১।
- কিন্তু দাদু, মাত্র তো হাফ নোট!
- হাফ নোট! হাফ নোটের গুরুত্ব বুঝিস?
- দাদু, তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো!
- বাড়াবাড়ি! ওই বেতালা বাঁশিওয়ালার মাথায় আমার এই লাঠি ভাঙবো একদিন! হতভাগা!!
শেষের কথাটা দাদু অনিল'দাকে উদ্দেশ্য করে বললো। ভালোই বাজায় অনিল'দা, বেশ ভালো। সুমির তো বেশ লাগে ওর বাজানো শুনতে। বিশেষত রাত দ'শটার পরে যখন অনিল'দা দেশ বাজায়। সুমির প্রিয়তম রাগ।
অনিল'দার নিজের পছন্দ অবশ্য দরবারি কানাড়া । সেটা অবশ্য অনিল'দা বাজায় আরো রাতে, পাড়ার সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পরে। সক্কলে। রাত দেড়টা থেকে দুটোর মধ্যে। রাতের তৃতীয় প্রহরের রাগ দরবারি কানাড়া । অত রাত অবধি জাগতে পারেনা সুমি। বড়োজোর বারোটা। তারপরেই সুমি শয়নে পদ্মনাভ! একদিন মাঝ রতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়াতে শুনতে পেয়েছিলো। ভীমপলাশি। অনিল'দা বাজাচ্ছিলো। তারপর চেষ্টা করেও কোনোদিন শুনতে পায়নি। অত রাত অবধি কিছুতেই জাগতে পারেনা সুমি। দাদু অবশ্য রোজই শোনে। দাদুর রাতে ঘুম হয়না তেমন।
দোলের সময় গ্রামের বাড়িতে এসেছিলো সুমি দাদুর সাথে দেখা করতে। ভেবেছিলো কটা দিন কাটিয়ে কলকাতা ফিরবে। কিন্তু তার মধ্যেই হয়ে গেলো লকডাউন! মে মাসের আগে খোলার কোনো চান্সই নেই। কি ভাগ্গীস ল্যাপটপটা সাথে এনেছিলো! এখন তাই এখান থেকেই অনলাইনে ক্লাস গুলো করা যাচ্ছে। শাপে বর হয়েছে সুমির। কলকাতায় থাকতে ভালো লাগেনা ওর। বলা ভালো, বাড়ীতে থাকতে ভালো লাগেনা সুমির। বাবা মা'র কাছ থেকে একটু দুরেই থাকতে চায় ও। আর একটা বছর। তারপর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ তে চাকরি নিয়ে সুমি চলে যাবে ব্যাঙ্গালোর। বা পুনে, অথবা গুরগাঁও। কিন্তু কলকাতায় আর না। কিছুতেই না। দাদুর জন্য খুব মন কেমন করবে অবশ্য। তাই তো সুমি সুযোগ পেলেই চলে আসে দাদুর কাছে। ঘন্টা তিনেকের রাস্তা কলকাতা থেকে। একটু লঙ উইক এন্ড পেলেই সুমি নিজের ছোট্ট অল্টোটা চালিয়ে চলে আসে গ্রামে - দাদুর কাছে। সুমির ভয় করে। খুব ভয় করে যখন দূর্গাপুর হাইওয়েতে সাঁই সাঁই করে গাড়ি গুলো ওকে ওভারটেক করে বেড়িয়ে যায়। যখন দুটো ট্রলারের মাঝখান দিয়ে বেড়িয়ে আসে ও নিজের মেরুন রঙের অল্টোটা নিয়ে, যখন নিজের কম্ফরটেবল ষাট কিলোমিটার পার আওয়ারের স্পিড ছেড়ে একশো ছোঁয় ওর স্পিডোমিটারের কাঁটা অন্য গাড়িকে ওভারটেক করার জন্য - খুব ভয় করে ওর। দাদু অবশ্য এসব জানে না। শুধু বলে, দিদিভাই, সাবধানে গাড়ি চালিয়ো কিন্তু! দাদু যখন সুমি কে "তুমি" বলে, তখন দাদু একটা উৎকন্ঠায় থাকে। সুমি জানে। তখন যেন আরো, আরো বেশি দুঃখ হয় সুমির বুড়ো মানুষটার জন্য। আর সেই দুঃখর পেছন পেছন ধেয়ে আসে একটা চাপা, বোবা রাগ। বাবা মায়ের প্রতি।
আগে ছোটোবেলায় গ্রামের বাড়ীতে আসার জন্য পুরো একটা বছর অপেক্ষা করতে হত সুমি কে। পুজোর সময়। মা নীমরাজি হয়ে আসতো সে সময়। তারপর অরেকটু বড় হওয়ার পর, মানে সুমি যখন ক্লাস সেভেনে পরে, তখন থেকে আসা বন্ধ হয়ে গেল ওর। বাবা মা না এলে তো আর একা একা আসা যায় না! কলেজে ওঠার পর থেকে তাই সুমি দিন তিনেকের ছুটি পেলেই চলে আসে এখানে। প্রথম প্রথম বাসেই আসতো, কিন্তু বাবা জোরাজোরি করে বছর দেড়েক আগে গড়িটা কিনে দিয়েছে সুমিকে। বাবার সব কথা ফেলতে পারেনা সুমি। তবে এই যে গাড়ি চালিয়ে এতটা পথ আসা - এতেও আপত্তি ছিলো মায়ের। অবশ্য যখন সুমি বাসে করে আসতো, তখনো যে মায়ের খুব সায় ছিলো তেমনটা নয়। তাই মায়ের আপত্তিটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে এই বছর দেড়েক হলো সুমি একা একাই ড্রাইভ করে আসে। ভয় করলেও।
গাড়িটার নাম ষষ্টিচরণ। সুমিই দিয়েছে। ভারি ভালো ছেলে। সুমির কথা মতন চলে। একটুও বেগড়বাঁই করেনা। কলকাতা থেকে পুরো রাস্তাটা ষষ্টিচরনের সাথে কথা বলতে বলতেই আসে সুমি।
দক্ষিণের জমিটার ওপরে যে জাম গাছ্টা আছে, সেটায় বসে একটা পাখি ডেকে চলেছে। পাখিটার নাম ডাহুক, দাদু বলেছে। বাড়ীটা ভারি সুন্দর। মানে, গ্রামের দিকের সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ী যেমন হয়, তেমন। উঠোন, পুকুর গাছ-গাছালি নিয়ে ছড়ানো বাসস্থান। হরিণখোলা নদীর ওপরের ব্রীজটার পরেও অল্প কিছুটা পাকা রাস্তা থাকে। তারপর বাঁ দিকে নেমে যেতে হয় সুড়কি বেছানো লাল রাস্তায়; দু দিকে ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি। সেই রাস্তা ধরে কিলোমিটার দুয়েক এলেই এই বাড়ি। ঢোকার মুখে অনেকটা খালি জমি। তারপর সদর দরজা। সদর দরজা দিয়ে ঢুকে উঠোন। উঠোনটা পেরোলেই লাল মেঝের টানা বারন্দা। বারন্দা বরাবর ঘরের সারি। সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। দোতলার ওপরে চিলেকোঠার ঘর। বাড়ীর সামনের জমিটার পাশেই বড় পুকুর। সুমি এলেই দাদু ওটাতে জাল ফেলতে বলে অভিরাম'দা কে। অভিরাম'দা সপরিবারে থাকে এ বাড়ীতেই। দাদুর দেখাশোনা করে। বাড়ীর পেছনে খিড়কি পুকুর। বাঁশ ঝাড় দিয়ে ঘেরা। ওটাতে আগে বাসন মাজা হত। এখন কিছুই হয়না। আর খিড়কি পুকুরের ওপারেই অনিল'দা দের বাড়ির পেছনের বাগান ।
এখানে এলে সুমি রাতে দো'তলাতেই শোয়। অভিরামদা'র বউ মালতী'দি ও থাকে সাথে। ঘরের মেঝেতে বিছানা করে শোয় মালতী'দি। রাতের ঠান্ডা বাতাস বাড়ীর লাগোয়া ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে এসে জানলা দিয়ে ঢোকে ঘরের ভেতর। বাতাসের সাথে সাথে ঘরের ভেতরে ঢোকে অনিল'দার বাঁশির সুর।
দাদুর কাছ থেকে সুমি শিখেছে ভূপালি আর দেশকারের পার্থক্য। কলেজে ওঠার আগে অবধি সুমি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখলেও, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সাথে ওর পরিচয় দাদুর কাছ থেকেই। প্রত্যেকবার এখানে এলেই দাদু তানপুরা নিয়ে বসে ওকে বুঝিয়েছে আরোহ - অবরোহ, বাদি-সম্বাদি, ঠাট, মাত্রা, তাল। নিজে গান শেখার সময়ও এ সবের কিছু কিছু শিখেছে সুমি, কিন্তু দাদুর কাছ থেকে শেখার আনন্দই আলাদ। দাদুর কাছেই ওর পরিচয় রাগ - রাগিনীর সাথে।
অনিল'দা অবশ্য খালি বাঁশিই বাজায়, গান গায় না। ওর বাঁশি সুমি প্রথম শোনে বছর দুয়েক আগে। অনিল'দা তার আগে ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করতো। সফটওয়্যার। দু-বছর হলো চাকরি বাকরি ছেড়ে গ্রামে এসে সম্পত্তি সামলাচ্ছে আর চাষ করছে। অর্গ্যানিক ফার্মিঙ। দাদু খুব খুশি হয়েছিলো অনিল'দার ডিসিশনে। সুমিকে দাদু বলেছিলো, ঠিকই তো করেছে অনিল। নিজেদের সম্পত্তি থাকতেও লোকের গোলামি কারা করে জানিস? মূর্খরা! এই যেমন তোর বাবা।
দাদু আর জমিজমা দেখে উঠতে পারেনা ঠিক মতন। মুনিষরা চুরি করে সুযোগ পেলেই। একা মানুষ। তা ছাড়া শরীরটাও তো ঠিক যাচ্ছেনা দাদুর কিছু বছর ধরে। বাবা অবশ্য বারে বারেই বলে দাদুকে কলকাতা চলে আসতে, কিন্তু দাদুর ওই এক গোঁ - নিজের জন্মভূমি ছেড়ে যাবেনা। তাছাড়া ঠামুর স্মৃতিও আছে এখানে, তাই দাদু কিছুতেই কলকাতায় গিয়ে পাকাপাকি থাকতে পারবেনা। সুমি সব বোঝে। দাদু না বললেও ও বোঝে।
তাই অনিল'দা যখন গ্রামে চলে এলো সব ছেড়ে ছুড়ে, তখন দাদু আনন্দ পেয়েছিলো সব থেকে বেশি। অনিল'দার বাবা মা - সুধাকর জেঠু আর মেনকা জেঠিমা - ওরা পর্যন্ত অবাক হয়েছিলো অনিলদার এহেন সিদ্ধান্তে। কিন্তু দাদু ওদের বুঝিয়েছিলো। দাদু জেঠিমাকে বলেছিলো, বউমা, গ্রামের একটা ছেলে তো অন্তত ফিরে এলো! ও ঠিক পারবে সব সামলাতে! আরে, চাষবাস যে ওর রক্তে আছে! বুড়োর কথা তুমি মিলিয়ে নিও।
তা সামলে নিয়েছে বটে অনিল'দা। নতুন জমি কিনেছে অনেক। সেখানে লোক ও খাটছে প্রচুর। সুমিদের জমিজমা গুলোও কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখে দেয় অনিল'দা। দাদুই বলেছে ওকে এসব কথা। এই সব গল্প শুনতে যে সুমির খুব একটা ভালো লাগে তা নয়। ধান-চালের খবরে কোনো উৎসাহ নেই সুমির। কিন্তু দাদু যখন কথা গুলো বলে, তখন চুপ করে শোনে সুমি। শুনলে দাদুর ভালো লাগবে। সুমি জানে।
তা এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু গন্ডগোলটা বাধলো গত বছর বিজয়া সম্মেলনীর দিনে। না, রাতে। প্রতি বছর বিজয়া সম্মেলনীতে গ্রামের পুজোতে বেশ একটা জলশা মতন হয়। মানে, ঠিক ওই মাইক বাজিয়ে আগডুম বাগডুম যা কিছু একটা নয়। ছোটো অথচ সুচারু অনুষ্ঠান। শিল্পীরা সকলেই হয়ত তেমন নামি কেউ নন, কিন্তু সকলেই দড়। জলশাটা দাদুর তত্ত্বাবধানেই হয়। অগস্ট মাস থেকেই মহড়া চালু হয়ে যায় এ বাড়ীতে আসেপাশের শিল্পীদের নিয়ে। তো হোলো কী, অনিলদা'র সেদিন বাজানোর কথা ভূপালি। কারন, হিসেব অনুযায়ী অনিল'দার স্টেজে ওঠার কথা রাত আটটা নাগাদ। মহড়াও সেই মতই হয়েছে। দাদু ওর বাজনা শুনে বলে দিয়েছে, ঠিক আছে। দাদু ঠিক আছে বলেছে মনে, সত্যিই ঠিক আছে। দশ গ্রামের লোকে জানে সে কথা। লোকে বলে বারিন মুকুজ্জের সুর-তাল ভুল হতে ই পরেনা কখনও ।
অনিল'দার আগের শিল্পী পাশের গ্রামের হারাধন পোদ্দার। অনিল'দা বারে বারে বলে দিয়েছিলো, হারাধন জেঠু, আটটার আগেই স্টেজ থেকে নেমে যেও কিন্তু। ন'টা বেজে গেলে কিন্তু ভূপালি বাজানো যাবে না!
হারাধন জেঠু বলেছিলো, আরে চিন্তা করিস না। আমি কি আজ থেকে এই ফাংশান করচি? তোর তখনো জন্ম হয়নি!
জলশার দিন হারাধন জেঠু সময় মতন বেড়িয়েও ছিলেন বাড়ী থেকে নিজের বেহালা কাঁধে নিয়ে। হরিণখোলার ব্রীজের কাছে এসেই আক্কেল গুড়ুম! অবরোধ। বাস থেকে নেমে প্রথমে ছেলে ছোকরাদের সাথে তো একচোট হম্বিতম্বি করলেন, কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। শেষে জেঠুর কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে অবরোধওয়ালাদের মনে একটু দয়া হলো। বললো, দাদু, পায়ে হেঁটে ব্রীজ পেরিয়ে যান। ওপারে গাড়ি পেয়ে যাবেন।
হাঁফাতে হাঁফাতে হারাধন জেঠু যখন প্যান্ডেলের সামনে এসে পৌঁছুলেন তখন বাজে সাড়ে সাতটা। অনিল'দাকে দাদু ঠেলে স্টেজে পাঠাচ্ছে। দাদু বললো, হারাধন তুমি তাহলে জিরিয়ে নাও। অনিল নামলে তুমি উঠো না হয়? "বারিনদা, ফেরার গাড়ি পাবো না! রাতে বাড়ী না ফিরলে গিন্নি কুরুক্ষেত্তর বাঁধাবে।" এই বলে ঠেলেঠুলে সেই যে স্টেজে উঠলেন হারাধন জেঠু, নামলেন সেই পৌনে ন'টায়। নেমে অনিল'দা কে বললেন, দেখ, এখনো রাতের প্রথম প্রহরই আছে। তোর ভূপালি বাজিয়ে নে খানিকটা। কিছু মনে করিসনা বাবা! তোর জেঠিমাকে তো জানিসই!
দর্শকদের মধ্যে সেদিন সুমিও ছিলো। অনিল'দা স্টেজে উঠলো ন'টার পরেই। সুমি ভেবেছিলো হয়তো দেশই বাজাবে অনিল'দা, কিন্তু দু-মিনিটেই বুঝতে পারলো ওটা রাগ যোগ। সেও ঠিকই ছিলো। আলাপটা শুনে দাদুও মৃদু মৃদু মাথা নাড়ছিলো, কিন্তু গোল বাঁধলো জোড়ের সময়। হ্যাঁ, সত্যিই সেদিন বিট মিস করেছিলো অনিল'দা। অন্তত বার তিনেক। সুমির কানেও এড়ায়নি য্খন, তখন দাদুর তো কথাই নেই। সুমির পাশ থেকে দাদু উঠে গট গট করে প্যান্ডেল ছেড়ে বেড়িয়ে গেছিলো। আর সেদিনের পর থেকেই অনিল'দার নাম শুনলেও রেগে যাচ্ছে দাদু। সাড়ে পাঁচ মাস হয়ে গেলো, দাদুর রাগ একটুও কমেনি। এত অবুঝ কেনো দাদু?
সুমি ভাবে, সেদিন দুম করে যোগ বাজাতে গেলো কেন অনিল'দা। রাত ন'টার পরে দেশ বাজালেই তো পারতো! দেশটা বেশ ভালো বাজায় অনিল'দা; যাকে বলে ফ্ল-লেস। কিন্তু অনিল'দা ওরকমই। কি যে করবে, তা নিজেই জানে না! দুম করে যে লোক মাল্টিন্যাশান্যাল কোম্পানির মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে এসে চাষ শুরু করতে পারে, সে যে দেশ ছেড়ে যোগ বাজাবে - তাতে আর তেমন আশ্চর্যের কী আছে!
২।
-দিবাকর, ওদিকটায় ছড়া। ওদিকটায়। কোনের জমি গুলোতে সার ঠিকমতন পড়া চাই।
সকালের দিকে মাঠে এসে নিজে কাজ গুলো দেখতেই হয়। না হলেই ভুলভাল হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। দুটো আলের সংযোগস্থলের জমি টুকু সর্বদাই নেগলেক্টেড হয়। নিজে না দেখলেই ওই যায়গাটুকু তে সার পড়তো না। জমির চারটে কোনা ধরলে, অনেকটাই জমি। এরকম আরো খুঁটিনাটি নিজে না দেখলে চলে না। তাইতো ভোর ভোর জমিতে চলে আসে অনিল। তা ছাড়া চাষবাস করবে বলেই তো টিম লিডের পজিশন ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছে ও। না, ঠিক তা নয়। চাকরি ছেড়েছে বলে ও গ্রামে এসেছে, গ্রামে আসবে বলে চাকরি ছাড়েনি। নিজের কাছে সৎ থাকাটা খুব প্রয়োজন।
চাকরিটা সমস্যা ছিলো না। সমস্যা ছিলো অনুষঙ্গ গুলো। কর্পোরেটে চাপ তো থাকবেই। সেটা খানিকটা উপভোগ ও করতো অনিল। কিন্তু সেই একই গতে রোজ জীবনটাকে চালানো, খানিকটা অর্থহীন মনে হতে লেগেছিলো। অফিস, অফিস-পলিটিক্স, উইকএন্ড-পার্টি, অফিস, অফিস-পলিটিক্স, উইকএন্ড-পার্টি, অফিস, অফিস-পলিটিক্স, উইকএন্ড, পার্টি - সেই একই বৃত্ত। আসলে সেটাও হয়ত সবটা নয়। অনুষ্কা। ব্রেক আপের পরও অনুষ্কা কিন্তু বন্ধুর মতই মিশতে চাইতো অনিলের সাথে। কিন্তু ব্রেক আপের পর একই অফিসে, একই টিমে একসাথে কাজ করতে অনিলের একটু অসুবিধেই হচ্ছিলো। একটু নয়, বেশ অসুবিধে হচ্ছিলো। নিজের কাছে সৎ থাকাটা খুব জরুরি। সারাক্ষণ মনে হত যেন, অফিসের সকলে ওর দিকে অলক্ষ্যে তাকিয়ে আছে। মনে মনে হাসছে। সে রকম মনে হওয়ার কোনো কারন অবশ্য ছিলো না, কিন্তু তবু মনে হতো।
অন্য চাকরি জয়েন করাই যেত, কিন্তু সেও তো একই রকম হত। সেখানেও হয়ত কারোর সাথে সম্পর্ক হত। হয়ত টিকতো সম্পর্কটা, হয়ত ট্কিতো না, কিন্তু হরেদরে জীবনটা একই থাকতো। কোনো গুণগত পার্থক্য হতোনা।
অথচ ভেবে দেখলে দেখা যাবে, এ সবই কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জানা ছিলো অনিলের। ছিলো না কি? শিবপুরে যেদিন কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ও ভর্তী হয়েছিলো, সেদিনই তো ও জানতো - ব্যাঙ্গালোর, অফশোর, ব্যাঙ্গালোর - এই গতেই কাটবে ওর জীবন। বাকি যারা ভর্তী হয়েছিলো, তারাও জানতো। কর্পোরেট লাইফ কী - তারও একটা ধারনা হয়ে গিয়েছিলো চার বছরে। কিন্তু তবু যেদিন চাকরিটা ছাড়লো ও, একটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলো। চাকরি করতে করতে কিন্তু মনে হয়নি যে কোনো বন্ধনে জড়িয়ে আছে ও।
গ্রামে ফিরে কটা দিনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো - এবার কী! জমিজমা দেখাটা শুরু করছিলো একটা স্টপগ্যাপ ব্যবস্থা হিসেবে। কিন্তু কটা মাস যেতেই ধীরে ধীরে ব্যবস্থাটার সাথে মানিয়ে নিলো অনিল। ঠিক মানিয়ে নেওয়ার কিছু ছিলো না অবশ্য। ছোটোবেলা থেকে দেখা, চেনা পরিবেশ। স্কুলে পড়ার সময় বাবার সাথে রোজ জমিতে আসতো ও। মুনিষরাও প্রায় সকলেই চেনা। বরং দেখতে গেলে মাঝের কটা বছরই একটা অন্য পরিমণ্ডলে কেটেছে ওর। ঝাঁ চকচকে। আর্বেন। প্লাস্টিক।
জমিজমার তদারকি করতে করতে হয়ত বা ভালোও বেসে ফললো এই জীবনটাকে অনিল। লেড ব্যাক; নিজের সময় মতন কাজ করো। কোনো ডেডলাইন নেই। নিজেই নিজের বস। আর আসপাশের সবাই যখন বলে - ইঞ্জিনিয়ার হয়েও কি সুন্দর জমি সামলাচ্ছে - তখন, মিথ্যে বলে লাভ নেই, একটা শ্লাঘা অনুভব হয় বই কি!
তবে কর্পোরেট লাইফটাকে একেবারেই যে মিস করেনা, তেমনটা নয়। পুরোনো কলীগদের ফোন এলে একটু যেন খারাপ লাগা তৈরি হয় বটে, তবে এখন যাকে বলে পয়েন্ট অফ নো রেটার্ন। "ওয়াও ম্যান! অর্গ্যানিক ফার্মিঙ!! টু গুড।" অনিল জানে, দে ডোন্ট মিন ইট। বাইরের লোককে বলার জন্য অনিল অর্গ্যানিক ফার্মিঙ বলে, কিন্তু তাতে পর্তায় পোষাবে না। পশ্চিমবঙ্গে এখনো সেই মার্কেটটা তৈরি হয়নি অর্গ্যানিক ফার্মিঙ -এর। তাই গ্রামের আর সকলের মতনই রাসায়নিক সার আর পেস্টিসাইড নিয়েই ওর কারবার।
তবে দিনের শেষে যে নিজের হাতে নিজের জন্য যে অঢেল সময়টা থাকে, তার জন্য এই জীবনটাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পরে না অনিল। অনেক, অনেকে দিন পর বাঁশি নিয়ে নিয়মিত রেওয়াজ করতে পারছে ও। গ্রামের শুদ্ধ বাতাসে আয়ু কিছু না হলেও পাঁচ বছর বেড়ে তো গেছেই। এই পার্কস গুলো তো আর পয়সা দিয়ে কেনা যাবে না!
সামনের বছর একটা হার্ভেস্টর কিনবে ঠিক করেছে অনিল। অনেক কম লোক দিয়ে, তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে যাবে। এই জীবনটা যখন বেছেই নিয়েছে ও, তখন এটাতেই পূর্ণতা খুঁজতে হবে।
বেলা বাড়ছে। একবার বারিন দাদুর জমিটাও ঘুরে আসতে হবে। উঠে পড়লো অনিল।
-পঞ্চা, আমি বারিন দাদুদের জমিটা হয়ে বাড়ী যাবো, তুই কাজ গুটিয়ে মালপত্র নিয়ে বাড়ী চলে যাস।
বারিন দাদু আজ অবধি রেগে রয়েছে। সেদিন স্টেজে ওঠার আগেও অনিল ভেবেছিলো দেশ বাজাবে। কিন্তু স্টেজে উঠে সুমি কে দেখে মনে হলো, রোজই তো দেশ শোনাই মেয়েটাকে, আজ যোগ শোনাই। অনিল জানে রাতে ও যখন বাঁশি বাজায়, তখন সুমি শোনে। রাতের নিস্তব্ধতায় ওর বাঁশির সুর যে পোঁছে যায় সুমির কানে, তা বিলক্ষণ জানে অনিল। হ্যাঁ, সারা বছর আর সুমি কে পাচ্ছে কোথায়। তাই পুজোর কটা দিন সুমি যখন এসেইছে কলকাতা থেকে, তখন রাতের রেওয়াজটা কিছুতেই বাদ দিতো না অনিল। এখনও যেমন সুমি আটকা পড়েছে লকডাউনে, রাতের রেওয়াজটা কিছুতেই বাদ দেয় না অনিল।
আর ওই যোগ বাজাতে গিয়েই গোলটা বাঁধলো। বিট মিস করলো। হওয়ার কথা নয়, তবু হলো। এক আধবার হয়, তবু এক কথা। তিন-তিন বার। আসলে প্রথমবার বিট মিস করেই একটু টেন্সড হয়ে গিয়েছিলো অনিল। সেই টেনশনেই আরো দু-বার মিস করলো। হাফ বিট, কিন্তু বারিন দাদুর কাছে ওই হাফ বিটের ক্ষমা নেই।
বারিন দাদু'দের জমিটার কাছাকাছি অসতেই অবাক হলো অনিল। সুমি দাঁড়িয়ে আছে। মাঠের দিকে মুখ করে, অনিলের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে সুমি। পাশে বারিন দাদু। অনিল গিয়ে দাদু'কে প্রণাম করলো। ওর মাথায় হাত ছোঁয়ালো বারিন দাদু, কিন্তু কোনো কথা বললো না। সেদিনের পর থেকে এরকমই চলছে। যেতে আসতে দেখা হচ্ছে, মা ও বাড়ীতে গেলে সকলের সাথে অনিলের খবরও নেওয়া হচ্ছে - কিন্তু বুড়ো কথা বলবে না! এ কী আজব ছেলেমানুষী রে ভাই!
একটা কচিকলাপাত রঙের সালওয়ার কামিজ পরেছে সুমি। সাদা ওড়না।
-অনিলদা, ভালো আছো তো?
- হ্যাঁ রে! তুই ভালো তো?
- এই চলে যাচ্ছে। অনলাইন ক্লাস করেই কেটে যাচ্ছে। দাদু তুমি চললে কোথায়?
বাড়ীর দিকে পা বাড়িয়েছে দাদু।
- তুই কথা বল, আমি বাড়ী চললাম।
- সাবধানে যেও কিন্তু দাদু! কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে, মাটি ভেজা আছে এখনও।
মন্থর পায়ে লাঠি হাতে চলে যাচ্ছে দাদু। সেদিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল সুমি।
-অনিল'দা, একদিন বিলাওয়াল শোনাবে?
- মুস্কিলে ফেললি!
- কেনো গো!
- বিলাওয়াল বাজানোর সময় তো সকাল দ'শটা থেকে বারোটার মধ্যে। ওই সময়টা তো মার্কেট হই হই করে চলছে! ট্রেডিঙে ব্যস্ত থাকি তো ওই সময়! আচ্ছা, একটা কাজ কর। শণিবার সকালে চলে আয় আমাদের বাড়ী, শেয়ার মার্কেট বন্ধ থাকে ওদিন । তা ছাড়া মা জিজ্ঞেস ও করছিলো তোর কথা।
- আচ্ছা অনিল'দা, তুমি কক্ষোনো সময়ের বাইরে গিয়ে বাজাও না কেনো বলো তো! কি হয়?
- হয়না হয়তো কিছুই, কিন্তু যে রাগের যে সময় নির্দিষ্ট করা আছে, তার বাইরে গিয়ে বাজাতে আমার ভালো লাগে না!
- আই সী! ঠিক আছে, তাহলে ওই কথাই রইলো কিন্তু, অনিল'দা! এই শণিবার যাচ্ছি তোমাদের বাড়ী। এখন যাই। দাদু বাড়ীতে ঢুকে গেলো বোধহয় ।
সুমির চলে যাওয়ার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো অনিল। তাকিয়ে রইলো, যতক্ষণ না সুমির শরিরটা রাস্তার বাঁকে বাশঝাড়ের আড়ালে ঢেকে যায়। বারিন দাদুদের জমিটা বাড়ীর সাথে লাগোয়া হলেও, রাস্তা দিয়ে আসতে হলে খানিকটা ঘুরে আসতে হয়। অনিলদের আর ওদের বাড়ীর মাঝে যে পুকুরটা আছে, তার পাশেই ওদের খিড়কির দরজা। এইমাত্র সুমি যে বাশ ঝাড়ের পাশ দিয়ে চলে গেলো, সেটা ওই ওদের খিড়কি পুকুরটাকে ঘিরে রয়েছে। খিড়কির দরজা দিয়ে ঢুকে যাবে সুমি।
৩।
গা পা নি ধানি সা । বিলাওয়াল বাজাচ্ছে অনিল'দা। শুরুর আগে বলে দিয়েছে - শোন, পিওর বিলাওয়াল বাজাবো কিন্তু! আলহাইয়া-বিলাওয়াল নয় যে কোমল নি লাগবে। বুঝলি?
সে আর বুঝবে না সুমি! এতো মেটিক্যুলাসলি যে কেউ গানের গ্রামার ফলো করতে পারে, তা অনিল'দা কে না দেখলে জানতো না ও। না, শুধু অনিল'দা নয়, দাদুও আছে।
অন্তরায় ঢুকেছে এবার। পা - নি নি সা - সা - সা গা গা মা গা রে সা - । এই ভজনটা সুমিও শিখেছে দাদুর কাছ থেকে। এই ভজনটা ভালো, তবে বিলাওয়ালের কিছু বিস্তার যেন মনকে আরো গভীর ভাবে ছুঁয়ে যায়। যেমন, - সা রে সা, গা, মা রে সা, নী, ধা পা ধা নী নী সা, গা, রে গা পা, মা গা, মা রে সা - বিলাওয়ালের এই বিস্তার টা ওর সব চাইতে পছন্দের। মনে হয় বারে বারে শুনি! পরে কোনো একদিন অনিল'দা কে বলতে হবে এইটা বাজাতে।
ধানি সা ধানি সা ধানি সা - তেহাই তে পোঁছে গেছে অনিল'দা । বেশ বাজালো কিন্তু!
- বাহ! চমৎকার বাজালে গো অনিল'দা!!
- থ্যাঙ্কস রে! আর বল তোর ক্লাশ কেমন চলছে?
- ওই আর কি! অনিল'দা, সেন্সর নেটওয়র্কে তোমার ফান্ডা কেমন গো?
- কাজ চালানোর মতন আর কি! কেনো বল তো?
- একটা প্রজেক্ট আছে প্রীসিশন এগ্রিকালচারের ওপর। অপটিমাম সয়েল ময়েশ্চার ডিটেক্শন। একটা বড় জমির শুধু সেই প্যাচ গুলোতে জল দাও, যে গুলো ডিহাইড্রেটেড - নট দি এন্টায়ার ল্যান্ড ।
- ইন্টারেস্টিঙ! ইন্টারেস্টিঙ ইনডীড!
- তাই! কেনো বলোতো?
- কেনো কী রে! তোর মডেলটা যদি আমাদের জমি গুলোতে ইনস্টল করা যায়, তা হলে তোর প্রজেক্টটা একটা অন্য হাইটে পৌঁছে যাবে। তা ছাড়া, অমাদেরও অনেকটাই রিসোর্স বাঁচবে। নয় কি?
- কিন্তু অনিল'দা, আমাদের এখানকার মাটি তো সর্বদাই হাইড্রেটেড। আই মিন, মোস্ট অফ দ্য টাইম। আমার মডেলটা
রাজস্থানের মতন স্টেটের জন্য ঠিক আছে যেখানে জল একটা সত্যি স্কার্স রিসোর্স।
- ওহো, তা কেনো। পুরো মডেলটা এক রেখে, শুধু সেন্সর গুলোই তো চেঞ্চ করতে হবে। ময়েশ্চার সেন্সরের জায়গায় আমি কেমিক্যাল সেন্সর লাগাবো! জমিতে কোন তত্ত্বটা কম আছে জানা যাবে, আর সেই মতন সার দেবো! অপটিমাম ফার্টিলাইজেশন অফ এগ্রীকালচার ল্যান্ড! নে, তোর নেক্সট পেপারের টাইটেলটা বলে দিলাম!
- কিন্তু অনিল'দা, তুমি তো অর্গ্যানিক ফার্মিঙ করো!
- না রে! ওতে পর্তায় পোষায় না। ওসব লোককে বলার জন্য!
- অনিল'দা তুমি…
- আরে এই সুমি! কোথায় চললি? স্ট্রেঞ্জ!
ঘরের জানলা দিয়ে নিচে তাকিয়ে অনিল দেখলো সুমি উঠোনটা পেরিয়ে সদর দড়জা দিয়ে বিড়িয়ে যাচ্ছে। কি হোলো
জানে!
৪।
-কিন্তু একটা মানুষের এইটুকু সেল্ফ এস্টিম থাকবে না! এটাই বা কেমন কথা!!
ফোনটা কেটে দিয়ে খাটের ওপর ফেলে দিলো সুমি। সেদিন অনিল'দার কথা শুনে ভীষন রাগ হয়েছিলো। দু-তিন দিন গুম হয়ে থাকার পর আজকে ওর বন্ধু সুরঞ্জনা কে ফোন করেছিলো সুমি। সুরঞ্জনার সাথে কথা বললে মনটা অনেক হাল্কা হয়ে যায়। আজকেও হোলো, তবে খানিকটা। সেদিন বাড়ি ফিরে এসে দাদুকে কথাটা বলেছিলো সুমি। বলেছিলো, এ তো লোক ঠকানো দাদু! দাদু বলেছিলো, আমি মানুষ চিনি দিদিভাই! ও বেতালা আর যাই করুক, লোক ঠকাবেনা, এ আমি তোকে হলপ করে বলতে পারি! ছোটোবেলা থেকে তো দেখছি ওকে!
তারপর ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিলো, আর তা ছাড়া লোক ঠকানোর কথাটাই বা অসছে কোত্থেকে? ও তো মার্কেট রেটেই মাল বেচছে! খদ্দের কে তো আর বলছে না, এই নাও আমার অর্গ্যানিক পটল নব্বই টাকা কিলো!
কথাটা শুনে একটু থমকে ছিলো সুমি। অনিল'দার ওপর রাগটা যেন কমে গেছিলো এক নিমেষে। খানিকটা আস্বস্তও হয়েছিলো। অথচ ভেবে দেখলে সুমির আস্বস্ত হবার কোনো কারন কিন্তু নেই! রাগ করারও না। হ্যাঁ, অনিল'দা কে ও চেনে ছোটো বেলা থেকে। পুজো পার্বণে গ্রামের বাড়িতে এলে ওদের বাড়ির সকলের সাথে কথা হয়, এটা সত্যি। এটাও সত্যি যে অনিল'দাদের বাড়ির সকলে দাদুর খুব খোঁজ খবর রাখে, কিন্তু তাতেও কি ওর অনিল'দার ওপরে রাগ করার অধিকার জন্মায়?
এই ব্যাপারটা তলিয়ে ভেবে মনে মনে একটু লজ্জাই লাগছিলো সুমির। লজ্জা লাগছিলো এই ভেবে যে সেদিন ও ওভার রিয়্যাক্ট করে ফেলেছে। এখন অনিল'দার সামনে পড়ে গেলে সেই লজ্জা ঢাকার প্রয়াস করতে হবে। এই সব হিজিবিজি ভাবতে ভাবতেই সুরঞ্জনা'কে ফোনটা করেছিলো সুমি। তা সুরঞ্জনাও একই কথা বললো, দাদুর কথাগুলোই বললো। ফোনটা রেখে দেওয়ার পর তাই আরেকটু যেন ফুরফুরে লাগছে মনটা। কিন্তু ওই একটা কাঁটা খচখচাচ্ছে বটে! সেল্ফ এস্টিম! একটা মানুষের এইটুকু সেল্ফ এস্টিম থাকবে না! নিজের বেছে নেওয়া প্রফেশন কে নিয়ে, একটা মানুষ এইটুকু শ্রদ্ধাশীল, এইটুকু সৎ হবেনা!
মাথাটা টিপটিপ করছে। একবার ছাদ থেকে ঘুরে আসবে নাকি! এই সন্ধেবেলায় ছাদে ওঠার কথা শুনলে মালতি'দি চেঁচাবে। সুমির নিজেরও কেমন যেন গা ছমছম করে। চারিদিকে অন্ধকার, বড় বড় গাছ গুলো অন্ধকারে ভূতের মতন দাঁড়িয়ে, চারিদিক প্রায় নিঃশব্দ।ভয় করাই স্বাভাবিক। কিন্তু সুমি কাউকে বুঝতে দিতে চায় না। পায়ে পায়ে ছাদেই চলে এলো সুমি। ছাদে এই অন্ধকারে এলে ও কিছুতেই পেছন ঘুরে তাকায় না। ঠামু ওকে ছোটোবেলায় বলেছিলো, ভয় পেলে পেছন ঘুরে না তাকাতে। ছাদের ধারটায় চলে এলো সুমি। বুক সমান উঁচু রেলিঙটায় ভর দিয়ে নিচের দিকে তাকালো। উঠোনের আলো জ্বলছে। ও বেশ বুঝতে পারছে যে নিচের বারন্দাটায় দাদু এখনো বসে গড়গড়া টানছে। অভিরাম'দাও আশেপাশেই আছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না কউকেই। কেউ একটা উঠোনে নামলে দেখতে পেত সুমি। একটু হয়ত ভরসাও পেত। অনিল'দাদের বাড়িটার দিকে তাকালো ও। আলো জ্বলছে। বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল সুমি। হঠাৎ মনে হোলো, গতকাল রাতে অনিল'দা রোয়াজে বসে নি! তার আগের দিন বসিছিলো কি? মোস্ট প্রোব্যাবলি না ! তার আগের দিন? সেই দিনই তো সুমি রাগ করে চলে এসেছিলো অনিল'দার ঘর থেকে।
দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল সুমি।
৫।
সকাল থেকে নেট কানেকশনটা বাগড়া দিচ্ছে। মার্কেট চালু থাকার সময় নেট বেগড়বাঁই করলে মাথাটা গরম হয়ে যায়। ব্রোকারকে ফোন করা ছাড়া উপায় ছিলোনা। আর ফোনটা করার সময়ই সুমির নম্বরটা চোখে পড়লো। ব্রোকারের নাম সুমন কিনা! সুমন-এর ঠিক পরেই সেভ রয়েছে সুমির নম্বরটা। ফোনটা হাতে নিয়ে সুমির নম্বরটার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ অনিল। সেদিনের ঘটনাটা বড্ড আকষ্মিক। প্রথমে তো অনিল বুঝতেই পারেনি সুমির ওরকম ব্যবহারের কারন। বুঝতে পারার পর প্রথমে মনে হয়েছে সুমি ছেলেমানুষি করছে, ওভার রিয়্যাক্ট করছে। দু-তিন দিন যাওয়ার পর আজকে মনে হচ্ছে, সুমি হয়তো অতোটাও ছেলেমানুষ নয়। তবে সুমির জানা উচিৎ, যে অনিল দত্ত লোক ঠকায় না। খদ্দের তো বটেই, কোনো মুনিষ পর্যন্ত বলতে পারবে না যে অনিল ওদের একটা টাকাও কোনোদিন ঠকিয়েছে।
তবে কেনো বলা এই অর্গ্যানিক ফার্মিঙ-এর গল্প লোককে? এটা কি আত্মবিশ্বাসের অভাব? তা কি করে হয় - হোয়াইট কলার জব ছেড়ে একটা মানুষ গ্রামে এসে চাষ শুরু করতে পারে, আত্মবিশ্বাস না থাকলে?
সেদিনের পর আর রেওয়াজে বসা হয়নি অনিলের । প্রথম দিন বসতে পারেনি কারন ঘটনাটা নিয়ে একটা বিহ্বলতা কাজ করছিলো। তার পরের দিন একটু ধাতস্থ হওয়ার পর সুমির ওপর যেন হাল্কা অভিমান হয়েছিলো ওর। তাই ইচ্ছে করে বসেনি রেওয়াজে। আর কালকে তো রাত দশটা নাগাদ পুরোনো বন্ধুদের একটা মিটিঙ ছিলো। জুম এ। সে মিটিঙ শেষ হতে হতে প্রায় বারোটা - এত দিন পর সকলের একসাথে দেখা! হলোই বা ভার্চুয়্যাল! রাত বারোটায় আর রেওয়াজে বসলো না অনিল। ও জানে, অত রাতে সুমি জেগে থাকে না।
গতকালের মিটিঙে কে কি করছে, কোথায় আছে সকলে যখন জিজ্ঞেস করছে - তখন অনিল বলেছে যে ও চাষ করছে। অর্গ্যানিক ফার্মিঙ নয়, জাস্ট বলেছে চাষ করছে। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো অবাক হয়েছে, কিন্তু অনিলের আর ওসবে কিছু আসে যায়না। নিজের কাছে সৎ থাকাটা খুব জরুরি।
মা ডাকছে নিচ থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে একটু চমকালো অনিল। সুমি দাঁড়িয়ে আছে । অনিলের দিকে তাকাচ্ছে না।
- আমাকে বিলাওয়াল শোনাবে অনিল'দা? আলহাইয়া-বিলাওয়াল।
-কিন্তু আমি যে বেতালা সুমি। দাদু কে জিজ্ঞেস কর।
- দাদুর সাথে কাল রাতেই কথা হয়েছে অনিলদা। দাদু বলেছে মাঝে মাঝে তাল ভুল হওয়া ভালো।
মা এসে দাঁড়িয়েছে সুমির পাশে। অনিল দেখলো মা মিটিমিটি হাসছে। মায়ের স্বভাবই এরকম। কথায় কথায় বোকা বোকা হাসা।
কিন্তু অনিলের আর ওসবে কিছু আসে যায়না।
সমাপ্ত।
কৌশিক ঘোষ? নবদ্বীপ এবং কোলকাতা ও সত্তরের দশক নিয়ে চমৎকার উপন্যাসটির লেখক?
হ্যাঁ, রঞ্জন'দা! শুভ বিজয়া, ভালো থাকবেন।
ওকে।পুরনো বন্ধুর সঙ্গে এখানে দেখা, শুভ বিজয়া,