রবিবারের সব্জি বাজার সরগরম। রাস্তার দু-পাশের সব্জিওয়ালাদের ফলাও করে ফল আর সব্জি সাজিয়ে বসার আয়োজনে রাস্তাটাকে আর রাস্তা নয়, ক্ষেত মনে হচ্ছে। অথবা বাগান। আর আমাদের সদা ব্যস্ত কামুকাকু সেই ক্ষেতসদৃশ বাগানে গরুর মত বিচরণ করছেন। চায়ের দোকান থেকে লক্ষ্য করছি বেশ খানিকক্ষণ ধরে। মনে হল, একরাশ বিরক্তি মাখানো মুখে কি সব যেন বিড়বিড় করছেন। ওঁর হাতে চিরাচরিত একটা ঢাউস নাইলনের ব্যাগ। পরনে ফতুয়া, পাজামা আর সবুজ স্ট্র্যাপওয়ালা হাওয়াই চটি। আমি ওঁর মুখোমুখি হতেই কাঁধ টাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রায় তেড়ে আসার ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন, "আর বলো কেন! সামনে দোল-উৎসব। কোথায় একটু দিশি, টাটকা সব্জি নেবো, তা না, সব হাইব্রিড! দেশটা একেবারে উচ্ছন্নে গেল!"
এই "উচ্ছন্নে গেল" শব্দবন্ধটা সম্ভবত ওনার মুদ্রাদোষ। এর আগেও বেশ কয়েকবার বিভিন্ন ইস্যুতে বলতে শুনেছি।
এই সেরেছে! কথায় কথায় ওনার পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি যে! কুমুদরঞ্জন ঘোষ। বয়স - তা হবে পঞ্চাশ কি বাহান্ন। ওনার স্ত্রী, মানে আমাদের কুমুকাকিমা গত তিনবছর ধরে তেত্রিশে আটকে আছেন। কাকিমার ভাল নাম মনে হয় কুমুদিনী। মা'র কাছে শোনা, কাকুর বিয়েটা হয়েছিল বেশি বয়সেই। নীচের দুই বোনকে পার করে নিজে বিয়ে করেন খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রী কলমে বিজ্ঞাপন দিয়েই। আরও শোনা যায়, কেবলমাত্র নামের মিল দেখেই কাকিমাকে নির্বাচন করেন উনি। কোনও এক বহুজাতিক সংস্থার কনিষ্ঠ কেরানী হওয়ার সুবাদে পয়সাকড়ি মন্দ নয়। কাকুর সঙ্গে কাকিমার বয়সের ব্যবধান নয় নয় করে চোদ্দ পনেরো বছর তো হবেই। কাকিমার বর্তমান বয়স তর্কের খাতিরে তেত্রিশ থেকে ছত্রিশে টেনে তুললে, কাকুর বয়স একান্ন হতে বাধ্য। ওঁদের একমাত্র মেয়ে মলি, মানে মল্লিকা, এবার ক্লাশ টেন। মানে ঐ ধরা যাক ষোলো। কাকিমা বিশ বছরে মা হলে, আমার হিসেব কেশব নাগের অঙ্কের মত মিলে যাচ্ছে একেবারে। কিন্তু কামুকাকুদের পরিবারের ব্যাপারে এতকিছু জানার বা বলার আগ্রহ অন্যখানে। সে হল মলি। আহা! কি তার রূপ! এমনি এমনি ডোবার মাঠের চ্যাংড়াগুলো খেলতে গিয়ে তেকাঠি মিস করে! ঝুলবারান্দায় মলি এসে দাঁড়ায় যে! আমায় এ পাড়ায় লোকে ভাল ছেলে বলেই জানে। কাকুরাও হয়ত। পড়াশোনায় ভাল। এক থেকে দশের মধ্যে থাকতুম প্রতিবছর। উচ্চ মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন। নামকরা কলেজে ফিজিক্স নিয়ে অনার্স। ভালর পর্যায়েই পড়ি মোটামুটি। একটা সেলফ রেসপেক্টও তৈরি হয়েছে। কিন্তু, তাই বলে যৌবনকে তো সংযমের কঠিন শৃঙ্খলে বাঁধা যায় না। তাই, ফিজিক্সের ফাঁক গলে মলির ফিজিক্যাল অবয়বে কেমন ফেঁসে যায় চোখ। এই সেরেছে! গপ্পো করতে গিয়ে নিজস্বতা জলাঞ্জলি দিচ্ছি যে! সেলফ রেসপেক্টের একেবারে ল্যাজে-গোবরে অবস্থা! আরে বাবা, তেমন আহামরি কিছু না। ঐ একটু বয়সী বায়াসনেস। ঘাবড়াবেন না আপনারা।
কাকু কাকিমাও ঘাবড়ান নি। বরং ওঁদের বাড়ি মাঝে মধ্যে গেলে খুশিই হতেন। মাঝে মধ্যে বলতে - ঐ ধরুন বিজয়া দশমীর নমস্কার, রবীন্দ্র জয়ন্তীতে রবিঠাকুরের ফোটো আনা, হারমনিয়াম আনা, বা দোলের দিন পায়ে আবির দেওয়া - এই আর কি! তাও, একা নয়, বন্ধুরা মিলেই যাই। আর হ্যাঁ। সরস্বতী পুজোর চাঁদা কাকু ভালই দেন। ঘাবড়ান না।
কিন্তু আজ কেমন যেন ঘাবড়ে আছেন। বিরক্তির আড়ালে ওনার ঘাবড়ানো মুখটা দেখে বললুম, "আরে কাকু! টাটকা, দিশি সব্জি পাচ্ছেন না? ছেড়ে দিন না! একটু রেওয়াজি খাসির মাংস নিয়ে যান। রোব্বারের লাঞ্চ জমে যাবে।"
"কি যে বল ভাইপো? দিশি, টাটকা সব্জি কি আর খাবো বলে খুঁজছি? সামনে দোল না?"
"খাবেন না? কি করবেন তবে? আর দোলের সঙ্গে সব্জির সম্পর্কই বা কি?"
এইবারে কাকু আমার দিকে বেশ কিছুটা ঝু্ঁকে বললেন, "চলো। চা খেতে খেতে শুনবে।"
অতএব আর এক রাউন্ড চা নিতে হল। আজ ছুটির দিন। তেমন তাড়া নেই আমার। বাজার সেরে ফেলেছি। একটু সময় কাকুর সাথে কাটানো যেতেই পারে। কাকু চা-য়ে একটা সুড়ুৎ শব্দ করে বেশ আগ্রহ নিয়ে বলতে শুরু করলেন - "গত দু'বছর তো সেভাবে বাড়ির বাইরে রেরোনোই হল না। রোগে, আতঙ্কে আমরা সবাই আধমরা। তাই ভাবলাম এবার দোলটা একটু জাঁকিয়ে পালন করলে কেমন হয়?"
আমি খুব আনন্দের সাথে বললুম, "তা তো বটেই! আমারও এবার বসন্ত উৎসবে খুব আনন্দ করার ইচ্ছে আছে। বেশ জমিয়ে রং খেলবো! কিন্তু তার সাথে সব্জির কি সম্পর্ক?"
কাকু বরাবরই বেশ আমুদে প্রকৃতির মানুষ বলেই শুনেছি। বেশি বয়সে বিয়ে করার জন্য কি না জানিনা, কাকিমার প্রতি ওনার অতি ভালবাসাটা পাড়ার সকলেই বিলক্ষণ টের পেতো, এখনও পায়। অফিস থেকে ফেরার সময় ক্লাবের দাদারা ডাকাডাকি করলেও একটিবারের জন্যও ক্লাবমুখো হন না। "ঘরে প্রচুর কাজ" - বলে কাটিয়ে দেন।
"কি এত কাজ?" ক্লাব সেক্রেটারি অপুদা জানতে চাওয়ায় একদিন কাকু সরাসরি উত্তর দিয়েছিলেন,
"স্ত্রী কে, ওঁর কাজে সাহায্য করতে হবে।"
"কেমন সাহায্য?" কৌতূহলী প্রশ্ন অপুদার।
"রুটি বানানোয়। আটা মেখে লেচি বানিয়ে দিতে হবে।"
"আপনি এখন রুটি বানাতে ... "
অপুদার কথা শেষ করতে না দিয়ে কাকু সহাস্যে বলে ওঠেন, "কেন? স্ত্রীও তো আমার কাজে হেল্প করে আমায়!"
অপুদা অবাক হয়ে বলে, "কি কাজে?"
কাকুর গর্বিত উত্তর, "বাসন মাজায়!"
তো এই অসাধারণ স্ত্রী কর্মমুখি মানুষটির কাম (কর্মই ভাববেন শুধু, অন্য কিছু নয়) রূপে আবিষ্ট হয়ে এরপর থেকেই আমরা তাঁকে আর কুমুদ বা কুমু কাকু নয়, 'কামু' কাকুই ডাকি।
"শুনছো! আরে কি হল? কনসেনট্রেট করো!"
কাকুর ডাকে আমার সম্বিত ফিরলো। টাটকা দিশি সব্জির ক্ষেতে নেমে এলাম রং খেলার বাসনা নিয়ে।
কামুকাকু বেশ আগ্রহ নিয়ে বলছেন, "বাজারে সব রং, আবির একেবারে অখাদ্য, বুঝলে। তোমার কাকিমার তো সেবারে র্যাশ বেরিয়ে গেল! মেয়েটাও বড় হচ্ছে। ঐ বাজারী রঙে আর ভরসা নেই। তাই ঠিক করেছি এবার নিজেই রং বানাবো বাড়িতে। একেবারে দিশি, টাটকা সব্জি, ফল, মূল দিয়ে তৈরি করবো অর্গ্যানিক রং। মানে হল গিয়ে ঐ হার্বাল রং। ভেষজ আবির। তার কোনোটায় থাকবে বকুল ফুলের গন্ধ, কোনোটায় জুঁই, কোনোটায় রজনীগন্ধার সুবাস!"
আমি হতভম্বের মত কাকুকে দেখছি। লোকটা আস্ত পাগল! না কি বিজ্ঞানী হতে চাইছে? সেই কারণে চাঁদি ফাটা রোদ মাথায় নিয়ে বাজারে সব্জির তল্লাশি করতে এসেছেন! আমি অস্ফুট স্বরে জিগালুম, "আপনি বাড়িতে এই সব করবেন? এসব তো কেমিষ্ট বা গবেষকদের কাজ?"
এক অপূর্ব জ্যোতি এখন কাকুর মুখমণ্ডলে। চা এতক্ষণে ঠান্ডা জল হয়ে গেছে। তলানিটা সুড়ুৎ করে চালান করে দিয়ে, ফতুয়ার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন মুচকি হেসে। ফস্ করে লাইটারটা জ্বেলে সিগারেটটা ধরালেন রাজকীয় ভঙ্গিমায়। একরাশ ধোঁয়া বাজারের জনজঙ্গলের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন আবার।
"গত চারমাস ধরে পড়াশোনা করছি। গুগল ঘেঁটে সব কারিগরি শেখা হয়ে গেছে, বুঝেছো! ভেজাল প্রোডাক্টে ছেয়ে গেছে একেবারে। দেশটা উচ্ছন্নে গেল! তা যাক্। শুভ দিনে মনের সুখে দোল খেলার একটা রাস্তা বের করেছি। হুঁ হুঁ বাবা! দেশী ঘি এনে রেখেছি। বুনসেন বার্নার থেকে পোর্সেলিন পাত্র, কিচ্ছু বাকি নেই। কচি কেসুত্তি থেকে ঘন সবুজ আর কাঁচা হলুদ এর সাথে বোরাক্স মিশিয়ে, সামান্য সূর্যমুখীর পাপড়ি বেটে, কয়েক ফোঁটায় বাসন্তী রঙ। সবুজ রং টা ক্লোরিনেও খুলত, কিন্তু ওটাতো আবার হ্যালোজেন গোষ্টীর, তাই রিস্ক নিই নি। এখন শুধু লাল রং-টা বানাতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম জবাফুলের সাথে ব্রোমিন জল মেশাবো। কিন্তু ব্রোমিনও হ্যালোজেন। তাই টাটকা দিশি লাল শাক আর রাঙা আলুর খোঁজে বেরিয়েছি। দেখি এক্সপেরিমেন্ট করে একটু।"
"আপনি তো ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছেন! রঙিন ইতিহাস! এবারের দোল কামুকাকুময় হচ্ছে তাহলে! ক্লাবের দাদারা জানলে আপনাকে কাল্টিভেট করবে তো!"
"প্রমিস করো, কাউকে কিচ্ছু জানাবে না! এ হল দোলিও সারপ্রাইজ! ঐদিন সকালেই সবাই সব জানবে। কেবল লাল রং টা হয়ে গেলেই...."
"আচ্ছা কাকু, আমি আসি আজ। অনেক কাজ বাকি। আপনি লাল রং বানানোর জন্য দিশি রাঙা আলু খু্ঁজুন। এ্যাডভান্স হ্যাপি হোলি।
সাইকেলটা ঘুরিয়ে নিয়ে প্যাডেলে একটু জোরে চাপ মারলুম। ব্যস্ত রাস্তার ভীড়ে আমার সাইকেল রথের মত এগিয়ে চলেছে। কাকুর কথা কানে আসছে, "কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই ..." আমি ভাবছি, রোব্বারের সকালে পাগলের প্রলাপ শোনার কি খুব প্রয়োজন ছিল?
মা কে বাজারের ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে ক্লাবের দিকে রওনা দিলুম। মলিদের বাড়ির দিকে চোখ যেতেই অর্গ্যানিক রঙের আগাম গন্ধে মনটা ম ম করে উঠল। ঔৎসুক্য নিয়ে তাকাতেই দেখি মলি মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলছে ঝুলবারান্দায়। ওর শরীরী জৌলুসে আমার দেহের প্রতিটা অর্গ্যান থেকে মাউথঅরগ্যানের মেলোডি শেষ ফাগুনের সাথে মিলেমিশে একসা! বোকার মত তাকিয়ে আছি সাইকেলের সিটে বসে। একটা পলাশ খসে পড়ল সামনের চাকায়। মলির ভ্রূক্ষেপ নেই। সে মোবাইলে ব্যস্ত। অভিব্যক্তি বেশ ঝাঁঝালো মনে হচ্ছে। তবে কী হ্যলোজেন গোষ্ঠীর কেউ আছে অন্য প্রান্তে? কি জানি বাবা? এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। ভাল ছেলে বলে আমার একটা সুনাম আছে। সেটাকে খোয়াতে চাই না। কুমুকাকিমার কাছে তাহলে মুখই দেখাতে পারব না। তার চেয়ে ক্লাবে গিয়ে অপুদাকে রং বানানো, না না, হার্বাল রং তৈরির সম্ভাব্য ইতিহাসের কথাটা বলাই শ্রেয়। ছুটির দিনের রঙিন টপিক।
কাল দোল। পরশু হোলি। কাল আমাদের। পরশু ওদের। মানে আমাদের পাড়ার অবাঙালিদের। আজকাল খবরের কাগজগুলো ছাড়া এই বাধাটা তেমন কেউ মানে না বোধহয়। বাংলা কাগজগুলো বন্ধ থাকে দোলে, আর হিন্দি কাগজগুলো হোলিতে। বেচারা ইংরাজী আর উর্দু কাগজের কর্মচারীগুলো পড়ে মহা ফাপরে! কলেজে তো গত পরশু থেকেই রং খেলা শুরু হয়ে গেছে। জোড়াসাঁকো থেকে শুরু করে কাঁটাকল রবীন্দ্রভবন হয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ি পর্যন্ত বসন্ত উৎসবের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে ছাত্রসমাজ। শান্তিনিকেতনের "ওরে গৃহবাসী"র জন্য আজ আর কেউ ওয়েট করে না। মানুষের জীবনে কষ্ট যত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে আনন্দ বেড়েছে তার চারগুন। যুদ্ধে লোক মরছে, রোগে লোক মরছে, না খেতে পেয়ে লোক মরছে, গলির মধ্যে গুলি খেয়ে লোক মরছে, আত্মঘাতী হয়ে চাষি মরছে - এতো এতো মৃত্যুও মানুষের জীবন থেকে আনন্দকে কাড়তে তো পারেই নি, বরং বাড়িয়ে দিয়েছে। ষাট টাকা কেজি আবির দু-বছরের বন্দীদশা কাটিয়ে দুশো টাকা হয়ে মানুষের বুকে, পিঠে, মুখে, গলায়, হাতে বিরাজ করছে স্বমহিমায়।
এখন রাত তিনটে। ইদানীং আমার এই সময় ঘুম ভেঙে যায়। ছাদে যাই। মলিদের বাড়িটার দিকে তাকাই অভ্যাসে। মলিকে কোনোদিন অবশ্য দেখতে পাই না। তবু। যদি কোনোদিন ...
আশায় বাঁচে চাষা। আর আমার মত নিতান্ত সাধারণ, হাইব্রিড, অ-হ্যালোজেনীয়রা। একদিন পরেই পূর্ণিমা। প্রায় গোলাকার চাঁদটা সে আভাস দিচ্ছে। একটা বিড়ি ধরিয়ে লম্বা টান মেরে তাকালুম সেদিকে। আরে! ও বাড়িতে আলো জ্বলছে! তবে কি আজ ষোড়শীর অবয়ব ধরা দেবে এই ভাল ছেলেটার অবলোকনে? কি সব ভাবছি আমি! কাল দোল। কাকু রাত জেগে রং তৈরি করছেন হয়ত। ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর। না কি পাথর গলিয়ে রং? মোবাইলের আলোটা জ্বলে উঠল। তাকিয়ে দেখি একটা কল আসছে। এ সময়ে অজানা নম্বর থেকে ফোন কল?
" হ্যালো!"
"আমি কাকিমা বলছি বাবা! কুমুকাকিমা! তোমার নম্বরটা মলির ফোনে ছিল। তুমি একটু আসতে পারবে বাবা? আমাদের খুব বিপদ!"
ফোনটা কেটে গেল। কাকিমার গলা কান্নাভেজা। তবে কি কাকু আবার অন্য পাগলামি শুরু করল? কাকিমা আমাকে ফোন করল কেন? মলি আমার নম্বর পেল কি করে? একঝাঁক প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। এক ছুটে নিচে নেমে এলুম। মা কে ডেকে বললুম কাকিমার ফোনের কথা। তারপর সদর দরজাটা খুলেই দৌড়ে কাকুদের বাড়ি।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে মলির অচৈতন্য শরীরটা। হাতের শিরা কাটলে এমন টকটকে লাল রং পাওয়া যায়, কাকু কি সেটাই বোঝার চেষ্টা করছেন? যে অর্গ্যানিক লাল রং বানানোর চেষ্টায় বিভোর ছিলেন, এই কি তা? আমি ফোন করলুম অপুদাকে। কাকু আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, "দোলের সকালে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি। এত বড় একটা সারপ্রাইজের মুখোমুখি হব। মেয়েটা বড় হয়ে গিয়েছে আমার। বুদ্ধিটা বড় হয়নি। সব ভেজাল, বুঝলে! কার সাথে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে...উচ্ছন্নে গেল! উচ্ছন্নে গেল! কাকিমার ফ্যাকাশে মুখটা একলহমায় ওঁর সাজানো বয়েস ভেঙে চুরে দশবছর বাড়িয়ে দিয়েছে যেন। মলির অচেতন শরীরটার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। জ্যোৎস্নার সাদা আলোয় কাকিমার মুখের কালচে রেখাগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
এ্যাম্বুলেন্সের বিছানায় আমার বুকের কাছে এখন মলি। মলির গথিক ষোড়শী ফিজিক আমায় আর দোলাচ্ছে না তো! অনেক সময় অনেক কিছু করার থাকলেও, ইচ্ছে থাকে না। অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও কিচ্ছু করার থাকে না। ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, চান্স ফিফটি ফিফটি। চব্বিশ ঘন্টা না গেলে কিচ্ছু বলা যাবে না। কামুকাকু আর কাকিমাকে কিছুতেই হাসপাতাল চত্বর থেকে সরানো যায়নি। আমি বাড়ি ফিরছি একা, অনেক প্রশ্ন মাথায় নিয়ে। সেদিনের মলির উত্তপ্ত ফোনালাপটা কি তবে এই কারণে? সদ্যযৌবন কি তবে এতটাই নিঃস্ব করে কাউকে? সত্যিই কি দুঃখের চারগুন হতে পারে আনন্দ? উত্তর পাওয়ার চান্স ফিফটি ফিফটি। ভাল ছেলেটা ক্ষ্যাপার মত খুঁজে বেড়াচ্ছে ফিফটি ফিফটি অনিশ্চয়তার দোলাচলে হাঁটতে হাঁটতে। আজ দোল। বাঙালিরা দোল খেলতে শুরু করবে একটু পরেই। রঙে ডুবে যাবে সব কষ্ট। কাকুদের বাড়ির দেওয়ালে অজান্তেই হলুদ, নীল ভেজাল রং ভর্তি বেলুন ছুড়বে ডোবার মাঠের চ্যাংড়াগুলো। ভয় নেই কাকু। মলি বা কাকিমা, কারোর গায়েই সেই ভেজাল রং লাগবে না। র্যাশও বেরোবে না। কি যা তা ভাবছি আমি! মলি তো খেলবে না দোল! ও তো এখন ফিফটি ফিফটি ম্যাচ খেলছে! হাসপাতালে দোল খেলা নিষেধ। সবাই যখন রং মাখছে, মলির শরীর থেকে তখন মুছে ফেলা হচ্ছে রং। অবাধ্য মন মানছে না তবু। হাইপোথ্যালামাস বলছে, মলির গায়ে এখন বকুল ফুলের গন্ধভরা কাকুর বানানো অর্গ্যানিক রং। সে রঙের নাম লাল হতে পারে না। আপনি তো লাল রং বানাননি কাকু! মলির দোল বেঁচে থাকুক ফিফটি ফিফটি টাটকা, দিশি হলুদ, সবুজ প্রত্যাশা হয়ে ...