এক আধুনিক সহাবস্থানের রূপকথা
"কেবলমাত্র মানুষদের জন্যই তো আর পৃথিবী না, পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও হরেক প্রাণী আছে, প্রাণ না থাকলেও ভূতেরাও তার অন্তর্গত। কি উদ্ভিদ জগৎ কি প্রাণী জগৎ কি ভৌতিক জগৎ - মাইগ্রেশন অত্যন্ত জরুরি।"
এই বইয়ের মাঝামাঝি এসে এই কথাটা পড়ে পাঠক উপলব্ধি করবেন কথক প্রকৃতপক্ষে পাঠককে এক আধুনিক রূপকথার আখ্যান পড়াতে চাইছেন। যে রূপকথা বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে এক সহাবস্থানের গল্প বলে।
"গ্রামে ঘরে ইহারা আর খাইতে পায় না, শহরে আসিলে তবু দুধটা ঘিটা।" - তাই হাওড়া শহরবাসী লেখকের অনুরোধে তাঁর গ্রামের দুই গুরুভাই ভুজু আর ডিবরা মাটির হাঁড়িতে 'কলম' করে তৈরি কালামুহি, ঝাঁপড়ি, কুচলা, চিড়িকিনি এইসমস্ত প্রজাতির ভূতের 'চারা' আনে বড় হলে আর পাঁচটা 'অর্গ্যানিক' ফসলের মত বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে।
প্রথমদিন হাঁড়ি দুটো কথকের বাড়ির পাশে রক্তকরবী গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হল। তাদের খাবার দেওয়া হল দু-ঘটি জল আর দু'মুঠো মাটি। টিভিতে শুনে তারা হিন্দি গান পটাপট গলায় তুলে ফেলল। কয়েকদিন পর তাদের স্থান হল মাটির হাঁড়ি থেকে অ্যালুমিনিয়ামের ডেচকিতে। সুষম খাদ্য তালিকা অনুযায়ী তাদের খাবার দেওয়া হতে থাকল। ভুজু ডিবরা গ্রামে ফিরে যাওয়ার সময় কথককে অনুরোধ করে গেল ‘গাঁইয়া ভূত’ বলে তাদের যেন অনাদর না করেন, সর্বদা যেন সন্তান স্নেহে ‘মানুষ’ করেন। সত্যিকারের কোনো দোষ করলে আচ্ছা করে কানমলা দিয়ে শাস্তি দিতেও যেন না ভুলে যান।
বিশেষ এক কাণ্ড ঘটানোর পর এদের মধ্যে গোমুহা ভূত গোল্লুকে নাসা এসে নিয়ে যায়, মঙ্গলে পাঠাবে বলে। তেল-সিঁদুর মাখিয়ে গোল্লুকে আকাশে ছেড়ে দেওয়া হয়। মঙ্গল থেকে তাকে আনতে হবে এক ঝুড়ি মাটি আর পাথর। সুবর্ণরেখা নদীতীরের গ্রামের বাসিন্দারা, নাসার লোকজনেরা সকলে মহাকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে কখন গোল্লু ফিরে আসবে। ইতিমধ্যে, বাকি ভূত দের চড়া দামে বিক্রিতে কি আদৌ সুরাহা হবে? লোকায়ত জীবনের মাটি থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে শহরের জলহাওয়ায় বড় করার অভিবাসন প্রক্রিয়া সফল হবে কি? নাকি তারা লেখকের বাড়ির পিছনে পুকুরেই মাছেদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে থাকবে আর মাঝে মাঝে মাথা তুলে 'কব' 'কব' আওয়াজ করবে?
এই আধুনিক রূপকথায় ধীরে ধীরে এক মলাটের ভেতর চলে আসে বোর্হেসের বইতে গরুড়ের উল্লেখ থেকে 'দ্য ট্র্যাকিং অফ চে গেভারা '। 'ভূষণ্ডির মাঠে ' থেকে 'হেশোরাম হুঁশিয়ার'। হাওড়া অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস থেকে পুরোনো আমলের পাঁজিতে দেওয়া বশীকরণ বিজ্ঞাপন। ভুজু ডিবরার বাবা নামজাদা গুণিন বালকা মুর্মুর এক চিড়িকিনি ভূতকে নিজের বৌ বানিয়ে রাখার গল্প থেকে 'সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে' তত্ত্ব প্রচারে ব্যস্ত কার্তিক চন্দ্র পাল। আর পাঠক সাক্ষী থাকেন সুবর্ণরেখা তীরের এক আলো অন্ধকার লোকায়ত জীবনের সঙ্গে হাওড়ার শহর মফস্বলের জীবনের এই আশ্চর্য সহাবস্থানের। যে রূপকথার পৃথিবীর চরাচর জুড়ে বিস্তৃত থাকে এক বিশাল বাস্তুতন্ত্রের ছাতা, যার তলায় বসবাসকারী মানুষ উপলব্ধি করতে শেখে সে আসলে এই বাস্তুতন্ত্রের এক ক্ষুদ্র অংশমাত্র।
সাদাকালো এই রূপকথার পৃথিবীর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে স্কেচপেনে করা সাদাকালো প্রচ্ছদ বইটিতে নিঃসন্দেহে এক অভিনব মাত্রা যোগ করেছে।
বইঃ ভৌত খামার
লেখকঃ নলিনী বেরা
প্রকাশকঃ গুরুচণ্ডা৯
মূল্যঃ ১২৫ টাকা