‘অসমের স্নিগ্ধ শ্যামল প্রকৃতির মধ্যে যদি আমার জন্ম না হত, গ্রামের সুর ও তাল, উৎসব-পার্বণ, নাচ-গানের মাঝে শৈশবের দিনগুলি অতিবাহিত না হলে, স্বদেশ ও বিদেশের মৃত ও জীবিত কবি এবং শিল্পীদের অস্তিত্ব না থাকলে আমি কবিতা লিখতে পারতাম না’
—নীলমণি ফুকন
একথা অনস্বীকার্য, নিসর্গ অসমিয়া সাহিত্যকে এক বিশিষ্টতা দিয়েছে। মহাকাব্যের যুগে অসমের নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষ। এর পরে মর্ধারণ্য নাম হয়। পরবর্তী কালে জনপ্রিয় হয় কামরূপ নামটি। যোগিনী তন্ত্রে কামরূপের সীমা নির্দেশ করা হচ্ছে এইরকমভাবে ‘নেপালের কাঞ্চনগিরি থেকে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গম পর্যন্ত এর সীমানা। উত্তরে পর্বতমালা, পশ্চিমে করতোয়া, পূর্বে দিক্ষু এবং দক্ষিণে লক্ষা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গমস্থল...’
ভূগোলের নদী-পাহাড়, তার গা ছমছমে সৌন্দর্য নিয়ে, বারবার ছায়া ফেলেছে অসমের সাহিত্যে। স্থানটি যত প্রাচীন, সাহিত্য কিন্তু কম প্রাচীন নয়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শুরু থেকে এর যাত্রা শুরু। মাগধী অপভ্রংশ এর উৎস। তবে অসম শব্দটির উৎস নিয়ে বিতর্ক আছে। তা কি সংস্কৃত অ-সম, অর্থাৎ সমকক্ষহীন না বোড়ো শব্দ হ-কোম যার মানে নীচু বা সমান্তরাল দেশ? নাকি অসমান, উঁচু-নীচু জায়গা?
যে-কোনো বিতর্ক মুক্ত পরিবেশে সবসময়ই স্বাগত। কিন্তু জাতিগত দাঙ্গা-সংঘর্ষ জ্ঞানচর্চার স্বচ্ছ জলকে অনেকটাই ঘুলিয়ে তুলেছে।
যাক সে কথা। এ কথা বলাই যায়, অসমিয়া সাহিত্য অনেকগুলি পর্ব পেরিয়ে এসেছে। যেমন প্রাথমিক যুগ, বৈষ্ণবীয় যুগ, আধুনিকতার উন্মেষ যুগ। গদ্যসাহিত্যের বিকাশে যেমন প্রতীচ্যের প্রভাব রয়েছে, তেমনি বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যাবে না। ভৌগোলিক নৈকট্য ও ভাষাগত নৈকট্যের কারণে বাংলা ও অসমিয়া সাহিত্যের আদানপ্রদান শুরু হয়েছিল, যার হোতা ছিলেন কলকাতায় পড়তে আসা তিন অসমিয়া যুবক, পরবর্তীকালে যাঁরা অসমিয়া সাহিত্যের দিকপাল হয়েছিলেন। এই যুবকদের উদ্যোগে ১৮৮৮ সালে (রবীন্দ্রনাথ তখন ২৭ বছরের যুবক) কলকাতায় অসমিয়া ভাষা উন্নতি সাধনী সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৯ সালে, চন্দ্রকুমার আগরওয়াল (১৮৬৭-১৯৩৮), হেমচন্দ্র গোস্বামী (১৮৭২-১৯২৮) এবং লক্ষ্মীকান্ত বেজবড়ুয়া (১৮৬৪-১৯৩৮) শুরু করেন অসমিয়া সাময়িকপত্র জোনাকি। এই লক্ষ্মীকান্ত বেজবড়ুয়া বিবাহ করেন রবি ঠাকুরের ভাইঝি প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীকে, যাঁর রান্নার বই বিখ্যাত।
এরপর সময়ের অনেক পালাবদলের মধ্যে দিয়ে অসমিয়া সাহিত্য তার আধুনিকতম রূপটি খুঁজে পেয়েছে—সৈয়দ আবদুল মালিক (১৯১৯-২০০০), বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য (১৯২৪-১৯৯৭), হেমেন বরগোহাঞি (জন্ম ১৯৩২), লক্ষ্মী নন্দন বোরা (জন্ম ১৯৩২), নগেন শইকিয়া (জন্ম ১৯৩৯), ইন্দিরা গোস্বামী (১৯৪২-২০১১), থেকে শুরু করে একেবারে সাম্প্রতিক কালের নবীন মৃণাল কলিতা, রূপলেখা দেবী পর্যন্ত।
ঘটনাচক্রে হাতে এল রূপলেখা দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘অন্যত্র বিরলা দেবী’। এর জন্য ২০১০ সালে মুনীন বরকটকী যুবা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
এ এক আশ্চর্য উপন্যাস। ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে দেবীপীঠ। এক-একটি মন্দিরকে ঘিরে কত মিথ, আবার পূজারি সম্প্রদায়ের জীবনযাপন—সেও ভারী কৌতূহলের বিষয়। আমরা সকলেই জানি পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে কালীঘাট বা তারাপীঠ, কিন্তু সেসব পীঠ নিয়ে কই এমন একটি উপন্যাস লেখা হল না তো?
অনেকের মতে কামাখ্যা প্রাক-আর্য দেবী। এ প্রসঙ্গে হেম বরুয়া লিখেছেন ‘distinctly tribal in its traits and ideal… it is relic of the pre-Aryan sex worship that was a part of the ancient social organization of the tribal people.’
এই কামাখ্যাধাম হয়ে উঠেছে রূপলেখার উপন্যাসের বিষয়। তিনি এই দেবীপীঠের কন্যা। তাঁর কাছে কামাখ্যাধাম তাই নিছক একটি তীর্থস্থান নয়, সম্পূর্ণ আলাদা একটি সংস্কৃতির পীঠ। এখানকার মূল পূজারি পরিবারকে কেন্দ্র করে তিনি গেঁথেছেন কামাখ্যার লোকগাথাগুলির মালা। প্রাক-স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতার উত্তরকাল পর্যন্ত সময়কালের এই উপন্যাস আসলে ধরতে চেয়েছে নীলাচল পাহাড়ের সমস্ত উৎসব, বিশ্বাস, পরম্পরা, রূপকথা, ব্রত ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে স্পন্দমান মানুষের জীবন। ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকেও কাজটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য, কারণ কামাখ্যাধামের ভাষার একটি বিশিষ্টতা আছে। এখানকার ভাষা নিম্ন আসামের প্রচলিত অন্য কথিত ভাষা থেকে আলাদা এবং উচ্চারণ ভিন্ন। শুধু তো ভারতবর্ষ নয়, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ থেকেও এখানে পুণ্যকামী মানুষ আসেন। তাই অসমিয়ার সঙ্গে মিশে যায় নেপালি, বাংলা, মৈথিলি ভাষা। আমাদের শোনা ছড়া বা বিয়ের গানও কেমন বদলে যায় তা দেখতেও বেশ মজা লাগে।
এ উপন্যাস শুরুই হয় বিয়ে দিয়ে—‘আজ অভয়ার বিয়ে’। অভয়ার বিয়ে বড়োপূজারি বাড়ির ছোটোছেলে প্রতাপ বড়োপূজারির সঙ্গে। সে বাড়ির খুঁটি অম্বিকা বুড়ি, পাঁচ ছেলে, বউমা, নাতিপুতিতে তার ভরা সংসার। তার বড়ো ছেলে প্রমথেশ্বর এই দেবীধামের প্রধান পুরোহিত, ‘দেবীর চরণে দেওয়া টকটকে রক্তজবার মতো লাল রঙের গরদের কাপড়ে শক্তি পূজারির রূপ প্রকাশ পায়। অম্বুবাচীর সময়ে দেবীর গুপ্তস্থানের আচ্ছাদনের রক্তবস্ত্র কেটে তৈরি করা রুদ্রাক্ষ, স্ফটিক ও মৃত্যুঞ্জয় তাবিজ ডান হাতে, মাথায় রক্তজবা, কপালে চন্দনের তিলক।’ একদিকে যেমন এই অলৌকিকতার জ্যোতি নির্মাণ, অন্যদিকে উৎসবে পার্বণে লৌকিক জীবন, প্রকৃতির উদ্যাপন। একদিকে নিয়ম-রীতির কঠোর নিগড়, অন্যদিকে বাঁধন না মানা জীবনের তরঙ্গ। তাই তো বড়োপূজারির মেয়ে শেষ পর্যন্ত ইস্কুলে যাবার অনুমতি আদায় করেই ছাড়ে, সেজ ভাই বিদ্যা কলকাতায় গিয়ে ডাক্তার হয়ে আসে পরিবারের সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। একদিকে অন্য পরিবার থেকে বউ হয়ে আসা মেয়েদের অস্তিত্ব বিলোপ, তাদের নাম মুছে গিয়ে ডাকা হয় জায়গার নামে। শশীপ্রভা হয়ে যায় শোয়ালকুচিনী। এরকম মনাকুচেনী, পলাশবাড়িনী, রাঙ্গামাটিনী। অন্যদিকে বিধবা মালিনী হয়ে ওঠে উমাকান্তের শরতের শিউলি।
‘বর্ষায় তরতাজা হয়ে ওঠা নীলাচলের গাছপালা থেকে শরত নরম কাপড় দিয়ে আলতো ভাবে মুছে দিল জলবিন্দুগুলো... শরতকালের চিত্রকূট পাহাড়ের রূপ যে কবি বর্ণনা করেছেন তিনি নিশ্চয়ই এই পাহাড়ের রূপ দেখেননি। বকুল, শেফালি, তমাল মালতী, কাঞ্চন, চম্পা, দ্রোণফুল আরও কত যে রং-বেরঙ্গের ফুল ডালে ফুটে উঠেছে তা শুধু শরতের নীলাচল পাহাড়ই জানে।’
আর-একদিকে ব্রহ্মপুত্র। ‘জানলা খুললেই ব্রহ্মপুত্র, চোখের ওপর লাফিয়ে আসে। নদীর ওপর থাকা উমানন্দ শিবের মন্দিরকে জলের ওপর জেগে ওঠা একটি বৃক্ষের মতো মনে হয়।’ (কামাখ্যার ভৈরব এই উমানন্দ। দ্বীপটি অবিকল ময়ূরের মতো দেখতে বলে এর নাম পিকক আয়ল্যান্ড।) কামাখ্যাপীঠের নানা কুণ্ড, সৌভাগ্য কুণ্ড, ঋণমোচন কুণ্ড। তাদের ঘিরে গল্পগাথা রহস্য। সৌভাগ্য কুণ্ড নাকি খনন করেন ইন্দ্র। এটি দেবতাদের জলকেলির কুণ্ড। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভেঙে গেলে এর পুনর্নির্মাণ করেন দ্বারভাঙ্গার মহারাজ। অতীন্দ্রিয়তা এর কোণে কোণে। পাহাড় কেটে রাস্তা বানাতে আসা ইঞ্জিনিয়ারও দেবী মহিমাকে লঙ্ঘন করতে চান না। আধুনিক সভ্যতা তবু হাত বাড়ায় কামাখ্যায়। বড়োপূজারি পরিবারে নেমে আসে এক অতর্কিত আঘাত। উমানন্দের আত্মহত্যা। শোয়ালকুচিনী তার স্বামীকে পেতে চেয়েছিল শরীরে, তাতে নিজেকে ধর্ষিত মনে করেছিল উমানন্দ। সে যে খুঁজে বেড়ায় তার মালিনীকে। সে চলে গেলেও তার বীজ থেকে যায় পৃথিবীতে। তাকে তুলে আনে ডাক্তার বিদ্যা। ‘জাত-পাত একটি মানুষের জীবন থেকে বড়ো হতে পারে না দাদা। যে সমাজের নিয়ম-নীতি একটা বাচ্চাকে বাঁচার অধিকার দেয় না, সে নিয়ম থাকার থেকে না থাকা ভালো।’
আমাদের মনে না পড়ে পারে না কামাখ্যায় দেবীর যোনিমণ্ডল পড়েছিল, তাই এই পীঠকে সৃষ্টিতীর্থ বলা হয়।
কামাখ্যে বরদে দেবী নীল পর্বতবাসিনী
ত্বং দেবী জগতাং মাতর্যোনিমুদ্রে নমোহস্তুতে
কথামৃতে আছে সৃষ্টির বীজ দেবী তুলে রেখে দেন। এইভাবেই বয়ে চলে জীবনপ্রবাহ। ছড়া, লোককথা, কিংবদন্তীতে একটি বর্ণময় মেখলার মতো সেই প্রবহমান জীবনের কথাই বুনতে চেয়েছেন লেখক, প্রথম উপন্যাসেই তিনি যে পরিণতির ছাপ রাখলেন, তাতে তাঁর সম্পর্কে আশা জাগে বইকি।
মূল ভাষা থেকে অত্যন্ত আন্তরিক অনুবাদ করেছেন নন্দিতা ভট্টাচার্য, তাঁকে ধন্যবাদ। শুধু গান আর ছড়াগুলি অনুবাদে ছন্দ ও গীতলতা হারিয়েছে। পরের সংস্করণে এ বিষয়ে একটু মন দিতে অনুরোধ করছি। ধন্যবাদ ভাষা সংসদকে অসাধারণ একটি বই বাঙালি পাঠকের হাতে তুলে দেবার জন্য।
সুন্দর আলোচনা।
লেখাটি ভালো হয়েছে । লেখিকা অত্যন্ত আন্তৰিকতাৰ সংগে আলোচনাটি লিখছেন । তাকে ধন্যবাদ।
তবে দু একটি ত্ৰুটি চোঁখে পৰছে। যেমন লক্ষ্মীকান্ত বেজবডুয়া নয়, শুদ্ধ নাম লক্ষ্মীনাথ বেজবডুয়া। ৱা বাংলাই লিখতে না পাৰলেও বৰুয়া লেখা যায় কি? তেমনি হেমেন ভুল; হবে হোমেন...