কে না জানে যে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা জিএম খাদ্যের সাহায্যে কায়েমী স্বার্থ চরিতার্থ করে পৃথিবীকে আবার নিজের পদানত করতে চায়। কদিন আগে ঐ পুঁজিবাদী কালো হাত বেগুনের দিকে অগ্রসর হয়েছিল, কিন্তু বাঙালির এই সনাতন সব্জিটিকে কব্জা করতে পারে নি। প্রথমে ওরা অ্যারিজোনাতে এই জিএম বেগুন পেটেন্ট করার আগের অবস্থায় চাষ করতে শুরু করে। ওতে নাকি ফলন বেশি হয়, পোকা ধরে না আর কীটনাশকও কম লাগে। তখন সার্ক এগ্রিকালচার ইনস্টিটিউট থেকে সময়মতো মাটির রিপোর্ট পেশ করে এবং প্রফেসর আহমেদের করা গবেষণার সাথে তুল্যমূল্য বিচার করে সম্যকরূপে প্রমাণ করতে হয় যে জিএম বেগুন ফলালে কয়েক ফসলেই মাটির উৎপাদনক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে। আমরা সকলেই এই অন্যায়ের বিরূদ্ধে কলম ও মাউস ধরেছিলাম এবং ফেসবুকে হাজার হাজাঅর সই সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
এই প্রতিবিপ্লবের পরে আমেরিকাকে বাধ্য হয়ে আধুনিক খামারগুলিতে পরীক্ষামূলক বেগুন চাষ বন্ধ করতে হয় এবং গোপনে বাংলাদেশের জল-হাওয়া একটি ক্লাইমেট চেম্বারে সিমুলেট করে নাভাহো মরুভূমির কাছাকাছি একটি স্পেস এজেন্সিতে ভরশূণ্য অবস্থায় ফলিয়ে চাষের উপযোগী সব্জি হিসাবে পেটেন্ট পাওয়ার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা শুরু হয়। মাটির নমুনাসমূহ ওদের কাছে আগে থেকেই ছিল। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যে বাংলাদেশ আর আমেরিকার মধ্যে পলিমাটি বিষয়ে গবেষণায় গত পাঁচ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গড়ে প্রায় প্রতি বছর তার আগের বছরগুলির তুলনায় পাঁচ গুণ অধিক অর্থ ব্যয় করেছে। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের মাটি বিশ্লেষণ করা হয়েছে আমেরিকার ল্যাবোরেটরিতে। অপিচ, সেই বিশ্লেষণ থেকে বেরিয়ে আসা মূল পরীক্ষাগুলি বড়ো করে করা হয়েছে দক্ষিণ-বাংলার পলির বুকে। আরও কথা এই, যে এ কাজে মার্কিনিরা একা নয়, মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত একাঅধিক বৈজ্ঞানিক ও অধ্যাপকও জড়িত। ঐ প্রত্যেকটি গবেষণাতে এদের সরাসরি হাত রয়েছে।
সুতরাং এতে আর অবাক হবার কী আছে যে এই ভরশূন্য পরীক্ষাগুলি শেষ হবার কিছুদিনের মধ্যেই একটি আমেরিকান অ্যাগ্রো কোম্পানি, যার নাম আমরা সকলেই জানি, তারা ভরহীন বেগুন চাষের পেটেন্ট নেয়। এই পেটেন্টের নাতিকাল পরে এই দাবি করা হয়, যে মাধ্যাকর্ষণ যেহেতু বেগুনের কোনও ধর্ম নয়, বাইরে থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র হতে বেগুনের কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে একটি টান, সেহেতু এই ভেক্টর রাশির সাথে ভরহীন বেগুন চাষের কোনও সম্পর্ক নেই। সুতরাং ভরহীন বেগুন পৃথিবীতে চাষ করলে বাইরে থেকে মাধ্যাকর্ষণ যদি এসে বিরক্ত করে তাহলে কিছু করার নেই।
আমাদের কত বড়ো সৌভাগ্য যে মতিউর রাহমান চৌধুরি, প্রসিদ্ধ আইনজীবি, সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্টের বুকে বসে এই আগ্রাসনের মোকাবিলা করেন এবং একথা স্মরণে নিয়ে আসেন যে ভার এর তুলনায় ভরই হল পদার্থের মূল ধর্ম। এবং শুধু তাই নয়, জিএম বেগুন চাষ করতে যে পরিমাণ জলের প্রয়োজন তাতে করে সুজলা সুফলা বাংলাদেশের জল গোপনে কেড়ে নেওয়া বই আর কিছুই হচ্ছে না। অবশ্য ড: এখলাসুর (উনি অবশ্য এখলাস ডাকেই স্বচ্ছন্দ) ইসলামের বিখ্যাত থিসীসটি এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় এই ঠাণ্ডা লড়াই অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। ওনার থিসীসে* জিএম বেগুনের জিনগত তারতম্যের সাথে তার ভক্ষকের জিনের মিউটেশান ও প্রতি ফসলে এই মিউটেশানের পরিবর্তনের হারের যে মারাত্মক যোগাযোগ দেখা যায়, তারপরে সারা পৃথিবী থেকেই জিএম বেগুন ও তার পেটেন্ট এর বিরূদ্ধে একযোগে ধিক্কার উঠতে থাকে।
বেগুনের ভরের চেয়েও, বেগুনের জিন এর এই গুরুত্ব কিন্তু এর আগে বোঝা সম্ভব হয় নি। আসলে ভেবে দেখতে গেলে, জিএম বেগুনের জিনে এত বেশি রকমের তারতম্য, যে এগুলি বেগুনের উপসর্গ মাত্র। প্রকৃত প্রস্তাবে, এটি একটি সম্পূর্ণ নূতন প্রজাতির সিন্থেটিক সব্জি। এই তো কদিন আগেই বিদেশমন্ত্রী জুবেদা খাতুন রাষ্ট্রসংঘের বক্তৃতায় বললেন যে অর্গ্যানিক বেগুন চাষ বাংলাদেশের কৃষি স্বাধীনতা এবং সামাজিক পছন্দ (সোসাল চয়েস) এর দৃঢ় প্রতীক। কৃত্রিম উপায়ে প্রস্তুত জিএম বেগুন যে শুধু মুনাফালোভী চক্রান্ত তাই নয়, সেগুলি বেগুনই নয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সদ্ভাব রক্ষা ও গবেষণায় সম্পূর্ণ সাহায্যে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মহামান্য আদালতের রায়ের পরে আশা করা যেতে পারে যে এ নিয়ে কোনওরকম ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না ও প্রকৃতির দান প্রকৃতির কাছেই থাকবে। এ নিয়ে যেন দুই দেশের মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্ববোধে আঘাত না লাগে। এমন কি তিনি এও বললেন - লেট বাইগনস বি বাইগনস।
*আ হায়ারার্কিকাল কোলোকেটেড ক্রিটিকাল অ্যাসেসমেন্ট অফ এ-যে-ফোর-টু-জিরো অবার্জিনস, পি ইসলাম, ২০১০, কার্লশ্রুয়ে ইনস্টিটিউট অফ জেনেটিক্স, জার্মানি (প্রকাশকঃ বাকেরভাই ফাকেলম্যান)