অতিবৃষ্টি হলে মাঝে মাঝেই ঢাকুরিয়া লেকের আশেপাশে জল জমে যায়। একথা আশ্চর্যের কিছু নয়। মুশকিল হল, যখন হঠাৎই হয় কথায় নয় কথায় কামানের দিকটায় জল জমতে আরম্ভ করল। লেকের ওদিকটা যাদের বিশেষ আসা যাওয়া নেই তাদের কাছে এই খবর বিশেষ উদ্বেগের নয়। কিন্তু যাঁরা লাফিং-ক্লাব, বা হাসি সংসদের সদস্য তাঁদের অনেকেই ভুরু কুঁচকে অট্ট, মৃদু, মুচকি, মিচকে, দমফাটা ও চুক্কি ইত্যাদি হাসি প্র্যাকটিস করতে করতে এই পরিবর্তন খেয়াল করেছেন। বয়স্ক লোকের সুবিধে হল এই অনুসন্ধিৎসা। ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলে ধানের শীষের ওপর শিশিরবিন্দু দেখেই অনেক বিষয়ের অবতারণা করতে পারেন - জোয়ান ছেলেপিলেদের হট্টগোলে ভরা জীবনের মুকুরে সেসব দেখা ধরা দেয় না।
4
যে কোনও হাসি-সদস্যকে জিজ্ঞাসা করলেই জানা যাবে যে কামানের ওদিকে কোনওদিনই জল জমতো না। হয়তো কামান লাগানোর সময়েই জমি ঐভাবে তৈয়ার করা হয়েছিল, যাতে বসেটসে গিয়ে জল না জমে। দু হাজার চার সালে (ইং) যেদিন আকাশ ভেঙে পড়লো ও যাদবপুরের মোড়ে হস্টেলের ছেলেরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেই বৃষ্টিতে বড় রাস্তার ওপর গামছা ফেলে চারা মাছ ধরলো সেদিনও কামানের ওখানে বড়জোর একটু জলের উদ্রেগ হয়েছিল মাত্র। আর এখন, ভবানীপুরের আকাশে মেঘ কল্লেই ওখানটা কেমন কাদাকাদা হয়ে যাচ্ছে, পরপর দুদিন খটখটে রোদের পরেও একটু জলের আভাস রয়ে যাচ্ছে। লক্ষণ গোলমেলে।
এমনটি কি হতে পারে, যে ঢাকুরিয়া লেকের নীচে একটি স্তরায়ন তল ছিল, যার থেকে তিলোত্তমা কলকাতা শহরের টিউবওয়েল ইত্যাদি জল জল তুলে তুলে জলশূন্য করে দিয়েছে? মাটিতে তো জোর হয় তার জল, হাওয়া ও কাদার অনুপাত থেকে। মাটি যেমন ছিল হয়তো তেমনই আছে, মাঝখান থেকে জল টেনে যাওয়াতে একটা স্তরায়ন তল হয়তো বসে গেছে। যেভাবে কি না কলকাতা আর ত্রিশ বছরে আস্তে আস্তে বসে যাবে ও জলশূন্য হবে। তবে এই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কম কারণ সেক্ষেত্রে একটা বড় অঞ্চল বসে যেত ও বাঁধানো পাড়ের কংক্রীট ফুটিফাটা করে দিত। নিদেনপক্ষে বসে যাওয়া মাটি এতটুকু জায়গা নিয়ে বসত না। এও হতে পারে যে ওখানে হয়তো কোনও ভারী বস্তু দিয়ে পেটানো হয়েছে, বা কেউ কিছু খুঁড়ে পুঁতে রেখে গেছে। এদিকটা আবার তেমন ভালো না - চোর জোচ্চোর ছিনতাইবাজের উপদ্রব লেগেই আছে। কিন্তু তাহলে খোঁড়ার চিহ্ন থাকত। লেকের মাঠের কোনও রোলার ধামসালেও সে চিহ্ন ঘাসের ওপর রয়ে যেত।
রহস্যের সমাধান হল না, কিন্তু ধীরে ধীরে মাটি বসে যেতে লাগলো। মাস তিনেকের মধ্যেই প্রশ্নটা শুধু লাফিং ক্লাব নয়, এলাকার অন্যান্য বাসিন্দাদের মনেও চাড়া দিয়ে উঠতে লাগলো। দেবে যাওয়া ছোট্ট এলাকার এই ক্রমবর্ধমান নিম্নগামিতা মানুষের মধ্যে মৃদু বিস্ময়ের সঞ্চার করলো। এই সময়েই হাসি সংসদের এক প্রধান সদস্য, ডঃ পাত্র, বিই (অনার্স), এমএস (উইসকনসিন), পিএইচডি(আইওয়া), প্রেসিডেন্ট - জিওটেকনিকাল স্টাডি সার্কল, ক্যালকাটা চ্যাপ্টার, লক্ষ্য করলেন যে জল ঐ দেবে যেতে থাকা এলাকায় জমছে শুধু তাই নয়, বেরিয়ে যেতেও বেশি সময় নিচ্ছে। অর্থাৎ জল জমে মাটি দিয়ে নিচে নিষ্কাশিত হবার পথ পাচ্ছে না, বাতাসেই বাষ্পীভূত হচ্ছে। এর অর্থ, ঐ এলাকায় মাটির ঘনত্ব বোধ হয় বেড়ে যাচ্ছে।
ডঃ পাত্র এর একটা বিহিত বা হেস্তনেস্ত করার দায়িত্ব নিলেন। অবশ্য এতে ওনার একটা অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্টও ছিল। সময়সুযোগ থাকলে একদিন তিনিও পুরোদস্তুর গবেষণা করতে পারতেন, শুধু ছাত্র ঠেঙিয়েই চাকরির জীবনটি চলে গেল। সে যাই হোক, উনি অনেক আঁকজোঁক করে কিচ্ছু বের করে উঠতে পারলেন না। এই অবস্থায় উনি একদিন কাকভোরে উঠে লেকের মাঠে গাছপালার ঝোপে বান্ধবগড় থেকে কেনা ক্যামোফ্লাজ জ্যাকেট পরে ঘাপটি মেরে কী হয় দেখার জন্য বসে রইলেন। প্রথম দু দিন কিচ্ছু দেখতে পাওয়া গেল না। সুস্থ শরীর ব্যস্ত করে রাতের ঘুম নষ্ট হল। কিন্তু তাতে ডঃ পাত্র দমলেন না। এক সময় তিনি ডক্টরেট করেছিলেন, তাই অকিঞ্চিৎকর জিনিস নিয়ে খামোখা লড়ে যাবার ক্ষমতা তাঁর পুরনো।
তিনদিনের পর চারদিনের দিন উনি দেখতে পেলেন যে দূর থেকে তাপস পাল আর শতাব্দী রায় এদিকেই আসছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে উনি পুরো ব্যাপারটা নোট করলেন। মাঝে মাঝেই এখানটায় এসে তাপস আর শতাব্দী শরীরটাকে রক্ষা করতে ভোরের দিকে স্কিপিং করে। বলা বাহুল্য, এর পরে সমস্ত রহস্যই খোলসা হয়ে গেল। লাফিং ক্লাব নিশ্চিন্ত হয়ে আবার হাসি প্র্যাকটিস করতে লাগল।
পুঃ অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এই ঘটনায় বর্ণিত লোকজনেদের সাথে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা টলিউডের কোনও সম্পর্ক নেই।