মহানগর ২ ওয়েব ধারাবাহিকের দ্বিতীয় খণ্ডের এই দৃশ্যটা বেশ মজার। মজার স্মৃতিও উসকে দেয়। একবার হয়েছে কী, সৈয়দ জামিল আহমেদ-মহসিনা আক্তার এবং যাদের নাম জানি না, সে সব কলাকুশলীদের ৪.৪৮ মন্ত্রাস (সারাহ কেইনের ৪.৪৮ সাইকোসিস) দেখতে গিয়েছি বেইলি রোডের মহিলা সমিতিতে। নিচে প্রক্ষালন কক্ষে গিয়ে দেখি এক প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক ইউরিনালে মনোযোগ দিয়ে ইউরিয়া বের করছেন। আর তখন ‘স্যার, স্লামালিকুম!’ বলে কুশল বিনিময়ের খায়েশটা! উনি যখন প্রক্ষালন কক্ষ থেকে বেরোচ্ছেন, তখন একজন এ কাজটাই করে ফেলল। উনি প্রত্যুত্তর দিলেন বটে, কিন্তু তাঁর চেহারা দেখে মনে হলো এটা খ্যাতি উপভোগের জন্য আদর্শ জায়গা না। ‘বিখ্যাতদের শৌচাগারনামা’ ধরনের বই বের হতে পারে, তাঁরা রেচনকালে কতটা মনোযোগী বনাম নিজের কাজে কতটা মনোযোগী—এই নিয়ে আলোচনা।
আসেন, ভিতরে ঢুকি। শিরোনামে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ বলতে বুঝিয়েছি তাদেরকে, যাদের ওপর বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্র ছড়ি ঘোরাচ্ছে, নির্যাতন চালাচ্ছে। ওয়েব ধারাবাহিকটি বাস্তবকে তুলে ধরতে গিয়ে ফিকশন ও বাস্তবের ক্ষতি করছে বলে কেউ কেউ দাবি করছেন। তা ভাই, আমি তো প্রফুল্ল চক্রবর্তীর যমালয়ে জীবন্ত মানুষ, জিগা ভেরতফের মুভি ক্যামেরা হাতে মানুষটি বা কুরোসাওয়ার রাশোমন দেখতে বসি নাই (দেখতে পাব এক সময়, এই ওটিটি পাটাতনেই — এটাই প্রত্যাশা)। প্রোপাগান্ডা কন্টেন্ট বা আধেয় বলেও কেউ দাবি করেছেন। জীবন থেকে নেয়া, আগুনের পরশমণি, ওরা ১১জন—এগুলো কি নির্মিত হওয়া দরকার ছিল না, আপনার কী মনে হয় — এগুলোকেও প্রোপাগান্ডা বলতে রাজি আছেন? আমি ঠিক পরিষ্কার না আপনাদের অবস্থান নিয়ে। ইউটিউবে সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা কার্টুন বা আমেরিকান প্রোপাগান্ডা কার্টুন লিখে খুঁজতে পারেন। সেগুলোর মাপের কার্টুন শিল্প আমাদের এখানে এতাবৎ দাঁড়ায় নি। কার্টুনগুলো অল্পবিস্তর প্রোপাগান্ডা মাধ্যম হিসাবে কাজ করেছে, সে সম্পর্কে সজ্ঞান হয়েই তো অযুত-নিযুত মানুষ আঠার মতো লেগে থেকে দেখছে এখনো। মহানগর ২ যদি কিছু না হয়েই থাকে, তাহলে ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের’ খাউজানি শুরু হলো কেন? আপনার যদি মনে হয়ে থাকে, এটা তেমন প্রতিবাদী কিছু না, তা মেনে নিলেও বলতে হয় যুগপৎ কর্তৃপক্ষের কণ্ডূয়ন এবং দর্শকের সাতিশয় সাড়া এটাই প্রমাণ করে যে দেশ এতটাই উদ্ভট উটের পিঠে চলছে যে, জবাবদিহিতায় এতটাই বেপরোয়াভাব, স্রেফ নাগরিক পরিচয়ে বিচরণ এতটাই সীমাচিহ্নিত যে, এই ‘অ-প্রতিবাদী’ ‘নিরীহ’ আধেয়রও বড়ো খরা এই দেশে। বাইরে বেশুমার ভালো ভালো প্রামাণ্যচিত্র হয় ওটিটি পাটাতনে, বাংলাদেশে হয় না। তাজউদ্দীন আহমদ ও বাকি তিন নেতা, আবুল হাশিম, যোগেন মণ্ডল, ১৯৯৬-এর ব্যর্থ অভ্যুত্থান, রক্ষীবাহিনী, জাতীয় ওষুধ নীতি ১৯৮২, মুহাম্মদ ইউনূস এমন বহু বিষয় আছে আপনাদের সাহস দেখানোর জন্য, কোনো পুলিস প্রসিজারাল না, খাঁটি সাহস দেখাতে পারবেন। তাছাড়া আবেদ চৌধুরী, মাকসুদুল আলম, মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, হাজী দানেশ, ইলা মিত্র—এঁদেরকেই দৃশ্যমাধ্যমে কতটুকু ফোটানো হয়েছে?
আমার পর্যবেক্ষণ: মানুষ নিজের এবং সম্প্রসারিত-নিজের অর্থাৎ তাদের গোটা সমষ্টির হেরে যাওয়া এবং সুড়ঙ্গ শেষের আলোর প্রতিফলন এ ওয়েব ধারাবাহিকে দেখতে পাবে বলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুনের মৃত্যু বা বেঁচে থাকা ধারাবাহিকটা টেনে নেওয়ায় কোনো প্রভাব ফেলবে না, যতক্ষণ ধারাবাহিকটি প্রাসঙ্গিক থাকে।
ওটিটিতে প্রতি পর্ব শেষে ক্লিফহ্যাংগার বা উৎকণ্ঠা-মুহূর্তের যে প্রচলন, সেটা তো এক রকম ম্যানিপুলেশন বলে খোদ নিপুনই জানিয়েছেন এক সাক্ষাৎকারে। আমারও এ বিষয়টা ভালো লাগছে না, কোনো কিছু কড়াভাবে সূত্রবদ্ধ হয়ে গেলে তা উপভোগ করা যায় না। ভিডিয়ো প্লেয়ার বার ধরে ঘোড়া দৌড়াতে দৌড়াতে যত শেষের কাছে চলে আসে, উৎকণ্ঠা-মুহূর্তের অবস্থান জেনে নিলে গল্পাংশের কিছুটা তো অনুমেয় হয়েই পড়ে। বৃক্কের ওপরকার অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রেনালিন নিঃসরণ করাতে গেলেও তা ক্লিশেই হয়ে যাচ্ছে, সব ওয়েব ধারাবাহিকের কথাই বলছি।
আর অনির্বাণকে রজব আলী বলে মানতে কষ্ট হচ্ছে। সাজসজ্জা বেশি হয়ে গিয়েছিল কি? অনির্বাণ অন্য সব ছবিতে চরিত্রের সাথে এত দারুণভাবে মানিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু এখানে মানাচ্ছে না। অনির্বাণকে চমক হিসাবে না দেখিয়ে স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে মিলিয়ে দেখালেই বরং দেখতে ভালো লাগত। এটা কি তাঁর ফ্রেমটায় তিনি পুরো একা, তাই তাঁকে বিচ্ছিন্ন লাগল?
সাংবাদিক শফিকুল আলম লিখেছেন, ইতিহাসের পক্ষে না বিপক্ষে আছেন, তার চেয়ে জরুরি কোনো গণবুদ্ধিজীবী মানবাধিকার প্রশ্নে ইতস্তত করেন কি না, তা দিয়ে তাঁর সততা যাচাই। সে জিনিস অন্য বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেও আমি প্রয়োগ করি, কিন্তু তাঁরা সৎ-অসৎ যা-ই হোন—তাঁদের কাজকে আমি আলাদা করে দেখতে চাই, মাঝেমধ্যে তাঁদের কাজ ছাড়া আমরা গতিই করতে পারি না। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করে থাকেন, তবে আপনার পাঠ্য ইংরেজি বইগুলোর মার্কিন লেখকের সাথে মার্কিন সেনাবাহিনী-নৌবাহিনীর কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না? সেসব লেখক ফিলিস্তিন নিয়ে কী মত প্রকাশ করেন? কিন্তু আপনি তো তাঁদেরকে বাতিল করতে এতকিছু ঘাঁটেন না, বাতিল করেনও না, কারণ আপনার তাঁদেরকে লাগবে। কিন্তু মুহম্মদ জাফর ইকবালকে বাদ দিতে পারেন, গালি দিতে পারেন, কারণ আপনার তাঁকে তেমন প্রাবল্যে প্রয়োজন হয় না। ভূতের বাচ্চা সোলায়মান নিয়ে হইচই করতে পারেন, কিন্তু নিউরনে অনুরণন, দেখা আলো না দেখা রূপ, গণিত এবং আরো গণিত, একটুখানি বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ—এগুলো তো ‘কাজে লাগবে‘। বিনোদন পাঠের ক্ষেত্রেও (গল্প-উপন্যাস-নাটক-মন্ময় প্রবন্ধ) আপনি এমন ‘অসহায়’ বোধ করতে পারেন। সোফোক্লিস থেকে আজকের সের্গেই লুকইয়ানেনকো পর্যন্ত সবার রাজনৈতিক কুষ্ঠিবিচার করে আপনি তাঁদেরকে পাঠ করেন না, পাঠকালে-দর্শনকালে রাজনৈতিকভাবে অযথার্থ কিছু ধরা পড়লে উঠে চলে যান না, তাঁদেরকে বাতিল করে দেন না।
তবে দ্ব্যর্থহীনভাবেই কয়েকদিন আগে জাফরুল্লাহ্ চৌধুরীর মৃত্যুতে নিকট মানুষের মৃত্যুসম যে দুঃখ ভেঙে পড়েছিল আকাশ থেকে, জাফর ইকবালের বেলায় সেটা তো আর হবে না। তাঁর ভৌতিক একটা বই বেরিয়েছে এই মেলায়, নেড়েচেড়ে দেখলাম, আবার আগের ফর্মে ফিরেছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই—লেখক হিসাবেই বিবেচনাটুকু বা গণিত অলিম্পিয়াডের সংগঠক হিসাবে বা পাঠ্যবইয়ের সংস্কারক হিসাবে, আর কোনো উচ্ছ্বাস কাজ করে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর থেকে তিনি আমাদের প্রজন্মের সংবেনশীল অংশের কাছে মৃত। আশফাক নিপুন এমন করে আগেই মরে যাবেন না আশা করব, তাঁর মৃত্যুর পর নিকট মানুষ হারানোর দুঃখে কাঁদতে চাই।
আরেকজনের কথা বলতে চাই, কাজী নওশাবা আহমেদ, যিনি মহানগর ১-এর পর ২-তেও আছেন পার্শ্বচরিত্রে। তিনি অভিনয় করেছেন ভালো। তবে আমি স্মরণ করি, ২০১৮-র নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় আমরা লক্ষ করলাম একজন অভিনেত্রীকে ‘গুজব’ ছড়ানোর দায়ে গ্রেফতার করা হলো। ঐতিহ্য বলে, এদেশে পুরুষ শিল্পীদের সমান্তরালে নারীরাও দীপিকা পাড়ুকোনের মতন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে সংহতি জানান না, বিউটি সার্কাসে সার্কাস দেখান। কিন্তু নওশাবা সেদিন দেখালেন মেরুদণ্ড কাকে বলে, how beauty, coupled with courage, can be personified. তাঁকে শ্রদ্ধা। এই মেরুদণ্ডসম্পন্ন সব মানুষের কথা আমরা লিখে রাখব, স্মরণে রাখব।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।