পাঞ্জাবি সাহিত্যের আদি নিদর্শন মেলে একাদশ শতকের নাথযোগী গোরক্ষনাথ (বিশদে জানতে দেখুন এই সাইট) প্রমুখের রচনায়। স্বাভাবিক ভাবেই এর সুরটি ছিল মিস্টিক্যাল। এর পরে আসেন ফরিদুদ্দিন গঞ্জ্শকর (১১৮৯ – ১২৬৬), মৃত্যুর পর যাঁর রচিত সুফি কবিতা স্থান পায় আদি গ্রন্থে। (তাঁর বিষয়ে বিশদে জানতে ও কিছু কবিতার ইংরেজি তরজমা পড়তে দেখুন এই সাইট)। তবে, এ সমস্তই কবিতা। গদ্যসাহিত্যের প্রথম সাক্ষর ধরে রেখেছে ‘জনমসখী’ যা গুরুনানকের জীবনের নানা ঘটনা ও কিংবদন্তি নিয়ে রচিত। গুরুবাণী পরম্পরা অনুযায়ী পাঞ্জাবি সাহিত্য প্রথম থেকেই সংস্কৃত, আরবি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে এসেছে। সুফি কবিতার পাশাপাশি প্রচলিত ছিল রোম্যান্টিক ট্রাজেডি নির্ভর পাঞ্জাবি কিস্সা যেমন সোনি মাহিয়াল।
১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ ভারতে লুধিয়ানায় গুরুমুখী হরফ সম্বলিত পাঞ্জাবি প্রিন্টিং প্রেস খোলা হয়, পাশাপাশি ছাপা হয় পাঞ্জাবি শব্দকোষ (রেভারেন্ড জে নিউটন ১৮৫৪)। এই দুটি ঘটনার হাত ধরে পাঞ্জাবি সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা।
নানক সিং ও বীর সিং লিখলেন উপন্যাস, একে একে এলেন আধুনিক পাঞ্জাবি কবিতার জনক বলে খ্যাত পূরণ সিং (১৮৮১-১৯৩১), বামপন্থী লেখক উস্তাদ দামন (১৯১১-১৯৮৪), এলেন অমৃতা প্রীতম (১৯১৯-২০০৫), নারীর ভুবন ও দেশভাগ যাঁর লেখায় ঘুরে ফিরে আসে। কমিউনিস্ট সাহিত্যিক যশবন্ত সিং রাহি (১৯১৩-১৯৯৬), কবি ও নাট্যকার শিবকুমার বাতালভি (১৯৩৭-১৯৭৩), বিপুল জনপ্রিয় সুরজিত পাতর (জন্ম ১৯৪৫), নকশাল আন্দোলনের অকুণ্ঠ সমর্থক কবি অবতার সিং সন্ধু ওরফে পাশ, যিনি ১৯৮৮ সালে খুন হল খালিস্তানি উগ্রপন্থীদের হাতে মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে, কর্তার সিং দুগগল (১৯১৭-২০১২) — এঁরা পাঞ্জাবি সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সেই ধারারই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র অজিত কৌর। জন্ম ১৯৩৪ লাহোরে। দেশভাগের পর লাহোর থেকে দিল্লি আসেন। ইকনমিক্সে এমএ ও বিএড। বিবাহ-বিচ্ছিন্না হয়ে একা হাতে দুই মেয়েকে বড়ো করে তুলেছেন সাংবাদিকতার পেশাকে অবলম্বন করে, একসময় সম্পাদনা করেছেন ‘রুপি ট্রেডের’ মতো পত্রিকা।
মানুষ কেন আত্মকথা লেখে? কুন্দেরার কথা মানলে ‘They are fighting for access to the laboratories where photographs are retouched and biographies and histories rewritten.’ এর ঠিক আগের কথাটা হল, ‘The only reason people want to be masters of the futures is to change the past.’ এর সহজ উদাহরণ হল যে কোনো উঠতি স্টারলেটের ইন্টারভিউ, যাকে বলা যায় আত্মজীবনীর একটা টুকরো, যেখানে তার বাল্যের জ্ঞানদানন্দিনী-ঈশান চন্দ্র বালিকা বিদ্যালয় হয়ে যায় নিউ গ্লোবাইজন ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।
আরও এক কারণে মানুষ আত্মকথা লেখে। লেখে নিজেদের ক্ষতচিহ্নগুলো লুকিয়ে বেড়ানোর ভার আর বইতে পারে না বলে। তারা ‘কিনারাহীন মরুভূমির মধ্যে শব্দ দিয়ে ফণীমনসার বীজ বয়ে চলে। আর প্রতি গাছের পাশে বিস্তৃত হয়ে থাকে শুষ্ক বালু রাশি, তপ্ত-মূক-নিথর।’
যেমন অজিত কৌর। যিনি শৈশবে দেশভাগের দাঙ্গা দেখেছেন লাহোরে, পরিণত বয়সে ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুতে শিখ নিধন। ‘কালে কুয়ে’, ‘তোতা চশম’, ‘গুলবানো’ প্রমুখ অসাধারণ গল্পের স্রষ্টা অজিত পদ্মশ্রী, সাহিত্য অকাদেমি সহ বহু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, মনোনীত হয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যেও। সেই অজিতের ব্যক্তিজীবন এত রক্তাক্ত যে একটি নয়, তাঁকে নিজের জীবন লিখতে হল দুইখণ্ডে। প্রথমটি জিপসি নদীর ধারা। দ্বিতীয়টি আবর্জনা। মূল পাঞ্জাবিতে এ দুটির নাম যথাক্রমে ‘খানা বাদোশ’ আর ‘কড়া-কাবাড়া’।
খানা-বাদোশের অনুষঙ্গে অজিত এক ভ্রাম্যমাণ জনজাতির সঙ্গে নারীজীবনের তুলনা টেনেছেন, ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত যাদের গায়ে দাগা ছিল ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া অপরাধপ্রবণ জাতির তকমা। অজিত দেখিয়েছেন ভারতীয় সমাজে মেয়েদের কপালে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে এমন অনেক অবমাননাকর তকমা সাঁটা হয়ে যায়। অপয়া, আবর্জনা, পরের ধন, সারা জীবন তাদের নিজের কোনো ঘর থাকে না, মৌল অধিকারটুকু পেতে হয় অনেক লড়াই করে। তাই শিক্ষিত পরিবারে শিক্ষিত ডাক্তার পিতার ঔরসে জন্মেও অজিতের জন্য কখনও ভাবা হয়নি যথাযথ শিক্ষা বা কেরিয়ার প্ল্যান। পাঞ্জাবি পরিবারে যেমন ছেলেদের কোনো নামের সঙ্গেই কৌর জুড়ে মেয়েদের নাম দেওয়া হয়, মেয়েদের আলাদা নামও থাকে না, তেমনি ফেলাছড়ার জোড়াতাপ্পি দেওয়া এক পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে আক্ষরিক অর্থে আগাছার মতো বেড়ে ওঠেন অজিত। বিয়েও দেওয়া হয় তেমনিভাবে, ডাক্তার স্বামী দুই মেয়ে সুদ্ধু তাঁকে বিতাড়িত করেন সাতবার। জিপসির মতোই এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে বেঁচে চলেন অজিত। বড়োমেয়ের চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা, ছোটোমেয়ের অকালমৃত্যু, নিজের প্রেম—সব সমেত। কারণ বালিতে আছড়ে পড়লেও ‘তারার নিজস্ব অস্তিত্ব থাকে অখণ্ড, সম্পূর্ণ।’
ভারতীয় উপমহাদেশের নারী লেখকবিশ্বে অবশ্য এই ঘরহীন নারীর আত্মকথার ধারাটি বেশ পরিপুষ্ট। অমৃতা প্রীতম, কমলা দাস, ইন্দিরা রায়সম গোস্বামী—প্রত্যেকের আত্মকথা অনিকেত নারীর অস্তিত্ব সন্ধানের রক্তাক্ত দলিল। এই উপমহাদেশে কোনো নারী যদি নিজের কলমকে অবলম্বন করে নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব তৈরি করতে চায়, তার লড়াই যে কত তীব্র আর যন্ত্রণাময় হয়, তার সাক্ষ্য অমৃতা প্রীতমের ‘রসিদি টিকেট’ কমলা দাসের ‘এই আমি’ কিংবা ইন্দিরা গোস্বামীর ‘মরচে ধরা তরোয়াল’। এই ধারায় অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংযোজন জিপসি নদীর ধারা এবং আবর্জনা। অনুবাদক যথাক্রমে জয়া মিত্র এবং পুষ্পা মিশ্র। অজিতের শাণিত অথচ পুষ্পল গদ্যের সৌরভ মেলে অতি সুখপাঠ্য অনুবাদে।
‘বেদনা আর নিঃসঙ্গতা যদি একা একা বহন করারই ব্যাপার, তবে একাহিনি আপনাদের শোনাতে বসেছি কেন? আমি তো আহত বাজের মতো এক পুরোনো রিক্ত গাছের ডালে বসেছিলাম, একা নিজের ক্ষতচিহ্নের লজ্জায় বিব্রত, সেসব চিহ্ন লুকোনোর চেষ্টায় ব্যকুল। সেই শব্দহীন নিঃসঙ্গতার অসহ্য নিথরতার কাহিনি আপনাদের শোনাতে শুরু করলাম কখন?’ (জিপসি নদীর ধারা)
অজিতের লড়াই শুরু শৈশবেই। নিজের বাড়িতেই লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হতে হয় নারীশিশুকে। শিশু অজিতের শৈশবস্মৃতিতে দগদগে হয়ে থাকে ভাইয়ের জন্মের দিনটা, যেদিন পুত্রের জন্মের উল্লাসে বাড়ির সবাই তার অস্তিত্বটাই ভুলে গেছিল, তার চুল আঁচড়ানো হয়নি, খাওয়াও জোটেনি সেইদিন। শীলা দাই হাসি মুখে বলেছিল ‘তুই বড়ো ভাগ্যবতী রে। নিজের পেছন পেছন ভাইকে নিয়ে এসেছিস।’
মেয়েদের জীবন গোড়া থেকেই কতকগুলো অনির্দেশ্য সাবজেক্টিভিটির শিকার হয়। ভাগ্য, ঐতিহ্য, ইজ্জত। অজিতের জীবনও তাই ঘুরতে লাগল সদ্যোজাত একটি পুরুষমানুষ, ঘুগগীর জীবনের চারপাশে।
‘সারা বাড়িতে শুধু ঘুগগী আর ঘুগগী। আমি তো কোথাও ছিলামই না’। অজিতকে প্রথমে স্কুলে পাঠানোই হয়নি। ‘আমাদের বাড়িতে সব সিদ্ধান্ত দারজীই নিতেন। তাই মেয়ে স্কুলে যাবে না, এই সিদ্ধান্ত দারজীরই ছিল। স্কুলে গেলে মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে’ দারজী মানে বাবা, যিনি ছিলেন ডাক্তার। মজার কথা, অজিতের স্বামীও ছিলেন ডাক্তার। যিনি শুধু পুত্র উৎপাদনের জন্য বিবাহিত জীবনে অজিতকে মাত্র দুবার শয্যায় নিয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয়, দুবারই কন্যা জন্মায়। তের বছরের বিবাহিত জীবনে দুই কন্যা সুদ্ধু মোট সাতবার অজিতকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বামী। আটবারের মাথায় আর ফেরেননি অজিত, পিতৃগৃহের অসম্মানের মধ্যেও যাননি। দুই মেয়েকে নিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে কাটিয়েছেন ওয়ার্কিং ওম্যান্স হস্টেলে। ডলি আর ক্যান্ডি—এই দুটি আদরের ডাকনাম ছাড়া অন্য নাম দেননি মেয়েদের। যাতে তারা বড়ো হয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো নিজেদের পোশাকি নাম দেয়। কারণ পাঞ্জাবি সমাজে মেয়েদের জন্যে আলাদা নামটুকুও বরাদ্দ নেই। একই নামে সিং যোগ করলে পুরুষ আর কৌর জুড়ে দিলে নারী। এতই আবর্জনা নারী। ডলি বড়ো হয়ে নিজের নাম নেয় অর্পণা (অপর্ণা নয় কিন্তু)। বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী অর্পণা কৌরকে কে না চেনে? আর ছোটো মেয়ে ক্যান্ডি ফ্রান্সে পিএইচডি করতে গিয়ে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে মারা যায়।
অষ্টমবার বিতাড়িত হবার পর ‘বহু বছর জমে থাকা ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে লুকোনো অঙ্গারের মতো’ (আবর্জনা) উঠে দাঁড়িয়েছিলেন অজিত, কিন্তু তাও তিনি লিবারেশনের স্বাদ পাননি। কারণ বাইরের শৃঙ্খল ভাঙা বা আর্থিক স্বাধীনতা নয়, সত্যিকারের লিবারেশন আসে মন থেকে। ক্যান্ডির মৃত্যু তাঁকে সেই লিবারেশন দিল। সারাজীবন দুই সন্তান বুকে আঁকড়ে আতঙ্কে দিন কাটানো অজিতকে সে শিখিয়ে দিয়ে গেল ভয়হীন বাঁচা। পুরোনো অজিত কৌরের ভস্ম থেকে জেগে উঠল নতুন জীবন। যে আবর্জনা প্রবল বৃষ্টিজলে ভিজল, ঝোড়ো হাওয়ায় ছত্রখান হল, তা জীবনকে উর্বর করার সারে পরিণত হল।
দুটি খণ্ডের অনুবাদই অসাধারণ। তবে কোথাও উল্লেখ নেই মূল পাঞ্জাবি থেকে অনুবাদ কি না। আর একবার কলকাতা বইমেলার (২০০৯) সময় অজিত কৌরের সঙ্গে দুদিন কাটানোর সুযোগ হয়েছিল এই আলোচকের। তাঁকে মহাশ্বেতা দেবীর বাড়িও নিয়ে যেতে হয়। গাড়িতে তিনি কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন জিপসি নদীর ধারা নামটা তাঁর বড্ড লিরিক্যাল লাগে। স্থায়ী আবাসহীন অপরাধী জাতি হিসেবে চিহ্নিত প্রান্তিক জীবনের রুক্ষতা এতে ধরা পড়ে না। জানি না, দ্বিতীয় খণ্ডের বাংলা নাম আবর্জনা দেখে তিনি কী বলেছেন। ছাইগাদা নামটা অনেক বেশি যেত মনে হচ্ছে যে!
পড়শির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার বাইরেও অনেক কিছু এই লেখায় । ভালো লাগল।
"লেখে নিজেদের ক্ষতচিহ্নগুলো লুকিয়ে বেড়ানোর ভার আর বইতে পারে না বলে"।
--খাঁটি কথা। মানুষ আত্মজৈবনিক লেখা লেখে স্মৃতি ্থেকে টক্সিক বের করে দিতে এবং খানিকটা নস্টালজিয়ায় ডুব সাঁতার।
ভালো লাগল।