“পথ আমার চলে গেল শুধুই সামনে, সামনে, দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের দিকে, জানা থেকে অজানার পানে... মহাযুগ পার হয়ে যায়, পথ আমার তখনও ফুরোয় না, চলে চলে, এগিয়েই চলে। অনির্বাণ তার বীণা শোনে শুধু অনন্ত কাল আর অনন্ত আকাশ, চলো এগিয়ে যাই”
—বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, 'পথের পাঁচালী'
শৈশব এক আশ্চর্য সময়। একদিকে তাকে ক্রমাগত হাতছানি দেয় দূরের জীবন, অন্যদিকে ঘরের স্নেহ বারে বারে তার পিছু টেনে ধরে। এই টানাপোড়েন নিয়েই একটি শিশু পা রাখে ভবিষ্যতের পথে, কিন্তু তার শৈশব কোনোদিন তাকে ছেড়ে যায় না। অপুকে বারবার ডাকে নিশ্চিন্দিপুর। শাঁখারীপুকুর, বাঁশবন, সোনাডাঙ্গার মাঠ। সব কিছু।
“ওই আস্তাবলের মাথায় যে আকাশটা, ওরই ওপারে পুবদিকে, বহুদূরে তাহাদের নিশ্চিন্দিপুর। তাহাকে দিনে রাতে সবসময় ডাকে।” একদিকে নিশ্চিন্দিপুরের ডাক, অন্যদিকে আকাশের নীল আস্তরণ ভেদ করে আসা অনন্তের হাতছানি। এই দুয়ের মধ্যে শৈশবের স্বল্প কয়েকটি মহার্ঘ বছর।
বাংলার যেমন অপু, অসমিয়ায় তেমনি বাপুকণ। এদিকে নিশ্চিন্দিপুর, ওদিকে অসমের এক অখ্যাত গ্রাম—মহঘুলি। কী আশ্চর্য মিল। পাঠকের চোখ এড়ায় না। হোমেন বরগোহাঞি-র অসামান্য উপন্যাস ‘সওদাগরের পুত্র নৌকা বেয়ে যায়’-এর অনুবাদক বাসুদেব দাসেরও একই কথা মনে হয়েছিল, “এতদিন পথের পাঁচালীর অপু আর দুর্গা আমার কিশোর মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। দুর্গার সঙ্গে অজান্তেই আমার মনে আরও একটি নাম গাঁথা হয়ে যায়। তা হল বাপুকণের বোন মাখনী।” দুর্গার মৃত্যু যেমন অপুর বুকে একটা চিরস্থায়ী আঘাত, তেমনি মাখনীর মৃত্যুও বাপুকণের জীবনে।
অসমিয়া সাহিত্যিক হোমেন বরগোহাঞি
“মাখনী মারা গেল। মাত্র গতকাল বিকেলে সে বাপুকণের হাত জোরে খামচে ধরে জীবনের প্রতি কী ভীষণ ভালোবাসা ঘোষণা করেছিল। সে আর কোনোদিন তার সেই কোমল মধুর কণ্ঠে তাকে দাদা বলে ডাকবে না। ... সে কল্পনা করতে লাগল—এইমাত্র মানুষগুলি মাখনীকে গর্তে রেখে মাটি দিতে শুরু করে দিয়েছে। প্রথম চাপড়া মাটি মাখনীর ওপর পড়তেই বাপুকণ আর্তনাদ করে উঠল—মাটি দিও না, মাটি দিও না—ও ব্যথা পাবে। ... মানুষগুলি যখন নদীতে স্নান করে বাড়ি ফিরল, বাপুকণ শেষবারের মতো আর্তনাদ করে উঠল ‘যে মাখনী কখনও একা ঘরে ঘুমোয়নি সেই মাখনী আজ নদীর পারে নির্জন শ্মশানে মাটির নীচে একা কীভাবে শোবে? জেগে উঠলেই সে খুব ভয় পাবে, সে নিশ্চয়ই আদুরে কণ্ঠে ডেকে বলবে—দাদা, ও দাদা, আমাকে তোমরা একা এখানে কেন রেখে গেছ? আমার খুব ভয় লাগছে...”
শুধু ‘পথের পাঁচালী’ই নয়, অনুবাদকের মনে পড়েছে ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কথাও। বাপুকণ আর হেবাঙের বন্ধুত্বের মধ্যে তিনি দেখেছেন শ্রীকান্ত আর ইন্দ্রনাথের ছায়া।
এই যে সাদৃশ্য, তা কিন্তু কেবলই মানব-অনুভূতির চিরকালীনতা, যা দেশ, ভাষা নির্বিশেষে এক, শুধু স্থানিকতা আলাদা।
তাই ‘সওদাগরের পুত্র নৌকা বেয়ে যায়’ একটি স্বরাট উপন্যাস। অসমিয়ার বরেণ্য লেখক হোমেন বরগোহাঞির এক অসামান্য কীর্তি এই উপন্যাস। হোমেন বরগোহাঞির জন্ম ১৯৩২ সালে লক্ষীমপুর জেলার ঢকুয়াখনায় (উল্লেখ্য ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে রঞ্জন প্রকাশনালয় থেকে)। ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক হোমেন সাংবাদিকতাকে পেশা করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে ‘পিতাপুত্র’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পান। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে—‘আত্মানুসন্ধান’, ‘বিভিন্ন নরক’, ‘সুবালা, মৎসগন্ধা’, ‘হালধীয়া চরায়ে বাওধান খায়’ এবং অবশ্যই ‘সাউদর পুতেকে নাও মেলি যায়’।
অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে বাপুকণের চারপাশে অনুশাসনের বেড়া। পড়াশোনা শিখে সফল মানুষ হবার চাপ তার ওপর। হেবাঙের ওসব বালাই নেই। তারা বড়ো গরিব। তবে তাদের ঘরে অভাব থাকতে পারে, কিন্তু প্রকৃতি তো অকৃপণ হাতে দিয়েছে সবাইকেই, গরিব-বড়োলোক নির্বিশেষে। তাই গরমের দমবন্ধ করা দুপুরে বাবার দেওয়া অংক ফেলে হেবাঙের ডাকে সেই বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যায় বাপুকণ। হলিবাড়ির আমবাগান আমে ভরে আছে। এই সেই হলিবাড়ি, যেখানে নাকি ঘুরে বেড়ায় এক প্রেতিনী, বড়োরাই সাহস করে সেখানে যায় না, কিন্তু আমের মরশুমে বাচ্চাদের কোনো ভয়ই আটকে রাখতে পারে না।
“হেবাঙ বাড়ি থেকে ছুরি, লবণ আর কাঁচা লঙ্কা নিয়ে আসবে। কলাপাতায় কচি আম ফালা ফালা করে কেটে তাতে নুন লঙ্কা মেখে গাছের নীচে বসে দুজনে খাবে... আম খাওয়া হয়ে গেলে তারা সর্বেশ্বরদের বাগানে কালো জাম খেতে যাবে।”
মনে পড়ে যায় মণীন্দ্র গুপ্তের ‘অক্ষয় মালবেরি’—“ধন দিদির ঘরের কোণ ঘেঁষে ছিল এক সটান উঁচু কালোজাম গাছ। সেই গাছে কর্ত্রীর অনুমতি ছাড়া ওঠা যেত না। কিন্তু একবার অনুমতি পেলে কখন নামছি তাও কেউ দেখত না। জাম খেতে খেতে জিভ বেগুনি নীল এবং পুরু হয়ে যেত। তখন ডালে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে গাছের তলায় অপেক্ষমান বালিকাদের জন্যে হরির লুট দিতাম। ... আমরা ছাড়তাম না কিছুই। বসন্তকালে রক্তিম পলাশ আর শীতের মাঠে যেতে যেতে সাদা দ্রোণফুল তুলে তাদের অকিঞ্চিৎকর মধুও চুষতাম। সেই কণিকামাত্র মধুও জিভের ডগায় মিষ্টি স্পর্শানুভূতি দিয়ে মিলিয়ে যেত। তাও কত সুখ।”
আসলে এই যে জীবন, তা ছিল সব ইন্দ্রিয় দিয়ে উপভোগের। এই জীবনকে প্রকৃতি দু-হাতে স্পর্শ করে। মনে হয় যেন এরা প্রকৃতির চির মুক্ত সত্ত্বা।
গরমের দুপুরে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে চারিকরিয়া নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে হেবাঙ, সে ডাক দেয় বাপুকণকে।
ঘামে ভিজে তিতিবিরক্ত হওয়া শরীরে নদীর কোমল স্পর্শ, নগ্ন শরীরে স্রোতের আঘাত, নগ্ন শরীরে কলকল করে বয়ে যাওয়া জলের আলিঙ্গন কল্পনা করে লুব্ধ হয়ে ওঠে বাপুকণ। সে ঝাঁপ দেয় নদীতে। “কিছুক্ষণ পর সমস্ত জগত, সময়ের চেতনা, বাবার শাস্তির ভয়—এসমস্ত কিছুই তার চেতনা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল। তাদের নগ্ন সুকুমার শরীর দুটিতে জল্রস্রোত মৃদু মন্দ আঘাত হেনে একটা অবর্ণনীয় সুখাবেশের সৃষ্টি করল, দুরন্ত শিশু মাকে টানাহ্যাঁচড়া করে বারবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, নাকে-মুখে চুমু খেয়ে ধেমালি করার মতো তারাও মহঘুলি নদীর সঙ্গে বিচিত্র মধুর খেলা শুরু করে দিল।”
কিন্তু শিশুর মন বড়ো বিচিত্র, নিষ্ঠুরও বটে। খুব দ্রুত তার ভালোবাসার মানুষ বদলে যায়। হেবাঙকে মুছে দিয়ে বাপুকণের নতুন বন্ধু হয়ে ওঠে তাদের স্কুলে নতুন ভরতি হওয়া মেধাবী ছেলে দুলাল। দুজনের বন্ধুতার সূত্র বই। তারা মেতে ওঠে গ্রামে লাইব্রেরি খোলা নিয়ে। অভিমানী হেবাঙ বুঝে পায় না বাপুকণ এত বদলে গেল কেন। আসলে বাপুকণের শরীরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মন। সে আগ্রাসী খিদে নিয়ে শুষে নিতে চাইছে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার। সে জানতে চায় পৃথিবীর আদিতে কী ছিল? হেবাঙ তার মনের খিদে মেটাতে পারছে না। আবার বয়ঃসন্ধির উন্মেষে দুলাল থেকে তার মন সরে আসে সদ্য আবিষ্কৃত রেণুর দিকে। কী এক অজানা সুগন্ধ তাকে টানে নেশার মতো। নারীর রহস্য তার মনোজগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ঠিক তখুনি সে জানে খুব শিগগির তাকে গ্রামের স্কুলের পাট চুকিয়ে শহরে চলে যেতে হবে। সেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছে এক উজ্জ্বল জীবন। সওদাগরের ছেলে যেমন সপ্ত ডিঙা মধুকর নিয়ে রোমাঞ্চকর সমুদ্রযাত্রায় যায়, তেমনি তাকে এবার নিরাপদ গৃহকোণ ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে অজানাকে জানতে, অচেনাকে চিনতে। বাপুকণ ভাবে শহরে গিয়ে কি তার গ্রামের প্রিয় পরিচিত আকাশকে সে দেখতে পাবে?
জীবনের এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করে এত বিপুল আনন্দ আর এত দুঃসহ বিষাদ সে জীবনে কখনও অনুভব করেনি।
“বিকেলের দিকে মাঠে গোরু খুঁজতে গিয়েই তো সে আবিষ্কার করেছে পাখির ঝরা পালক বুকের মধ্যে কেমন কোমল করুণা জাগায়, অস্তগামী সূর্য রক্ত রঞ্জিত করা আকাশটা হৃদয়ের মধ্যে কী অপরূপ মত্ততা সৃষ্টি করে... শিশিরে ভেজা মাঠে জ্যোৎস্নার আলো উপছে পড়লে জীবন মরণের সীমা পার করে কোথায় যেন চলে যেতে ইচ্ছে করে...”
শৈশব শেষ হয়ে যাবার এক চাপা কষ্ট মধুর বিষের মতো মিশে যায় রক্তে।
“ক্রমে শিশুকাল চলে যায়, দুর্গার ছুঁড়ে ফেলা পুঁতির মালার
মতো পড়ে থাকে পুকুরে।
শিশুকাল, পানাপুকুরের মধ্যে ডুবে আছে, বুড়ো আংলা প্রেত।
পচাপাতা, চৌকোপানা বুনানো জলের মধ্যে ওর সবুজ আঁধার
ভোলাবাবা ঘর। আজ কতদিন হল, সেখানে ও মা-বাবাকে ছেড়ে
মাছবন্ধুদের সঙ্গে ভূতের কুহকে একা।”
(মণীন্দ্র গুপ্ত)
মৃত্যুচেতনা আর প্রকৃতিপ্রেম—হোমেন বরগোহাঞির লেখার দুটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। আত্মজৈবনিক এই উপন্যাসে এর সঙ্গে তিনি শিশু মনস্তত্ত্বকে মিশিয়ে দিয়েছেন নিপুণ দক্ষতায়। এই উপন্যাস পাঠ শেষে পাঠকের মনে হবেই—আমিও তো বাপুকণ, আমিই তো বাপুকণ।
হোমেনের অসাধারণ ভাষার অত্যন্ত সুখপাঠ্য অনুবাদ করেছেন বাসুদেব। আমার জানার মধ্যে এটি নিঃসন্দেহে তাঁর সেরা অনুবাদ। তবে গরমের বন্ধ না বলে গরমের ছুটি বললে বেশি ভালো শোনাত। কিংবা ঘুরিয়ে নেওয়ার বদলে ফিরিয়ে নেওয়া। ভূমিকায় তিনি যে কথাটি বলেছেন, সেটি প্রতিবেশী সাহিত্যকে না জানার অন্যতম কারণ। “আজ বলতে লজ্জা বোধ হয় আশৈশব অসমের আলো হাওয়ায় বড়ো হয়েও তখনও পর্যন্ত অসমিয়া সাহিত্যের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় গড়ে ওঠেনি... অসমিয়াদের সঙ্গে কেন জানি এক ধরনের দূরত্ব রক্ষা করে চলাই ছিল তখনকার সামাজিক নিরাপত্তার শর্ত।”
এ পাপক্ষালন করতে পরবর্তীকালে যে বাসুদেব উদ্যোগী হয়েছেন, তার মূলে আছে এই বইটি পড়ার মুগ্ধতা। তাঁকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ প্রতিভাসকে এমন একটি শুভ সূচনার জন্য।