ধরা যাক এ একটা নদীর গল্প। কিংবা হারিয়ে যাওয়া একটি লিপি, যে নদীর মতোই নাব্য ছিল একসময়, আর তার নামের মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে নদী। তিরহুত বা তিরহুতিয়া যার উৎস, তীরভুক্তি মানে এমন এক নদীতীর যাকে তিন-তিনবার বলিদান দ্বারা শুদ্ধ করা হয়েছে। তীরভুক্তি নামটা প্রথম পাওয়া যায় বৈশালীর কাছে বসাঢ়ের মুদ্রায় খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে। ভূগোলের তীরভুক্তি আসলে বিদেহ, প্রচীন ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে যার প্রতিপত্তি ছিল অসামান্য। সাধারণাব্দ (Common Era) চতুর্থ-পঞ্চম শতকে এর নাম হয় মিথিলা বা তীরভুক্তি।
মৈথিলি চিত্রকলা। বিবাহ-বিগ্রহ। শিল্পী পিঙ্কি কুমারী। ২০০৪। সৌজন্য: Office of Resources for International and Area Studies, Berkley
এই সেই মিথিলা যেখানে জনকের রাজসভায় যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন করে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিলেন মনস্বিনী গার্গী “নক্ষত্রলোক কীসে ওতপ্রোত?’ তাঁর সঙ্গে পেরে না উঠে তর্কযুদ্ধের সব শালীনতা অতিক্রম করে যাজ্ঞবল্ক্য বলে উঠেছিলেন, “অতি প্রশ্ন করো না গার্গী, তোমার মস্তক খসে পড়বে” সেই মিথিলার মেয়ে জানকী শর্ত সাপেক্ষ দাম্পত্যের চেয়ে শ্রেয় মনে করেছিলেন বসুন্ধরার কোলকে।
শতপথ ব্রাহ্মণের (পূর্ব সাধারণাব্দ—Before Common Era—১০০০-৬০০) বিদেহর সীমা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সদানীরা নদীকে (যার অন্য নামগুলি গণ্ডক রাপ্তী, করতোয়া) যা কৌশল থেকে বিদেহকে আলাদা করেছিল। বৃহৎ বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে পূর্বে কৌশিকী, পশ্চিমে গণ্ডকী, দক্ষিণে গঙ্গা ও উত্তরে হিমালয় দ্বারা পরিবৃত মিথিলা।
শুধু তো দেশের নয়, ভাষারও একটা নিজস্ব ভূগোল আছে, তারও সীমারেখা নির্দিষ্ট করে গেছেন জর্জ এ গ্রিয়ারসন। উনিশ শতকে এই মানুষটি মৈথিলি ভাষা নিয়ে যে মাপের কাজ করে গেছেন তা এককথায় অবিশ্বাস্য। সেই গ্রিয়ারসন বলেছেন, “প্রাচীন মিথিলার ভাষার ওপর পশ্চিম প্রান্তে হিন্দি (ভোজপুরি) অনধিকার প্রবেশ করে এবং তা যেন প্রতিশোধ রূপে গঙ্গা পেরিয়ে উত্তর পটনা এবং মুঙ্গের ও ভাগলপুর জেলার দক্ষিণ প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া কাশী পেরিয়ে পূর্ণিয়াও অধিকার করে।”
জর্জ এব্রাহ্যাম গ্রিয়ারসন (১৮৫১-১৯৪১)
এখন মৈথিলি ভাষায় কথা বলে উত্তর-পূর্ব বিহারের ২৬ টি জেলার প্রায় ৩ কোটি মানুষ। এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালের ১২ শতাংশ মানুষ। ভাষাদিবসে যখন আমরা পূর্ববঙ্গ এবং শিলচরের ভাষা শহিদদের স্মরণ করি, তখন কজন মনে রাখি রঞ্জু ঝা-কে, নেপালের অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী রঞ্জু ঝা, যিনি মৈথিলি ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন?
ভারতের যে অঞ্চলে মৈথিলি ভাষা প্রচিলত তা সবুজে চিহ্নিত। সৌজন্য: Derivative of India-locator-map-blank.svg
এখানে শুনুন রঞ্জু ঝা-র কণ্ঠে মৈথিলি গান
যেমন মৈথিলি ভাষা, তেমনি মৈথিলি সাহিত্য। এর মধ্যে মিশে আছে অনেকখানি আবেগ, স্বাভিমান আর মাটির জোর। আগে যখন তিরহুতিয়া লিপিতে মৈথিলি লেখা হত, তখন বাংলা লিপির সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য থাকা এই লিপির কারণে বাংলা ও মৈথিলি ভাষা বড়ো কাছাকাছি ছিল।
মৈথিলি ভাষায় প্রথম সাহিত্য নিদর্শন জ্যোতিরীশ্বর ঠাকুরের বর্ণরত্নাকর (১৩২৪ সাধারণাব্দ)। এরপরে আবির্ভাব হয় যুগান্তকারী কবি বিদ্যাপতি ঠাকুরের ( ১৩৬০-১৪৫০ সাধারণাব্দ), বহু বাঙালি যাকে আজও বাঙালি ভাবতে ভালোবাসেন।
এটা খুবই পরিতাপের যে, বিদ্যাপতি নিয়ে বাঙালি প্রভূত হইচই করলেও বিদ্যাপতি-পরবর্তী মৈথিলি কবিতা সম্পর্কে তারা প্রায় কোনো খবরই রাখেন না। যতদূর জানি, বাঙলা অনুবাদে মৈথিলি কবিতার তিনটি মাত্র গ্রন্থ আছে। একটি, আজ আমাদের আলোচ্য বই—কালিদাস কোঙারের সম্পাদনা আর অনুবাদে মৈথিলি কবিতা, দ্বিতীয়টি সাহিত্য অকাদেমির অনুবাদ কর্মশালায় অনূদিত উদয়নারায়ণ সিংহের সম্পাদনায় অনুকৃতি। আর তৃতীয়টি একক মৈথিলি কবির কাব্যগ্রন্থ—অজিত আজাদের কবিতা, এই আলোচকের অনুবাদ আর সম্পাদনায়।
আজকের আলোচনা প্রথম বইটিকে নিয়ে। সংকলনটিতে কবিতা সাজানো হয়েছে কালানুক্রমিকভাবে। শুরু ১৯০৬ সালে জন্মানো কবি কাঞ্চীনাথ ঝা সুমনকে দিয়ে এবং শেষ ১৯৭৬ সালে জন্মানো অবিনাশকে দিয়ে। এর মধ্যে জায়গা পেয়েছেন ৪৭ জন কবি, যাদের মধ্যে মাত্র দুজন নারী—বিভারানী এবং সুস্মিতা পাঠক। রয়েছেন ধূমকেতু, নচিকেতা, তারানাথ বিয়োগীর মতো বিখ্যাত সব কবিরা। প্রত্যেক কবির একটি বিশদ পরিচিতি দেওয়া আছে।
যখন এ ধরনের কোনো সংকলনে কেউ হাত দেন তখন তাঁর সামনে কয়েকটি রাস্তা খোলা থাকে—
১। কালানুক্রমিক সংকলন অর্থাৎ প্রাচীন কবি থেকে নবীন কবি।
২। বিষয়ভিত্তিক সংকলন। হতে পারে মৈথিলি প্রেমের কবিতা। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কালানুক্রমিকতা রাখা দরকার। তাহলে মৈথিলি প্রেমের কবিতার কী বিবর্তন হয়েছে, যুগের কী ছাপ এসে পড়েছে, তা আমরা সহজেই বুঝতে পারব।
৩। লিঙ্গভিত্তিক। হতে পারে মৈথিলি নারীদের কবিতা।
৪। সময়ভিত্তিক—এই সময়ের মৈথিলি কবিতা।
৫। ওপরের কোনোটাই নয়, একটা পরিকল্পনাহীন, যা পাওয়া গেছে তাই নিয়ে কোনোরকমে খাড়া করা সংকলন।
বাংলায় যেসব অন্য ভারতীয় ভাষার কবিতা বা গল্প সংগ্রহ চোখে পড়ে, তার বেশিরভাগই এই পঞ্চম বর্গের। তার কারণ, পড়শি ভাষার সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাস জানা থাকে না, তাই এদিক-সেদিক থেকে খামচা খামচা করে নিয়ে একটা সংকলন দাঁড় করানো হয়।
সুখের কথা, কালীকৃষ্ণ কোঙারের কাজের মধ্যে একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট। অনেকটা কপি বুক ক্রিকেটের মতো তিনি প্রায় নিখুঁত ভাবে মৈথিলি কবিতার (১৯০৬-১৯৭৬) এই সত্তর বছর অর্থাৎ সাতটি দশককে ধরেছেন। তাই একটা সময় পর্যন্ত বইটি বিশ্বাসযোগ্য রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়। তবে সব সংকলনের মতো এটিও একেবারে বিতর্কের ঊর্ধ্বে বলা যায় না। বাদ গিয়েছেন সুরেন্দ্র ঝা সুমন বা শেফালিকা ঝা-র মাপের কবিরা যাঁরা এই সময়কালেই পড়েন। কেন তাঁদের কবিতা নেই, তার যুক্তি দিয়ে একটি বিশদ ভূমিকা থাকা প্রয়োজন ছিল। এই ধরনের অনুবাদ গ্রন্থে ভূমিকা কিন্তু অপরিহার্য যাতে জানা যাবে কবি নির্বাচনের ব্যাপারে কোন্ মানদণ্ড তিনি ব্যবহার করেছেন, ভাষার ক্ষেত্রেই বা তাঁর পরিকল্পনা কী ছিল। এই ব্যাপারে নিদা ফজলির উর্দু কবিতার অনুবাদে অনুবাদক অরুণা মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকাটি অনুসরণযোগ্য।
সেই হিসেবে খুবই সংক্ষিপ্ত, অগভীর একটি ভূমিকা লিখেছেন কালীকৃষ্ণ, তবে তাতে কয়েকটি মূল্যবান কথা আছে—
“... এমন অবস্থা মৈথিলিতে যে একটি আধুনিক সাহিত্য আছে তা আমরা অনেকেই খোঁজ রাখি না। তার অন্যতম কারণ হল বাঙালির উন্নাসিক মানসিকতা... জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে এবং মৈথিলি ভাষার প্রতি আন্তরিক দুর্বলতায় আমি এই সংকলনটি প্রস্তুত করেছি। কারণ আমি দেখেছি যোগ্যতর লোকেরা প্রায়শই এইসব কাজ আমাদের করার জন্য ফেলে রাখেন।”
হয়তো ‘যোগ্যতর লোকরা’ এমন একটি প্রকাণ্ড কাজে হাত দিতেই ভয় পাবেন। এতগুলি কবিতা সংগ্রহ এবং অনুবাদ অতি কঠিন কাজ।
তাঁর নির্বাচিত কবিতাগুলিতে উঠে এসেছে গ্রামকেন্দ্রিক মৈথিলি লোকজীবন, সমাজকে কষাঘাত, শ্লেষ এবং অবশ্যই নগরায়ণের যন্ত্রণা।
বিখ্যাত কবি যাত্রী (জন্ম ১৯১১) (ইনিই হিন্দির প্রখ্যাত নাগার্জুন) যেমন লেখেন ‘কৌশিকীর স্রোত’—
“নৌকায় বসে যখন পাড়ি দিচ্ছিলাম
কৌশিকীর স্রোত
দেখে তখন তার রুদ্ররূপ...
মনে পড়ছিল ডুবে ধ্বংস হওয়া নৌকাকে
কলেরা ম্যালেরিয়ায় শূন্য বাস্তুভিটে, শূন্য গ্রাম”
আবার ‘রাধিকা’ কবিতায় কটাক্ষ আধুনিক রাধিকাদের প্রতি—
“বব করা চুল—বেশ ছাঁটা কৃষ্ণকুন্তল দাম
ভ্রূ বেশ ধারালো
মর্মভেদী বাণের মতন কাজল দেওয়া আঁখিপল্লব
অনাবৃত খোলা পেট, আবর্ত-দারুণ নাভি
রং করা বিশটা নখের উজ্জ্বল পিঠ
সবুজ রসনা আজকালের রাধিকা
দেবী স্কুটার বাহিনী
ঘুরে আসুন সন্ধ্যাবেলা
কোন হোটেলের মধ্যে পথের দিকে চেয়ে আছেন বাঁকে বিহারীলাল”
মৈথিলি ভাষার কালজয়ী কবি রাজকমল চৌধুরী (জন্ম-১৯২৯) কী চমৎকার পুরাণ থেকে ইমেজারি ব্যবহার করেছেন এই সময়কে বোঝাতে। কবিতাটি এখনও কত প্রাসঙ্গিক আর আধুনিক।
“সময়: একটা অন্ধ সাপ
সময়: একটা অন্ধ সাপ, বুঝতে পারে না কাকে কামড়াচ্ছে।
সময়: একটা অন্ধ গলি—এক, আপনি আর সে
কেউ জানে না আমরা কেন আর কোথায় যাচ্ছি।
সময়: একটা অন্ধ সাপ, একটা আঁধার গলি। আর মানুষ
অজগরের পেটে ছটফটানো পাখি।
আর মানুষ চৌরাস্তার উপর পড়ে থাকা কুকুর—শুধু
মৃত চোখের
অভিব্যক্তি
শুধু মৃত চোখে ভরা সমস্ত ইতিহাস, সমস্ত পরম্পরা
ক্ষিপ্ত বরাহের দীর্ঘ দাঁতের উপর রাখা সারা বসুন্ধরা
আর চারদিকে সমুদ্র। চারদিকে সমুদ্র।
অজগরের পেটে ছটফটানো পাখি উড়ে কোথায় যাবে?
অন্ধ সাপ
কি আবার দেখতে পাবে নিজের সূক্ষ্ম বিবর?
অন্ধকার গলি কি আমাদের সবাইকে নিয়ে যাবে জ্যোতি-নগর?”
এই ধর্মান্ধ ভারতবর্ষকে নিয়ে কী অসাধারণ কবিতা ফজলুর রহমান হাশমি-র—
“চন্দ্রের পর
চন্দ্রের পর
মানুষ নক্ষত্রে যাওয়ার কথা ভাবছে।
কম্পিউটার-যুগ এসে গেছে
আর আমরা
যেখানে ছিলাম
তারও পিছনে দাঁড়িয়ে আছি
চিন্তার বিষয় এটাই
আমরা আজ পর্যন্ত
বাবরি মসজিদ আর রাম জন্মভূমির থেকে এগুতে পারিনি।”
নারীর স্বাধিকারের চেতনা সুস্মিতা পাঠকের কবিতায়—
“স্ত্রীলোকদের চিরে রুটি গড়া হয়
পুরুষ সেঁকতে থাকে
আপনার হাতে”
কিংবা
“তুমি প্রত্যেক আবহাওয়ায়
তাজা থেকে যাও কী করে, চম্পা?
যখন তোমার মালিক
মাছির মতো
ভনভন করতে থাকে মদের বোতলের ওপর
আর তোমাকে শুঁকতে থাকে
একটা কালো
ভোমরার মতো”
ভাগ্যিস কালীকৃষ্ণ ‘যোগ্যতর’ ব্যক্তি নন, তাঁদের মতো মানুষই অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ করে আমাদের চিন্তাবিশ্বকে প্রসারিত করেন। তাঁরাই অভিধান রচনা করেন, আমাদের সাহিত্য দাঁড়িয়ে থাকে এইসব মানুষের নিরলস শ্রমের ওপর, যেমন চলে সৃষ্টিশীল কবির কলম।
“আমি লিখি
আপনি মুছে দেন
আপনার মুছে দেওয়া শেষ হবে
আমার লেখা বন্ধ হবে না
সেটা আমার জীবন
আপনার মুছে দেওয়া আজ বা কাল বন্ধ হবেই
ওটা আপনার বোধ নয়
অবাধ্যতা”
(লেখা, মুছে ফেলা, রমেশ, জন্ম ১৯৬১)
এত অসাধারণ এই কবিতায় ‘অবাধ্যতা’ শব্দটা খটকা জাগায়। আর কবিতাগুলি কি মূল মৈথিলি থেকে অনুবাদ করা? তেমন কোনো ঘোষণা কোথাও চোখে পড়ল না।
এত মূল্যবান একটি কাজ প্রকাশ করতে কলকাতা নয়, এগিয়ে এসেছে বাকপ্রতিমার মতো জেলার প্রকাশনা। এ বড়ো অদ্ভুত কথা। মধুবনি চিত্র ব্যবহার করে চমৎকার প্রচ্ছদ শ্যামল জানার। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলা ও মৈথিলি ভাষার সেতুবন্ধ বিদ্যাপতিকে।
সত্যি মৈথিলি ভাষার কোনো তুলনা নেই। এমন মিঠে ভাষা! বইটি সংগ্রহ করবার চেষ্টায় রইলুম।