এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভারত–তুরস্ক

    prabhat ray লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ | ২৫ বার পঠিত
  • একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গ্লোবাল অর্ডার এখন আর আগের মতো  নেই। কোল্ড ওয়ার–এর পর যে ইউনিপোলার কাঠামো গড়ে উঠেছিল—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ছিল প্রধান ক্ষমতার কেন্দ্র—তা ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। তার জায়গায় সামনে আসছে এক মাল্টিপোলার বাস্তবতা। এই নতুন পরিস্থিতিতে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে এমন কিছু দেশ, যাদের পরাশক্তি বলা যায় না, কিন্তু যাদের প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না। জনসংখ্যা, অর্থনীতি, সামরিক সক্ষমতা এবং অবস্থানের কারণে তারা নিজেদের অঞ্চল ছাড়িয়ে বড় পরিসরে প্রভাব ফেলতে পারে। ভারত ও তুরস্ক এই ধরনের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ—কারণ দু’টি দেশই এখন নিজেদের কেবল আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক ধারার ধারক সিভিলাইজড রাষ্ট্র হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।

    দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রকে বোঝা হয়েছে সীমান্ত, ভূখণ্ড ও ক্ষমতার ভিত্তিতে। কিন্তু ভারত ও তুরস্কের বর্তমান পথচলায় সেই ধারণা আর যথেষ্ট নয়। দু’টি দেশই এখন নিজেদের ইতিহাস, স্মৃতি, ধর্ম এবং সাংস্কৃতিক আইডেনিটিকে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে নিয়ে আসছে। ফলে পররাষ্ট্রনীতি আর শুধু নিরাপত্তা বা বাণিজ্যের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ থাকছে না; তা হয়ে উঠছে অতীতকে কীভাবে দেখা হচ্ছে এবং ভবিষ্যৎকে কীভাবে কল্পনা করা হচ্ছে—তারই প্রতিফলন। আতাতুর্কের পরবর্তী সময়ের তুরস্ক সচেতনভাবে অটোমান ও ইসলামি অতীত থেকে দূরে সরে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। একইভাবে স্বাধীন ভারতের শুরুর দিকে নেহেরুর  রাষ্ট্রচিন্তাও ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনীতির বাইরে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দুই দৃষ্টিভঙ্গিই চাপে পড়েছে।এরদোয়ানের নেতৃত্বে তুরস্ক আজ তার নিও-অটোমান আইডেনিটিকে নতুন করে রিনিউ করছে। এই ভাবনায় তুরস্ক নিজেকে মুসলিম বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ, তুর্কি জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক অভিভাবক এবং ইউরেশিয়ার একটি স্বতন্ত্র শক্তিকেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরছে। অন্যদিকে ভারতের “বিকশিত ভারত ২০৪৭” কেবল উন্নয়নের কথা বলে না; এটি ভারতকে তার নিজস্ব ঐতিহাসিক ধারার ধারক এবং বিশ্বগুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস।

     দুই রাষ্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষাই ভারত–তুরস্ক সম্পর্কের ভেতরের টানাপোড়েনের মূল জায়গা।
     
    ভারত–তুরস্ক সম্পর্কের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় কাশ্মীর। ভারতের কাছে কাশ্মীর তার নিজস্ব ভূখণ্ডের প্রশ্ন—যেখানে বাইরের হস্তক্ষেপের কোনো জায়গা নেই। তুরস্কের কাছে কাশ্মীর আবার ভিন্ন অর্থ বহন করে। এটি এমন একটি প্রসঙ্গ, যার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের পক্ষে কথা বলা যায় এবং পাকিস্তানের পাশে থাকার বার্তা দেওয়া যায়। ২০১৯ সালে ভারতের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর তুরস্কের অবস্থান এই পার্থক্যকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। এই অবস্থান কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি তুরস্কের বৃহত্তর রাষ্ট্রচিন্তার অংশ। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপে তুরস্ক তার বক্তব্য কিছুটা রিভাইস করতে বাধ্য হয়েছে, তবু মূল মতভেদ অটুট রয়ে গেছে। এই প্রেক্ষিতেই  মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে তুরস্ক–পাকিস্তান–আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যাকে অনেকেই “থ্রি ব্রাদার্স” বলে উল্লেখ করেন। নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধে তুরস্কের ড্রোন ও সামরিক সহায়তার সাফল্য ভারতের কাছে একটি বাস্তব উদাহরণ —যা ভবিষ্যতে অন্য জায়গায়ও প্রয়োগ করা হতে পারে।
    ভারত ও তুরস্ক—দু’দেশই স্ট্র্যাটেজিক অটোনমির কথা বলে, কিন্তু বাস্তবে এর অর্থ দুই দেশে এক নয়। ভারতের ক্ষেত্রে স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি মানে সাধারণত কাউকে পুরোপুরি অনুসরণ না করা, কোনো সামরিক জোটে বাঁধা না পড়া এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা। এই পথ একদিকে স্বাধীনতা বজায় রাখে, অন্যদিকে অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবও প্রকাশ করে। তুরস্কের স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি আবার অনেক বেশি সক্রিয়। ন্যাটোর সদস্য হয়েও রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র কেনা-বেচা, আবার ইউক্রেনকে ড্রোন দেওয়া—এই দুই বিপরীত অবস্থান একসঙ্গে সামলানোই তুরস্কের কৌশল। এতে ঝুঁকি আছে, কিন্তু তুরস্ক সেই ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না।
    রাজনৈতিক সম্পর্ক যতই টানটান হোক, ভারত ও তুরস্কের মধ্যে অর্থনৈতিক যোগাযোগ পুরোপুরি থেমে যায়নি। বাণিজ্য চলছে, ব্যবসায়িক আলোচনা চলছে, এবং কর্পোরেট স্তরে যোগাযোগ বজায় আছে। মাল্টিপোলার গ্লোবাল অর্ডারে এই ধরনের সহাবস্থান অস্বাভাবিক নয়—বরং অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয়। এই বাস্তবতা ভারত–তুরস্ক সম্পর্ককে এমন এক অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যেখানে দুই দেশ পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েও একে অপরকে এড়িয়ে চলতে পারে না। ভারত ও তুরস্ক একে অপরের শত্রু নয়, আবার পুরোপুরি মিত্রও নয়। তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী—কিন্তু একই সঙ্গে একে অপরের উপস্থিতিকে হিসাবের মধ্যে রাখতে বাধ্য। মাল্টিপোলার গ্লোবাল অর্ডারে এই ধরনের সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সাধারণ হয়ে উঠবে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের জন্য প্রয়োজন স্থির দৃষ্টিভঙ্গি ও দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা। 
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন