দুটি বিষয়ে পাবলিকের পণ্ডিতি আপসে সর্বগ্রাহ্য ও সর্বজ্ঞানসমৃদ্ধ। এক - ডাক্তারি, এবং দুই - সিভিল ইÏনিয়ারিং। পোস্তার পোল ধূলিসাৎ হবার পর যখন ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে সেলফি ও লাশের রাজনীতির ঝাণ্ডা চারপাশের বাড়ির দোতলা তিনতলা থেকে আটপৌরে শাড়ি হয়ে পতপত করে উড়ছিল আর সরকারবাহাদুরের 'দরকার নেই' তকমা দেওয়া রক্ত যাচ্ঞা করে মানুষ হন্যে হয়ে ফিরছিল, তখন সেই যার নাম বলা যাবে না, সে আর থাকতে না পেরে এই কথা বলেই ফেলল। এবং অতঃপর আশ্চর্য হয়ে দেখলাম পথচারী থেকে মুদি, দাদু-টাইপ লোক, শ্রমিক ও খবরের কাগজের রিপোর্টার, আইটির ভাইটি - এমনকি ডজনে ডজনে সিভিল ইÏনিয়ারে অবধি সকলেই মুখে মুখে দেশে বিদেশে বসে খেল খেল মে ক্যাপ্টেন স্পার্কের মতো ডাকু গণ্ডারিয়াকে ধরে ফেলেছে।
তাতে অসুবিধা কী? এরা তো কেউ আর ছাগল বা হাফপ্যান্ট নয়। অতএব এই ক্রাউডসোর্সড, মুফত কনসাল্টেন্সিকে সুশীল শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক কৃত একটি সুস্পষ্ট সুরতহাল হিসাবে দেখলেই হল। আফটার অল - ভারতবর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বটে।
মুশকিলটা এইখানে, যে এই ধরণের কাজে গণতান্ত্রিকভাবে চাট্টি আলোচনা, বা কথা বলাটা গ্রাহ্য নয়। পাবলিক বলতেই পারে, এইসবই তারা করে আসছে শতশত বছর ধরে, কিন্তু বললেই শুনতে হবে, এরকম ধাষ্টামো করার সাহস ও শিক্ষা আমাদের থাকবে কেন? ছাগুলে পাবলিকের পাগুলে কথা নাহয় বাদই দেওয়া হলো, কিন্তু এমনকি আমাদের সিভিল ইÏনিয়ার ভাইবোনেরা ও উচ্চপদাসীন বিশেষজ্ঞরাই বা খবরের কাগজে - টিভিতে-মায় ফেসবুকে নিজেদের মতামত দেখে পুলকিত হয়ে ওঠার নাবালক লোভে বিশু থেকে শিশু হয়ে উঠছে আর আমরা সেই দেখে ধিনিকেষ্ট নাচ জুড়েছি। এভাবে হয় না। এজলাসে এই মোকদ্দমা উঠলে এই এতগুলি পণ্ডিতের রায় শুধু এক্তিয়ারবহির্ভূতই নয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই দায়িত্বজ্ঞানহীন হিসাবে গণ্য হতে পারে। ফলতঃ, আমোদগেঁড়ে জনতা নিজেদের মধ্যে প্রতর্ক করুক। কিস্যু আসে যায় না। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্পূর্ণ ঠিক কথা বলে থাকলেও না। সোসাল মিডিয়া আর খবরের কাগজে চ্যানেলে বসে এসব হয় না। তাই অন্ততঃ সাংবাদিক ভাইবোনদাদাদিদিবেয়াইবোনাই সকলকেই করজোড়ে অনুরোধ, এই বিশেষজ্ঞ মতামতটা দেওয়া একটু তামাদি রাখুন না। অনুভব করছি, তাই বলছি।
মনে মনে না হয় অনেকেই রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের মতো দোষ ও দোষী সাব্যস্ত করে অপরাধীর শাস্তির ব্যবস্থা দেখবো এরকম আশা রেখেছেন। এমনকি অনেকে ফাটাকেষ্ট দিয়ে এখানে মেরে শ্মশানে লাশ ফেললেই অন্ধকার থেকে আমরা আলোর দিকে অগ্রসর হবো ভেবে রেখেছেন। মুশকিলটাও কতকটা সেখানেই হয়েছে। চটজলদি দোষী সাব্যস্ত করে ঝটজলদি বিচারের রায় বের হয়ে গেলে সকলেরই সুবিধে। গোটা গোটা তদন্ত মন দিয়ে করলে হয়তো এই টি-টোয়েন্টি টেস্ট ম্যাচে পরিণত হবে - এবং বহু ঝামেলার পর কতকটা ভালো করে জানা যাবে যে কী হয়েছিল ও সেই অবস্থায় নানান লোকের নানান বিষয়ে দোষ এবং দায়িত্বশীলতার অভাব বেরোবে। এবং অনেক কিছুই প্রমাণাভাবে খালাস পাবে। সবশেষে হয়তো পোস্তার ছুঁচ সুবিশাল ফাল হয়ে অনেকগুলি বড়ো বড়ো প্রশ্ন তুলবে, আমাদের এই পুরো পরিবহন-কাঠামো নিয়েই। তার চেয়ে একটা ছোট ক্যাপসুলে দোষ পুরে একটি (বা কয়েকটি বাছা বাছা ও সুচিন্তিত) দোষীকে শাস্তি দিলে অনেক সহজেই স্বস্তি পাওয়া যায়। আমরা আবার তখন আমাদের জীবনে নূতন দোলাচলের সন্ধানে পোস্তা এরিয়ার ক্ষীয়মান ভিড় থেকে অপসৃত হতে পারি।
পণ্ডিতি যেমন চলছে চলুক, কিন্তু সঠিকভাবে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে ভালো করে তদন্ত হোক। এখন তো সব গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে - যেখানে যা যা দেখা যেতো, পারতো, ও যা দেখা উচিত তার অনেক কিছুই উদ্ধারের পথে হয়তো চিহ্ন মুছে দিয়েছে - কিন্তু যা আছে, তাতেও চলবে। তদন্ত হোক গ্রাহ্য মতামতের মাধ্যমে - তদন্ত হোক পার্টির ঝাণ্ডার বাইরে। পুল পড়লেই কারওর দোষ হবেই এর কোনও মানে নেই - কিন্তু যেখানে এদিকে ওদিকে আকছার এসব হয়ে চলেছে সেখানে দাঁড়িয়ে একটি তদন্ত হোক যা আমাদের কতগুলো বৃহত্তর প্রশ্নের সম্মুখীন করে ও মানুষের জীবনের যে কোথাও কোনওরকম একটা মূল্য আছে তা স্বীকার করায়। এই সব পুল-গুলি আমাদের আধুনিক জীবনের ধমনীর মতো, এবারে অন্তত: তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের মধ্যে একটু সচেনতা আসুক। মুনাফা বা ভোট নয় - সত্যিই, সরাসরি প্রয়োজনের ভিত্তিতে এদের পরিচর্যার জন্য যথেষ্ট সময়,চিন্তা ও রসদ জোগানো হোক। কাকে হাজতে দেওয়া হবে, তার বাইরেও আরও কিছু গোদা প্রশ্ন উঠে আসুক। কাজ দেবার পদ্ধতি, তার তদারকি এইসব বড়ো করে, নতুন করে ঢেলে সাজাতে তো হবেই। তাছাড়াও, পরিকাঠামোর প্রয়োজন ও তার রক্ষণাবেক্ষনের আবশ্যিকতা এই এখন হয়তো সকলেরই বোঝার সময় হয়েছে - নইলে ধনেপ্রাণে যে মারা যেতে হতে পারে সে জ্ঞান বোধ করি পণ্ডিত নির্বিশেষে টনটনে হয়েছে। একটা ভালো তদন্ত হোক, সেই টিম-এ সঠিক লোকজন থাকুক, - আর আসুন না, অন্ততঃ সবাই মিলে সেই তদন্তের পুরো রিপোর্ট জনগনের কাছে প্রকাশ করার আর্জি জানাই। অনেক সময় অনেকে মিলে চাইলে কাজ হয়- হাজার হোক, ডেমোক্র্যাসি - অজস্র কাঁসর বাজালে কুম্ভকর্ণেরও ঘুম ভাঙে। বড়ো প্রশ্নগুলো তাতে উঠে আসবে। ২০১৬তে বসে কি সরকারবাহাদুরের কাছে এইটুকুও জানা আছে যে পশ্চিমবঙ্গে ক-টি ব্রিজ কোথায় আছে - তাদের হাল-হকিকত কেমন? মোটের ওপর জানলেও ভালো, আর তা না হলে খুদা মেহ্ফুজ রখ্খে হর বলা সে।
*** পরিচিতিঃ লেখক চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার ও ব্রিজ বিষয়ে গবেষক এবং অধ্যাপক। ব্রিজের কাঠমো, পরিকাঠামো, তার সুস্থতা অসুস্থতা এবং ভেঙে পড়া ব্রিজের ফরেনসিক তদন্ত নিয়ে লেখকের কারবার।