এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একটা অ-সমাপ্ত গল্প (পর্ব: ৩১ -৩২)

    Kaushik Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ | ২৮২০ বার পঠিত
  • ৩১।

    আজাদ পরিন্দা কভি কিসিকা আপনা না হুয়া। গুরুজী কে আজ শায়রীতে পেয়েছে। গান কম হচ্ছে আর শায়রী বেশি - একটুও ভালো লাগে না শোভার! ভালোটা লাগবে কি করে? কবিতার মানে বুঝতে যদি দশ বার মানে বই খুলতে হয়,তবে তাতে আনন্দ আছে কোন? ভাবটা নয়, ভাষাটাই যে বুঝতে পারেনা শোভা! হিন্দি ভাষাটাই জানেনা ও, তার আবার উর্দূ!

    তবে ভাষাটায় একটা মাদকতা আছে - এটা মানতেই হবে! গুরুজীর শায়রী গুলোর বিশেষ মানে না বুঝলেও ওনার গলায় শব্দ গুলোর ধ্বনিময়তা, বাচন ভঙ্গী, উপস্থাপনা আর সকলের মতই ওকেও আবিষ্ঠ করে রাখে। আর সকল মানে বিশ্বনাথ দা, তবলা বাদক তাপসদা আর এস্রাজের এনায়েৎ। এই কজনের বাইরে আর কেউ কখনও গুরুজীর শায়রী শুনেছে বলে তো মনে হয়না শোভার। ভীষণ প্রচার বিমুখ মানুষ উনি।

    পরিন্দা মানে কি? পরে বিশ্বনাথদা কে একলা পেলে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। আজকাল অবশ্য বিশ্বনাথদা কে একলা পাওয়ায় তেমন অসুবিধে নেই। গান শেখা হয়ে গেলে সকলে চলে যাওয়ার পর এটা ওটা ছুতো করে বিশ্বনাথদা ওকে আরো কিছুক্ষণ বসিয়ে অল্প কিছু গল্প গাছা করে, তারপর বাড়িতে ছেড়ে আসে। শোভা বোঝে। আসলে কিছু দিন হল, গুরুজীকে বিশ্বনাথদা নিজেদের বাড়িতেই নিয়ে এসেছে; আজকাল গুরুজী এখানেই থাকেন। ছাদের ওপর একটা একটেরে ঘর আছে, তাতেই থাকেন উনি। আগের বাড়িটার বাড়িওয়ালা বড্ড বিরক্ত করছিল গুরুজীকে। তা শাপে বরই হয়েছে বলতে হবে। বিশ্বনাথদা সারাদিন গান নিয়ে থাকতে পারে। সত্যি, অনেকটাই শিখে গেছে বিশ্বনাথদা। শোভা তো গত সপ্তাহ অবধিও পিয়া কি নজরিয়া তেই আটকে ছিল, আজকে সবে অন্তরাটায় ঢুকেছে।

    বিশ্বনাথদার সাথে একলা সময় কাটাতে ভারি ভালো লাগে শোভার! হোক না মোটে দশ পনের মিনিট,তাই বা কম কি? রাস্তায় বেরলেই বিশ্বনাথদা গম্ভীর ভাবে চুপচাপ হেঁটে যাবে, দু-একটা কথা বলবে হয়ত কখনও সখনও আর শোভাদের বাড়ি চলে এলে- আসছি, সামনের শুক্রবার দেখা হবে - বলে পেছন ঘুরে চলে যাবে। একবারের জন্যও ঘুরে তাকাবে না।

    গান শেখা হয়ে গেলে বিশ্বনাথদা গুরুজীকে নিজের ঘর অবধি পৌঁছে দেবে , যাওয়ার আগে শোভাকে বলে যাবে অপেক্ষা করতে। ফিরে এসে এটা ওটা গল্প করে শোভাকে আটকে রাখবে কিছুক্ষণ আর তারপরে বলবে চল, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওই সময়টা বিশ্বনাথদা কে আরো, আরো ভালোবেসে ফেলে শোভা, নিজের সব কিছু দিয়ে ভালোবেসে ফেলে।

    গান-শায়রী শেষ হলে পর আজকে শোভাও গেল বিশ্বনাথদার সাথে গুরুজীর ঘর অবধি। ছটা দেওয়াল ঘরটায়। একটা দেওয়ালে দরজা আর বাকি পাঁচটায় জানলা রয়েছে। ঘরের মধ্যে তাই সর্বদাই খেলে বেড়ায় আলো আর বাতাস। গুরুজীকে এরকম একটা ঘরেই মানায়। ঘরটা যেন অনেকটা গুরুজীর মতই - একা, কিন্তু সদানন্দময়। একটু থমকাল শোভা। গুরুজী সদা হাস্যময় বটে কিন্তু সর্বদাই আনন্দে থাকেন কি?

    বিশ্বনাথদার সাথে বাড়ির রাস্তায় পা বাড়াতে বাড়াতে অন্যদিনের মতই সন্ধ্যে হয়ে গেল। আগে হলে মা বকা ঝকা করত, কিন্তু বিশ্বনাথদা সাথে থাকে বলে আর কিছু বলে না। হতে পারে বিশ্বনাথদার প্রতি মায়ের একটা ভরসা জন্মেছে। জন্মালেই ভালো!

    আজ হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা বলছে বিশ্বনাথদা, ফিরে ফিরে তাকাচ্ছেও শোভার দিকে, অন্যদিনের মতন চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছেনা। মনের ভেতরের নাম না জানা শিরশিরানিটা অল্প অল্প ছড়িয়ে পরছে শরীরেও। পথ চলতি মানুষজন বা রিক্সার শব্দ কানে ঢুকছেনা ওর। কথার উত্তর দেওয়ার ছলে বিশ্বনাথদার দিকে তাকিয়ে নিচ্ছে শোভাও। চোখে চোখ মিলতে শিহরণ লাগছে বুকে।

    সেই একই রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির দড়জাটা এসে পড়ে আগের দিনের মতই, কিন্তু যেন আগের চাইতে একটু বেশি তাড়াতাড়ি। বাড়ির সামনের রাস্তাটাতে থামল দুজনে। আর কটা মূহুর্তের পরেই এক সপ্তাহের অদর্শন। ভগবান, আরো কিছুক্ষণ বিশ্বনাথদাকে সঙ্গে রাখো! ঞ্জআসছিঞ্জ বলে বিশ্বনাথ পেছন ঘোরা মাত্রই ঝুপ করে লোডশেডিঙ হয়ে গেল। শোভাদের পিঠের দিক থেকে সমবেত কন্ঠে একদল কিশোর কিশোরীর উল্লাস ধ্বনি ছুটে এল - ঘোষ বাড়ির পোড়োর দল! অন্ধকার আর চিৎকারেরর আকস্মিকতা থেকে নিজেকে সামলে নিতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগেনি শোভার। ধ্বাতস্থ হতেই শোভা নিজের ডান হাতের তালুটা আবিষ্কার করল বিশ্বনাথদার কঠিন হাতের মধ্যে। চারি দিকে নিকষ অন্ধকার। কোন কথা না বলে শোভা সমস্ত অন্তঃকরন দিয়ে শুষে নিচ্ছে নিজের কাঙ্খিত পুরুষের প্রথম স্পর্শ। কয়েক সেকেন্ড। একটা দুটো আলো জ্বলছে বাড়ি গুলোতে। হ্যারিকেন মোমবাতি। যতটা আকস্মিক ভাবে ওর হাতটা ধরেছিল, ততটাই আস্তে আস্তে ওটাকে ছেড়ে দিল বিশ্বনাথদা। বিশ্বনাথদার অবয়বটা পেছন ঘুরে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। ছিটে ছিটে আলো আঁধারিতে দাড়িয়ে মনের ভেতরের অশান্ত ঘোড় দৌড়টাকে প্রশমিত করে বাড়ির দড়জার দিকে পা বাড়াল শোভা।

    কলঘরে ঢুকে চোখে মুখে বেশ করে জলের ঝাপটা দিল শোভা। গামছাটা হাতে করে দাদা-বৌদির জন্য তৈরি নতুন ঘরটাতে ঢুকল। বৌদি! হি হি! ওদের বয়সী চাঁপা নাকি ওর বৌদি! আর শুধু ওর? বড়দি মেজদিরও বউদি! প্রথম প্রথম সম্বোধনটায় চাঁপাও বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিল, কিন্তু কিছু করার নেই - মায়ের কড়া নির্দেশ। তা এই মাস কয়েকে ওরা সকলেই বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে ব্যাপারটায়। এখন আর চাঁপা বৌদি ডাক শুনে লজ্জা পায়না। চাঁপাকে মনে মনে নাম ধরে ডাকলেও পারস্পরিক কথোপকথনে শোভারও আজকাল কোন অসুবিধে হয়না চাঁপাকে বৌদি বলে ডাকতে।

    বিছানায় বসে ছিল চাঁপা। শোভাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ”কি রে, তোর গান শেখা হল?”

    -হ্যাঁ! তুমি কি করছ?

    -কিছুই না রে! এই বসে আছি এমনিই।

    চাঁপার মুখে লেগে থাকা আবছা বিষাদটা পড়তে পারল শোভা। বেচারা চাঁপা! কিচ্ছুক্ষণ ওর সাথে কথা বার্তা বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে এল শোভা। পড়তে বসতে হবে।

    শোভার চলে যাওয়া দেখছিল চাঁপা। এক সময়ের সহপাঠিনী আজকে ননদ, কেমন অদ্ভূত না ব্যাপারটা? অল্পদিন হল এ বাড়িতে এসেছে, কিন্তু মানিয়ে নিতে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। এরা সকলে খুব ভালো, ওকে খুব ভালোও বাসে। শুধু বরকে ছেড়ে সারাটা সপ্তাহ থাকতে হয় - এটাই ভালো লাগেনা ওর। সপ্তাহান্তে ক্লান্ত মানুষটাকে আবার সেই কলকাতা থেকে এতটা পথ আসতে হয় - সে তো শুধু ওরই জন্য! শণিবার কত রাত করে বাড়ি ঢোকে মানুষটা! মাঝখানের একটা দিন পলক না ফেলতেই কেটে যায়। সোমবার কাক ভোরে উঠেই দৌড়তে হয় আবার অফিসের উদ্দেশ্যে। চাঁপার একদম ভালো লাগে না। ওর ইচ্ছে করে কলকাতায় চলে যেতে। সদ্য বিয়ে হয়েছে ওদের। এভাবে মন তো দুরের কথা, একে অপরের শরীরটাকেও যেন চিনে উঠতে পারছেনা ওরা।

    লালের আভা লাগল চাঁপার গালে; ওর অজান্তেই। প্রথম বার সঙ্গমের পর খুব ব্যাথা বোধ হয়েছিল,কিন্তু এখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে ওর শরীর। এ যেন এক নেশা। কিন্তু অনিয়মিত মিলন ওকে তৃপ্ত করার চাইতে অস্থির করছে বেশি। অথচ এ কথা কাউকে বলতেও পারছেনা ও; নিজের স্বামীকেও নয়।

    বিয়ের আগে থেকেই এ বাড়িতে যাতায়াত চাঁপার। ওর এই ঘরটা আগে ছিলনা। ওদের বিয়ের কথা শুনে বাড়িওয়ালা বানিয়ে দিয়েছে। ভাড়া অবশ্য কিছু বেড়েছে তাতে।
    ঘরটা হওয়ার ফলে বাড়ির ভেতরের উঠোনটাই লোপাট হয়ে গেছে।একটা চাঁপা গাছ ছিল উঠোনটায়,সেটাও কাটা পড়েছে। কলকাতায় কখনও যাওয়া হয়নি ওর। কলকাতায় একটা বাসা ভাড়া করে ওরা দুটিতে থাকতে পারলে বেশ হত! বিয়ের পর পড়াশোনার পাট চুকে গেছে। তা এক দিক থেকে মন্দ নয়! কিন্তু সাথে সাথে খেলাধুলোর পাটও উঠেছে। সময় সময় বড্ড খারাপ লাগে সে কথা ভাবলে।

    মাঝে মাঝে যে পড়াশোনা করবার জন্য মন খারাপ হয়না তেমনটা নয়। শ্বাশুড়ি মাও বলেন - তুমি লেখা পড়াটা ছেড়ে দিলে কেন বৌমা? কিন্তু সে আর হয়না! এক মাথা সিঁদুর নিয়ে ইস্কুলে যেতে পারবে না ও! আর তা ছাড়া শ্বাশুড়ি মা ওর খাবার বেড়ে দেবেন আর তাই খেয়ে ও স্কুলে যাবে - এমন শিক্ষা চাঁপা পায়নি মায়ের কাছ থেকে।

    মায়ের কথা মনে হতেই চোখ দুটো আপনা থেকেই ভিজে গেল চাঁপার। একই শহরে থেকেও মায়ের সাথে রোজ দেখা হয়না। দশদিনে একবার যদিবা দেখা হয়, তাতে প্রাণের সাধ মেটে কই? শোভা-কিরনরা কিরকম নিজের মায়ের কাছে রয়েছে! যখন ওর ননদেরা শ্বাশুড়ির কাছে এটা ওটা আব্দার করে তখন বুকের ভেতরটায় ভারি কষ্ট হয় ওর। ওর বয়স তো শোভারই মতন, কিন্তু এই বৌ সেজে থাকতে থাকতে মনে হয় ও যেন আগমেশ্বরি পাড়ার চাঁপাটি নয়, যেন অন্য কারুর ভূমিকায় অভিনয় করতে নেমেছে। অনেকটা স্কুলের স্বরস্বতী পুজোর ফাংশানের মতন।

    প্রতিবার স্কুলে স্বরস্বতী পুজোর ফাংশানের নাটকে মূল চরিত্রটা ওর একরকম বলতে গেলে বাধাই ছিল। আর মেল পার্ট হলে তো কথাই নেই! চাঁপা ছাড়া আর কারোর কথা ভাবতেনই না দিদিমনিরা। গতবারের নাটক ছিল অবাক জলপান। পথিকের পার্টটা করেছিল চাঁপা। শেষ দৃশ্যে যখন বৈজ্ঞানিকের হাত থেকে জলের গেলাস নিয়ে ঢকঢক করে জল খাচ্ছে - প্রচুর ক্ল্যাপ পেয়েছিল ও!

    ওই দিন গুলো আর কোনদিনই ফিরে আসবেনা। চাঁপা জানে।

    এ বাড়ির আবহাওয়া ওর বাপের বাড়ির মতন রক্ষণশীল নয়। এখনও অবধি কোন কিছুতে ওকে কেউ বাধা দেয়নি। কিন্তু তবু চলতে ফিরতে একটা আড়ষ্টতা চেপে ধরে থাকে ওকে, সর্বদা। আজন্ম দেখে আসা জগতটা ওর মননে যে স্থায়ী ছাপটা ফেলেছে, তা চাইলেই উপড়ে ফেলা যায়না। ও জানে, শ্বশুরবাড়িতে কখনও নিজের বাড়ির স্বাচ্ছন্দ পাওয়া যায় না, তাই সে কথা ভেবে মন খারাপেরও কোন মানে হয়না। এবাড়ির সকলে খুব ভালো। মেয়েদের যেটা ভয়ের জায়গা - শ্বাশুড়ি - তিনিও খুবই ভালো মানুষ। তবু, শ্বাশুড়ি কি কখনও মা হয়!

    ৩২।

    এ এক নতুন উপসর্গ হয়েছে ছবির। কাজের মাঝে বেখেয়াল হওয়ার অভ্যেস তো কোনদিনও ছিলনা! হ্যাঁ, অবসর সময়ে বসে ফেলে আসা কিছু কথা, কিছু স্মৃতি নাড়াচাড়া করার অভ্যেসটা বরাবরই ছিল বটে, কিন্তু সে আর কোন মানুষ না করে!
    রান্না করতে বসে আজ মনের ভুলে কোথায় যে চলে গেছিলেন তার ঠিক নেই। তরকারিটার তলা লেগে গেছে, ইস্‌! বৌমা ছেলে মানুষ। তাকে আগুনের কাছে আসতে দেন না ছবি। আর তা ছাড়া এরপর তো সারা জীবন হাঁড়িঠেলা রইলই কপালে। মানুষ জন্ম বড় পূণ্যের ফল। মেয়ে হয়ে জন্মানো বোধহয় পূণ্যতর কর্মের ফল।

    খোকনের বিয়ে হয়েছে আজ মাস ছয়েক হতে চলল। খোকন চাকরি পাওয়ার পর বৌমার বাবা-মা আর অপেক্ষা করতে চাননি। ছোট্ট শহর এই নবদ্বীপ। সকলেই প্রায় সকলকে চেনে। খোকনের যে ওনাদের মেয়েকে পছন্দ, সে কথা পাঁচকান হতে সময় লাগবে না। আর সে সবের পর যদি খোকনের বিয়ে অন্যত্র স্থির হয়, তবে মেয়েকে পাত্রস্থ করা ওঁনাদের পক্ষে একটু অসুবিধে জনকই হবে। এমনটাই জানিয়েছিলেন ওঁরা।
    ছবি নিজে অবশ্য সে কথা মানেন না। ওদের দুজনের যখন দুজনকে পছন্দ তখন অন্য কোথাও ছেলের বিয়ের প্রস্তাব তুলবেনই বা কেন ছবি! এক যদিনা বৌমার বাপ-মায়ের খোকনকে অপছন্দ হয়। এ সব কথা অবশ্য ওঁদের আর বলেননি ছবি। নিজে মেয়ের মা; ওঁদের চিন্তা ধারার সাথে একমত হতে না পারলেও বুঝতে পেরেছেন ওঁনাদের চিন্তার কারন, সম্মান দিয়েছেন তাঁদের যুক্তিকে। তাইতো ঘরে আইবুড়ি মেয়ে রেখেও বিয়ে দিয়েছেন ছেলের।

    খোকনের চাকরি হওয়াতে অল্প মাত্রায় হলেও সংসারে লেগেছে স্বচ্ছলতার ছোঁয়া। মেজ মেয়ে সুধা এম।এ।-তে ভর্তি হতে পেরেছে। এবার লিপিটার একটা বিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হন ছবি। আর সব ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় ভালো। যে যার আখের ঠিকই বুঝে নেবে, কিন্তু লিপিটার যে কি হবে তা ভেবে কুল করতে পারেন না ছবি। মেয়েটার লেখাপড়ায় মাথা কোনদিনই ছিলনা। একটা ভালো ঘরে বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত ওকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তার অন্ত নেই ছবির। আর বিয়ে দেওয়ার অন্য সমস্যাও আছে। সোনার দর প্রায় পঁচাত্তর টাকা ভরি। নিজের অল্প যা কিছু ছিল তার খানিকটা খরচা হয়েছে খোকনের বিয়েতে। নতুন কিছু গয়না না গড়ানো অবধি লিপির বিয়ের কথা ভাবতে হবে শুধু মনে মনেই।

    তবু বাঁচোয়া এই যে সোনার দামটা বছর খানেক হল কমেছে খানিকটা। বছর তিনেক আগে, বেশ মনে আছে ছবির, সোনার দাম ছুঁয়েছিল একশ কুড়ি টাকা ভরি! ভগবানের অশেষ দয়া, খোকার বিয়ের সোনা ওই দামে কিনতে হয়নি ছবিকে। একশ টাকার নিচে যে সোনার ভরি আবার নামবে, সে আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছিলেন প্রায়। তবে হয়ত সত্যিই ভগবান আছেন। থাকতেই পারেন, কিন্তু ভগবানের ধারনাটা ওঁনার মাথায় এমন তালগোল পাকানো অবস্থায় রয়েছে যে তার থেকে ভগবান সম্পর্কে কোন স্বচ্ছ মতবাদ গড়ে ওঠেনি এই এতদিনের জীবনে।

    ভগবান কে? কার্সিয়াঙের স্কুলের চ্যাপেলের দেওয়ালে টাঙানো রক্তাক্ত যিশু না কি ব্রাক্ষ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের পরম ব্রক্ষ্ম? সাকার না নিরাকার? নাকি দুটোর একটাও নয়! হয়ত শোভা-কিরনদের বাবার ধারনাই ঠিক - প্রকৃতিই ঈশ্বর। প্যানথেইজিমেরও সকল ধারনা ছবির কাছে স্পষ্ট নয় কিন্তু ভীষণ ইচ্ছা করে ধারনাটাকে ঠিক বলে মানতে - মানুষটাকে তো জীবনে কিছু দিতে পারবেন না ছবি, তাই তাঁর দর্শনটাকে অন্তত গ্রহন করে যদি ওঁনাকে খানিকটা সম্মান দেওয়া যায়!

    রান্না একরকম শেষ হয়েই এসেছে। শোভা কিরন আর ওদের বাবা খেয়ে দেয়ে স্কুলে বেরুবে। সুধার এম।এ।-র ক্লাস শুরু হতে এখনও মাস খানেক সময় আছে। কলকাতায় থেকে পড়তে হবে তখন মেয়েটাকে। খোকনের অফিসও কলকাতায়। সপ্তাহান্তে একদিনের জন্য বাড়ি এসেই আগে বউয়ের খোঁজ করে; বড় বুকে লাগে তখন ছবির। আগে হলে পারতিস ছ'দিন পরে বাড়ি এসে মায়ের কাছে সমস্ত গল্প নাকরে থাকতে? দু'দিনের জন্য কলকাতায় মামার বাড়ি গেলেও ফিরে এসে মায়ের কাছে সমস্ত কথা না উগরানো অবধি শান্তি ছিল না খোকার। আর আজকে? আজ বুঝি মায়ের আঁচলটা পুরনো লাগছে খোকার?

    বৌমাও খোকার জন্য সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকে। নতুন বিয়ে হয়েছে, তারও সখ আহ্লাদ থাকাটা স্বাভাবিক। শুধু খোকা যদি একবার বাড়ি ঢুকে আগে মায়ের কাছে আসত, তবে বোধহয় এমন শূণ্যতা ছেয়ে থাকত না ছবির বুকে।
    খোকা যখন বাড়ি ঢুকে বৌমার ঘরে ঢুকে যায় তখন কেমন যেন একটা সুরক্ষার অভাব বোধ করেন ছবি। একটা মেয়ে, ওঁনার শোভারই বয়সী - যেন রোজ একটু একটু করে হারিয়ে দিচ্ছে ছবিকে।

    শোভার কথা মনে হতেই চমক ভাঙল। মেয়েটা কদিন হল আনমনা হয়ে রয়েছে। মেয়েদের এই বয়সটাকে বড় ভয় ছবির। ঘর পোড়া গরু কিনা! শোভা যেদিন প্রথম গান শিখতে চেয়েছিল সেদিনই মনে মনে প্রমাদ গুনেছিলেন উনি। সব বুঝেও কিছু বলতে পারেননি, শুধু গান শেখার সম্মতি টুকু দিয়েছিলেন মেয়েকে। আর তা ছাড়া কিই বা বলতেন? নিজে গান শিখতে গিয়ে মনের চাবিকাঠিটা হারিয়ে বসেছিলেন বলে মেয়েকে বারণ করবেন গান শিখতে, তাই আবার হয় নাকি! সেই হারানো চাবির গোছা আজও ফিরে পেলেননা। আর তাই একটা ভালো নির্বিবাদী মানুষকে তাঁর প্রাপ্য সুখ থেকে বঞ্চিত করলেন ছবি। সারা জীবন অনুক্ত বিষাদ বয়ে বেড়ানো ছাড়া নিজেই বা কি পেলেন?

    শোভার ব্যবহারে কদিন ধরেই একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন উনি। মায়ের চোখ। আর সবাই যা দেখে তার চাইতে বেশিই ধরা পড়ে সন্তানের মানসিক ভাঙাগড়া। কদিন ধরেই মেয়েটা চুপচাপ,আনমনা। একা একা বই পড়ে আর না হলে বসে বসে কি যেন ভাবে। অথচ মেয়ের মুখ দেখে কোন দুঃখ পেয়েছে বলেও তো মনে হচ্ছেনা। নাকি ছবির বুঝতে ভুল হচ্ছে? শোভার মতন বয়সেই তো ছবির আলেক-এর সাথে প্রথম দেখা। শোভার মতন বয়সেই প্রথম দুঃখ পাওয়া। সে দুঃখ থেকে সজত্নে বাঁচিয়ে রাখতে চান নিজের সন্তান কে, শোভাকে। কিন্তু পারবেন কি?

    জানেন না ছবি। নিজের জীবনের আরো অনেক প্রশ্নের উত্তরের মতই এ প্রশ্নটার উত্তরও অজানা ওঁনার কাছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ | ২৮২০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ***:*** | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৩:৪২73982
  • আচ্ছা কৌশিক, আপনি কেবলই আলাদা আলাদা পর্ব করে চলেছেন কেন? একটার তলায় অ্যাপেন্ড করুন না। যেমন সুকান্ত করছেন বা সিকি করছিল। মন্তব্যের ঘরে লিখতে অনুরোধ করছি না কিন্তু। আসল ব্লগটার তলায় জুড়তে বলছি।

    যদি অ্যাপেন্ড করার অপশান খুঁজে না পান তাহলে এই লিঙ্কে মন্তব্যের ঘরে সিকি'র 22 Nov 11:10 এর্পোস্ট দেখুন, ছবি দিয়ে দেখিয়েছে।
    http://www.guruchandali.com/blog/2013/11/22/1385098318543.html#.UwjDDNIW0bA

    আসলে প্রতিবারই ভাবি এইবারে এক এক করে পড়ে ফেলব, কিন্তু তার মধ্যে আরো একটা নতুন ব্লগ চলে আসে বলে আমি গল্পটা কিছুতেই পড়ে উঠতে পারছি না, কেবলই পিছিয়ে যাচ্ছি। :-(
  • kaushik | ***:*** | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৩:৩৮73983
  • হুমম।
    ঠিক আছে, পরের পর্ব গুলো থেকে এটা মাথায় রাখতে হবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন