ঐতিহাসিকরা বহু পর্যালোচনা করে ইদানিং সেই শাশ্বত সত্যটিকেই শেষ পর্যন্ত বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছেন যে একসময় সমগ্র পৃথিবীই সংস্কৃত সভ্যতার পদানত ছিল। আজ যদি আমাদের গ্লানিময় অস্তিত্ত্বের মধ্যে সুপ্রাচীন ও স্বর্ণখচিত সংস্কৃত যুগের কণামাত্র আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে হয় ও জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনটিতে উপবিষ্ট হবার যোগ্য হয়ে উঠতে হয়, তবে বর্তমান কালকে সেই জয়ধ্বজ যুগের পটভূমিকার মুকুরে প্রতিবিম্বিত করতেই হবে।
অতীতের গৌরবের রেশ তাই আজও ছড়িয়ে আছে এই পৃথিবীরই আনাচে কানচে, ক্ষুদ্রতর থেকে ক্ষুদ্রতম জিনিসে - একটি ধানের শীষের ওপর একটি শিশিরবিন্দুর ন্যায়। আর সেই ক্ষুদ্র থেকেই আমাদের জাগ্রত করতে হবে ঐতিহ্যের বৃহৎকে। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে এ কথা তো সপ্রমাণ হয়েই গেছে যে তাজমহল আসলে তেজো মহালয় নামক এক দেবস্থান। এমনকি সেকথা যাতে না প্রকাশ পায় তাই ঐ শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্যের গভীরে চার চারটি গর্ভগৃহ আজও আমাদের দেশের সরকার উন্মোচন করতে পরাঙমুখ। বিচারের বাণী এভাবেই নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
চীন (এ নামটিও সংস্কৃত) এর সাথে আমাদের যখন প্রাচীন কালে রেশম পথে যোগাযোগ ছিল, তখন সেখানে রাজত্ব করতেন চারজন বিখ্যাত মিং সম্রাট। তাঁদের মিলিত সুশাসন এমনকি সংস্কৃত ভারতের মানুষকেও এতটা আবিষ্ট করে তোলে যে আজও আমরা অতি সুন্দর স্বভাবের অধিকারী বা অধিকারিনীকে চার্মিং বলে থাকি। এমন প্রভাব অবশ্য চরক-শুশ্রুতের চিকিৎসাবিদ্যার বইতেও দেখা যায়। এক বৈশ্যসন্তান হৃদরোগে মারা যাবার সময় তাঁর শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন যে তিনি যেন পরজন্মে স্ত্রী-রূপ ধারণ করে মহামানবের সাগরতীরে ফিরে আসতে পারেন। অনাম্নী সেই বৈশ্য প্রৌঢ়ের শেষ ইচ্ছার সম্মানে শুশ্রুত তাঁর দেহ কর্তন করে হৃদয়ের রক্তবাহক নালীর নাম দেন করোনারী। এমন উদাহরণের শেষ নেই।
তবে ভেবে দেখতে গেলে, সংস্কৃত সভ্যতার ব্যাপকতর প্রভাব সম্যকরূপে অনুধাবন করা গেছে একমাত্র ভৌগোলিকদের মাধ্যমে। কলকাতার পুরনো নামটির কথাই ধরা যাক না কেন - এখনকার নাম তো বিদেশি। প্রাচীন বঙ্গে প্রথিতযশা সম্রাট বিজয়ের একমাত্র পুত্র ছিলেন রাজকুমার জয়। তিনি একবার সুতানুটির তীরে অপরূপ বাঙালি বৌদিদের গঙ্গাবক্ষে স্নানদৃশ্য দেখে বিহ্বল হয়ে তাঁর রসোপলব্ধি দুই ঠোঁটের ফাঁকে বায়ুর গতায়াত সংকুচিত করে তীক্ষ্ম ধ্বনিতে প্রকাশ করেন। তখন থেকে সেই এলাকার নাম হয় সিটি অফ জয়। সাগর পেরিয়ে বহু বিদেশেও সেই নামকরণের চিহ্ন বিদ্যমান। দক্ষিণ আমেরিকায় সংস্কৃতভাষী ভারতীয় নাবিকদের অজস্র অর্জুন গাছ লাগানোর স্মৃতি আজও বয়ে বেড়ায় আর্জেন্টিনা। অভ্রের খনি সমৃদ্ধ সুন্দরী অভ্রিকা আজ এক বিশাল মহাদেশ।
আবার কত অকিঞ্চিৎকর ঘটনা থেকেও যে কত বড় বড় দেশের নামকরণ হয়েছিল যে আজ সে কথা ভাবলে গর্বে রোমহর্ষ হয়। বাঙালিরা সংস্কৃত ভাষা থেকে পৃথক থেকেও যখন চীনেরও ওপারে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে, তখন একদিন চন্দ্রকেতুগড়ে এক সামান্য কৃষক রমণীর শ্বশুর হাটবারে কুটিরের দ্বারে সমাসীন হয়ে প্রশ্ন করেন - বৌমা, কী আনব? বৌমা উত্তর দেন - যা পান। পরে এই শ্বশুর ও বৌমার যুগলবন্দীই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত পদানত দেশ নামকরণ প্রতিযোগিতায় যা-পান উত্তরটি পাঠিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে ও তাঁরা অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলায় পাঁচটি মৌজা পান। নামটি সময় মতো ধরে ফেলার সম্মানে তাঁদের পাকড়াশী উপাধি দেওয়া হয়। ঠিক এভাবেই মদ্ররাজ্যের আয়ার সম্প্রদায়ের নাবিকরা পশ্চিম ইউরোপ দখল করে নাম দেন আয়ার্ল্যান্ড। তখনও হিন্দুধর্মে সমুদ্রযাত্রা নিষেধ হয় নি।
আসলে মদ্র শব্দের অর্থ হল দক্ষিণ। প্রাচীন সংস্কৃত পড়লেই দেখা যাবে যে তার সাথে যথাক্রমে অজ্ (অর্থ - তীরবর্তি) ও ইদ্ (অর্থ - কেন্দ্রবর্তি) প্রত্যয় যোগ করে মাদ্রাজ ও মাদ্রিদ শহরের উৎপত্তি। আমাদেরই মহাগ্রন্থ রামায়ণের সম্মানে পশ্চিম ইন্ডিজ (ইন্ডিজ<ইন্ডিজা<ইন্ডিয়া<হিন্দিয়া<হিন্দু+য়া, যেমন যা দেবী সর্বভূতেষু) এর জাতীয় পানীয় রাম। ঐ দেশেই ঝিঁঝিঁ পোকার প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ কৃকট্ট থেকে ওদের জাতীয় ক্রীড়া কৃকেট এর উৎপত্তি। এমনকি যখন গান্ধার প্রদেশের রাজদূতকে জম্বুদ্বীপের সর্বেশ্বর তলব করে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্য কৈফিয়ত তলব করেন, তবে থেকেই সে জাতির নাম পাঠান।
এসব তথ্য ধর্মভীরু মানুষের মধ্যেই বহুযুগ ধরেই শ্রুতির মাধ্যমে প্রচলিত। লেবাননের তীরে (লভ্য+আনন, সুন্দরী কিন্তু সহজেই ধরা দেওয়া নারীর প্রাচুর্যের সম্মানে) যখন এক মহাপুরুষ সত্যধর্মরক্ষার্থে আপন শরীর পাত করেন, তখন তাঁর কৃশ দেহের কষ্ট দেখে রোরুদ্যমান ভারতীয়রা তাঁর নাম দেন কৃষ্ট। আজ তা এক মানবধর্ম। আর তাই, কৃষ্টের প্রকৃত অনুগামীরা আজও কৃষি নিয়েই থাকেন। তাঁদের প্রো-কৃষ্ট বলা হয়। সেভাবেই, কে না জানে যে বলরাম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে আরবভূমিতে গিয়ে গদা শেখানো শুরু করেন ও তাঁর অনুগামীদের নিয়ে মহাভারতের মুষলপর্বে ফিরে আসেন। এই অনুগামীরাই আজ মুষলমান নামে সুপরিচিত। যদিও এ ধর্মে সকলেরই সমানাধিকার, আজও দেখা যায় যে আলচাষ করা মুসলমানকে আলি, খনিশ্রমিককে খান, মল্লযোদ্ধাকে মোল্লা ইত্যাদি নামে ডাকা হচ্ছে। মাথায় শিখরশোভিত ধার্মিককে শিখ, কামরিপুজয়কারীকে জৈন, আত্মবোধহীনকে বৌদ্ধ, নিদ্রালুকে বা-হাই তথা বিমর্ষ ধার্মিককে মরমন বলে তো ডাকা হয়েই থাকে। ইহুদীদের নিয়ে অবশ্য এখনও গবেষনা চলছে। কেউ কেউ বলেন যে ইহুদীদের ধর্মগুরু আসলে অভ্রিকা মহাদেশে খনিজদ্রব্যের একচেটিয়া ব্যবসায়ী ছিলেন (যেমন এখনকার অ্যাগ্রো ব্যবসায়ী - কফি আনান), তাঁর নাম ছিল অভ্র-হাম্। সেই মহাদেশেরই অজস্র পশুপ্রাণী ও প্রকৃতির চিরসবুজ সত্তা তাঁর হৃদয়ে সদাজাগ্রত ছিল, যে কারণে ধর্মপ্রচার করে তাঁর অনুরাগীদের তিনি স্নেহের সঙ্গে নামকরণ করেন - জু।