কিছুদিন আগে মূল মৈথিলি থেকে কবি অজিত আজাদের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে দুটি একটি কবিতার ক্ষেত্রে সমস্যা হল। ‘চম্পা ঋতুস্নান করো না’ শীর্ষক কবিতায় মেয়েদের ঋতুকালীন নানান বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। অসাধারণ প্রতিবাদী কবিতাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে ‘চম্পা, তুমি সব অনুষ্ঠানে হেগেমুতে দাও’। লেখার মেজাজ ধরে রাখতে গেলে মূলের কোনো পরিবর্তন করা যায় না, কিন্তু কবিতাটি পড়ে অনেকেই ঠিক হজম করতে পারলেন না, বাঙালি পাঠকের শালীনতার ধারণায় কোথায় যেন আঘাত করল। আবার কোনো তুলনায় অনগ্রসর সমাজের রচিত সাহিত্য বাংলায় অনুবাদের সময় প্রাসঙ্গিকতা মাথায় রাখতে হয়। বাঙালি সমাজ যা ২০০ বছর আগে ফেলে এসেছে, সেই বিষয়ে লেখার বাংলা অনুবাদ কতটা পাঠকপ্রিয় হবে তা ভাবতে হয় বইকি।
তাই অনুবাদের ক্ষেত্রে কী অনুবাদ করব এবং কেন অনুবাদ করব, তা বেশ চিন্তাভাবনার বিষয়। কিন্তু অনুবাদ মূল থেকে করা হবে না লিংক ল্যাঙ্গয়েজের মাধ্যমে, অনুবাদের ভাষা কী হবে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা চোখে পড়লেও, কোন্ টেক্সট অনুবাদ করা উচিত, তা নিয়ে কিন্তু বিশেষ চিন্তা ভাবনা বা আলোচনা চোখে পড়ে না। এই ব্যাপারগুলো প্রকট হয়, যখন ভারতীয় ভাষার গল্প বা কোনো বিশেষ লেখকের বারো বা পনেরোটি গল্প বেছে এক-একজন অনুবাদক একটি সংকলন বার করে ফেলেন। খুবই প্রত্যশিত, বাঙালি পাঠক সেই ভাষার বা সেই লেখকের গল্প প্রথম পড়ছেন, তাই তাঁর প্রতিনিধিত্বমূলক গল্পই বাছা উচিত। একবার কর্তার সিং দুগগলের একটি গল্পগ্রন্থে এমন একটি গল্প সংকলিত হতে দেখেছি, যা এই সময়ে নারীর অবস্থানের প্রেক্ষিতে আদৌ পলিটিকালি কারেক্ট নয়। অর্থাৎ পছন্দ হল আর অনুবাদ করে ফেললাম—এইভাবে অনেক কিছুই অনুবাদ করা যায়, কিন্তু সেগুলি গ্রন্থভুক্ত করতে গেলে তার একটি দর্শন থাকতে হবে। একসময় আমাদের দেশে অনুবাদ কিন্তু কোনো না কোনো মহৎ প্রেরণা থেকে হয়েছে।
“With regard to the translation of English or European texts into Indian languages, there were notable examples like Bharatendu’s Hindi translation of Shakespeare, Premchand’s Hindi translation of John Galsworthy’s plays, as also Hindi versions of Alexander Pope, Matthew Arnold and Edward Fitzgerald’s Rubaiyat of Omar Khayyam. Translations amongst different Indian languages were a special feature of the Indian Renaissance and helped build the nation during the freedom struggle.
Bhartendu, Ramakrishna Varma, Gopal Ram Gehamari, Roop Narayan Pandey, Dwijendranath Roy and others translated Bengali and other native language texts into Hindi. These translations during the early years of independence and the late colonial period were not profit-oriented; dedicated translators came up in many languages making a Tagore, a Sarat Chandra Chatterjee or a Premchand household names across the country” (Satchidanandan The Hindu Literary Review).
উল্লেখ্য, প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতে এমন বহু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যসৃষ্টির ভাষান্তর হয়েছে যাকে ‘ট্রানস্লেশন’ না বলে ‘ট্রাস্নক্রিয়েশন’ বলাই শ্রেয়তর। সংস্কৃত আকরগ্রন্থ বিভিন্ন পণ্ডিতের হাতে টীকা বা ভাষ্য হয়েছে, মধ্যযুগে রামায়ণ মহাভারত বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় আক্ষরিক অনুবাদ হয়নি, বরং স্বতন্ত্র একটি টেক্সট হয়ে গেছে। বাল্মীকির রাম থেকে কৃত্তিবাসের রাম তাই অনেকখানিই আলাদা। তবে সময়ে সময়ে আবার অনুবাদকের স্বাধীনতা ভয়ানক হতে পারে। উর্দুতে একসময় রবীন্দ্রনাথের গল্পের তিরিশ খণ্ড বেরিয়েছিল। দেখা গেল তাঁর অনেক কবিতাও গল্প হিসেবে অনুবাদ হয়ে গেছে। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় বলেছিলেন অনুবাদে অনেক কিছু বাদ যায় আর তর্জমায় জমা পড়ে। এ বুঝি সেই জমার হিসেব!
এই কথাগুলি মনে হল পড়শি ভাষার গল্প বইটি হাতে নিয়ে। অনুবাদের অনেক বই হাতে আসে, কিন্তু এত ওয়েল রিসার্চড একটি ভূমিকা কমই দেখা যায়। বিপ্লব নির্ভুলভাবে চিনে নিয়েছেন ভারতের অন্য ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদের সমস্যার জায়গাটা। ‘এ বাংলার লেখক পাঠকের মধ্যে একজাতীয় দ্বিষদ উন্নাসিকতা দীর্ঘকালীন। একদল ভাবেন বাংলায় যা লেখালেখি তা অন্য যে-কোনো প্রাদেশিক ভাষার চাইতে উন্নততর আর দ্বিতীয় দলের ভাবনা সরাসরি ভাষা না জানা থাকলে অনুবাদ গ্রহণযোগ্য নয়, অর্থাৎ সেই উৎস ভাষা আর লক্ষ্য ভাষার মধ্যে অপ্রতর্ক্য বিরোধ।’ সেই উচকপালেপনা আর বিবাদবিসংবাদকে ডিঙিয়ে বিপ্লব দুই মলাটের মধ্যে চোদ্দটি ভারতীয় ভাষা থেকে মোট ২৬ টি গল্প সাজিয়ে দিয়েছেন।
‘A B Zee of My India’ শিল্পী জ্যোতি ভাট। ২০০৫। ছবিসৌজন্য Asia Art Archive
সবচেয়ে বেশি গল্প নেওয়া হয়েছে ওড়িয়া আর উর্দু থেকে, চারটি করে। দেখে ভালো লাগল বাঙালি পাঠকের প্রায় অপরিচিত সিন্ধি, কাশ্মীরি আর ডোগরি থেকেও একটি করে গল্প আছে। সিংহভাগ গল্পই সংশ্লিষ্ট ভাষার দিকপালদের, যাঁদের জন্ম বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে যেমন মুলকরাজ আনন্দ, আর কে নারায়ণ, মান্টো, কালিন্দীচরণ পানিগ্রাহী প্রমুখ। এমনকি উনিশ শতকের একেবারে শেষেরও আছে, যেমন ধূমকেতু (জন্ম- ১৮৯২)। তরুণতর ওড়িয়ার জগদীশ মহান্তি বা উর্দুর জিলানি বানো। বেশ কয়েকজনের পরিচিতিতে তাঁদের জন্মসাল দেওয়া নেই, বা তাঁদের পরিচিতিই নেই। যেমন কন্নড় বা সাঁওতালি কিংবা পাঞ্জাবির গুরবক্স সিং। তবে আন্দাজ করা যায় এই সংকলনের সবচেয়ে তরুণ লেখক সাঁওতালি থেকে সুন্দর মনোজ হেমব্রম। গল্পগুলি বেশিরভাগই সাহিত্য অকাদেমি সূত্রে প্রাপ্ত। সেই জন্যেই ভাষার নামের ক্ষেত্রে সাহিত্য অকাদেমির বানান অনুসরণ করাই প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। একসঙ্গে অনেকগুলি অসাধারণ গল্প পড়ার সুযোগ পাবেন পাঠক। ভোলা যাবে না জগদীশ মহান্তির ‘ইঁদুর’ কিংবা ডোগরি গল্পকার বি পি সাদে-র ‘মুখদেখানি’ কিংবা কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহীর ‘না-মানুষী অথবা’, খাজা আহমদ আব্বাসের ‘চড়ুই’ কিংবা জিলানি বানোর ‘তামাশা’। জিলানি বানোর ‘রেললাইনের ধারে পড়ে থাকা গল্প’তে যেরকম শ্বাসরোধকারী বাস্তবতা, ‘তামাশা’ গল্পটিও তেমন। একটি মৃতপ্রায় ভিখিরি শিশু, করুণ সুরে একটা রুটি চাইছে, তাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে ওকে কাজে লাগাবার পরিকল্পনায় মেতে ওঠা পরিবার-এ গল্প সরাসরি আমাদের বুকে এসে ধাক্কা দেয়।
‘... আজরা দুম করে মনস্তত্ত্বের বইটি বন্ধ করে রান্নাঘর থেকে একটা রুটি নিয়ে এল। জোরে হেসে বলল, এইবার মজাটি দেখ। তাই বলে হতভাগীর মাথার ওপর রুটিটি দোলাতে দোলাতে সেটি ওকে খেতে বলল এবং ওর ঘাড়টি তুলে ধরতে চেষ্টা করল কিন্তু তা ভেঙে পড়েছে। হঠাৎই লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে পিছিয়ে আসে আজরা কেননা সেখানে দেখাবার মতো আর কোন মজাই অবশিষ্ট নেই’। তবে ভারতীয় ইংরেজি থেকে মুলকরাজ আনন্দ বা আর কে নারায়ণ না নিয়ে তুলনায় কম পরিচিত কাউকে অনুবাদ করাই ভালো হত। সেইভাবে ধূমকেতুর বহুপঠিত ‘চিঠি’ গল্পটি না নিয়ে অন্য গল্প নেওয়া যেত। অত্যন্ত যত্ন করে অনুবাদ করেছেন বিপ্লব। তবে কোথাও কোথাও হয়তো আরও সাবলীল হতে পারত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়:
‘অসহায়ভাবে বাতাসে এলোমেলো ঘা খেয়ে সপ্তর্ষিমণ্ডলের মতো গোছাবৃষ্টি গড়িয়ে পড়ল। অবিরাম চার মাস ঝরে ঝরে একেবারেই ক্লান্ত সে। কিন্তু নিরাশাজনক ভাবে এটাই তো তাদের কপালে ছিল’ (মারাঠি গল্প বোধিস্নান, কুসুমাবতী দেশপাণ্ডে) এখানে ‘নিরাশাজনক ভাবে’-টা যদি অন্যভাবে করা যেত! কিংবা ‘দৃঢ়তায় মনস্থির করে এবারে ওর কাছে গেলাম’ (অসমিয়া গল্প সচল মুদ্রা, রমা দাস) এখানে ‘দৃঢ়তায়’ শব্দটি অনায়াসে বাদ দেওয়া যেত। বা ‘দৃঢ়ভাবে’ লিখলে ভালো শোনাত।
তবে পাঠকের প্রাপ্তির তুলনায় এসবই ছোটো ছোটো ত্রুটি। ভূমিকায় বিপ্লব বলেছেন ‘ভারতবর্ষের মতো দেশে একমাত্র অনুবাদই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য আনতে সক্ষম। কেননা ‘Indian culture is a mosaic of many subcultures of various regional literatures—a salad of different vegetables and organic growth rather than a ‘melting pot’ in which different ethnic components swiftly melt away and lose their identity’।
সেই ঐক্যসাধনের অতীব পুণ্যকর্মটি তিনি করেছেন সংযোগকারী ভাষা ইংরেজির মাধ্যমে। তিনি ঠিকই বলেছেন, নেই মামার থেকে কানা মামা ভালো। অনুবাদকের পক্ষে হরিনাথ দে হওয়া সম্ভব নয়। তিনি বইটি উৎসর্গ করেছেন অনুবাদ সাহিত্যের নাকউঁচু সমালোচকদের উদ্দেশে। তবে এটা তো সত্যি, মূল ভাষা জানা থাকলে আরও গভীরে যাওয়া সম্ভব, সম্ভব সঠিক নির্বাচন। আর তার জন্যে চাই একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা, যাতে এক-একজন এক-একটি ভারতীয় ভাষা নিয়ে কাজ করতে পারেন। এর জন্য অনুদান এবং সহায়তা প্রয়োজন। তবেই ভাষা দিয়ে ভারতবন্ধনের স্বপ্ন সার্থক হবে।
বইটির মুদ্রণ পরিপাট্য মুগ্ধ করে। ভারতীয় সাহিত্যকে জানতে বইটি একটি জরুরি সংযোজন নিঃসন্দেহে।