আরে, এই হয়েছে মুশকিল।
বড়ো মুখ করে খুব তো ইজারা নিলাম মাসান্তিক গোছের "কলাম" লেখার। আবার আদিখ্যেতা করে নামও দিলাম সিরিজ টু। ওঃ। ইদিকে মগজে কার্ফু। বয়স তো হলই। এখন তো উত্তর সত্তর, তো কী? অভিজ্ঞতা কী? খাওয়া দাওয়া নিয়ে যে লিখবো, তো জানি টা কী? দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে, বহু যায়গার আর খাবারের ফটো টটো দিয়ে তেমন জমজমাট লেখার মতন অভিজ্ঞতাই বা কই? আমি কি পেরুতে গিয়ে গিনিপিগ ভাজা খেয়েছি বা উগান্ডায় গিয়ে কুমীরের রোস্ট খেয়ে বলেছি হলদি নদীতে এর চেয়ে বেশি সরেস মাল পাওয়া যায়?
শালা, সারা জেবন ধরে একই জিরা,ধনে,লংকা,হলুদ (একটু গ্যাপ দিয়ে পড়বেন প্লীজ) ঐ সব দিয়ে একই ঘ্যাঁট রেঁধেছি আর খেয়েছি- দিনের পর দিন। তা ও ভালো ইউ টিউব আসায় গুল তাপ্পি মারা সহজ হয়েছে। কিন্তু মাসের পর মাস - কতোই বা লিখবো? সুবিধের মধ্যে এই, যে আপনেরাও বিশেষ পড়েন টড়েন না।
তা ও, কথা যখন দিইছি, তখন লিখবোই। এইবারের থিম হচ্ছে "হারিয়ে যাওয়া খাবার"। জানেননি তো, যাদের আর কিছু নেই, তাদের নস্টালজিয়াই সম্বল।
তবে আগেই চেতাবনি (ডিসক্লেইমার রে বাবা) - এটা হচ্ছে বেসিক্যালি আত্মজীবনী মার্কা লেখা। এতোটা বয়স হল - কিন্তু জীবনের ফার্স্ট হাফটাই (সে ও তো এক ধ্যাড়ধ্যাড়ে লম্বা ইনিংস, ছ্যাঃ) তো সাধের পশ্চিমবঙ্গে - প্রথমটায় নিদেন মফঃস্বলে আর শেষটায় কলকেতায়। আর সেকেন্ড হাফটা পুরোটাই প্রবাসে। আমার কাছে যেটা "হারিয়ে যাওয়া খাবার" সেটার সাথে আপনাদের কি খাপ খাবে? পেত্যয় হয় না। তায় আপনেরা যদি ফিনল্যান্ডে বড় হয়ে থাকেন, আর চাকরী করেন টোকিওয়ে - বা এক বিশ্ব নাগরিক, আজ কামচাৎস্কায় তো পরশু পোপোকেটাপোটোলে - তাহলে ঠিক বুঝবেন (ইন্টার্নালাইজ করবেন) ক্যামনে?
তা ধরুন, ব্রেকফাস্ট থেকেই শুরু করি। খেতাম একঘেয়ে নিতান্ত মামুলি। সেই পাউরুটি আর মাখন। কখনো জ্যাম, জেলি। না রে বাবা, ডিম ফিম হতো না। চীজ চোখেও দেখি নি।
হারিয়ে যাওয়া খাবারের মধ্যে জেলি ও আছে। ফলের রস দিয়ে হয় জেলি আর পাল্প দিয়ে জ্যাম। তো বহুদিন হল দোকান টোকানে "জেলি" বস্তুটি আর দেখি নি। ফলেদের কি আর রস হয় না? কে জানে? পেয়ারা থেকে জেলি হতো সবুজ রঙের, আর একটা লাল রঙের জেলিও হতো। বোধয় আমের। কোথায় গেলো সেই জেলি? মার্মালেড? নাম ও শুনিনি।
আর পাউরুটির কথা বলি। তখনো কোনো ব্র্যান্ডেড পাউরুটি ছিলো না। প্রতিটি পাড়ায় বেকারি থাকতো। বড়ো টিনের বাক্সে তিন চাকা লাগিয়ে "পাউরুটি, ব্রেড" বলে ভোর থেকেই চেঁচিয়ে মেচিয়ে বিক্রি হতো। ওভেন থেকে সদ্য নামানো হাতে গরম পাউরুটি। কী সুবাস। কিন্তু এমনি নরম যে কাটাও যেতো না। একটু অপেক্ষা করতে হতো । প্রতি বাড়ীতেই রুটি কাটার দাঁতালো ছুরি থাকতো। স্লাইসড ব্রেড? হাসাবেন না মশাই। আমি সত্য যুগের কথা বলছি - কুল্লে তখন সিপিএম এসেছে মসনদে। মানুষ চাঁদে যাবে শিগগিরই কিন্তু ছাতার ফোল্ডীং দশা বা সুটকেসের নীচে চাকা আবিষ্কার হতে আরো এক যুগ বাকী। সত্যি, প্রযুক্তির গতি কী কুটিল!
আর পাউরুটিও নিছক ময়দার হতো। সাদা, ফ্যাটফ্যাটে। নরম সরম। তখনো তো ফাইবারের কথা লোকে জানতো না। কোষ্ঠে কাঠিন্য থাকলে রাত্রে ইসব গুলই সেব্য। সকালের পাউরুটিতে আটা, হোল হুইট, ফাইভ গ্রেন .... ধুর, এসব তখন কোথায়?
চেরি (অভাবে চিনির রসে চুবানো করমচা) দিয়ে একটা মিষ্টি পাউরুটি পাওয়া যেতো - তবে সে সব সাহেব পাড়ায়, কেৎএর দোকানে। না হলে সোজা দার্জিলিং'এ। আরেকটা জিনিস ছিলো। লোকে বাসী পাউরুটি বিশেষ খেতো না। এক পাউন্ড বেশি ঠেকলে হাফ পাউন্ড এমন কী কোয়ার্টার পাউন্ডেরও রুটি পাওয়া যেতো।
টিপিনের সময় কয়লার উনুনে সেঁকে, একটা মাখনের ইশারা, তার উপরে গোল মরিচ- চাইলে ঝাল আলুদ্দম দিয়ে দিব্বি পেট ভর্তি লাঞ্চ বা টিপিন হয়ে যেতো - কোনো অপচয় হতো না।
আর একটু পুরোনো হয়ে গেলেই সেই কোয়ার্টার পাউন্ডের রুটি একেবারে শক্ত ইট হয়ে যেতো। তো, কুছ পরোয়া নেই, মধ্যিখানে খুবলে একটু গর্ত মতন করে সোডা (ফটাস জল- সেই যে - ছিপিটা খুললেই ফট করে আওয়াজ হতো - বোতলের মুখের কাছে একটা কাঁচের গুলি? সেই ফটাস জল) ঢেলে দিলেই রুটি অতীব নরম ও সুস্বাদু। খান, ভালোবেসে খান।
জানি না, স্কুলের গেটের কাছে সেই ছোট্ট মাদ্রাজি কুল - কারেন্ট নুন দিয়ে খেতে হতো? সেগুলো ও আর পাওয়া যায় কি না। সার্কাস বিস্কুট, হাতি ঘোড়া বিস্কুট (ও আরো নানান জন্তুর শেপের বিস্কুট; বেশির ভাগ সময়েই প্রজাতি ঠিক আইডেন্টিফাই করা যেতো না) - তারাও আর নেই। রাস্ক তো সর্বত্র পাওয়া যায়ই- কিন্তু আদি লেড়ে বিস্কুটের মতন অভিমানী ঝুরঝুরে নয়। কোথায় সেই চুড়মুহে বনেদীয়ানা?
আর ছিলো ফল। ফল এবং ফ্রুট। তফাৎটা কী? ফল হচ্ছে পাতি, কলা, বেল, আতা, পেয়ারা, শাঁকালু, নারকেলি কুল..... ইত্যাকার আর ফ্রুটসের মধ্যে আপেল, আঙুর, নাসপাতি এইসব ছ্যাঁকা দেওয়া দামের খাদ্য বস্তু। অন্ততঃ ১০৩ ডিগ্রি জ্বর না হলে সাধারণ বাড়ীতে ঢুকতোই না ঐ সব ফ্রুট। কিন্তু তাবলে হারিয়ে গেলো কে? তাহলে জেনে রাখুন হারিয়ে গেছে অস্বাভাবিক টক সব ফলেরা। আপেল, আম, আঙুর বা কমলালেবুও - সবকটা নয়, কিন্তু একেকটা এমনি বাদশাহি টক হতো যে এক কামড় দিলেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঝন ঝন করে উঠতো। অনেকক্ষণ পর্যন্ত দাঁতে কোনো সার থাকতো না।
নঃ। সেই প্রথম কামড়ের বুক ঢিপ ঢিপ উত্তেজনা, শিহরণ, রোমাঞ্চ এবং পতন ও মূর্ছা আর নেই। এখন আর বেছে বেছে কিনবার দরকার নেই - কোনো ফলই ফেল করে না। কোথায় গেলো সেইসব শিরদাঁড়া কাঁপানো যক্ষ টক ফলেরা? সিলেকটিভ ব্রিডিং? বা কোনো সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র?
এর ফলেই কি গ্লোবাল ওয়ার্মিং?
হ্যাঁ, ওয়ার্মিংএর কথায় মনে পড়লো - সেই ওয়ার্ম বা পোকা গুলোই বা কোথায়? মটরশুঁটি বাছতে হতো। পিলপিল করে বেরত সবুজ রংএর পোকা। ফুলকপিতেও। আরো নানান সবজী কাটতে গেলেও ওয়ার্মিংএর চোটে অস্থির হতাম। চালে, ডালে, পাতায় পাতায় - সর্বত্রই নানান রঙের ছোটো বড় পোকা হতো। আম এবং আরো অনেক ফল কাটলেই বোঝা যেতো ভেতরটা কতোটা পোকায় ভর্তি। বাইরে থেকে কিছুই দেখে টের পাওয়া যেতো না। এখন আর নেই। ভারতে ব্যান হলে কী হবে? দেশের সহজ সরল চাষি ভাইরা (সবজিদাতারা) স্মাগল করে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসছে বিটি বেগুন। পোকাহীন বেগুন - এ তো ভাবতেও পারতাম না। এখন সবই হয়। আরে না রে না, সেরকম সজল নয়নে 'সেই যে আমার পোকা বাছার দিনগুলি' বলে স্মৃতি ভারাক্রান্ত হচ্ছি না। সে ভাবে বলতে গেলে সত্যি কি আর মিস করছি কাঁকর সম্পৃক্ত চালকে? একমাত্র ভামেরাই জানবেন, কাঁকর কাকে বলে। চালের মধ্যে সে এক অদ্ভুত পাথর কুচি- ঝট করে বোঝাই যেতো না কোনটি চালের দানা, কোনটি পাথর কুচি। কুলোয় ফেলে চাল অনেকক্ষণ বাছা হতো - তাও অসাবধানে এক আধটা চালের ছদ্ম বেশি পাথর থেকেই যেতো আর জানান দিতো ঐ ভাত খাবার সময়। কড়াত কড় করে মুখের মধ্যেই বজ্রপাত। ভাত খেতে গিয়ে একবারও আহত, রক্তাক্ত হন নি ও রকম লোক তখন কমই ছিলো।
আর পাঁঠার কথা নতুন কী বোলব। অলরেডি একবার লিখেছি সেই হারিয়ে যাওয়া ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটেদের কথা। - সিজন ওয়ানের কোনো এক প্রাতঃস্মরণীয় পর্বে। সেই হাবলা দুবলা হাড় সর্বস্ব প্রজাতি এখন বিরল। হাইব্রিড পাটনাইয়া পাঁঠায় এখন ভরে গেছে মাংসের দোকান। ফলে সেকালের মাংস কেনার মতন এখন অ্যাডভেঞ্চারে পূর্ণ নয় মাংস কেনার দিনগুলি। সকাতরে অনুনয় বা সগর্জনে হুমকিতেও অবিচলিত কসাই নির্বিকারে চোখের সামনেই প্রায় সবটাই হাড় ভর্তি মাংস দিয়ে দিতো, আর হাড় মেনে পরাজিত সৈনিকের মতন বাড়ীতে এসে আর এক প্রস্থ লাঞ্ছনা জুটত কপালে।
বাড়ীতে লাঞ্চে বা আপিসের টিপিনে, এলুমিনিয়ামের বাক্স খুলে ঐ বরাদ্দ আটারুটি আর তরকারীই মিলত। ছুটির দিনে শেষ পাতে অবশ্যই থাকতো টক বা অম্বল। কুলের বা চালতার। ট্যালট্যালে ফিকে রংএর জলের মতন, একটু কালোজিরের ছিটে। লিখতে গিয়ে মনে পড়লো - কতো বছর হয়ে গেলো চোখেও দেখিনি সেই সব টকের চেহারা। হারিয়ে গেছে না কি আমিই এক অম্বলবিছিন্ন প্রবাসী দ্বীপবাসী?
মুখরোচোকের মধ্যে খেতাম গোলাপ লেউরী আর তিলে খাজা। এখানে ওখানে খুঁজলে হয়তো এখনো পাবেন - কিন্তু সহজলভ্য নয়। পিঠে পুলি কিন্তু হারায় নি। বরং আরো ফ্যাশনেবলি জাঁকিয়ে বসেছে। কেতাদুরস্ত মিষ্টির দোকানে পাটিসাপটা বা লবঙ্গলতিকা দিব্বি পাওয়া যায়। যদিও খেয়েই বলতে হয়, আরে, ধুর, বাড়ীর মতন টেস্ট কই? এই প্রবাসে, দৈবের বশে, এক বাঙালি পার্টিতে (পার্টি, নেমন্তন্ন নয়) গিয়ে বোঁদে দেখে উচ্ছ্বসিত সমবেত জনতা। খাবে কী- কেঁদেই ভাসিয়ে দিচ্ছে। তবে ৯কার মার্কা গুজিয়া এখনো দেখি নি।
যারা বয়সে তরুণ, তাদের কাছে এগুলো রিলেটেবল হবে না। তা ও, ইতিহাসের কথা ভেবে একটু ইয়ে হতেও পারেন।
এমন কি প্রবাসে বাঙ্গালর শহরে ঠেলা গাড়ীতে করে বিক্রি হতো পানিফল। সে ও কতদিন হয়ে গেলো আর দেখি না। পশ্চিমবঙ্গে কি বকফুল, কুমড়ো ফুল - এখনো বাজারে গেলেই পাওয়া যায়? না কি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে লোকে এখন টিউলিপ ভাজাই খায়?
জানেন, সাধারণ বাড়ীতে তখন আট নয় দশবার বা আরো বেশিবার চা হতো। হতেই থাকতো। কফি খুব একটা ছিলো না। ইনস্ট্যান্ট কফি সবে আসতে শুরু করেছে আর বাড়ীতে তৈরি ফিলটার কফি শুধু মাদ্রাজিরাই খেতো। সেই টেকনোলজি ট্র্যান্সফার তখনো ঘটে নি। হারিয়ে গেছে গ্রীষ্মকালের বাড়ীতেই রাখা স্কোয়াশ বা ক্রাশ। জলে গুলে চিনি ঢেলে দেদার ফুর্তি। আর বরফ দিতে পারলে তো দেমাকে পা পড়তো না। আর সেই হজমি গুলি? এখনো পাওয়া যায়? আমরা খুব মশকরা করতাম, হাতের তেলোর ঘেমো ময়লা রগড়ে রগড়ে হজমি গুলির সাইজ বাড়ানো হতো। ইইক। বলতাম, খ্যা খ্যা করে হাসতাম আর আবার হজমি গুলি খেতে যেতাম। নিশ্চয়ই ভক্তি ভরে খুঁজলে আলুকাবলি পাওয়া যাবে, আর হরিদাসের চুড়মুড় ভাজাও।
তবে গোদা বাংলায় সহজ কথাটা বলি।
হারিয়ে গেছে তো অনেক কিছুই - কিন্তু পেয়েছি অনেক অনেক বেশি। কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে দু-একটা খাবার এর কথা মনে হয়। কিন্তু স্মৃতি মেদুরতায় ভারাক্রান্ত হই না।
আসলে জানেন, ভাষা বলুন, পোশাক বলুন, প্রিয় গান বলুন, দুর্ধর্ষ নায়ক বলুন, খ্যাতনামা গুন্ডা বলুন.... বা খাওয়া দাওয়া। খুব কম জিনিসই সারা জীবন টিকে থাকে। কৈশোর তো পলক ফেলতেই কেটে যায়। সেই সময়ের স্বাদ গন্ধ - সেই সবই বা আর পাবো কোথায়? সুতরাং এক অনামা পাশ্চাত্য দার্শনিকের সাথে একমত হয়ে, ভবদুলালীয় দর্শন মানতেই হয়।
সেই যে, শ্যামল মিত্তির যেমনটি বলেছিলেন "যা গেছে তা যাক, যা গেছে তা যাক" সেইরকমই…