বিকাশ সেনের চোখের চামড়া মোটা হয়ে যাচ্ছে। ঘটনাটা রূপক হিসাবে বলা হল না - সত্যিই মোটা হয়ে যাচ্ছে। বিকাশবাবুর মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ আলোকচিত্রী যে অত্যন্ত অনুভবী পুরুষ তাতে কোনও সন্দেহ নেই - কিন্তু শিল্পীমানস যত পেলবই হোক, অন্য তাবড় শিল্পীদের তো কখনও চোখের চামড়া পাতলা হতে বা অদৃশ্য হয়ে যেতে আটকায় নি। তাহলে বিকাশবাবুর চামড়া মোটা হচ্ছে কেন? চোখের সাইজ কিন্তু যেমন ছিল তেমন মাঝারিই আছে, খালি চোখের কোণের দিকে চামড়া কুঁচকে গিয়ে অল্প হলেও মনের মধ্যে একটু অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে।
এ কি তবে বয়সের লক্ষণ? অসম্ভব। বয়স হলে কিছু কিছু পরিবর্তন হয় বটে, যেমন মাথার চুলে পাক ধরে, মানুষ ভুলো আর বোকা হয়ে যায়, কান শুনতে ধান শোনে, প্রত্যুষ ব্যানার্জিকে অলোক নাথ বলে ভুল করে, খামোখা রাগ করে তারপর ক্যাম্পারির চিকেন রোলে স্বাদ পায় না - কিন্তু চামড়া কারোর কুঁচকে গেছে বলে তো শোনা যায় নি। বিকাশ সেনের এই বাকিসব বার্ধক্যজনিত লক্ষণ থাকলেও চামড়া কুঁচকোনোর তাই কোনও কারণ নেই। অবশ্য এই সসাগরা পৃথিবীর আর কতটুকুই বা আমরা জানি।
কেউ কেউ বলছে যে কম্পিউটরের সামনে বসে থেকে থেকে এমনধারা হয়েছে। সকাল থেকে রাত্তির হুমড়ি খেয়ে খালি কাজ আর কাজ - আম পর্যন্ত রোদে রাখলে আমসত্ত্ব হয়ে যায়, আঙুর হয় কিশমিশ, বিকাশ সেনের চোখের কোণের চামড়ায় গলকম্বল তৈরি তো কোন ছাড়। যারা বিকাশবাবুকে কাছ থেকে চেনে, তারা বলছে কম্পিউটার নয়, এক চোখ বন্ধ করে ক্যামেরার মধ্যে দিয়ে লেন্সের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে দেখতে দেখতে আজ এই অবস্থা। চোখ কুঁচকোতে কুঁচকোতে চোখের কুঁচকে থাকাই অভ্যেস হয়ে গেছে, আর লেন্সের মধ্যে দিয়ে আসা আলো খুব কড়া আর ঘন বলে কোণের দিকটা ফোকাস করে সেঁকে দিয়েছে। ফটোগ্রাফারদের এরকম হয়েই থাকে। অনেকের বছরের পর বছর পরিশ্রমে পায়ে ভ্যারিকোস ভেন ধরে যায়, আবার অনেকের চোখের চামড়ায় তারতম্য ঘটে।
কারণ যা-ই হোক না কেন, এ নিয়ে বিকাশ সেনের ভেতরে ভেতরে মনটা মোটের ওপর খারাপই আছে বলা চলে। সবসময় মনের মধ্যে একটা খচখচ। কম্পিউটারের সামনে বসতে চিন্তা, ক্যামেরায় চোখ রাখলে চিন্তা, লোকে মুখের দিকে দুদণ্ড তাকালে চিন্তা, উঠতে বসতে চিন্তা। এমন কি কদিন আগে উনি যখন দূরদর্শনে ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন, সে সময়ের প্রোগ্রাম আবার চালালেই ধরা পড়বে যে উনি চুলে হাত বোলানোর অছিলায় মাঝেই মাঝেই কায়দা করে চোখের কোণ ঢাকার অপচেষ্টা করছিলেন। এমনিতেই মানুষের জীবনে ঝুটঝামেলার অন্ত নেই, তার মধ্যে ওনার ব্যস্ত জীবনকে শশব্যস্ত করতে বাঘের ওপরে এই টাগ এসে সওয়ার হয়েছে।
তবে উপায়? বিকাশ প্রথমে ওয়াটার থেরাপির ধান্দা করলেন। দিনে আট গেলাস জল পেটে ঢুকতে লাগলো, মদ্যপান বন্ধ, আর প্রতি ঘন্টায় দুচোখে জলের ঝাপটা। এতে করে কোনও লাভ হল না, বার বার বাথরুম যাবার প্রয়োজন পড়ল, ঝাপটা দিতে গিয়ে জামা ভিজে একশা হল, সন্ধ্যায় ইয়ারবক্সীরা 'উল্লাস' বলার একটি সাথী আপাততঃ হারিয়ে সামান্য বিমর্ষ হলেন। রাতে ঘুম এল না। ঘুম আসার জন্য সানন্দায় কানে কানে পড়তে গিয়ে মাথাটা শেষে খেলল। বিকাশবাবু গোপনে ওনার সহধর্মিনীর প্রসাধন সামগ্রী হাঁটকে শসা, লেবু ইত্যাদি প্রাকৃতিক ভেষজ দেওয়া ক্রিম চোখে লাগাতে শুরু করলেন ও কদিনের মধ্যেই ক্রিম সরাতে গিয়ে ধরা পড়লেন। লাগিয়ে ফল হল কচু, হাতি আর ঘন্টা। চৌর্যের কোনও কারণ বাৎলানো দায় হল, গৃহিনীর মুখনাড়া সার হল, বিবিজান লবেজান করে দিলেন। কিছুতেই কিছু হল না দেখে মরিয়া বিকাশ খুব ভোরে উঠে আদা-মধু আর কল ওঠা ছোলা মুখে ফেলে দু-আঙুলে টেনে টেনে চোখের চামড়ার ব্যায়াম আরম্ভ করলেন। এতে তাঁর জীবনযাত্রা পূর্বের চেয়ে স্বাস্থ্যকর হল, তর্জনীর গাঁটে ব্যথা হল, কিন্তু চোখের কোনও রদবদল ঘটল না। হতাশ, ভগ্ন, ভীত, রোগগ্রস্ত বিকাশ সেন ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন।
চোখের ডাক্তার, চ্যাটার্জি, বসেন বার্মা ক্লিনিকে, প্রায় দুশোর কাছে বয়স হবে এবং ধন্বন্তরি হিসাবে তাঁর খ্যাতি আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ভালো করে উনি একটা ধাতব চশমার ফ্রেমে নানা পাওয়ারের কাচ বসিয়ে বিকাশবাবুকে অক্ষর পড়তে বললেন। দরকার ছিল না। বিকাশ খালি চোখে অনায়াসে আবৃত্তি করলেন এ ও এক্স, এইচ ভি টি, ভি ও টি এইচ - এমন কি শেষের লাইনের ওয়াই, এক্স অবধি আটকালো না। চ্যাটার্জি ব্যারিটোন ভয়েসে প্রশ্ন করলেন - 'কী করা হয়?', বিকাশ সেন বললেন 'এই ছবিটবি তুলি বলতে পারেন'। 'ওঃ, শিল্পী!' বলে ডাক্তারবাবু ঘরের সব আলো জ্বালিয়ে একটা অ্যালুমিনিয়ামের সন্না দিয়ে বিকাশ সেনের চোখের কোণায় একটা মৃদু খোঁচা দিয়ে শুরু করলেন - 'শুনুন মিঃ সেন, আপনি তো শিল্পী মানুষ, ফটোগ্রাফার। সুতরাং এ থিং অফ বিউটি যে জয় ফর এভার সেকথা আমাকে আর নতুন করে আপনাকে বলে দিতে হবে না। ছোটবেলা থেকেই আপনি চোখের কোণ দিয়ে কারণে অকারণে সুন্দরী মহিলাদের দেখে চলেছেন। সেই সুন্দরীদের দেখে দেখে আপনার চোখের কোণে সিফিলিস হয়েছে। চিন্তা করার কিছু নেই, ক্রিয়েটিভ লোকেদের এসব হয়েই থাকে।'
বিকাশ সেন চিঁ চিঁ করে বললেন 'অ্যাট্রোপিন দিলে কাজ হবে?'। ডাক্তার চ্যাটার্জি বক্র দৃষ্টি হেনে ফিসফিস করে বললেন - 'স্যালভারসান'।