ভারতবর্ষে যে কতিপয় তারকা লেখক আছেন, তাঁদের অন্যতম কমলা দাস। সাহিত্যের হল অব ফেমে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন তাঁর জীবৎকালেই, এবং তা শুধু মাতৃভাষা মালয়ালমে লিখেই। যদিও ইংরেজিতেও তিনি লিখতেন, কিন্তু মালয়ালম্ই তাঁর আসল জায়গা।
১৯৮৪ সালে তাঁর নাম নোবেল প্রাইজের জন্যে মনোনীত হয়েছিল।
জীবনকাল ১৯৩৪-২০০৯। জন্ম কেরালার মালাবারে। তিনি মাধবীকুট্টি ছদ্মনামে লিখতেন। তাঁর লেখার অভিজ্ঞান তাঁর তীব্র সংরক্ত ভাষা এবং সংবেদনশীলতা।
তাঁর জীবনযাপন, প্রেম, দাম্পত্য, জীবনের শেষভাগে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ (যার পরে তাঁর নাম হয় কমলা সুরইয়া)— এইসব কারণে তিনি জীবৎকালেই হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। তাই তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশ পেলে তা আগ্রহ জাগিয়েছিল সাহিত্যের মনোযোগী পাঠকের তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও।
১৯৭৩ সালে ‘এন্তে কথা’ নামে বেরোয় মালয়ালমে লেখা এই আত্মকথা। বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই তা সাড়া ফেলে দ্যায়। তাঁর লেখায় উঠে আসে নারীর এতদিন চেপে রাখা অশ্রুত স্বর। তাঁর কলকাতার শৈশব, মালাবারের বাড়ি, বম্বের যাপন, সমকাম, শরীরী প্রেম, যৌনতা, বিষাক্ত দাম্পত্য সব তিনি তুলে ধরেন কিছু আড়াল না করে। পরে এই বইটি ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় ‘মাই স্টোরি’ নামে।
এইরকম এক আইকনিক ব্যক্তিত্বের রাখঢাকহীন জীবনী অনুবাদ করা একজন অনুবাদকের স্বপ্নের কাজ যেমন, তেমনি তা খুব চাপেরও। সে চাপ পাঠকের প্রত্যাশার চাপ। কবি ও অনুবাদক বিতস্তা ঘোষাল এই কাজে চমৎকার উতরে গেছেন। এতটাই উতরেছেন যে পড়তে পড়তে মনে হয় মূল বাংলার লেখা পড়ছি। অনুবাদ বিশ্বাসঘাতক, আর যে অনুবাদ যত সুন্দর তা তত বিশ্বাসঘাতক। বিতস্তা মূল মালয়ালম্ নয়, অনুবাদ করেছেন ইংরেজি থেকে। তাই ট্রান্সমিশন লস কতটা হয়েছে সে কূট প্রশ্নে না গিয়ে বলা যায় তাঁর অনুবাদ সুখপাঠ্য হয়েছে।
এই স্মৃতিকথার মূল কেন্দ্রে ব্রিটিশ কলকাতায় এক ভারতীয়, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ত্বকের, শিশুর বিষণ্ণ মেয়েবেলা। সেই শিশু পরে দেশভাগের বীভৎসতাও দেখে ফ্যালে, খুব অল্প পরিসরে সেই দেখা আমাদের শিউরে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট।
দেশভাগ যখন হয় তখন মালয়ালম্ লেখিকা কমলা দাস ছোটো, তাঁর বাবার চাকরিসূত্রে তাঁরা কলকাতায় থাকতেন। দেশভাগের আগেই শুরু হয়ে গেছিল বীভৎস দাঙ্গা, আর সেইসময়ই কমলা জানতে পারেন তাঁরা হিন্দু।
কলকাতায় ধর্মীয় দাঙ্গা। ১৯৪৬। পড়ে আছে মৃতদেহ, চলছে জীবন।
‘১৯৪৭-র প্রথম দিকে কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হল। স্কুলে সকলে বলল হিন্দুরা স্কুলে ঢুকে পিয়ন আওলাদকে বের করে খুন করতে এসেছিল। ঘটনা হল যে একজন শিক্ষিকা তাকে তার বিছানার তলায় লুকিয়ে রেখেছিল।
শুক্রবার সাড়ে পাঁচটায় আমার চোখ পরীক্ষা করার জন্য ডঃ আহমেদের কাছে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বৃহস্পতিবার কয়েকজন হিন্দু তাকে কুপিয়ে মেরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল। কাছে-দূরে সব জায়গা থেকেই আমরা দাঙ্গাবাজদের শ্লোগান শুনতে পাচ্ছিলাম, তারা রাতে অন্ধকারে তাদের পোস্টার আর অস্ত্র নিয়ে মিছিল করে হাঁটছিল।
স্কুল ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল, আমরা শুধু ভাত, ডালই খাচ্ছিলাম দুপুরে ও রাতে। কোথাও কোন সব্জি পাওয়া যাচ্ছিল না। মাংসও নয়। মালাবার যাওয়া বা ঠাম্মার সঙ্গে যোগাযোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ডাক ব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়েছিল। একদিন দেখলাম এক লরি ভর্তি মানুষ, বেশির ভাগই শিখ—সবাই হাসছে আর লরির মাথায় আটকানো শূলবিদ্ধ এক বৃদ্ধার হলুদ দেহ।
মরফেদ ছাড়াও নরেশ নামে এক ড্রাইভার বাবাকে অফিস পৌঁছে দিত। ছেলেটি খুবই কাজের ও বুদ্ধিমান। সে একই সঙ্গে মুসলমানের ফেজ টুপি আর হিন্দুর পাগড়ি রাখত নিজের কাছে, যখন পার্ক সার্কাসের কাছ দিয়ে যেত, যেহেতু সেটা মুসলিম অঞ্চল, তাই তাদের বোকা বানাবার জন্যে টুপি পরে নিত। আবার হিন্দু অঞ্চলে পাগড়ি...’
কমলা ও তাঁর ভাই সাহেবি স্কুলে চরম হেনস্থা হতেন গায়ের রং কালো বলে। তাঁর ভাইয়ের নাকে পেনসিল ঢুকিয়ে রক্ত বার করে দিত সাদা চামড়ার সহপাঠীরা। স্কুলে বর্ণবৈষম্য, বাড়িতে কবি মায়ের উদাসীনতা মনে পড়িয়ে দেয় স্বর্ণকুমারী দেবী আর সরলা দেবীর সম্পর্ককে। স্নেহহীন নিঃসঙ্গতা, আর সেই নিঃসঙ্গতা থেকেই এক বাঙালি আর্টিস্টের প্রেমে পড়া। যদিও সেই যুবক অন্যভাষী এই কিশোরীর প্রেমকে মোটেই পাত্তা দেয়নি। কমলার এই স্মৃতিকথায় কলকাতাও কিন্তু একটা চরিত্র। সেই সময়ের শহর এবং বাঙালি নাগরিকদের কথা চমৎকার উঠে এসেছে কমলার মাই স্টোরিতে।
‘বাঙালি অভিজাত-তন্ত্র’ নামের একটি অধ্যায়ে আছে তাঁদের ল্যান্সডাউন রোডের বাড়ির কথা, যার উলটোদিকে ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা খ্যাত বিধবা রানি থাকতেন, যিনি সাদা শাড়ি পরে বাগানে ঘুরতেন। বাড়ির বাঁপাশে ছিল বিরাট এক ধনী পরিবার, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিখ্যাত ব্যক্তিরা সে বাড়িতে আসা যাওয়া করত। গৃহকর্ত্রী ডাইনিং টেবিলের কাছে বসে রাঁধুনিকে নির্দেশ দিতেন আর স্যালাডের আনাজ কুটতেন। সে বাড়ির বিশাল মোটা ছোটো ছেলে এসে কমলাদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলত আর মাঝে মাঝেই আইসক্রিম খাবার পয়সা চাইত। ‘আইসক্রিমওলা তার সাইকেলে হলুদ রঙের একটা বাক্স নিয়ে আইসক্রিম ম্যাগনোলিয়া, আইসক্রিম ম্যাগনোলিয়া বলে সুর করে ডাকতে ডাকতে যেত।’
ডানদিকে এক ভগ্নপ্রায় মধুপুরের জমিদারবাড়িতে থাকত কমলার বন্ধু শান্ত, তার চিবুকে তিল ছিল। এই বিউটি স্পট নিয়ে খুব গর্ব ছিল তার। সে ব্রজবাসীর কাছে মণিপুরি নাচ শিখতে যেত। সেই বাড়িতে ছিল মূল্যবান পাথরের ছোটো ছোটো মূর্তি, ঘড়ি, বাদামি রঙের পারসি কার্পেট, দামি সিল্কের হলুদ ফিতেওয়ালা পর্দা।
এসব দেখে কিশোরী কমলা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করত তাকে খুব ধনী করে দিতে, যাতে সে একটা পুরোনো ম্যানসনে যেখানে অনেক স্ট্যাচু, রুপা, পুরোনো জরি আর অনেক লোক, সেখানে থাকতে পারে। সে চেয়েছিল ধনী কোনো জমিদারকে বিয়ে করে কলকাতাতেই থাকতে। এগুলো ছাড়া নিজেকে সামাজিক মর্যাদাহীন বলে মনে হচ্ছিল তার।
ল্যান্সডাউন মানে তো আজকের শরৎ বোস রোড। ঠিক কোন্ বাড়িটায় থাকতেন কমলারা? আশেপাশের এই বাঙালি পরিবারগুলিই বা কারা? এটা খুঁজে বার করা বেশ চিত্তাকর্ষক একটা কাজ হতে পারে। ভারতীয় জাদুঘরের পেছনের একটি রাস্তায় একবার চমকে দেখেছিলাম একটা বাড়ির দেয়ালে উৎকীর্ণ সেখানে লেখক থ্যাকারে থাকতেন। এইরকম কিছু কি আমরাও করতে পারি না?
স্কুলে পড়তে কমলার সবচেয়ে চতুর মনে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ধনী পরিবারের মেয়েদের ‘ ... তারা দ্রুত কথা বলত আর সব কিছু থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখত। তারা শরতবাবুর নভেল নিয়ে কথা বলেই যেত আর রবীন্দ্রসংগীত গাইত, তাদের দুপুরের খাবার স্কুলে চাকরেরা বড় বড় চকচকে টিফিন কৌটো করে আনত, যার ভিতরের লাল থকথকে করে রাঁধা মাছের কালিয়া, ভাত, ভাজা চিংড়ি আর ক্রিম দেয়া মিষ্টির সুগন্ধ সারা ক্লাসরুমে ছড়িয়ে পড়ত।’
এসব সত্ত্বেও কমলা বাঙালি মেয়েদের মতোই হতে চাইতেন। ‘আমি একটা সাদা লাল পেড়ে শাড়ি কিনেছিলাম ঠিক যেমন বাঙালি চাষির বউরা পরে আর চেষ্টা করতাম ওটা পরে আমার মধ্যে ছেলেসুলভ যে গঠন তাকে ঢেকে ফেলতে’
সেই সময় শরীরের তীব্র বোধ জাগছিল, পুরুষের প্রেম না পেয়ে সে শরীর হস্টেলের এক বান্ধবীকেও সাড়া দিতে প্রস্তুত ছিল আর সেইসময়েই তাঁর বিয়ে দেওয়া হল। কমলা এসে দাঁড়ালেন শরীরসর্বস্ব অপমানের দাম্পত্যের মুখোমুখি।
যেমন কলকাতা, তেমন এসেছে মালাবার, নালাপাত হাউস আর তার সর্প মন্দির আর নির্মাতলা ফুলের অলীক গন্ধ।
কমলার শৈশবের মালাবার ছিল আশ্চর্য সুন্দর।
‘পূর্বে ও উত্তরে ধানের দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত, পশ্চিমে নীল আরব সাগরের গর্জন। সর্প মন্দিরের কাছে দুর্মূল্য নির্মাতলা গাছ যাতে প্রতি গ্রীষ্মে গাঢ় মাখন রঙের গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফোটে, তার সুগন্ধ বাড়ির ভিতর অব্দি ভেসে আসে।’
এই সৌন্দর্য অম্বরের গন্ধের মধ্যে কমলার মনোজগতে ঢেউ তুলছিল। তাঁর রক্তে মা ও বাবার দিক থেকে কবিতা তো ছিলই। তাঁর বড়ো ঠাম্মার ছোটো বোনের কবিতা তিনি পড়েন তাঁর মৃত্যুর তিরিশ বছর পর। সেই কবিতা তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিল। মনে হল এই কবিতার মাধ্যমেই সেই মৃত নারী কমলা এবং বাকি পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। কবিতার শক্তি সেই প্রথম টের পেলেন কমলা। কিন্তু সত্যিকারের কবি হবার ধাক্কা তিনি পেলেন একটি অসফল বিবাহ থেকে। কী অসাধারণ সেই অংশটি।
“এই সময় আমার স্বামী আবার তাঁর পুরনো বন্ধুর কাছে ফিরে গেল। তাঁরা আমার সামনেই প্রেমিক-প্রেমিকার মত আচরণ করত। আমার জন্মদিনের দিন তারা আমাকে বেডরুমের বাইরে বার করে দিয়ে নিজেরা সেখানে ঢুকে গেল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম তারা শারীরিক মিলনে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার মর্যাদাবোধ আমায় সেখান থেকে সরিয়ে আনল। ছেলের কাছে গিয়ে শুলাম। আমার ভেতর থেকে কোন এক শক্তি জেগে উঠল। আমার বুক ভারি হয়ে উঠল, আমার ভিতরের আমি, আত্মা সব রক্তাক্ত। ছেলে জিজ্ঞেস করল ‘তুমি কাঁদছ কেন মা?’ আমি মাথা নেড়ে বললাম। কিছু হয়নি, কিছু না...।
কমলা দাস ও তাঁর স্বামী কে. মাধব দাস
রাতে যখন স্বামীর কাছে শুতে গেলাম দেখলাম তাঁর আর আমার প্রতি কোন ভালবাসা নেই। এক রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে আমি ছাদে গেলাম। ওপর থেকে নিস্তব্ধ রাস্তা, কলোনি দেখা যাচ্ছিল। চাঁদের আলো রাস্তায়।
এক মুহূর্তের জন্যে আমার নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল। চাঁদকে মনে হল সে এরই অপেক্ষায়। ল্যাম্পপোস্টের নিচে এক পাগল নিজের মত নাচ করছিল দুহাত তুলে আর কিছু বলছিল। তার সেই নাচের ছন্দে আমিও নাচতে শুরু করলাম। এলোচুল আমার মুখে এসে পড়ল। সে সময় সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি নাচতে লাগলাম, যেন শেষ মানুষ জন্মের নাচ...।
ঘরে ফিরলাম সেই নোংরা সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে। বসার ঘরে আলো জ্বালিয়ে আমি লিখতে বসলাম... আমার নতুন জীবন, এক নিশ্চিত ভবিষ্যতের লেখা...”
কমলার কলম দিয়ে তখন মধু ঝরছিল। এভাবেই জন্ম হল এক শক্তিশালী কবির।
অনেক ভালোবাসা।