উদয়পুরে কানহাইয়া লাল খুনের ঘটনায় হতবাক গোটা দেশ। হওয়ার কথাই। যে-কোনো হত্যাকাণ্ডই ভয়ংকর, কিন্তু এই ঘটনা শুধু একটা হত্যা নয়। যে পরিকল্পিত ও নৃশংস পদ্ধতিতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে তা বর্বরতার নমুনা। শুধু তাই নয়, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। এই হত্যাকাণ্ড ছিল নিখাদ গোঁড়ামির ফল। কানহাইয়া লালের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে নূপুর শর্মাকে (যিনি নবী মোহাম্মদকে অপমান করেছিলেন) সমর্থন করে কথা বলা হয়েছে বলে রিয়াজ আখতারি এবং গৌস মোহাম্মদের রাগ ছিল।
বিষয়টা শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। খুনিরা নিজেরাই ঘটনার ভিডিও তৈরি করে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করে। পরে জানা যায়, খুনিদের একজন ভারতীয় জনতা পার্টির সংখ্যালঘু সেলের সঙ্গে যুক্ত। বিজেপি নেতাদের সঙ্গে তার ছবি পাওয়া গেছে। সে ভারতীয় জনতা পার্টির কর্মী নাকি শাসক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছবি তোলা ছোটখাটো নেতা তা বলা খুব হঠকারিতা হবে। এই অপকর্মের অপরাধী যেই হোক না কেন, এটা স্পষ্ট যে, এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য শুধু একজনের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া ছিল না, বরং উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অপপ্রচার, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাস ছড়িয়ে সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা। এটা ছিল কানহাইয়ার মাধ্যমে ভারতকে আক্রমণের ষড়যন্ত্র।
এই ষড়যন্ত্র কি সফল হবে? এখনই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারা যাচ্ছে না, কিন্তু আমরা জানি কখন এই ধরনের ষড়যন্ত্র সফল হয়। মনুষ্যত্বের বিচারে না হয়ে, এই ধরনের ঘটনার প্রতিক্রিয়া সাম্প্রদায়িক পথে হলে, এই ষড়যন্ত্র সফল হয়। হিন্দু ও মুসলমান এই ঘটনাকে আলাদা আলাদা চোখে দেখে। এ ধরনের ষড়যন্ত্র আরও বেশি সফল হয় যখন রাষ্ট্র, সরকার ও পুলিশ একতরফা অবস্থান নেয়, আগুন নেভানোর বদলে তাতে ঘি ঢালে।
উদয়পুরের ঘটনায়, আমরা অন্তত সন্তুষ্ট থাকতে পারি এই দেখে যে, শুধু কিছু মাথা খারাপ লোক ছাড়া, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, প্রত্যেক নাগরিকই এই ঘটনার নিন্দা করেছে। দেশের সব মুসলিম নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবী ও প্রতিষ্ঠান নিসংশয়ে এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে। প্রাথমিকভাবে, কানহাইয়া লালকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর, অপরাধীদের গ্রেফতার করে এবং ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানো ব্যক্তিদের দৃঢ়তার সাথে রুখে দিয়ে, রাজস্থান সরকার শক্তিশালী এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে। পরের দিনই জাতীয় তদন্ত সংস্থা তদন্তের দায়িত্ব নেয় এবং আশা করা উচিত যে কানহাইয়া লালের খুনিরা অবিলম্বে কঠোরতম শাস্তি পাবে।
এ-ক্ষেত্রের এই কড়া পদক্ষেপ কি অন্য কোনো কানহাইয়ার অন্য কোনো সম্ভাব্য খুনিদের আটকাতে পারবে? ধর্মের নামে বিদ্বেষ ও হিংসা বন্ধ করায় কি সফলতা আসবে? আমরা কি এই ভয়ঙ্কর তাণ্ডব থেকে ভারতের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পারব?
এর উত্তর পাওয়ার জন্য, আমাদের পেছনের দিকে তাকাতে হবে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগের, ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল। স্থান একই রাজ্য রাজস্থানের আলওয়ার জেলার বেহরোর। দেশের প্রথম ভিডিও লিঞ্চিং হয়েছিল সেদিন, পেহলু খান নামে এক নাগরিকের। জয়পুরের পশু মেলা থেকে সরকারি রসিদ দিয়ে কেনা একটা দুধেল গরু নিয়ে নিজের বাড়িতে আনার সময়, পেহলু খানকে একদল লোক আটকায় এবং সমস্ত ব্যাখ্যা দেওয়ার পরেও, তাকে জনগণের সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয় এবং সেই ঘটনার ভিডিওগ্রাফি করা হয়।
এ হত্যাকাণ্ডও কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড ছিল না, এর পেছনেও ছিল ধর্মান্ধতা এবং একটা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়ানোর উদ্দেশ্য। কিন্তু গোটা দেশে সেদিন কোন প্রতিক্রিয়া হয় নি। রাজস্থানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিয়ে দেন। নিজেদেরকে হিন্দুদের প্রতিনিধি বলে দাবি করা কেউ কেউ খুনিদের ভগৎ সিং এবং চন্দ্রশেখর আজাদের সাথে তুলনা করেন। মামলার তদন্তে এতটাই শিথিলতা ছিল যে চারবার তদন্তকারী অফিসার বদল হয়ে যায়। আসামিরা অল্প দিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যায় এবং দু বছরের মধ্যেই ছয় আসামিকেও আদালত বেকসুর খালাস করে দেয়।
সেই রাজস্থানেই একই বছরের ডিসেম্বরে উদয়পুরের কাছে রাজসমন্দে আরেকটি ঘটনা ঘটে। শম্ভুলাল রেগার নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে লাইভ সম্প্রচার করে আফরাজুল শেখ নামে এক শ্রমিককে কুড়ুল দিয়ে হত্যা করে, এবং এই হত্যাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লাভ জিহাদের প্রতিশোধ হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘটনার পর শম্ভুলালকে সারা দেশে মহিমান্বিত করা হয়, তার পরিবারের জন্য চাঁদা তোলার অভিযান চালানো হয় এবং সেই উদয়পুর শহরেই তার পক্ষ সমর্থনে সভা সমিতি হয়। জেলে থাকাকালীন, শম্ভুলাল মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভিডিও তৈরি করলে তা ছড়িয়ে পড়ে। একটা দল তো তাকে লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী করার প্রস্তাবও দিয়েছিল।
গত পাঁচ বছরে দেশে এমন ডজন ডজন ঘটনা ঘটেছে। শিকার বিশেষত মুসলমান মানুষেরা, তবে দলিত ও আদিবাসীদের নৃশংস হত্যার খবরও রয়েছে। এখন এই খবর এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছে যে হিন্দি সংবাদপত্রে ‘মব লিঞ্চিং’ এখন একটা সাধারণ শব্দ। ভারত সরকার সংসদে ঘোষণা করেছে যে ২০১৭ সালের পর থেকে, জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর পরিসংখ্যানে মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনার গণনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাজস্থান ও ঝাড়খণ্ড সরকার এর বিরুদ্ধে আইন পাস করেছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেই আইনগুলো আটকে রেখেছে। গতকালই মধ্যপ্রদেশের গুণা জেলা থেকে সহারিয়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের রামপেয়ারী বাইকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার একটি ভিডিও সামনে এসেছে, খবর আসছে, কিন্তু গোটা দেশের তাতে কোন ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে না।
তিক্ত সত্য হল আমরা দুটো খুনের মধ্যে পার্থক্য করি, পোশাক দেখে লাশ চিনি। ইতিহাস দেখায় আইনের শাসন টুকরো টুকরো করে প্রতিষ্ঠিত হয় না। দেশে হয় সবাই নিরাপদ, নয়তো কেউ নিরাপদ নয়। যে কোনো রাস্তায় ভিড়ের সামনে দাঁড়ানো প্রতিটি নিরস্ত্র ব্যক্তি সংখ্যালঘু, সে যে জাত বা ধর্মেরই হোক। যতক্ষণ না আমরা জাত, ধর্ম, ভাষা বা পোশাক না দেখে তার নিরাপত্তার জন্য দাঁড়াতে পারছি, ততক্ষণ কানহাইয়া লালের খুনিরাই জিততে থাকবে।