আমাদের মানুষদের নীচের চোয়ালের হাড়টিকে বলা হয় ‘হনু’। যদি বুদ্ধি থাকলে কেউ আমাদের বুদ্ধিমান বলেন, কেউ ভেসে থাকলে যদি তাকে ভাসমান বলেন, তাহলে ব্যাকরণের সেই যুক্তিতে আমরা সবাই ‘হনুমান’ হবো না কেন?
‘চিকেন টপ’ টিভি চ্যানেলের স্টুডিও। শুরু হবে প্রাইম টাইম অনুষ্ঠান। অতিথি শ্রী ঘনশ্যাম কর্কট মহাশয়। আর রয়েছেন অ্যাঙ্কার, ক্যামেরাম্যান এবং অন্যান্য crew।
অ্যাঙ্কার - চিকেন টপ টিভি চ্যানেলের প্রাইম টাইম অনুষ্ঠানে আপনাদের সকলকে স্বাগত। শুরু হচ্ছে আজকের অনুষ্ঠান “ইতিহাসে পাতিহাঁস”। অতিথি হিসেবে আমরা আজকে পেয়েছি “ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টিরিয়া রিসার্চ” এর একজন স্বনাম ধন্য বাঙালি ইতিহাসবিদ শ্রীমান ঘনশ্যাম কর্কট মহাশয়কে... [ঘনশ্যাম কর্কট হাত তুলে নমস্কার করলেন] ঘনশ্যামবাবু আমাদের অনুষ্ঠানে আসবার জন্য ধন্যবাদ...
ঘনশ্যাম – [হেসে] জয় বজ্রং বলি... জয় হনুমান। আর ওটা হিস্টিরিয়া নয়, হিসটরিকাল।
অ্যা – সরি। ইয়ে, আপনি কি বজ্রংবলির ...
ঘ- হ্যাঁ। আমি শ্রীহনুমানের ভক্ত। কারণ শ্রীহনুমানই প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন..
অ্যা- একটু যদি খুলে বলেন...
ঘ- রামায়ণে দেখেননি, উনি কেমন ভাবে নিজের বুক চিরে রাম-লক্ষ্মণকে দেখিয়েছিলেন। আসলে এখন যত কিছু নিয়ে, এই বিজ্ঞান বিজ্ঞান করে খুব হই চই করছেন, তার সব কিছুই জানা যায় রামায়ণ এবং মহাভারত পড়লে। কারণ অনেকেই হয়ত জানেন না যে, বিজ্ঞানচর্চায় প্রাচীন ভারত আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে...
নেপথ্যে – হুপ হুপ
অ্যা- তাহলে বলছেন যে শ্রীহনুমানই প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি করেছেন?
ঘ – গণেশের দেহে হাতির মাথা......, কী করে এলো? হ্যাঁ? প্লাস্টিক সার্জারি, যা নিয়ে এখন সারা বিশ্ব হাকু পাকু করছে, সেটা প্রথম হয় এই প্রাচীন ভারতে...
নেপথ্যে – হুপ হুপ
ঘ – পুষ্পক রথ বা অন্যান্য যে সব রথের কথা পাওয়া যায় সেগুলো আসলে কী?
অ্যা – কী?
ঘ- বিমান। এবং ইউ.এ.ভি.
অ্যা - ইউ.এ.ভি.!!!
ঘ- ইয়েস। ইউ.এ.ভি. এই যে পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, মিসাইল ... এ সব নিয়ে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে সারা পৃথিবী তোলপাড়, সে সব তো কবেই ছিল আমাদের প্রাচীন ভারতে।
অ্যা – বলেন কী!! যেমন......
ঘ- ব্রহ্মাস্ত্র, নারায়ণাস্ত্র, ইন্দ্রাস্ত্র, পাশুপাত, ব্রহ্মশির, শক্তিশেল ..., কোথায় লাগে পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমা, কোথায় লাগে মিসাইল। বাচ্চা, বাচ্চা...
নে – হুপ হুপ
অ্যা – আপনি কি সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ পড়েছেন?
ঘ- না।
অ্যা- কিন্তু আমাদের এখানকার ও পাশ্চাত্যের জ্ঞানীগুণী জন বলছেন যে এইসব ভুয়ো, এই সব নাকি আপনাদের দলের মনগড়া। তথ্য অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে .........
ঘ- তথ্য অনুসন্ধান করে কী হবে? তথ্য অনুসন্ধানের কোনও দরকারই নেই। দরকার নেই চুল চেরা বিতর্কেরও। এতদিন ধরে যা পড়ান হয়েছে সেগুলোই আসলে পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিকদের সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র এটা জানবেন।
অ্যা – ষড়যন্ত্র?
ঘ – ষড়যন্ত্র নয়? কেন বলতে পারেন সমুদ্র গুপ্তকে ভারতের নেপোলিয়ন বলা হবে? সমুদ্র গুপ্ত আগে জন্মেছেন না নেপোলিয়ন?
অ্যা – সমুদ্র গুপ্ত!
ঘ – তাহলে? কে করেছে এই সব?
অ্যা –ভিনসেন্ট স্মিথ।
ঘ – ঐ ভিনগ্রহের প্রাণীদের পক্ষেই এই সব সম্ভব। তারপর আহমেদাবাদকে ভারতের ম্যানচেস্টার ..., বলি কে আগে আর কে পরে সেটাই তো গুলিয়ে ফেললি? ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কী এসব?
অ্যা – কিন্তু সব পণ্ডিতেরা বলছেন যে আগে ইতিহাস ছিল ক্রনোলজিকাল অর্ডারে, তারপর আসে মার্ক্সিয়ান সিস্টেম আর তারপর ফ্রান্সে লাদুরি এবং আমাদের দেশে রঞ্জিত গুহ বা গায়ত্রি স্পিভাক বললেন “সাব-অল্টার্ন” ইতিহাসের কথা। আর রামায়ণ-মহাভারত হল মিথলজি, মহাকাব্য। ওরা ইতিহাস হবে কী করে?
ঘ- [খুব হেসে] কী বলব সব এঁদের? লাদুরি না ভাদুরি। এরা জানেই না যে সময় রামায়ণ-মহাভারত লেখা হয় তখন লোক বানিয়ে বানিয়ে এতো কিছু লিখতে জানতো না। আর তাদের এতো বুদ্ধিও ছিল না যে সব কিছু বানিয়ে বানিয়ে লিখবে। যেমন ধরুন রাম...
অ্যা- হ্যাঁ, আপনাদের একজন মন্ত্রী বলেছেন যে আমরা সবাই নাকি রামের সন্তান।দিল্লির নাকি দুটো পথ, হয় রামজাদাদের বেছে নিতে হবে, নয়ত হারামজাদাদের।
ঘ- উফ, কেমন মিলিয়েছে দেখুন, রাম, আর তার সাথে ‘হা’ যোগ করলেই...
অ্যা – হারাম। কিন্তু উনি তো পরে এই নিয়ে বিতর্ক ওঠায় সংসদে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। আরও আছে যেমন আপনার দল বলছেন যে গান্ধিঘাতক নাথুরাম গডসে নাকি দেশপ্রেমী ছিলেন...
ঘ- উফ, দেখুন নাথুরামেও রাম আছে
অ্যা- তারপর...
ঘ- আসলে। আমাদের দেশ জুড়ে আছেন রাম। পৃথিবীর প্রথম সেতু কে করেন,...... রাম; আর্কিটেক্ট- একদল বানরসেনা......, ভাবুন বানর, যারা সামান্য প্রাণী মাত্র, কোন বুদ্ধি-সুদ্ধি নেই তাদের নিয়ে সেতু বানালেন। ভাবা যায়? আহা...
নে – হুপ হুপ।
ঘ- সেই বানর শ্রেষ্ঠ বীর শ্রীহনুমান আমাদের দেখালেন বিশ্বের প্রথম ল্যাবরেটরি।
অ্যা – কোনটা!!!!
ঘ- কেন? গন্ধমাদন পর্বত।
নে –হুপ হুপ
ঘ- [সন্দেহ প্রকাশ করে] আচ্ছা কাছে ধারে কি হনুমান সত্যিই আছে?
অ্যা- হ্যাঁ, আমাদের স্টুডিওর পাশেই একটা বড় জাম গাছে...
ঘ- আহা, আহা, জয় শ্রী হনুমান।
নে- হুপ হুপ হুপ ...
ঘ- বলি অশ্বিনী কুমারদের মতো ডাক্তার পাওয়া যাবে এই আজকের ইউরোপ বা আমেরিকায়? হ্যাঁ? রামায়ণে আছে যে গৌতমের অভিশাপে ইন্দ্রের অণ্ড যখন খসে পরে, তখন অশ্বিনী কুমারদ্বয় মেষাণ্ড সহযোগে ইন্দ্রের পুরুষত্ব ফিরিয়ে আনেন। Non-impotent থেকে impotent করেন। আহা, এরা সোনার রথে করে দিনে তিনবার এবং রাতে তিনবার জগত পরিভ্রমণ করতেন...
নে- হুপ হুপ হুপ
অ্যা- আপনি দেখেছেন এঁদের?
ঘ- উমম, ইয়ে,...। মানে, হ্যাঁ।
নে- হুপ হুপ হুপ...
অ্যা- আরও কিছু বলুন, মানে ভাবতেই কী রকম যেন ঘোর ঘোর লাগছে...
ঘ- [খুব তৃপ্ত চিত্তে] শুনুন তাহলে। মিসিং লিঙ্ক জানেন তো?
অ্যা- আরকিওপ্টেরিক্স?
ঘ- আর কিও পটে জানিনা তবে কিনা রিস্ক নেবেন না। ওসব তো অনেক পরে মশাই। তার অনেক আগে বলুন তো মানুষ আর দেবতার মিসিং লিঙ্ক কী? [অ্যাঙ্কার মাথা চুলকোতে থাকলেন] অঙ্গিরসগন। দেবতা থেকে মানুষ হওয়ার পথে এরা এসেছিল পৃথিবীতে। আবার পাখি থেকেও মানুষ হয়েছে। এখানে মিসিং লিঙ্ক হল গরুড়।
নে – হুপ হুপ হুপ হুপ
ঘ- আরও কত বলব। শুক্রাচার্যের মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা। কলির শরীর থেকে কৌষিকী মানে ক্লোন। জম্ভ্রিক আবিষ্কার করেছিল কড়া ঘুমের ওষুধ। বলতে পারেন ঘোড়াদের কেন স্তন নেই আর গোজাতির ক্ষুর হয় কেন?
অ্যা- ইয়ে, মানে না!! [মনে মনে বললেন ঘোড়ারা খুব জোর বেঁচে গেছে। আর গরুরা দাড়ি কামাবার জন্য বোধহয় ক্ষুর ব্যবহার করেন]
ঘ- প্রভু মহাদেব করেন এইসব। ত্রিপুরাসুরকে বধ করার সময়। [এই সময় অনেক খাবার ও কফি দিয়ে গেল চ্যানেলের কিছু ক্রু] এসব আবার...
অ্যাঃ খান না। সামান্য রিফ্রেশমেন্ট। কিন্তু অনেক জ্ঞানী মানুষ বলছেন যে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ এক বিশেষ ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ বিধিতে লেখা আছে এবং তার মানে বা অর্থ আপনারা যা বলছেন তা তো নয়ই, বরং তার থেকে অনেক অনেক ভিন্ন।
ঘ- ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থ বিধি!! নাহ, আমি ব্যাপারটা এই প্রথম শুনলাম ভাই। [ডিশ টেনে নিয়ে খেতে শুরু করেন]
অ্যা- আরে খান খান। আচ্ছা তাহলে গীতাকে কি জাতীয় গ্রন্থ করে দেবেন?
ঘ- [মন দিয়ে খেতে খেতে] হ্যাঁ। আমাদের বিদেশ মন্ত্রী তো বলেইছেন, যে ওবামার হাতে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন উপহার হিসেবে শ্রীমদ্ভাগবতগীতা তুলে দিয়েছেন, তখনই তো জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে গেছে। বাকি শুধু আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।
নে- হুপ হুপ হুপ হুপ
অ্যা- বলছিলাম কী, শুধু জাতীয় গ্রন্থ করে থেমে যাবেন কেন, জাতীয় বাহন, জাতীয় বিল্ডিং, জাতীয় কেলেঙ্কারি, জাতীয় পোশাক, জাতীয় জুতো, জাতীয় মারপিট, জাতীয় ঝগড়া, জাতীয় রাগ-রাগিণী, জাতীয় নাচ, জাতীয় মাছ......... মানে সাপ, খোপ, শকুন, উকুন সব জাতীয়করণ করছেন না কেন? আমাদের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী ব্যাঙ্ক, কয়লা জাতীয়করণ করেছিলেন। আপনারা অন্য সব কিছুর জাতীয়করণ করে দিন না..., কিন্তু তা না করে দেখছি আপনাদের সরকার সব বি-জাতীয়করণ করছেন, এই যে বিমান, রেল, বি এস এন এল... সব বেচে দিচ্ছেন।
ঘ- [খাওয়া থামিয়ে] এটা তো মন্দ বলেন নি। দাঁড়ান, এখুনি ফোন করে...
[ফোনে কথা বলা শেষ হয়েছে কী হয়নি, হঠাৎ একগাদা হনুমান ঢুকে পড়ল স্টুডিওতে। দেখেই তড়াক করে অ্যাঙ্কার আর ক্যামেরাম্যান সটান টেবিলের নিচে। ঘনশ্যাম বাবু তটস্থ ও হতবাক। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। হাতের খাবার হনুমানদের দেখিয়ে বললেন, “খা খা”। একটা গোব্দা হনুমান সটান এসে খাবারের প্লেট ধরে ছুঁড়ে ফেললেন আর অন্য জন ঘনশ্যামবাবুকে ঠাটিয়ে মারলেন এক চড় । উনি বাবাগো বলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। বাকী হনুমানেরা তখন খাবার খেতে ব্যস্ত। তার মধ্যে যে হনুমান সাহেব থাপ্পড় মেরেছিলেন তিনি ক্যামেরার সামনে মাইক হাতে বললেন, “এক খপ হুপ হুপ। ওক হুপ হুপ হুপ, ভুপ ভাপ ভুক, ভাপ ভুক। বক হপ, নক থাপ হুপ নত উম আম গপ]
পরে একজন হনুমান ভাষা বিশেষজ্ঞ এর মানে করেছিলেন। মানে হল, “এঁটো খাবার দিচ্ছিস? হারামজাদা। অনেকক্ষণ ধরে বারণ করছিলাম, যে ওরে এতো ভুলভাল বকিস নি, বকিস নি। বকলে হয় থাপ্পড় খাবি নয়ত গপ করে গিলে ফেলব”।
[হাসছেন? তা হাসুন কিন্তু যে রাজনৈতিক দল দেশটাকে বেচে দিচ্ছে, তুলে দিচ্ছে মুষ্টিমেয় ক্যাপিটালিস্টদের হাতে বিমা, এল আই সি, ২৭ কিমি জাতীয় সড়ক, ৪০০টি স্টেশন, ১০৯টি দূরপাল্লার ট্রেন, বিদ্যুৎ পরিবহণের ৪২,৩০০ কিমি সার্কিট লাইন, ৫০০০ মেগাওয়াট জল, বায়ু ও সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকাঠামো, GAIL এর ৮০০০ কিমি পাইপলাইন, IOC HP এর ৪০০০ কিমি তেলের পাইপ লাইন, BSNL, MTNL এর ৩৯০০০ টাওয়ার, ১৬০টি কয়লা খনি প্রকল্প, ২৫টি বিমানবন্দর এবং ৩১টি নদী ও সমুদ্র বন্দর। বলছেন যে লিজে দেওয়া হচ্ছে; সরকার আবার সব কিছু ফিরিয়ে নেবে। বাচ্চা ভুলানো কথা, নয় কি?]