনায়াসে পৌঁছবার পেছনে গৌতমের অবদান অনেকখানি।

    ভয়ডরহীন বাল্যসখার অপেক্ষায় মগ্ন ন্যায়াপুত্তের চোখের সামনেই বড় ছোট প্রস্তরখন্ডে পরিপূর্ণ কংসাবতীর স্রোতের ভেতর থেকে পূর্ণিমার গোল চাঁদ উঠে এল। সেই অপার্থিব জ্যোৎস্নায় সে দেখলো এই উচ্চ অবস্থান থেকে অববাহিকার অনেকটাই তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। অন্তত একটি মনুষ্যাবাস আছেই নদী যেখানে বাঁক নিয়ে উত্তরাভিমুখী হয়েছে সেইখানে। কারণ মৃৎ প্রদীপে আলো জ্বাললে যেমন হয়,তেমনি অনেকগুলি কম্পিত শিখা যেন বাতাসে নৃত্যরত। অর্থাৎ এখানে এই উচ্চভূমিতে আগুন জ্বাললে তা ঐ গ্রামবাসীর দৃষ্টিগোচর হবেই।

    এই চিন্তার মাঝখানেই ন্যায়াপুত্তের পায়ে বেড় দিয়ে উঠে এলো কোনো জলজ উদ্ভিদ অথবা প্রাণী। দু একবার পা ঝাঁকিয়েও সরাতে পারা গেল না সেই শীতল স্পর্শ। এবার নুয়ে দেখার চেষ্টা। জ্যোৎস্নার আলো আঁধার সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিলে নিজের বৃক্ষশাখার মতো বলশালী পদদ্বয়কে জোরে ঝাঁকাল ন্যায়াপুত্ত। প্রবল শক্তিশালী সেই আলোড়নে জল ছিটকে উঠে তার বুক ভিজিয়ে দিল আর উর্ধে উঠে এল এক বিশাল জলসর্পের প্রলম্বিত দেহ। ন্যায়াপুত্তের হাতের বেড়ের সমান মোটা সেই সাপের চক্ষু দুখানি চাঁদের আলোয় চকচক করছিল। ক্রমশ সরু হয়ে গেছে লেজের দিক, যদিও তার বেশির ভাগই এখনো জলে ডোবা।

    ন্যায়াপুত্তের মনে বিরাগ ঘৃণা ভয় কোন অনুভূতিই জাগলো না। বরং কোনভাবে যাতে মহাসর্পের আঘাত না লাগে সেদিকে তার সদাসতর্ক দৃষ্টি। ঔষধ সেবন করাবার সময় শিশুকে যেমন লোকে আদর করে ধরে সেইরকম কোমল অথচ দৃঢ় ভঙ্গিমায় সে একহাতে সাপের কন্ঠ মুষ্টিবদ্ধ করল, আর এক হাতে পা থেকে মাংসল বেড় খুলতে লাগল একটি একটি করে। শেষ প্যাঁচটি খোলা হলে ন্যায়াপুত্তের শ্বাস অল্প দ্রুত হল, ভালই কায়িক পরিশ্রমের কাজ জুটে গেল আজ। এখন প্রস্তরখন্ডটির ওপর দাঁড়িয়ে সে মুষ্টি তুলে ধরল আকাশে,যেন মহাসর্পের দৈর্ঘ মাপার ইচ্ছা। সর্প মহা-ই বটে, কারণ প্রায় বৃক্ষের উচ্চতাবিশিষ্ট ন্যায়াপুত্ত পাথরের ওপর দন্ডায়মান,তবু তার লেজের ডগাটুকু জল ছুঁয়ে আছে, যদিও আর ন্যায়াপুত্তের আর এক হাতে সর্পদেহের মধ্যভাগ ধরা আছে।

    দূর থেকে আসা গৌতমের চোখে জ্যোৎস্নালোকিত আকাশের প্রেক্ষাপটে বিরাট সাপকে মুষ্টিতে নদীর সমান্তরাল ক'রে ধরে থাকা ন্যায়াপুত্তকে মনে হচ্ছিল যেন স্বয়ং আদিগুরু ঋষভদেব। পায়ের নীচে প্রস্তরখন্ডটিই যেন তাঁর বাহন অতিকায় ষাঁড়। কিন্তু এই অলৌকিক দৃশ্যে বিমোহিত হয়ে থাকবার মতো সময় যেন গৌতমের হাতে ছিল না, সে জল ছপছপ করে প্রাণপণে ছুটে আসছিল প্রাণপ্রিয়ের অনিষ্ট ঘটবে এই আশংকায়। সে কাছে পৌঁছবার আগেই হাতের ইশারায় ন্যায়াপুত্ত তাকে নিরস্ত করল, তারপর সাপটিকে প্রস্তরাসনের পাশে নামিয়ে রাখল।

    বেশিরভাগ জলসর্পই বিষহীন হলেও কারো কারো এমন বিষ থাকে যে এক লহমায় তা মানুষ কেন হাতিরও মৃত্যু ঘটাতে পারে। কিন্তু এটি মহাকায় হলেও সেই যে পাথরের ওপর কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে তো আছেই। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডকেও অগ্রাহ্য করছে সেটি। ইন্দ্রভূতির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ন্যায়াপুত্ত সাপটির পিঠের একটি ক্ষতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
    হয় স্বজাতির সঙ্গে যুদ্ধে আহত, নয় গ্রামবাসীরা মৎস্যশিকারের সময় কোচা দিয়ে আঘাত করেছে। কেমন গৃহপালিত জীবের মতো আমার শরণ নিয়েছে ! যাই, এর নিরাময়ের ব্যবস্থা করি গে।

    একখণ্ড জ্বলন্ত কাঠ তুলে নিয়ে বন্য লতাপাতার ঝোপঝাড়ে কী যেন খুঁজে বেড়ায় ন্যায়াপুত্ত। তারপর পরম যত্নে কিছু পাতা নদীজলে ধৌত করে ছোট একটি পাথরের সাহায্যে সেগুলিকে থেঁতলে সাপের ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়। গুরুভার সর্পশরীর একটু নড়ে উঠেই আবার স্থির হয়। কিন্তু তার কাচস্বচ্ছ চক্ষু দিয়ে সে সর্বদা ন্যায়াপুত্তকে অনুসরণ করতে থাকে।

    শুশ্রূষা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় গৌতম অথবা ন্যায়াপুত্ত কেউই খেয়াল করেনি অগ্নিকুণ্ড ঘিরে নিঃশব্দে ঘন হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু মানুষের ছায়া। ন্যায়াপুত্তের অনুমান ঠিক। পার্বত্য নদীর অববাহিকার উপরি ভাগে আগুনের সংকেত নীচের গ্রামের মানুষজনের মনে কৌতূহল জাগিয়েছে। তারা দেখতে এসেছে কী হচ্ছে এখানে।

    তারা গ্রামবাসী, নগ্নপদ,উর্ধাঙ্গ অনাবৃত, কিন্তু কোমরে প্রত্যেকেরই লতাপাতার আচ্ছাদন। সাবধানতা হেতু প্রত্যেকেই লাঠি ও ভল্লে সশস্ত্র। দুই সন্ন্যাসীর চেহারা ও হাবভাবে এমন কিছু ছিল, যা প্রথমেই তাদের আক্রমণ করতে বাধা দিয়েছিল। চুপিসারে এসে তারা দেখছিল এদের কীর্তিকলাপ। বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল প্রবল পরাক্রান্ত জলসর্পটির এমতো ব্যবহারে। কারণ প্রায়ই সে এদের মাছ ধরার যাবতীয় বন্দোবস্ত তছনছ করে দিয়ে মাছগুলিকে খেয়ে ফেলত। মানুষের সঙ্গে তার এই বৈরিতায় গ্রামবাসীরা কোনো ভাবেই এঁটে উঠতে পারেনি, এমনি মহাবলী সাপটি! কোচের আঘাতে তাকে আহত করলেও তার উপদ্রব বিন্দুমাত্র কমেনি। আজ সেইই এমন নিরীহ অবস্থায় প্রস্তরখন্ডের ওপর পড়ে আছে, এ দেখেগ্রামবাসীদের চোখ কদম্ব পুষ্পের মতো বর্তুলাকার হয়ে উঠল !

    আক্রমণ না করবার পিছনে আর একটি কারণও আছে। ভয়ংকর অতিমারীর কবলে ছারখার হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি জনপদ। তার মধ্যেই ভেসে বেড়াচ্ছে দূর দেশ থেকে আগত এক মহাকায় নগ্ন সন্ন্যাসীর কথা। তার সঙ্গে একটি শিষ্যমতোও কেউ নাকি আছে। এই সন্ন্যাসী নাকি মারিজয়ী। তার করস্পর্শে মৃতও পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। এইসব লোককথায় প্রভাবিত হয়ে আক্রমণ করা হয়নি বটে, কিন্তু প্রত্যেকের হাতের লাঠি প্রস্তুত আছে। সেগুলি শক্ত ক'রে ধরায় পেশি ফুলে শিরা দেখা যাচ্ছে, ভল্লের সূচীমুখ দুই অচেনা আগন্তুকের দিকে তাক করা। একটু বেচাল দেখলে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাবে ন্যায়াপুত্ত ও গৌতম।

    এই গ্রামজনতার সমবেত নিঃশ্বাসের শব্দে সচকিত ন্যায়াপুত্ত সাপটিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সেই বিশাল দৈর্ঘসমণ্বিত উপস্থিতি এবং উজ্জ্বল আভামন্ডিত মুখস্থলে কী ছিল কে জানে, সকলে নিমেষে ভল্ল অবনমিত করল। তাদের হাতের পেশি শিথিল হল। সবচেয়ে দুর্বিনীত মানুষটির সঙ্গে ছিল তার পোষ্য এবং অতিবশ একটি কালো কুকুর। সে দুবার মুখে ছুক ছুক শব্দ করলেই কুকুরটি হিংস্রভাবে লক্ষ্যবস্তুর ওপর ঝাঁপিয়ে পরত। হয়ত নিজের বিক্রম ও কুকুরের বীরপনা দেখাবার জন্য সে হঠাত পারিপার্শ্ব ভুলে মুখে ছুক ছুক শব্দ করল। কিন্তু হিংস্র কুকুর নিজ স্বভাব ভুলে গিয়ে কেঁউ কেঁউ করে মালিকের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। তার লাঙুল ঢোকানো পেছনের দুই পায়ের ফাঁকে।

    ন্যায়াপুত্ত নিজে বৈশালির রাজবংশের পুত্র। পূর্ণ যৌবনে রাজগৃহ ত্যাগ ক'রে বেরিয়ে পড়া,তারপর বার বছরের কঠোর তপস্যার শেষে প্রভু পার্শ্বনাথের স্বপ্নাদেশে বজ্রভুমি বা লাঢ়দেশে ধর্মপ্রচারে আসা। বহু মানুষের,বহু রীতিনীতির সংস্পর্শে এসে নানা দেশের ভাষায় তার অসাধারণ বুৎপত্তি অর্জন সমীহের সঙ্গে লক্ষ করে দেখেছে গৌতম। সেই রকম অনায়াস দক্ষতা নিয়েই ন্যায়াপুত্ত এখন জিজ্ঞাসা করল,

    কে তোমরা? কী চাও?

    দলের সর্দার,ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় পালকের শিরস্ত্রাণ পরা মধ্যবয়েসী মানুষটি কুকুর ও সাপের আশ্চর্য ব্যবহারে কিছুটা হতচকিত ছিল। সে দু হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল,
    মহাত্মন, আমরা ঐ গ্রামের অধিবাসী। অতিমারীতে এর মধ্যেই অর্ধেক মানুষকে হারিয়েছি। লোকমুখে শুনেছি এক নগ্ন সন্ন্যাসী দৈব বলে মানুষকে ভালো করে দিচ্ছেন।আপনিই কী সেই সন্ন্যাসী ?

    ন্যায়াপুত্ত কিছুক্ষণ অগ্নিকুন্ডের ওপর তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখল। এ কথার কী জবাব সে দিতে পারে! প্রভু পার্শ্বনাথ তাকে অসুস্থতার মধ্যে স্বপ্নে দেখা দিয়েছিলেন, তাঁর আজ্ঞাতেই আজ এই অজানা বন জঙ্গল ও হিংস্র জাতি পরিপূর্ণ স্থান তাকে পরিক্রমা করতে হচ্ছে দৈব বলতে এইটুকুই। যেখানে সে গেছে, সেখানেই অতিমারির লক্ষণগুলি দেখে বুঝতে পেরেছে এটি অত্যন্ত সংক্রামক একটি রোগ, যা দাবানলের মতোই মূহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে। শারীরিক নৈকট্য এবং অপরিচ্ছন্নতা এর বড় কারণ। কিন্তু একবার আক্রান্ত হয়ে বেঁচে গেলে দ্বিতীয়বার আর কেউ এই রোগের কবলে পড়ে না। বেশিরভাগই নিহত হয়, কিন্তু যারা সুস্থ হয়ে ফেরে তাদের আর কোন আশংকা থাকে না। যেহেতু ন্যায়াপুত্ত নিজে এই রোগের কবলে পড়েছিল, এর যন্ত্রণা সে ভালই জানে। নিশ্চিত ওষুধ না থাকলেও অসীম যত্ন ও সুপাচ্য পথ্যে রোগের বাড়াবাড়ি কমে যায়, এটাও সে লাঢ়দেশের অধিবাসীদের শুশ্রূষা করার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছে। প্রচুর জলপান, আর কিছু বন্য লতাপাতার প্রয়োগে বিস্ফোটকগুলির প্রদাহ কমে এও প্রমাণিত সত্য। কিন্তু তাই বলে ন্যায়াপুত্ত এর সম্পূর্ণ অবসান ঘটাতে পারে, বাস্তব এরকম নয়।

    তাই সে বলে,
    আজ তোমরা গৃহে গমন কর। আগামীকাল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমি তোমাদের গ্রামে যাব।

    এতক্ষণে নদীতট নির্জন হয়ে আসে। শুধু শীতল হাওয়া আর স্রোতের কুলুকুলু শব্দ। নীচের গ্রাম থেকে কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছে। হয়ত সন্ধ্যার কালো কুকুরটিও তার মধ্যে কন্ঠ মিলিয়েছে। আর আছে মাথার ওপর রাতচরা পাখির ডানার ঝাপট। ন্যায়াপুত্ত তবু বিশ্রামহীন। তীরের লাগোয়া ঝোপে বিশেষ ঔষধির খোঁজে তার মাঝরাত অতিবাহিত হয়ে যায়।

    সূর্য তখন মধ্যগগনে। গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণের জন্য উপবিষ্ট গৌতমের কোলের উপরে জড়ো করে রাখা লতাগুল্ম সকলি প্রায় নিঃশেষ। এখনো দূরে বসে রয়েছে এক নারী আর তার সঙ্গে এক কুঞ্চিতকেশ যুবাপুরুষ। গৌতম ইশারায় তাকে ডাকেন। উঠে এসে করজোড়ে সে বলতে থাকে,
    প্রভু, আমার ধর্মপত্নী অতিমারিতে আক্রান্তা। দয়া করে তার চিকিৎসা করুন। আমার প্রাণও বাজি রাখতে রাজি আছি এই আরোগ্য চেষ্টায়।

    সদ্য পাড়া কিছু তাজা ফল-পাকুড় সে সন্ন্যাসীর সামনে নিবেদন করে।
    ন্যায়াপুত্ত বৃক্ষের আড়ালে অবস্থান করছিল বরাবরই। সেখান থেকেই ত্বকের বর্ণ, বিস্ফোটকের অবস্থা, রক্তাভ চক্ষু, হস্তপদের সঞ্চালন পর্যবেক্ষণের সুবিধা হয়। নাহলে এতো নিবেশ সহকারে তাকে কেউ দেখছে জানলে রোগী অনেক সময়ই শংকাতুর হয়ে পড়ে। এই নারী তার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করতেই দুজনেই চমকিত হলেন। কুঞ্চিত কেশে সজ্জিত সংকীর্ণ কপাল, তার নীচে কর্ণাবধি দুই থিরবিজুলি অতিকায় চক্ষু, আলপথের মতো ঘের দিয়ে থাকা কৃষ্ণ ভ্রুযুগল, কিন্তু রক্তিম ওষ্ঠাধর অদৃশ্য করে থকথক করছে অজস্র বিস্ফোটক। কপোল ও কানও রেহাই পায়নি। বোঝা যাচ্ছে নাকের নীচ থেকে সারা শরীরেই তার বিস্ফোটকের প্রাদুর্ভাব। অতিমারি দয়া ক'রে তার মুখমন্ডলের উপরিভাগকে কেন ছাড় দিয়েছে তা বোঝা গেল না। কিন্তু প্রচুর দুর্গন্ধযুক্ত রস নির্গত হচ্ছে তার নাকমুখ দিয়ে। প্রবল জ্বরে মেয়েটি বসে থাকার শক্তিও হারিয়েছে। বার বারই ধুলায় মস্তক লুটিয়ে দিচ্ছে, আবার সন্ন্যাসীর প্রতি সম্ভ্রমে উঠে বসার চেষ্টা করছে। দূর থেকে দেখেই ন্যায়াপুত্ত বুঝল এর মৃত্যু সমাসন্ন। দূরে দেখা যাচ্ছে এদের সঙ্গে আসা দুইটি শিশুপুত্র। হাস্যোজ্জ্বল, ক্রীড়ারত। হয়ত এই হতভাগিনীরই গর্ভজাত। এতো রূপের উপর শকুনের পক্ষবিস্তারের মতো মৃত্যুর ছায়া অনুভূত হচ্ছে। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর বিচলন ঠিক নয় জেনেও ন্যায়াপুত্ত ও গৌতম দুজনেরই হৃদয়ে গুরুভার বোধ হল। যুবকের হস্তে লতাপাতার রস একটি মাটির পাত্রে তুলে দিয়ে ন্যায়াপুত্তের নির্দেশ অনুযায়ী তাকে সন্ধ্যায় দেখা করতে বলল গৌতম।

    মৃত্যু ধ্রুব। তার কাছে মানুষ অনোন্যপায়। তবু শোক তাকে পাগল করে দেয়। চিরসঙ্গিনী যে দুই/ তিন দন্ডের মধ্যেই শেষ নিশ্বাস ফেলবে এ যেন যুবকটির কল্পনারও অতীত ছিল। সন্ধ্যায় সে যখন সন্ন্যাসী সমীপে উপস্থিত হল তখন মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নার ফলে তার কৃষ্ণ কেশ ধূলিধূসরিত। চক্ষুদ্বয় যেন রক্তপুষ্প। দুই হাতে ধরে আছে দুই সুকুমার শিশুকে, নদীজলে তাদের পায়ের পাতা ভেজা।ন্যায়াপুত্তের পার্শ্বে শায়িত মহাসর্পকে দেখে তারা ত্রস্ত আবার কৌতূহলীও।

    বৎস, শোক নিবৃত্ত কর। মাতৃহারা শিশুদের মুখ চেয়ে দৃঢ় হও। আজ থেকে পর পর সাত সন্ধ্যা তুমি যদি এইখানে আসো, আমি তোমাকে এমন অমৃতের সন্ধান দেব, যা তুমি কখনোই হারিয়ে ফেলবে না।

    যেন সে বৃশ্চিক দংশনের জ্বালায় ছটফট করছে এইভাবে শরীরে মোচড় দিতে দিতে যুবকটি নিতান্ত কাঙালের মতো ন্যায়াপুত্তের সম্মুখে জানু পেতে করাঞ্জলি তুলে ধরল,
    তবে দিন প্রভু। এই করপুটে দিন। এই যন্ত্রণা যে আর সহ্য করতে পারছি না।
    পিতার ক্রন্দনধ্বনি শুনে শিশুপুত্রেরাও গলা ছেড়ে এমন কান্না জুড়ল যে মহাসর্প বিস্মিত হয়ে তার মাথা তুলে সবাইকে অবলোকন করতে লাগল। তার খন্ডিত জিহবা বার বারই যেন নদীর সিক্ত বাতাসের আস্বাদ নিতে মুখগহ্বর থেকে বার হয়ে আসছিল।

    এরা চলে যাবার পর ন্যায়াপুত্ত অনেকক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল। এমনিতেই সে স্বভাবগম্ভীর। আজ অগ্নিকুণ্ড খুঁচিয়ে দিতে দিতে সে পূর্বতন ত্রয়োবিংশ তীর্থংকরের নাম উচ্চারণ করছে এমন মনে হল গৌতমের। বাতাসে স্ফুলিঙ্গ লাফিয়ে ওঠার ফাঁকে ফাঁকে কানে এল,
    সর্বনাথ ঋষভদেব,অজিত, শম্ভু, অভয়ানন্দ / সুমতি, পদ্ম,সুপার্শ্বনাথ, মহা আনন্দ, মহা আনন্দ!/ চন্দ্রপ্রভ,পুষ্পদন্ড শীতলনাথ নমি / অংশু,বাসু,বিমল,অনন্ত,পাদপদ্ম চুমি! / ধর্মনাথ, শান্তিনাথ, কুনহুনাথ স্মরি/ অরনাথ,মল্লিনাথ,পাদপদ্মে মরি।/ সুব্রতনাথ,জিমিনাথ,নেমিনাথ গুরু,/গুরুর গুরু পার্শ্বনাথ, উপাসনার শুরু।
    গৌতম জানে এরপর গীত হবে তেইশজন গুরুর লাঞ্জনচিনহ নিয়ে বাঁধা পদাবলী। ঋষভদেবের পায়ের নীচের বলীবর্দ থেকে শুরু ক'রে গুরু পার্শ্বনাথের সপ্ত ফণাযুক্ত অতিকায় ভুজঙ্গ অবধি। তাই সে হাতজোড় করে নীরব থাকে। এই সঙ্গীত শ্রবণ সর্বপাপহর। দিবালোকে চিকিৎসাবিধান দিতে গিয়ে বৃক্ষচ্ছায়ায় উপবিষ্ট হবার সময় দেহের চাপে কীটাণুকীটকে পিষ্ট করার মতো সূক্ষ্ম পাপেরও এতে প্রায়শ্চিত্ত হয়, এই তার বিশ্বাস। তাই ন্যায়াপুত্ত নীরব হলে তবেই সে জিজ্ঞাসা করল,
    যুবকটিকে কী বিধান দেবে সখা?
    আহত সাপটির ক্ষতস্থানে পাতার রস লাগাতে লাগাতে ন্যায়াপুত্ত বললেন,
    শোক প্রশমিত হলে আমি ওকে আর একটি বিবাহ করতে বলব।

    গৌতমের বিস্ফারিত চক্ষু ও ব্যাদিত মুখগহবরের দিকে না তাকিয়েই ন্যায়াপুত্ত হাঁটুজলে নেমে আচমন শুরু করে।



    ~~~~

    যাত্রারম্ভ
    ( চতুর্থ অধ্যায়)


    ইয়ুথ হস্টেলের দোতলার জানালাটি সম্পূর্ণ খোলা বলে পূর্ণ চাঁদের মায়া সত্যই মন ভোলানো। কে যে বাঁশি বাজাচ্ছে কে জানে। শুধু আলোর সঙ্গে সুরের ঢেউ ঘরের ভেতরটায় সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর নয়, কোনো ফিল্মি চটকদার গান নয়। ছোট ছোট শ্বাসাঘাত,ছোট ছোট ধুন, যেন এই মাঠঘাট নদীর ওপর ঘুরে বেড়ানো হাওয়া বাঁশির ভেতর ঢুকে সুরের টুকরো হয়ে বেরিয়ে এসে ঘর প্লাবিত করে দিচ্ছে। রিণির একবার মনে হল প্রকৃতিই আজ নিজের হাতে বাঁশি তুলে নিয়েছে। তান উঠছে -

    তুক তুক তুরু রু
    তুতুর তু আতু
    তুতুর তুআ তুতুর তুআ
    তুতুর তু আতু

    এই সুর আর আলো রিণিকে শান্ত থাকতে দিচ্ছিলো না । একটা উত্তেজনার আঁচ পাচ্ছিল থেকে থেকে। আজই কলকাতা থেকে মা ফোনে জানিয়েছে তন্ময়ের কোভিড হয়েছে। অবস্থা খুব খারাপ, প্লাজমা ট্রিটমেন্টের জন্য ডোনর খোঁজা হচ্ছে। রিণির প্রাক্তন প্রেমিক তন্ময়। সম্পর্কের শেষ সুতোটা কেটে গেল যেদিন, সেদিন এমন একটা গোল চাঁদ ছিল আকাশে। দোলপূর্ণিমার রাত। সারা দুপুর বন্ধুরা মিলে আবীর মাখামাখি হয়েছে। দেরি হয়ে যাবে বলে এইবার রিণি উঠতে চাইছিল বার বার,আর অল্প নেশাতুর তন্ময় তাকে জড়িয়ে ধরে, হাত ধরে টেনে রেখে বাগড়া দিচ্ছিল। অনেক জ্ঞানী জ্ঞানী কথাও বলছিল,কেন বিয়েটা তাদের এখনই করা উচিত নয়, রিণির কী কী অসুবিধে হতে পারে,এইসব ! শেষমেষ মায়ের ডাবল ফোনের পর তন্ময় রিণিকে বলল,
    -ঠিক আছে আমি স্নান সেরে আসছি। রাত হয়েছে,তোকে পৌঁছে দিয়ে আসব।

    রিণি তাই বিছানায় আধশোয়া হয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল,আর বার বার তন্ময়ের মোবাইলে মেসেজ আসবার শব্দে বিরক্ত হচ্ছিল।
    স্নানে ঢুকলে তন্ময় শাহেনশা। অনেক সময়,অনেক সুগন্ধি খরচ হয়। দিয়ে আসবে বলেছে বলে রিণি নিশ্চিন্ত ছিল,কারণ সত্যিই নিউ টাউনে তাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছতে অনেকটা শুনশান। কিন্তু এরপর যেটা হল, সেটা খুবই বিরক্তিকর। একটু থেমে থেমে তন্ময়ের ফোনটা বাজতে লাগল,যেন কেউ খেলাচ্ছলে রিং করছে ,আবার কেটে দিচ্ছে। আর প্রত্যেক বারই স্ক্রিনে ভেসে উঠে লাগল একটা নাম-চন্দ্রাণী। তন্ময়ের ছাত্রী,রিণি চেনে। একবার কল,একবার মেসেজের টুং, প্রায় পাঁচ মিনিট এই খেলাটা চলবার পর গালের নীচ থেকে বাঁ হাত সরিয়ে রিণি সোজা হয়ে বসল। আঙ্গুলের চাপে হোয়াটসএপ খুলল। অনেকগুলো মেসেজ,

    -স্যার কলটা ধরুন্না…
    -এইবার কিন্তু সত্যিই বাড়াবাড়ি করছেন…
    - আরে কী হল আপনার...
    - কাল যে ছবিটা দিতে বলেছিলেন সেটা দেবনা কিন্তু বলে দিলাম…
    -ও ছবি পাঠাতে দেরি হচ্ছে বলে রাগ করেছেন !
    - রাগ করবেন্না স্যার,এই যে পাঠালাম।

    এর পর সেই বহু প্রতীক্ষিত ছবি। বিছানার ওপর আদুল গায়ে বাঁ পায়ের ওপর ডান পা চাপিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে পৃথুলা চন্দ্রাণী। তার স্ফীত স্তনের একটিকে বাঁ হাতের ছড়ানো পাঞ্জায় ঢেকে ভুবন ভোলানো হাসি হাসছে সে। ছবির ক্যাপশন, শুধু তোমারই জন্য।

    মিনিটখানেক চুপ করে বসে ছিল রিণি। তারপর নিজের ব্যাগ নিয়ে কিছু না বলেই বেরিয়ে আসে। আর বলবেই বা কাকে, জল পড়ার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তখন তন্ময়ের ভরাট গলার গান ভেসে আসছিল, মম অখিল ভুবন / তুমি ভরিবে গৌরবে…
    তারপরেরটুকু যেমন হয়, রিণি ভুল বুঝেছে ,ব্যাপার ওরকম নয় আরেকরকম বা অন্যরকম,অনেক কথা। তার মা কে ফোন করে কান্নাকাটি, বন্ধুদের দিয়ে বলানো। এইসব থেকে দূরে থাকবে বলে ইউনিভার্সিটি সাত মাস স্কলারশিপের টাকা না দেওয়া সত্বেও রিণি স্যারের পারমিশন নিয়ে পুরুলিয়ায় চলে এসেছে। মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার করেছে আর স্যারের আর এক প্রাক্তন ছাত্র এখানে পুলিসে ডিএসপি, সেই নীলাঞ্জন সেন এক সিভিক পুলিশকে দিয়েছে তাকে নিয়ে অচেনা জায়গায় ঘোরাঘুরি করবার জন্য। সেইই মানস, মানস মাজি। পুরুলিয়াতে চারদিন কেটে গেলে, ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত রিণি অপমানের জ্বালা কম টের পাচ্ছিল। সবসময় একটা পোড়া পোড়া গন্ধ পেত নাকে, সেটাও কমে আসছিল। তার মধ্যেই এই খবর। একবার তাকে যেতে হবেই হাসপাতালে, রিণি জানে। গিয়ে দাঁড়াতে হবে। যদি তাতে মৃত্যুপথযাত্রী কোনো সান্ত্বনা পায়। সেটুকু থেকে কাউকে বঞ্চিত করার মতো অমানুষ সে এতো কান্ডের পরেও হতে পারল না।

    ঘুম আসছে না, তাই রিণি সুটকেস গোছাতে বসল। কাগজপত্র, জামাকাপড়, কতোগুলো এন্টাসিড আর ক্যালপল। মা জোর করে দিয়ে দিয়েছিল। চার্জারটা পরে ঢোকাবে। আসলে আগে থেকেই ঠিক ছিল আজ সে মানসকে নিয়ে পাকবিড়রা যাবে। সেখানে নাকি ভৈরব নামে পূজিত হচ্ছে কোনো জৈন সন্তের কষ্টিপাথরের মূর্তি। রিণি দেখে ছবি তুলে নিয়ে আসতে চায়। স্যারকে দেখাবে। ভোর ছ'টায় গাড়ি বলা আছে। সারাদিন ঘুরে সে দুপুর আড়াইটেয় স্টেশনে পৌঁছবে। তারপর রূপসী বাংলার জন্য অপেক্ষা। একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে ভালই হত, কিন্তু ঘুম তো তার হুকুম মেনে চলে না। একটু জল খায় রিণি। তারপর বালিশে অনিচ্ছুক মাথা রাখে। অনেকক্ষণ বাদে ঘুমে তলিয়ে যাবার আগেও সে টের পায় বাঁশি বেজেই চলেছে,

    তুরু তুরু তুরু রু
    তুতুর তু আতু-

    শীতের সকাল। গাড়ির সব জানালা বন্ধ রাখলে তবেই উষ্ণ লাগছে ভেতরে। পাশ দিয়ে দ্রুত পেছনে চলে যাচ্ছে টম্যাটো আর বেগুনের খেত। সারা রাত ধরে ঝরে পড়া শিশির আটকে রয়েছে দুই চারাগাছের মাঝখানে বোনা মাকড়সার জালে। রাতের ছটফটানি পার করে রিণি এখন অনেক শান্ত। যা করতে হবে তা সে করবেই, শান্ত নির্লিপ্ত থেকে যেন করতে পারে এই তার চাওয়া। যেন নিজের সঙ্গে প্রচন্ড লড়াই করে যেটুকু মানসিক শান্তি সে অর্জন করেছে তা আবার কিছুতেই তছনছ না হয়। কালো পিচ বাঁধাই রাস্তা সোজা চলেছে, কখনো উঁচু হয়ে উঠেছে আবার কখনো নিচু। ন্যায়াপুত্ত মহাবীরের সময় এই অসমতল ভূখণ্ড সমস্তই গভীর বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। হিংস্র পশুর আস্তানা। এতো কষ্ট ক'রে, এতো বিপদ মাথায় নিয়ে কেন এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া রিণি এখন যেন একটু হলেও বোঝে। সমস্ত জাগতিক দুঃখ আর আত্মিক টালমাটালের মহৌষধ অজানা প্রকৃতি এবং মানুষ। যদি হৃদয়ে অমৃত থাকে বাটোয়ারার পর তা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে, যদি হলাহল থাকে তারও নিরাময় হবে।
    গাড়ির কাচ একটু নামিয়ে রিণি ঠান্ডা হাওয়া মাখে কপালে। এই সাতসকালেই ঘোমটা দেওয়া মেয়েরা প্লাস্টিকের জার, কাচের গ্লাস, শাল পাতায় ছোলা সেদ্ধ নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। লোককে হালকা সাদা তরল ঢেলে দিচ্ছে তারা বার বার, এইরকম দেখতে দেখতে রিণি জিজ্ঞাসা করে,
    খেজুর রস তো মনে হচ্ছে না মানস। এগুলো তবে কী বিক্রি হচ্ছে গো?

    তাড়ি শুনে তার চোখ গোল গোল হয়ে যায়। সকালবেলাতেই তাড়ি ! মানস বেশ দার্শনিকের মতো জানায়, এখানে নেশা করার প্রচলন কিঞ্চিৎ বেশি। তাড়ির কোনো সকাল বিকেল নেই।

    আমাদের তো তাড়ি চলবে না, একটু দাঁড়াতে বল ইয়াকুবকে, আমরা চা খেয়ে নিই।

    যে দোকানের সামনে দাঁড়াল গাড়ি তা নামেই দোকান। মাথায় কালো প্লাস্টিকের ছাউনি,কেটলিতে জল নয় বানানো চা-ই ফুটছে তোলা উনুনে। কাচের ছোট গ্লাসে প্রচুর চিনি দুধ দেওয়া সেই ভারী তরল আর কিছু না হোক শীত তো কমায়। সঙ্গে পার্লে জি। চা খাবার পর মানস তাকে দাম দিতে দেয় না।

    না না, আজ আমি দিই। ভেবেছিলাম আপনাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব, গরীবের বাড়ি যদিও। কিন্তু আপনি তো আজই চলে যাচ্ছেন। বলেছিলেন বেস্পতিবার যাবেন। হঠাত আজই কেন!

    রিণি এই প্রশ্নের উত্তর দেবার থেকে চায়ের দাম দিতে দেওয়াই বেশি পছন্দ করত হয়ত। উত্তর মানস চায়ওনি, সে পরমূহুর্তেই দোকানীকে ভৈরববাবার থানের রাস্তা জিজ্ঞাসা করতে ব্যস্ত। যা বোঝা গেল, তারা এসেই পড়েছে। এক/দেড় কিলোমিটারের মধ্যেই ডানদিকে ঢুকে যাওয়া এক রাস্তা দেখা দেবে। দুপাশে তার নাকি অতিকায় দুই বাঁশ ঝাড়। সেখানে ঢুকলে আর একটু। একেবারে থানের কালো গেটের সামনেই গাড়ি দাঁড়াবে।

    হঠাত রিণি খেয়াল করল মানস ইয়াকুব দুজনেই হাওয়া হয়ে গেছে। ওরা তার সামনে বিড়ি খায় না কেন কে জানে। দোকানের পাশেই একটি পাতকুয়ো থেকে জল তুলছিল তারই বয়সী একটি মেয়ে। মেয়ে মানে বৌ। জলভরা বালতি তোলার দমকে তার হাতের শাঁখা পলা হড়কে পেছনে আসছিল, আবার দড়ি নিচু করলেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। দোকানের পেছনেই শুরু হয়েছে ফুলকপির খেত। তার আলে বসে একটা বাচ্চা, গায়ে একটা সোয়েটার আছে কিন্তু ন্যাংটো, মাঝে মাঝেই হাত বাড়িয়ে একটা ছাগলের বাচ্চাকে ধরবার চেষ্টা করছে। কী মনে হতে রিণি এগিয়ে যায় বৌটির কাছে।
    কুথায় যাছেন গ্য ?

    ঐ যে, জৈন মূর্তি
    দেখতে। পাকবিড়রাতে।

    অ, ভৈরব বাবাকে দরশন কইরবেন? বড়ই জ্যান্ত ভগমান গো। যা চাওয়া তাই পাওয়া।

    সত্যি ?

    তবে কি মিছা বলছি গ্য। হুইয্যে হামার ছানাটা দেইখছেন,হামার গেন্দা বঠে। বিহার দশ বচ্ছর পর ওনার থানে মানত কইরে তবেই পাঁয়্যেছি
    বাবা ভৈরবের দয়া। যান উনার থানে যান,টুকু দরশন করেন কেনে।
    বাবা ভৈরব তার মাথার উপর কিছু দিলে সহে নাই। যতবারই ছাউনি দিল, ঝড়জলে ততবারই ভাইঙে দিল। বাবা উটা নাই মাইনতে পারে।বারোটা মাস তাই উদম আকাশের নীচেই রহেন।

    মানসরা ফিরে এসেছিল। গাড়িও পৌঁছে গেল জালি দেওয়া কালো গেটের সামনে। গেটের গায়ে বোর্ডে লেখা ভৈরব বাবার থান। পাকবিড়রা পঞ্চায়েত। জুতা খুলিয়া প্রবেশ করুন।
    কিন্তু জুতো পাহারা দেবার কেউ নেই এখানে। জনশূন্য। দু একটা কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। রিণির ব্যাগ শুঁকে দু একবার ভুক ভুক করল বটে, কিন্তু মানস আর ইয়াকুবের দিকে তাকিয়ে চোখ করুণ আর ঘাড় লম্বা করে দাঁড়িয়ে রইল।

    ইয়াকুব ভেতরে ঢুকতে চাইল না। হয়ত কোথাও কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। কিম্বা অন্য ধর্মের মন্দিরে ও জ্ঞানত প্রবেশ করে না। মানসও ভদ্রতা করে ইয়াকুবের সঙ্গেই থেকে গেল। ডিএসপি সাহেবের ড্রাইভার বলে কথা। রিণিকে বলল,
    আপনি যান দিদি। আমি একটু বাদে যাচ্ছি।

    গেট খুলে রিণি ভেতরে ঢোকে। তার বাঁ দিকে পর পর দুটো মন্দির, মুখোমুখি একটা। তেলকুপির মতো বিশাল নয় মন্দিরগুলো, আবার একেবারে ছোটও নয়। তফাত দেখলো মেটেরিয়ালে। তেলকুপি মন্দির পাথরের স্ল্যাব পেতে পেতে উঁচু করা। শুধু মাপজোখের ওপর দাঁড়িয়ে। এইগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে পাতলা একধরনের ইঁট, গাঁথনির জন্য সুরকি। মন্দিরগুলোর ভেতরে জায়গা খুব কম। কালো পাথরের ছোট ছোট দেবমূর্তি আছে, তবে জমাট অন্ধকারে তারা পরিচয়হীন। রিণির মুখোমুখি মন্দিরটায় মোবাইলের আলোতে দেখা গেল যেন এক দেবী মূর্তি। হয়ত দেবী অম্বিকা।প্রচুর সিঁদুর লেপা। পোড়া ধূপকাঠির ছাই জমে আছে।
    কিন্তু যার নামে থান, সেই ভৈরববাবা কোথায় গেলেন! রিণি এদিক ওদিক তাকায়।

    মন্দিরগুলো ইংরেজি এল শেপে অবস্থান করছে। মাঝখানে খোলা জায়গায় বিরাট এক মহীরুহ। নীচটা গোল করে বাঁধানো। সেখানে রোদ পোহাচ্ছে কিছু বাচ্চা। আর কিছু বাচ্চা খোলা জায়গাটায় তেড়ে ফুটবল খেলছে। রাজ্য জুড়েই তো স্কুল কলেজ পাঁচমাসের বেশি বন্ধ। এরা যে সকাল থেকেই খেলবে তাতে আশ্চর্য কী! এখানে অনলাইন পড়াশুনোর কথা কেউ ভাবতেও পারবে না। পিছিয়ে যাবে, ওরা অনেক পিছিয়ে যাবে,রিণির মন বলে। তারপর বেশিরভাগেরই ভাগ্যে নাচবে স্কুলছুট হয়ে যাওয়া।
    রিণি জলের বোতল হাতে নিয়ে বাঁধানো বেদীতে বসে ছিপি খুলেছে আর ওমনি বাচ্চাদের চিৎকার,গোওওওল। আচমকা মুখ তুলে চাইল সে,আর কয়েক ফুট দূরে কী দেখে যেন জল খেতেও ভুলে গেল। আসলে ঢুকেই সে বাঁদিকের মন্দিরগুলি ধরে এগিয়ে এসেছে,এল শেপের কারণে ডাইনে ঘুরে দেবী অম্বিকার প্রস্তরপটে আলো ফেলে দেখেছে, কিন্তু পেছনে ফিরে চায়নি একবারও। এখন গাছের নীচে বসে মুখ উঁচু করা মাত্র তার নজরে এলো সামনে বাঁধানো বেদীর ওপর কালো কষ্টি পাথরের এক বিশাল মূর্তি, কম করেও ন' ফুট। আজানুলম্বিতবাহু, নিমীলিত চক্ষু,মাথার ওপর ঘুর্ণিত কেশ চুড়ো করে বাঁধা। সম্পূর্ণ বস্ত্রবিরহিত এক সন্ত। তাঁর মাথার ওপর সত্যি খোলা আকাশ, কোনো ছাউনি নেই।

    এক মূহুর্ত দেখেই রিণির মনে হল ইনি তার ভীষণ চেনা। ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়াতেই স্মৃতিতে ফিরে এল দামোদরের উপধারা বেষ্টিত দ্বীপের সেই আশ্চর্য সন্ধ্যা। প্রাচীরগাত্রে খোদিত সেই দেবমূর্তি যার সঙ্গে রিণির দেখা হয়েছিল প্রাকৃতিক পঞ্চপ্রদীপের অপার্থিব আলোয়। এক পলের জন্যই তো, কিন্তু অবিস্মরণীয় সেই অভিজ্ঞতায় রিণির গায়ে এখনো কাঁটা দিল। সে যেন নিজের ভার বহন করতে না পেরে বিস্তৃত বাঁধানো বেদীর এক কোণে সংকুচিত হয়ে বসে রইল। বসে বসে দেখতে লাগলো এই চির আরাধ্যকে। সেদিন যা আবছা দেখেছিল ধোঁয়া আর কুয়াশার মতো, আজকে তা দেহ পরিগ্রহ করে তার চোখের সামনে বিরাজমান। ঐ তো দুই পেশল দৃঢ় পদদ্বয়কে বেষ্টন করে উঠে গেছে বনলতা। তাদের প্রত্যেকটি পাতার মধ্যে মধ্য এবং পাশের রেখাগুলি আঁকতে শিল্পী ভোলেননি। আর সন্তের মুখমণ্ডল! আহা কী ভাবের আবেশে যে তা পরিপূর্ণ রিণি তা ব্যাখ্যা করতে পারবে না কিছুতেই। স্ফুরিত অধরে মৃদু হাসির রেখা, যে হাসি হাসা যায় সমস্ত বেদনা মন থেকে অপসারিত হলে পর।
    কেন, কেন তুমি মাথার ওপর আচ্ছাদন রাখতে দাও না ?

    রিণি নিশ্বাসের তলায় তলায় গোপনে জিজ্ঞাসা করে।

    ঘর পরিবার সম্পর্ক প্রত্যাশা, সব কিছু পার হয়ে
    এসেছ বলেই কি তোমার এই অনীহা?

    রিণি যেন সংগোপনে নিজের সঙ্গেই কথা বলে।

    কী করে পারলে, হে রাজনন্দন, ঐশ্বর্য রূপ বন্ধন এদেরকে কী করে তুচ্ছ করতে পারলে ! কী রইল তাহলে? পথ প্রকৃতি আর অচেনা দুঃখী মানুষ ছাড়া আর কী রইল তোমার ! তাতেই যদি অমন আনন্দের চ্ছটা তোমার মুখমণ্ডলে, এই আমি বসে আছি তোমার সামনে, আমাকে ভুলিয়ে দেবে সব? দাও। সব ভুলিয়ে দাও আমাকে!

    রিণির পিঠ ফুলে ফুলে ওঠে। কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে সে নতমুখী থাকে। টপ টপ করে চোখ থেকে জল পড়ে কুর্তার কোল ভিজে যায়। সেই বিচ্ছেদের পর থেকে এই মৃত্যুশয্যার খবর পাওয়া অব্দি একটি দিনও কেঁদে নিজেকে দুর্বল করেনি সে। সব কোথায় জমা ছিল কে জানে ! আজ মানুষের মহত্তম মেধার এবং সৌন্দর্যবোধের যৌথ সৃষ্টি এই অনুপম শিল্পের সামনে সে কেঁদে চলে নিতান্ত অসহায়ের মতো। প্রাণের প্রতিটি ভঙ্গি এতো নিখুঁত করে আঁকা যার চোখের কোণে, বরাভয় মুদ্রায়, তার জীবন্ত উপস্থিতি যেন সে নিজের মধ্যেও টের পায়। বৌটির কথা মনে পড়ে, বড় জ্যান্ত ভগমান!

    হঠাত গানের আওয়াজ, বাচ্চাদের কথায় রিণির ঘোর ভাঙে। তেলকুপির মতো এই মূর্তিও তার ঘোরের ফসল কিনা দেখবার জন্য বার বার চোখ মুছে ফিরে দেখে। না, মূর্তি চিরকালের মতোই দন্ডায়মান। রিণির চোখের সামনেই গ্রামের মেয়ে বৌরা বাচ্চাকাচ্চার হাত ধরে বেদীর চারপাশে ভিড় করে দাঁড়ায়। কেউ পেতলের ঘটে আনা দুধ ঢালে মূর্তির পায়ে, কেউ তেল সিঁদুর লেপে দেয়। তাদের কোনো মনোবাঞ্ছা আজ পূর্ণ হয়েছে। চারদিকে তাই বড় আনন্দ!

    প্ল্যাটফর্মে বসে ছিল রিণিরা।পাকবিড়রা থেকে সোজা এসেছে তারা, ইয়াকুব খুব দ্রুতই চালিয়েছে। কিন্তু গাড়ি আজ লেট। মানসের ওপর ডিএসপি সাহেবের নির্দেশ আছে সে যেন রিণিকে বসিয়ে তবে স্টেশন ছাড়ে। সারাদিনের পরিশ্রমে রিণির হাঁই উঠছিল। দু একবার হাঁটলো জড়তা কাটানোর জন্য,তারপর মানসের সংগে গল্প করে সময় কাটাবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

    মানস তোমার টাইটেল কী? মাজি না মাঝি ?

    মাজি, মাজি,আমরা মাজি।

    মাঝি হলে বোঝা যায়, নৌকো চালানো বা মাছধরা পেশা যাদের। কিন্তু মাজি...

    মানসের গলায় এবার বড় জাত ছোট জাতের বিভাজন। বেশ অবহেলায় হাত নাড়িয়ে সে বলে,
    -মাঝি হব কোন দুঃখে ! আমরা মাজি, জাতে শরাক। মাছ মাংস ছুঁই না, এমন কি ‘কাটা’ কথাটা আমার বাপ পিতেমো কখনও উচ্চারণ করত না। আমরা শিল্পীর জাত দিদি। ঐ যে দেখে এলেন ভৈরবকে, ঐ মূর্তি হয়ত আমার পূর্বপুরুষেরাই কেউ তৈরি করেছিল। ভৈরব ভৈরব বলে ,আমরাও মেনে নিই, কারণ এখন সংখ্যায় আমরা খুব কম। এইসব ঐ বামুনগুলোর কাজ। আমাদের ঠাকুর দেবতাও ছিনতাই করে নিয়েছে।

    কী বলছ মানস,তোমরা শরাক ? আগে বলনি কেন!

    রিণির মনে পড়ে যায় তার জৈনধর্মসংক্রান্ত পড়াশোনার মধ্যে শরাক বা শ্রাবকদের অনেকটা জায়গা জুড়ে থাকবার কথা। একসময় এরাই ছিল মানভুমে আদিবাসীদের পরেই সংখ্যাগরিষ্ঠ। লোহা ও তামার আকরিক নিষ্কাশনে যেমন দক্ষ,তেমনি ছেনি হাতুড়িতে পাথর খোদাই করে মূর্তি ও অন্যান্য নকশা ফুটিয়ে তুলবার কাজে দড়। কালের আবর্তনে বর্ধমান মহাবীর যেমন ভৈরব বাবা হয়ে গেছেন,শরাকরাও হিন্দুধর্মের অন্তর্গত হয়ে গেছে। এখন তাদের বিয়েতেও পাত্রীপক্ষের কাছ থেকে পণ চাওয়া হয়।

    দেখা যাচ্ছে মানসের বামুনদের ও মাঝিদের ওপর সমান রাগ। সে গজগজ করে বলে যেতে লাগল,
    আমার নিজের মামা খগেন্দ্রনাথ মাজি,তিনি বহুদিন পরেশনাথ পাহাড়ে শ্রমণ হয়ে ছিলেন।আমার গ্রাম চেলিয়ামায় তাঁকে একডাকে সবাই চেনে। কল্পসূত্র, আচারঙ্গসূত্র থেকে শুরু করে অনেক জৈন ধর্মগ্রন্থ আছে তাঁর কাছে। সবেতে আমাদের কথা বলা আছে।

    শুনেই রিণি লাফিয়ে উঠল। চেঁচামেচি করে মানসের হাত টাত ধরে একশা,

    -আগে বলবে তো, আরে আমাকে আগে বলবে তো ! ঐ বইগুলো সব আমার চাই। সব। তুমি তো জানো আমার কাজই এই নিয়ে। আজ কলকাতায় যেতেই হবে আমাকে। কিন্তু ফিরে এসে চেলিয়ামায় যাব তোমার মামার কাছে। নিয়ে যাবে তো মানস ?

    পেছন থেকে হুইশল বাজাতে বাজাতে রূপসী বাংলা ঢোকে। মানস তাড়াতাড়ি রিণির ব্যাগ নিয়ে ওঠে। জানালার ধারের সিট। রিণি সেখানে বসলে মানস তাড়াহুড়ো করে নামে। তারপর জানালার কাছে এসে মুখ বাড়িয়ে বলে,

    -দিদি, একটা কথা বলি? আপনি না একটু পাগলিমতো আছেন।

    রিণির হাসির শব্দে অন্যান্যরা ফিরে তাকালে ট্রেন চলতে থাকে। যতদূর দেখা যায়, মানস দাঁড়িয়ে থাকে,মুখে একগাল হাসি।



    ~~~~

    অনাগরিক নিগগন্থ ন্যায়াপুত্ত
    (পরিশিষ্ট)


    -নিগগন্থ অর্থ কী গৌতম?

    যাতে গ্রন্থি নাই, চিরমুক্ত। পিছন ফিরে যে তাকায় না।

    তবে এই জলসর্পের কথা ভেবে তুমি দুঃখী কেন? ওর নিরাময়ের জন্য যথাসাধ্য করেছি। এখন ও পূর্বাবস্থা ফিরে পেয়ে নিজের খাদ্য নিজেই সংগ্রহ করতে পারবে। যাত্রারম্ভের সময় ওর কথা ভেবে তুমি দুখী কেন গৌতম।

    গৌতম লজ্জিত হল। ইন্দ্রাভূতি গৌতম, যে যুগের সেরা মহামানবদের অন্যতমের সর্বক্ষণের সঙ্গী, তাকে এই দুর্বলতা সত্যিই মানায় না। সেইসঙ্গে প্রবল বিস্ময়বোধ তাকে অভিভূত করে ফেলে, ন্যায়াপুত্ত অলৌকিক শক্তিবলে তার মনের কথাও পাঠ করতে পারছে। সে তো মুখ ফুটে একটি কথাও উচ্চারণ করেনি, শুধু এই ঊষাকালে অগ্নিকুন্ডটি নির্বাপিত করবার সময় অনুকূল বায়ু বশে কোনো স্ফুলিঙ্গ যাতে সর্পটির ক্ষতি না করে সেই জন্য সাপ ও কুন্ডের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তারা আজই গমন করবে অনির্দেশ্য যাত্রায়। তাদের অবর্তমানে সাপটি আহত হলে যত্ন নেবার কেউ থাকবে না, এ কথাই তার হৃদয়পটে জাগরূক ছিল। ন্যায়াপুত্ত তার হৃদয়টিকে তবে উন্মোচিত পুস্তকের মতোই পড়ে ফেলেছে।

    সত্যি কথা বলতে কী, যারা ন্যায়াপুত্তের সংস্পর্শে আসছে তাদের প্রত্যেকের সম্বন্ধেই এই কথা খাটে। কী মন্ত্রবলে তাদের অন্তর সন্ন্যাসীর কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, গৌতম জানে না, কিন্তু তারা সবাই এমন ব্যবহার করতে থাকে যেন ন্যায়াপুত্ত বশীকরণ মন্ত্র জানে। অথচ তা যে নয়, এ কথা গৌতমের থেকে ভাল আর কে জানে ! ন্যায়াপুত্তের অস্ত্র বলতে গভীর শাস্ত্রজ্ঞান ও তা অন্যের মধ্যে সঞ্চার করবার অসীম ক্ষমতা। কঠোর অনুশাসন ও বিশ্ব চরাচরের প্রতি মমতাময় দৃষ্টিভঙ্গী।

    ন্যায়াপুত্তের প্রথম দর্শনেই মানুষ এমন বিহবল হয় যেন তারা ঈশ্বর দর্শন করছে। তারপর সুললিত বাণী শ্রবণে যেন তার দাস হয়ে পড়ে। শোকগ্রস্ত ক্রন্দনরত বা নিষ্ঠুরতমেরও হৃদয় পরিবর্তন হয়। যেমন ঐ পত্নীহারা সন্তপ্ত যুবকটি। সে ন্যায়াপুত্তের কথামতো সাতদিন নদীস্থলে এল। করজোড়ে সন্ন্যাসীর নিকটে অহিংসা, সত্য, অস্তেয় বা অচৌর্য, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ বা সংলগ্নহীনতার পাঠ নিল। তারপর যখন আজ রাত্রে তার শোকাবেগ সত্যিই প্রশমিত, তখন ছোটো ছোটো প্রশ্ন করে ন্যায়াপুত্ত জেনে নিল যুবকটির বৃত্তি তাম্র আকরিক নিষ্কাশন। তামাজুড়ি ও তামাখুন দুই খনিতেই সে এই কাজে মাঝে মাঝেই চলে যায়। এখন শিশুপুত্রদের সে কার কাছে রেখে যাবে! এই কথা বলে সে পুনরায় অশ্রু মোচনে প্রবৃত্ত হলে ন্যায়াপুত্ত তাকে বলল,
    শ্বশ্রূগৃহে এমন কেহ নাই যিনি তোমার সাহায্যে আসতে পারেন?

    হ্যাঁ মহাত্মন, আমার শ্বশ্রূমাতা ও তার কনিষ্ঠা কন্যা আছে। তারাই এই বিপদে ভরসা।

    যুবক, অন্য অসুবিধা না থাকলে তুমি শ্যালিকাটিকে বিবাহ কর।
    সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মুখে সংসারধর্মের কথা শুনে যুবকটি হতবাক হয়ে গেল। তারপর অতিকষ্টে সাহস সঞ্চয় করে বলল,

    তাহলে প্রভু আপনার দেওয়া এই ব্রহ্মচর্য শিক্ষা যে বিফলে যাবে!

    ন্যায়াপুত্ত কপালে গভীর ভাঁজ ফেলে অনেকক্ষণ কী চিন্তা করল। তারপর যেন নদী,আকাশ,দুই তীরের গভীর অরণ্য তার কথা শুনছে এমনভাবে দৃষ্টিকে দূরতম সীমায় ভাসিয়ে দিয়ে বলল,
    শোন বৎস, আমি ভবিষ্যত যা দেখতে পাচ্ছি তাতে তোমা হতেই শ্রাবক পল্লী গড়ে উঠবে। শ্রা অর্থে শ্রদ্ধা, ব বিবেকের প্রতীক আর ক বোঝায় ক্রিয়া। তুমি যেমন শ্রদ্ধাবান ও বিবেকী, তোমাকে আমি অধিকার দিলাম আমার শিক্ষা ছড়িয়ে দেবার। কংসাবতী, দামোদর, শিলাবতী, সুবর্ণরেখার প্রত্যেক ঢেউ গুণকীর্তন করুক প্রভু ঋষভনাথ থেকে ভগবান পার্শ্বনাথ অবধি ত্রয়োবিংশ তীর্থঙ্করের। তামা নিষ্কাশন, লৌহ নিষ্কাশনের ফলে যে ধাতু লভ্য তা দিয়ে পাথর কেটে ওঁদের মূর্তি বানাও, সুরম্য উপাসনালয় দ্বারা আবরিত কর মাঠঘাট, নদীতীর, পর্বতকন্দর। আলস্য ও অপরিচ্ছন্নতা ত্যাগ করে কর্মোদ্যোগী ও সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠবার মধ্যেই নিহিত আছে অতিমারী বিদায়ের বীজ।
    হয়ত আমার সঙ্গে তোমার আর এ জীবনে কখনো দেখা হবে না, কিন্তু শ্রাবক শিল্পী হিসাবে তোমার নাম বজ্রভূমে উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার করবে, ধর্মায়ুধ!

    চিরকাল রইবে প্রভু? আমার নাম?

    এ জগতে এমন কোনো কিছুর সৃষ্টি হয়নি বা হবেও না যা চিরকাল থাকবে। কালের নিয়মে সমস্ত হারাবে, এমনকি যে সুউচ্চ মন্দির তুমি তৈরি করবে তাও। থাকবে শুধু অপরিবর্তনীয় মানুষ তার জটিল মনকন্দর নিয়ে। তার অভ্যাসকে পরিচ্ছন্ন কর, তাকে অমৃতের সন্ধান দাও। তাইই ধর্ম। আর সবই ক্ষণিক সৌন্দর্যময়তার সাধনা!
    যাও বৎস। আমাদের বিদায়কাল সমাসন্ন।তুমি গৃহে সন্তানদের নিকটে যাও।

    অনিচ্ছুক ধর্মায়ুধ বিদায় নিলে, এই প্রথম গৌতম হেঁট হয়ে ন্যায়াপুত্তের চরণ স্পর্শ করে।

    কবে শিষ্যত্ব দেবে জানি না, তোমার শ্রীমুখের বাণী শোনবার অধিকার দিয়েছ, এই সঙ্গসুধাই আমার অনেক। আজ থেকে তোমাকে প্রভু বলে সম্বোধন করব।

    সেই প্রাতে যখন কুয়াশাজড়ানো কংসাবতীও নিদ্রাচ্ছন্ন, যখন এমনকি তার ঢেউয়ের শব্দও অনুচ্ছল, সেই ব্রাহ্মমূহুর্তে লালাভ আকাশের গায়ে দেখা গেল দুই চলমান প্রাংশু সন্ন্যাসীকে। তারা সর্বত্যাগী। একজনের হস্তধৃত কেবলমাত্র একটি দীর্ঘ দ। তাঁদের দৃষ্টি সংলগ্ন ছিল সম্মুখের পথে, প্রকৃতির নিদ্রাভঙ্গের অনবদ্য লীলায়। তাই তাদের কেউই খেয়াল করল না সেই নদীসর্পটি অনেকক্ষণ সাঁতার দিয়ে তাদের অনুসরণ করার পর জল থেকে তার বৃহত ও প্রশস্ত মাথাটি তুলে চেয়ে রইল গমন পথের দিকে, যতক্ষণ না সন্ন্যাসীদ্বয় তার দৃষ্টিসীমার বাইরে মিলিয়ে যায়। অমৃতের সন্তানের গতি কেবল সম্মুখের দিকে, তবু পিছনে কুয়াশা মাখা কিছু পিছুটান লুক্কায়িত থেকে যায়। তার খোঁজ বোধহয় না রাখাই শ্রেয়।



    পরিশিষ্ট
    ---------
    জিনজয়ী হবার পর বা সিদ্ধিলাভের পর নিগগন্থ ন্যায়াপুত্ত পরবর্তীতে মহাবীর বর্ধমান বা তীর্থংকর মহাবীর নামে খ্যাত হন। প্রাচীন রাঢ়দেশের যেটুকু এখন এই বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের কিছু অংশ, সেখানে তিনি পরিক্রমা ও ধর্মপ্রচারের নিমিত্ত এসেছিলেন। জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারঙ্গসূত্র অনুসারে "লাঢ়দেশ" বা "বজ্জভূমি" তখন পথঘাটহীন, কন্টকতৃণ ও বন্যজন্তু পরিপূর্ণ এক পান্ডববর্জিত ভূখণ্ড ছিল। ইক্ষ্বাকু বংশের এই পূর্বতন রাজকুমার সেখানে বহু কষ্ট পেয়েছেন,স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁর পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল বলে জনশ্রুতি, কিন্তু নিজের অভীষ্ট থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। রাঢ়দেশের পর আরো অনেক নতুন ভূখণ্ডে ৩০ বছর ধরে তিনি ধর্মপ্রচার করেন। ৭২ বছর বয়সে বিহারে রাজগৃহের কাছে পাবাপুরীতে তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।

    বাংলাভাষায় তীর্থংকর মহাবীরকে নিয়ে কোনো আখ্যান বিরচিত হয়েছে ব'লে আমার জানা নেই। হলেও অতি বিরল। কিন্তু কংসাবতী বা কাঁসাইয়ের ধারা বরাবর পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আপন খেয়ালে ও ইতিহাসের টানে ঘোরাঘুরি করবার সময় দেখেছি একেবারেই বিরল নয় জৈন মন্দির ও মূর্তির ধ্বংসাবশেষ, বরং তা প্রচুর এবং ক্রমশ বিলীয়মান। মন্দিরগুলি ভৈরবের থান বা শিবমন্দির ব'লে পরিচিত। মূর্তিগুলি নষ্ট হচ্ছে তেল সিঁদুরের প্রলেপে। বহু মূর্তির সামনে হাঁড়িকাঠ দেখেছি, শুনেছি নিয়মিত পশুবলি হয়। সর্বজীবে দয়া যে ধর্মের অন্যতম মূলকথা, একটি কীটকেও বাঁচার গৌরব দিতে যে ধর্ম সদা তৎপর, তারই উপাস্যের সামনে এ-ই রক্তস্রোত ভাগ্যের পরিহাসের মতোই লাগে!

    আচারঙ্গসূত্র অনুসারে বর্ধমান মহাবীরের দৈর্ঘ ছিল এখনকার মাপে সাড়ে দশ ফিট। তপ্ত কাঞ্চনের মতো গাত্রবর্ণ ও অসাধারণ শ্রীযুক্ত ছিলেন তিনি।
    জৈন তীর্থংকরদের প্রত্যেকেরই পৃথক পৃথক লাঞ্জনচিনহ, প্রতীক বা বাহন ছিল। ঋষভদেবের ষন্ড, পার্শ্বনাথের মহাসর্প, মহাবীরের সিংহ, ইত্যাদি। মূর্তিতে খোদিত এই লাঞ্জনচিনহ দেখেই বোঝা যায় মূর্তিটি কোন তীর্থংকরের।

    এই উপন্যাসিকাটির উপজীব্য তীর্থংকরের বিপুল পরিক্রমার খণ্ডাংশ। এতে মিশে আছে ইতিহাস, ধর্মগ্রন্থ, জনশ্রুতি এবং কল্পনা।
    মার শব্দের অর্থ প্রলোভনকারী, অশুভ শক্তি। জিন শব্দের অর্থ জ্ঞান।


    পড়তে থাকুন, শারদ গুরুচণ্ডা৯ র অন্য লেখাগুলি >>
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ১৪ অক্টোবর ২০২০ | ৫১৮২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পুরাণ | 100.25.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ০৩:২৯98479
  • বেশ 


    দীর্ঘতর কিছুর দাবি থাক 

  • i | 120.17.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১১:৩১98489
  • গতবছরের নবমীর লেখায় বীজ ছিল। সম্পূর্ণ আখ্যানের অপেক্ষায়-

  • শিবাংশু | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১২:০০98493
  • পুরোটা একসঙ্গে পড়ে ভালো লাগলো। তবে এটি এখনও গৌরচন্দ্রিকার স্তরে আছে। নির্গ্রন্থীদের  বেশ কিছু দর্শন সদ্ধর্মের থেকে বেশ খানিকটা পুরোনো। অধ্যাত্ম ও সমাজতত্ত্বের সম্মেলনে গড়ে ওঠা নাথপুত্তের সময়ের ইতিহাস ও রাজনীতি  বেশ কৌতুহল জাগায়। সদ্ধর্মের সঙ্গে নাথপুত্তের ধর্মীয় টানাপোড়েন থেকে আমাদের ইতিহাসের একটা বড়ো অংশ গড়ে উঠেছে। কেন শাক্যমুনির 'ধর্ম ' এদেশ থেকে একেবারে লোপ পেয়ে গেলো আর  নাথপুত্তের নির্বাসন হয়ে গেলো দেশের পশ্চিম সীমান্তের একটা ছোট্ট অংশে, তাও একটা আকর্ষণীয় বিষয়। বুদ্ধের ধর্ম তবু এদেশের বাইরে ছড়িয়ে গেলো।  কিন্তু নাথপুত্ত বন্দি থেকে গেলেন এদেশেই। তাও রাজস্থান, গুজরাট  আর কর্ণাটকের কিছু অংশ ছাড়া তাঁর অনুগামীদের খুঁজে পাওয়া যায়না। 


    পরের অংশটির জন্য অপেক্ষা থাকবে। 

  • বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় | 115.187.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১২:৪০98495
  • দুই কাহিনির মধ্যে নিহিত আছে ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাস। চলমান উপকথা। এই পাঠ অভিজ্ঞতা কোনদিন পুরনো হবে না।

  • অচিন্ত্য | 45.25.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১২:৫৫98496
  • যতবার পড়ি মুগ্ধ হই। আরো এমন লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

  • তীর্থংকর | 115.96.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১৩:০২98497
  • আমার পড়াশুনোয় বাংলা সাহিত্যে মহাবীরকে নিয়ে কিছু চোখে পড়েনি। রাঢ় বাংলায় ওঁর কর্মকান্ডের কথা কিছুই জানি না। ঐতিহাসিক ভাবে লেখিকাকে একটি বিরাট ধন্য্যবা দ। 


    আর সব মিলিয়ে ৫ এ ৫। 

  • বিপ্লব রহমান | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১৩:৩০98498
  • প্রতিটি পর্বই দারুণ। যেন গল্পোচ্ছলে ইতিহাসের  পরিভ্রমণ। ব্রেভো প্রতিভা দি! 


    তবে সন্যাসীর নাম "গৌতম" না হলেই  বোধহয়  ভাল হতো। যদি ভুল করে না থাকি, চরিত্রটি সম্ভবত তথাগত নন। 


    #


    উপন্যাসিকার শেষ তিনটি প্যারা বোধহয় লেখিকার ব্যক্তিগত অভিমত। গুরুচণ্ডালীর সম্পাদক মণ্ডলীকে অনুরোধ, সে ক্ষেত্রে এই অংশটি মূল লেখা থেকে আলাদা করে পাদটীকা হিসেবে প্রকাশের। 

  • রঞ্জন | 49.36.***.*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৪৪98505
  • জৈনধর্মের ইতিহাস বলতে গেলে কিছুই জানতাম না। এই লেখাটি আমার বড় প্রাপ্তি।

  • | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ১৮:২৭98509
  • ভারী ভাল লাগল।  


    একটা ছোট খতকা, কোভিডরোগীদের  কি হাসপাতালে দেখতে যাওয়া যাচ্ছে? পড়েছিলাম মনে হচ্ছে যাই ঘটুক না কেন দেখতে  পাওয়া যায় না। 

  • মধুমিতা | 2409:4060:2e17:6845::92cb:***:*** | ১৫ অক্টোবর ২০২০ ২২:৪০98515
  • অভিভূত হলাম, আবিষ্ট লাগছে এখন ও। আমি ক্রিটিক নই,সাধারন পাঠক । 

  • শক্তি | 49.37.***.*** | ১৬ অক্টোবর ২০২০ ২২:০৯98547
  • প্রাংশু পুরাণ বেশ অন্যরকম পরিবেশে ঘুরিয়ে আনলো কতক্ষণ, বিষয়বস্তু ছাড়া ও বিষয়ানুগ ভাষার বুনোট মুগ্ধ করলো 

  • Saoni Mandal | ১৭ অক্টোবর ২০২০ ০৮:১৭98560
  • এই সময়ের পরিপ্রেক্ষীতে  অসাধারণ  এক উপন্যাস। মনে থাকবে ।জৈন ধর্মের ইতিহাস নিয়ে এই প্রথম এমন লেখা পড়লাম .

  • জারিফা | 113.2.***.*** | ১৭ অক্টোবর ২০২০ ১৯:৪৬98585
  • পটভূমিটাই অন্যরকম। সাাথে তোমার লেখা। ঠিক এই দুই মেলবন্ধনের কারণেই লেখাটা উপন্যাস হলে তৃপ্তি  পেতাম আরও।

  • কুশান | 45.249.***.*** | ১৭ অক্টোবর ২০২০ ২২:৫১98586
  • অসামান্য লেখা। বিশেষত তীর্থংকরের চরিত্র ও সমসময় লেখকের মুন্সিয়ানায় চমৎকার ফুটে উঠেছে।


    প্ 

  • একলহমা | ২১ অক্টোবর ২০২০ ১০:৫৪98715
  • লেখা চেন-চেনা লাগল। মনে হয় আগের কোন লেখাতে এর কিছু পড়েছিলাম (হয়ত ছোটাইদি যেমন বলেছেন - বীজ)। আপনার লেখা সবসময়-ই আবিষ্ট হয়ে পড়ে যেতে হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। 


    একটু দ্বিধা - রিনি-তন্ময় অংশ (কোভিড সহ) বাকী অংশের প্রেক্ষিতে জোর করে আনা মনে হয়েছে। 

  • Yashodhara Raychaudhuri | ২২ অক্টোবর ২০২০ ১৬:১৫98756
  • প্রতিভাদির লেখার বহুদিনের ভক্ত। এ লেখা ত মন ভরিয়ে দিল। পড়াশুনো করা লেখা কিন্তু সেই লেখাপড়ার চিহ্ন সেদ্ধ না হওয়া আলুপটলের মত চেয়ে চেয়ে থাকে না যখন, তখন ই আসল আনন্দ।  এত নরম মায়াবী গদ্য কী করে লেখেন প্রতিভাদি!!! 

  • রুখসানা কাজল | 27.147.***.*** | ২৪ অক্টোবর ২০২০ ১০:৪১98846
  • লেখাটি বই হোক। 

  • রৌহিন | ২৫ অক্টোবর ২০২০ ১২:৪৪98940
  • এতদিন জমিয়ে রেখেছিলাম এটা, আজ সকালে একটানে শেষ করলাম। ন্যায়াপুত্তের অসুখ এবং স্বপ্নে পার্শ্বনাথ দর্শনের অংশটা আগে পড়া ছিল। তখন যে এক্সপেক্টেশন জেগেছিল, এখন তার অনেকটাই পুরণ হল।


    এটার পূর্ণ উপন্যাসরূপ দেওয়া খুব সহজ নয়, জানি। অনেক সময়সাপেক্ষ, পরিশ্রমসাপেক্ষ হবে। তবুও, শিবাংশুদা যেটা বলেছেন, সেই সময়ের জৈন ও বৌদ্ধধর্মের পারস্পরিক টানাপোড়েন, সমকালীন রাজনীতিতে তাদের প্রভাব, এবং পরবর্তী ৩০০০ বছরে তাদের গতিপথ - এসব যদি আসে -


    ইতিমধ্যেই যেটুকু পেয়েছি সেটা একটা মাইলস্টোন বাংলা সাহিত্যে। 

  • অরিন | ২৬ অক্টোবর ২০২০ ০২:৫০99034
  • পুরোটা পড়লাম। অসাধারণ লেখা! 

  • সুনৃতা | 157.4.***.*** | ০৪ নভেম্বর ২০২০ ১৭:৫০99622
  • অসাধারণ লাগল। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন