‘যেখানে সমভূমি শেষ আর পাহাড়ের শুরু, সেখানে থমকে দাঁড়ায় হরিণী। এতখানি পথ এসে এই প্রথম সে দোটানায়। সমতলের পথে চড়াই-উতরাই নেই, বাঁক নেই। পা ফেললে পথ এমনি এমনি গুটিয়ে যায়। পাহাড়ের চলন ভিন্ন। পায়ের গড়নও আলাদা। সে কি নতুন পথের হিসেব বুঝতে পারবে?’
কথার কথা, রামকুমার মুখোপাধ্যায়
উত্তর-পূর্বের দিকে তাকালে সত্যিই হিসেব গুলিয়ে যায়। যেমন সেখানে প্রকৃতি, তেমনি ভাষাজগত। এত বিচিত্র, এত বিশাল যে থই পাওয়া ভার। অষ্টম তপশিলভুক্ত তিনটি ভাষা সেখানে—অসমিয়া, মণিপুরি আর বোড়ো। এ ছাড়াও আছে অজস্র ভাষা যাদের রয়েছে লোক ও আধুনিক সাহিত্যের বর্ণাঢ্য সম্ভার। যেমন মিজো, খাসি, গারো, ছিলোমিলো, মিসিং, লেপচা এবং আরও অসংখ্য ভাষা। রয়েছে লাই, বংচের, মগ ভাষা যাদের এতদিন লিখিত সাহিত্য বলে কিছু ছিল না।
আগরতলার নজরুল কলাক্ষেত্রে বসা লোক উৎসবে শোনা গেছে টেনিডি, হালাম, ডিমাসা, চিরুর মতো ভাষার নাম।
সাইনো-তিব্বতি ভাষাশ্রেণির অন্তর্গত বোড়ো, উত্তর-পূর্ব ভারতের বোড়ো জনগোষ্ঠীর ভাষা। এটি এখন অষ্টম তপশিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগে অসমিয়া ও রোমান লিপিতে লেখা হলেও বর্তমানে এই ভাষা দেবনাগরি লিপিতে লেখা হয়।
তবে কিছুকাল আগেও বোড়ো আটকে ছিল মুখের ভাষায়। তার মুক্তি ঘটল গত শতকের ছয়ের দশকের গোড়ায় বোড়ো নেতাদের অক্লান্ত প্রয়াসে। মাধ্যমিক স্তর ছাড়িয়ে বোড়ো এখন স্নাতকোত্তর শ্রেণির পড়াশোনার বিষয়।
বোড়োর সঙ্গে মিল আছে আকাস, কাছারি, গারো প্রভৃতি ভাষার। অসমিয়ার সঙ্গে এর মিল দেখতে পেয়েছেন অনেক ভাষাবিদ। বোড়ো সাহিত্যের মুখপাত হয় বীরবর পত্রিকায় সতীশচন্দ্র বসুমাতারির (১৯০১-১৯৭৪) সম্পাদনায়। সেটা ১৯২৪ সালের কথা। বোড়ো ছাত্র সম্মিলনী ভাষা ও সাহিত্যের প্রসারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগ, গুরুদেব কালীচরণ ব্রহ্মের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলন এবং বিবার জেন্থকা, হাথরসি হালা প্রভৃতি পত্রিকার প্রকাশনা বোড়ো সাহিত্যকে পথ চলার প্রেরণা জোগায়। ১৯৫২ সালে বোড়ো সাহিত্যসভার প্রতিষ্ঠা তাকে পূর্ণ বিকাশের পথ করে দেয়। প্রসেনজিত ব্রহ্ম, অরবিন্দ উজির, সুরথ নার্জারী, চিত্তরঞ্জন মোসাহারি, কান্তেশ্বর ব্রহ্ম এবং আরও অনেক কবি গল্পকার ঔপন্যাসিক বোড়ো সাহিত্যের ক্ষুদ্র চারাটিকে বর্তমানের মহীরূহ করেছেন।
একথা বললে অনৃতভাষণ হবে না যে বাঙালি তথা ভারতীয় পাঠকের প্রায় কোনো ধারণাই ছিল না বোড়ো গল্প সম্পর্কে। প্রকৃত প্রস্তাবে বোড়ো শব্দটি বোড়োল্যান্ড আন্দোলনের অনুষঙ্গ ছাড়া শুনেছেন বা ক-জন? কিন্তু হিংসা বা ধ্বংস নয়, বোড়ো সাহিত্যে আর সব ভারতীয় ভাষার সাহিত্যের মতোই সৃজনেরই সুবাস। কিন্তু এতদিন বাঙালি পাঠকের কাছে সে সৌরভ এসে পৌঁছোয়নি। সেই অভাব দূর হল সাহিত্য অকাদেমির বোড়ো গল্প সংকলনটি পেয়ে। একসঙ্গে উনিশ জন আধুনিক লেখকের গল্প আমাদের একদম অপরিচিত ভষার সাহিত্যের আস্বাদের সুযোগ করে দেয়। গল্পগুলি অনুবাদ করেছেন যাঁরা, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই বাংলাভাষার সুপরিচিত লেখক, যা এই সংকলনের বাড়তি আকর্ষণ।
গল্পগুলি পড়তে পড়তে মনেই হয় না বোড়ো সাহিত্য মাত্র ছ-দশক ধরে যাত্রা শুরু করেছে। প্রকৃতি, প্রান্তিক মানুষ, রক্ষণশীলতা বনাম আধুনিকতার সংঘাত থেকে নিসর্গের শরীরী ভাষা, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সবই ছুঁয়ে ফেলেছে বোড়ো সাহিত্য।
বোড়ো গ্রাম। ছবিসৌজন্য https://footloosedev.com
উদাহরণ হিসেবে প্রখ্যাত বোড়ো লেখিকা অঞ্জু বসুমাতারির ‘পরীক্ষা’ গল্পটি। মাত্র দু-পাতার এই গল্পটি এক যোদ্ধার প্রথম মানুষ খুনের সাফল্য-পরবর্তী সংকট নিয়ে।
‘সে পরীক্ষায় সফল হয়েছি আমি, কিন্তু বুকে কোনও উচ্ছ্বাস নেই আমার। যেন কাঁটার খোঁচায় মনে ভার হয়ে আছে।’ কাকে গুলি করেছে সে? লেফটেন্যান্ট নির্দেশ দিয়েছিল টার্গেটকে গুলি করতে হবে, নইলে তাকেই গুলি করে শেষ করে দেওয়া হবে।
‘লোকটা কে? ওই শূন্য প্রান্তরে বেচারা মানুষটা। তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছে ও? কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে, ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড়... আমার হাত কাঁপছে।। খসে পড়ে যাচ্ছে।। মন চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও। আমার গরিব বাবার মুখখানা ভেসে উঠছে মাথার ভেতরে। ভেসে উঠছে যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে ওঠা আমার মায়ের মুখখানি। কেমন আছে ওরা? বাড়ি ছেড়ে আসার পর আর তো দেখা হয়নি। আর নাবলে? কেমন আছে সে? বুক মোচড় দিয়ে উঠল আমার। টুকরো টুকরো হয়ে গেছে আমার সমস্ত স্বপ্ন। উনুনের ওপর আথালে (উনুনের ওপর উঁচুতে রাখা বাঁশের তাক যেখানে শুকনো করার জন্য নানা জিনিস ঝোলানো থাকে।) যেখানে শূন্যে ঝুলতে থাকে হাজার জিনিস, সেখানেই যেন পড়ে রয়েছে আমার হৃদয়।’
এইভাবে দ্বিধাদীর্ণ হতে হতে চরম মুহূর্ত আসে, যখন টার্গেটকে গুলি করে হত্যা করে সেই যোদ্ধা। কিন্তু আসলে তো সে-ই মারা যায়, মৃত্যু হয় মনুষ্যত্বের।
বাঙলা মাধ্যম আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দ্বন্দ্ব বহুকালের, যদিও এখন বাঙলা মাধ্যম স্কুল পিছিয়ে পড়েছে, ইংরেজি মাধ্যমেরই রমরমা। তার সামাজিক-অর্থনৈতিক অনেক কারণ থাকতে পারে। সে নিয়ে একসময় অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়ে আপাতত স্তিমিত। সেই বিষয়টিই নতুন করে ভাবালেন নন্দেশ্বর দইমারী তাঁর ‘চ্যালেঞ্জ’ গল্পে। গল্পের বিষয় যে বোড়ো মাধ্যম বনাম ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। বইসাগু আর দৌহারু একই স্কুলে পড়ত। বইসাগু ছিল পড়াশোনায় ভালো আর দৌহারু অমনোযোগী। এখন বইসাগু একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক, সেখানে দৌহারু খুব কষ্ট করে তার ছেলে লিনকনকে পড়াচ্ছে। তার টিফিন পোশাক পরিচ্ছদ সব কিছুতেই তার অতি যত্ন। এটা দেখতে দেখতে বইসাগুর মনে জমে ওঠে বেদনা। সে দুই মাধ্যমের স্কুলের একটা তুলনামূলক আলোচনা করে। সে স্থির করে সে বোড়ো স্কুল খুলবে। মাতৃভাষার সেবা করার শুভ সংকল্প দিয়ে গল্পটি শেষ হয়। এখানে বইসাগুর পর্যবেক্ষণগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
‘... ম্যাট্রিকের ফলাফলেও এমনকি বোড়ো মাধ্যমের ছাত্রেরা আর ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেদের হারাতে পারছে না।
তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, বোড়ো মাধ্যমের অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি। বাস্তবে দেখা যায় ইংরেজি মাধ্যমের অভিভাবকেরা অনেক বেশি যত্নবান হয় পড়াশোনার ব্যাপারে। কিন্তু কতজন বোড়ো অভিভাবক শিশুদের পড়াশোনার বিষয়ে যত্ন নেন?
ইংরেজি মাধ্যমের অভিভাবকেরা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণে পোশাক পরিচ্ছদ, খাবার এইসবের ব্যবস্থা করে। ইংরেজি স্কুলের শিশুদের কোনো অভাবই নেই। স্কুলের প্রতিটি নিয়মের প্রতি আমরা অনুগত। কিন্তু বোড়ো স্কুলের শিশুদের ক্ষেত্রে একটা জ্যামিতি বক্স কেনার কথাও ভাবতে পারি না। এমনকি একটা পেনসিল দিতেও ভুলে যাই। যদি কোনো শিশু ফেল করে তবে আমরা শিক্ষকদের কাছে গিয়ে ঝগড়া করতে লজ্জা বোধ করি না’
তাই বইসাগু স্বপ্ন দেখে ইংরেজি মাধ্যমের এই নিয়মকানুন দিয়ে একটা বোড়ো স্কুল খুলবে, যেখানে অভিভাবকরা শিশুদের শিক্ষার প্রতি যত্নবান হবেন। কারণ ‘আমি তো আমার মাতৃভাষাকে ঘৃণা করতে পারি না... এবং মাতৃভাষার উন্নতি করারও দায়িত্ব আছে আমাদের’
আহা আমরাও যদি এভাবে ভাবতে পারতাম।
অসাধারণ একটি গল্প নীলকমল ব্রহ্মের ‘ভোঁতা তলোয়ার’। যেখানে একটি বনবাংলোয় বনমন্ত্রী আসবেন, তাঁকে হরিণের মাংস খাওয়াবার প্রস্তুতি চলছে। বিপন্ন পরিবেশ, বিপন্ন সংস্কৃতি কারণ রাজনীতির জুয়াড়িদের হাতের পুতুল বুদ্ধিজীবীরা। হরিণ শিকার করে চামড়া ছাড়াবার সময় ধরা পড়ে তার পেটে একটি হরিণ শাবক। এই বন্য পশু যেমন রক্ষা পায়নি, তেমনি রক্ষা পাচ্ছে না মানুষও। প্রকৃতির মতো বিপন্ন বোড়ো মানুষও।
‘বোড়ো জাতির লোকেরা আজ ফসিলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বুদ্ধিজীবীরা শাসক দলের পুতুল, বোড়োদের রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতারা এস্কেপিস্ট। বোড়োরা আজ নিজভূমে পরবাসী, নিজেদের জায়গাতেই সংখ্যালঘু। অর্থনীতির চাবিকাঠি বহিরাগতদের হাতে, বোড়োদের চারিদিকে আজ হতাশা’
এই হতাশা থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে বিচ্ছিন্নতার জন্ম। যা বাড়তে বাড়তে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ায় একদিন। ভারতবর্ষে এমন ঘটে চলেছে রোজ। কিন্তু কাদের বলা হবে বহিরাগত? এই প্রশ্নটিকেও আজ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। বিজ্ঞান বলছে প্রাণ এসেছে নক্ষত্রলোক থেকে। সেই হিসেবে আমরা তো সবাই বহিরাগত, তাই না?
ভালো লাগল
ঘরের কাছের পড়শীর সাহিত্য সত্যিই অজানা ছিল। আলোচককে ধন্যবাদ। কৌতূহলী হলাম।
সত্যিই অসাধারন। প্রতিদিন নতুন কিছু জানতে পেরে নিজেকে সাহিত্যের রসে সমৃদ্ধ করতে পেরে গর্বিত অনুভবে করছি।