কাক দিয়েই ব্যাপারটা প্রথম বোঝা যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাই ভোল্টেজ ল্যাবরেটরির সামনেই, যেখানে বড় বড় করে 'ডেঞ্জার, ওয়ান মিলিয়ান ভোল্টস ইনসাইড' লেখা থাকে, তার সামনে দোদুল্যমান ইলেকট্রিকের তারে বসে কিছু কাক পিচিক পিচিক করে বমি করতে শুরু করে। থার্ড ইয়ারের দুটি লাভলু ছাত্রছাত্রীর গায়ে তারই এক-দু ছিটে পড়ার পর এ তথ্য আমাদেরও সামনে চলে আসে।
সেদিনই দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ সত্যেনের ক্যান্টিনে এই ঘটনার কারণ আবিষ্কৃত হয় ও তারপরে এর জেরে বাঙালি সমাজ পরবর্তী বহু মাস নানান অজানা ও অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী অথবা শিকার হয়।
দোদুল্যমান ইলেকট্রিকের তারের চারিদিকে প্রকৃত প্রস্তাবেই তড়িচ্চুম্বক বলের লক্ষ্যণীয় উপস্থিতি আছে। শিশু থেকে বিশু হয়ে ওঠার বয়সে আমরা এই বল সম্বন্ধে যথাক্রমে সন্তরণ সূত্র, বার্লোচক্র তথা বাম বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রকল্প অধ্যয়ন করেছি। অপরদিকে, মাধ্যমিকের দত্ত-রথের জীবন বিজ্ঞান বই থেকে এ কথাও জানা যায় যে কাক একটি পক্ষী, এবং তার রক্তে হিমোগ্লোবিন আছে। হিমোগ্লোবিনের কেন্দ্রে আছে একটি লৌহ পরমাণু। অতএব, এ তো বলাই বাহুল্য যে তড়িচ্চুম্বক বলের প্রভাব কাকের রক্তের হিমোগ্লোবিনের লোহায় পড়বে, এবং তার ফলে সেই রক্তের উৎস্রোত শরীরের মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক গতিসম্পন্ন ও জটিল আবর্তের সৃষ্টি করবে। সোজা কথায়, ইলেকট্রিকের তারে কাক বসলে তড়িচ্চুম্বক বলের দরুণ কাকের গা গোলাবে ও ক্ষেত্রবিশেষে সেই কাক পিচিক করে বমি করবে। খুব হাই ভোল্টেজে এ সময় কাকের গায়ের লোম ভ্যান-ডি-গ্রাফ এফেক্টে খাড়া হয়ে উঠতে দেখা গেছে। এই তত্ত্ব আমরা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইন্স ক্লাবের মুখপত্র 'ফোটন' এর সম্পাদকীয়তে ধূর্জটি ব্যানার্জির (তখন চতুর্থ বর্ষ, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনীয়ারিং ও এখন সিইও, ইলেকট্রোপ্লাস-অ্যাগ্রো) কলমে পড়ে ফেলেছি।
তড়িচ্চুম্বক বল ও রক্তের সম্পর্ক জানাজানি হয়ে যাওয়ায় এই সময়ে মৎস্য দপ্তরে চিংড়ি মাছের ওপরেও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। চিংড়ির বিশেষত্ত্ব এই, যে তার রক্তের কেন্দ্রে আছে তামার পরমাণু, ও হিমোসায়ানিন নির্ভর সেই রক্তের রং নীল। এই জমিদারসুলভ মাছ, অর্থাৎ আসলে পোকাটিকে আন্ডারওয়াটার হাই ভোল্টেজ লাইনের কাছাকাছি এক থেকে দেড় হপ্তা রেখে দেখা যায় যে তার স্বাদে প্রায় ত্রিশ শতাংশ পর্যন্ত উন্নতি হয় এবং স্কোভিল ইন্ডেক্সে তার ঝাঁঝ ও ঝালের পরিমানও উপযুক্ত পরিমানে বেড়ে ওঠে - যার ফলে কাস্টমারকে আর আলাদা করে কাসুন্দি-লঙ্কা দিতে হয় না। এই টেকনলজি শেষ পর্যন্ত বেনফিস নিয়ে নেয় ও আজও পশ্চিমবাংলার ইলেকট্রোম্যাগনেটিকালি এনহ্যান্সড বাগদা স্বাদে গুনে অতুলনীয়।
মার্কেটের এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে যুগের হাওয়ায় এসময় আরামবাগও মুরগির খাঁচার চারিদিকে অল্প করে ভোল্টেজ পাঠাতে শুরু করে। অবশ্যই, এতে মুরগির কোনও ক্ষতি হয় না, কিন্তু তার ডিমে আয়রনের পরিমান বাড়তে শুরু করে। সেই স্বাস্থ্যকর ডিম বাজারে একচ্ছত্র সাম্রাজ্য তৈরি করার চেষ্টা শুরু করে ও হাসপাতালগুলিতে সেই আধিপত্য কায়েমও করে ফেলে। মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিক ও জয়েন্ট পরীক্ষার্থী, তথা চাকুরীজীবিরা শরীর ও মন ভেষজ উপায়ে তাজা রাখতে কেবলমাত্র আয়রন এনরিচড ডিমই কিনতে শুরু করে।
প্রত্যেক আবিষ্কারের যেমন একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, এই টেকনোলজিরও খুঁত ডিম বেচতে গিয়েই ধরা পড়ে। ডিমের ভেতরে ও খোসায় অধিক আয়রন থাকার দরুন কিছুদিনের মধ্যেই ডিমের গায়ে জল ও অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে জং পড়া শুরু হয় ও ফেরোসোফেরিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়ে খাবার অযোগ্য করে তোলে। ডিম কোম্পানীরা কিছুদিনের মধ্যেই গবেষণার মাধ্যমে স্টেনলেস ডিম তৈরি করতে সক্ষম হয়, কিন্তু তার দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে হওয়াতে সাধারন মুরগির ডিম কেনাই মানুষের পক্ষে শ্রেয় হয়ে ওঠে।
শুধু জং নয়, এই ধরণের ডিমের দরুণ খুচরো সামাজিক অপরাধও বাড়তে শুরু করে। অনৃতভাষী ও স্বার্থান্বেষী গৃহস্থ নাইলনের ব্যাগে লুকিয়ে পকেট বানিয়ে তাতে একটি বাটখারা সাইজের চুম্বক রাখতে শুরু করে ও গরীব ডিম বিক্রেতার অজস্র মরচেহীন ডিম চুরি করা শুরু হয়। আমাদের সে সব বচসার কথা মনে আছে, সেই যখন ডিম বিক্রেতার দোকান মাত্রেই চারিদিকে ডিমের সাইজের চেয়ে ছোট জাল দেওয়া থাকত।
বিপুল প্রতিবাদ ও তিন তিনটি মোকদ্দমায় পরাজিত হবার পর এ ডিম বাজার থেকে একেবারেই উঠে যায়। বাংলায় শান্তি ফিরে আসে। ডিম ও মুরগি চাষ লাভজনক না হলেও, এই প্রযুক্তি যে আমাদের চিংড়িকে বিশ্বের বাজারের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছে সে কথা অনস্বীকার্য। আর, এক পা এগোতে গেলে যে দু পা পেছোতে হবে, সে কথা তো স্বয়ং লেনিনই বলে গেছেন।