এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  ঘুমক্কড়

  • দানিয়ুব ও দ্বিচক্রযান

    sumana sengupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | ঘুমক্কড় | ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ | ৪৮৭ বার পঠিত
  • পঞ্চম দিন  ঘুম ভাঙল যেন এক নার্সারি রাইমের মধ্যে, পুব দিকে গোলাপি বেগুনি র ছোপ লাগিয়ে সূর্য উঠছে, বাগানে ক্যাচকোচ শব্দে কুয়ো থেকে জল তোলা চলছে, জানালার নীচে কাঠের চেয়ার টেবিলে  বসে গুনগুন গল্প করতে করতে ব্রেক ফাস্ট খাচ্ছেন আমার সহযাত্রীরা। রান্না ঘর থেকে ভেসে আসছে বেকিং এর মাতোয়ারা সুবাস। এহেন প্রাণ  মাতানো শব্দ বর্ণ গন্ধে র ভিতর ভাসতে ভাসতে ব্রেক ফাস্ট সারতে না সারতে ই আবার বেরিয়ে পড়ার তাড়া লেগে গেল। আজকের গন্তব্য অস্ট্রিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে হাঙ্গেরির ছোট্ট শহর মোসন্গ্ময়োর, পথে পড়বে স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভা। আবার সকলে হেলমেট বেধে রওনা দিলাম। লোকালয় থেকে বেরনোর পথে পড়ল এক চার্চের বাগানে মরশুমী রঙিন ফুলের ঢেউখেলানো সমুদ্দুর, আর তার পাশে ই চেরি ফলে র ভারে নুইয়ে পড়া গাছ । সাইকেল পার্ক করে ফুলের ছবি তুলে ই সবাই চেরিগাছ কে ভারমুক্ত করা র কাজে তৎপর হয়ে লেগে পড়লাম । সকলে পকেট, ব্যাগ, সাইকেলের বাস্কেট ভরে একে একে রওনা দিলেও সৌরভ পরম অধ্যবসায়এ ডাল ঝাকিয়ে চলেছেন, ডালের নীচে ই আমার সাইকেল, তার বাস্কেট আপনা থেকে ভরে উঠছে লাল টুকটুক চেরি ফলে। বিনা মেহনতে এহেন পরম ঐশ্বর্য লাভের আনন্দে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ দেখলাম সৌরভ ডাল ঝাকানো সাঙ্গ করে চেরি ভর্তি সাইকেল টি চেপে রওনা দিলেন। দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল, বুঝলাম ও সাইকেল ওনার ই ছিল। মনে র দুখ মনে ই চেপে আমি ও এগোলাম, এবং যথারীতি লাস্ট হওয়ার জন্য দাদা র কাছে ধমক খেলাম।
    আজকের পথ অন্যরকম,  একপাশে চওড়া রাজপথ, অন্যপাশে সূর্যমুখীর খেত আর মাঝখানে আপেল আর মেপল গাছের ছায়া য় সাইকেল চালানোর মেঠো রাস্তা। পাহাড়ের পাশ ঘুরে, এক নাম না জানা গ্রামের রেললাইন পেরিয়ে পথে পড়ল আকাশছোঁয়া এক কেবল ব্রিজ। নীচ দিয়ে সগর্জন বয়ে চলেছে ফেনিল ঘূর্ণিসঙ্কুল দানিয়ুব।   মাঝখানে ফোর লেন গাড়ি চলার রাস্তা, যার উপর দিয়ে তীর বেগে  ছুটে চলেছে ঝিনচ্যাক সব বিলাইতি গাড়ি, পাশ দিয়ে দুপাশে উচুঁ রেলিং দেওয়া সাইক্লিং এর সিঙ্গল লেন। সেখান দিয়ে মনে র আনন্দে ব্রিজ পার হচ্ছে বাচ্চা বুড়ো সাইক্লিস্ট। 
    যে মুহূর্তে ব্রিজে চড়লাম তৎক্ষণাৎ টের পেলাম আমার ফিয়ার অফ হাইট আসলে কি সাঙ্ঘাতিক। আদতে ভয়ের কিচ্ছু নেই, দুদিকে কাধ অবদি উচুঁ রেলিং, কোথাও পড়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা ই নেই, কিন্তু আমার প্রত্যেক পেডালিঙে হাটু লিকুইড হয়ে যাচ্ছে। নামার ও উপায় নেই, তাহলে পিছনে সবাই কে নেমে পড়তে হবে। দাতে দাত চেপে ডরকে আগে জিৎ হ্যায় জপতে জপতে কোনরকম মেজর কেলেঙ্কারি ছাড়াই ব্রিজ পার করলাম। ওপারে ব্রাতিস্লাভা । 
    অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরির সীমানা য় অবস্থিত এই শহরে ঢুকে আমরা ওল্ড টাউনে র হিস্টোরিক  মেন স্কোয়ারে সাইকেল  রেখে ব্রাতিস্লাভা কাস্ল দেখতে চললাম। লিটল কার্পাথিয়ান রেঞ্জের উপর অবস্থিত   এই কাস্ল আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়ার পর  বিঙশ শতকের মাঝামাঝি পুনর্নির্মিত হয়। সোনালী মূর্তি, লাল রুফটাইলস, সবুজ বাগিচা এবং রঙিন ফুলে সুশোভিত তুষার ধবল এই কাস্ল থেকে দানিয়ুব এবং পুরো শহরের মনোরম ভিউ পাওয়া যায়।
    ওল্ড টাউনের আরেক আকর্ষণ  সেণট মার্টিনস চার্চ যেখানে পুরুষানুক্রমে  হাঙ্গেরিয়ান রাজা ও রানীদের রাজ্যাভিষেক হত। ওল্ড টাউনের মেন স্কোয়ারে আছে কুমিল্ নামে এক মজার ইনস্টলেশন, এক সাফাই কর্মচারী ম্যানহোল থেকে উকি মারছে। তার পাশ ঘুরে ই হ্ভিজডোস্লাভোভো স্কোয়ারে ইন্দিরা গান্ধী র উদ্বোধন করা এক মার্চেণট  বিল্ডিং, আর স্লোভাক ন্যাশনাল থিয়েটার। এই স্কোয়ারে ই প্রথম লক্ষ্য করলাম পাব্লিক প্লেসে ইনস্টল করা আছে মিহি জলের ফোয়ারার তোরণ, যাতে গরমে হাঁসফাঁস মানুষ একটু ঠাণ্ডা হতে পারে। ছায়ায়ঘেরা এই স্কোয়ার থেকে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়েই দেখি অপূর্ব দৃশ্য। রমাকান্ত শর্মা, , এমটিএনএলের প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার, আমাদের পেয়ারের শর্মা জি,  এবঙ উনকি নমকিন, নৃত্য বিলাসিনী কসমেটোলজিস্ট আশা শর্মা চানাচুরের প্যাকেট খুলেছেন , আর সবাই তার সামনে লাইন দিয়ে দাড়িয়ে হ্যাঙলামি করছে। আমি ও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চানাচুর খেয়ে মুখ মুছে সাইকেল চেপে স্লোভাকিয়া থেকে বেরিয়েই ঢুকলাম হাঙ্গেরিতে । চোখ জুড়িয়ে গেল ছোট্ট গ্রাম রাইকায় এসে। ঝকঝকে পিচরাস্তা রঙিন রঙিন লেগোল্যাণ্ডের মতো বাড়ি,  আর কত যে গাছ আর কত রকমের যে ফুল। এখানে দশ মিনিট গাছের ছায়ায় বসে স্যান্ডউইচ,আর ফল দিয়ে লাঞ্চ সেরে টিউব ওয়েনের ঠাণ্ডা জল খেয়ে সাইকেলে বসে  আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেই না বলেছি, "আগলি বার মুম্বাই সে হি সাইকেল লেকে নিকলেঙ্গে," হুড়মুড় করে ধাক্কা মারলাম সামনে আমাদের সুপার সেক্সি ষাটোর্ধ্ব পেডিয়াট্রিশিয়ান রজনী মেওয়ারা ম্যাডামের  সাইকেলে। উনি যার নুপূরের ছন্দ বেণুকার সুর, সেই ডক্টর অশোক মেওয়ারা অর্ধাঙ্গিনীকে মাটি থেকে কূড়োতে কুড়োতে ফুট কাটলেন, " খুদা খ্যর করে "। 
      এমনই সব চিত্রার্পিতবৎ গ্রামের পর গ্রাম পার করে সন্ধের দিকে পৌছলাম মোসন্গ্ময়োর। পথে এমনকি নগণ্য   জনপদের ফিনফিনে রাস্তা তেও সাইকেল দেখলে সসম্ভ্রমএ পথ ছেড়ে দেয় সমস্ত অটোমোবাইল। সেসব গাড়ির রূপ গুণ এবং ভদ্রতার তারিফ কর তে করতে পৌছলাম শহরতলির ছোট্ট হোটেলে। তিনতলায় আবার সুটকেস টেনে তুলে দিলেন সৌরভ।  ওনাকে অসঙখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে রুমে ঢুকেই মন ভালো হয়ে গেল। জানালা দিয়ে সূর্যাস্ত দেখা যাচ্ছে আর বাথরুমে প্রকআণ্ড বাাথটব। 
    সন্ধেবেলা জানা গেল আজ সৌরভের জন্মদিন।ডিনারের পর রাস্তার ওপারে টেসকো থেকে কেক আর ওয়াইন কিনে এনে দেখি আরেক বিপত্তি। আমাদের সুন্দরী হাঙ্গেরিয়ান ম্যানেজারদ্বয় ডাইনিং রুম তালাচাবি দিয়ে ফেলেছেন এবং বাকি হোটেলে কোথ্থাও হৈ হুল্লোড় এলাওড নয়। অতএব নিশব্দে কেক কেটে ফিসফিস করে হ্যাপি বার্থডে গেয়ে সাইলেন্ট পার্টি পালন করা গেল। 
     
    এই পথ... 

     
    ব্রাতিস্লাভা মেন স্কোয়ার

     
    ব্রাতিস্লাভা কাস্ল

    কাস্ল গেট

     কাস্ল কোর্ট ইয়ার্ড

    সেণট মার্টিন স চার্চ


    কুমিল্

     স্লোভাক ন্যাশনাল থিয়েটার


     
    ঠাণ্ডা জলের তোরণ

     
    হ্ভিজডোস্লাভোভো স্কোয়ার

    রাইকা

     
    মোসন্গ্ময়োর
     

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ | ৪৮৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ** - sumana sengupta
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন