কেল্লা নিজামতের ভেতরে হাজারদুয়ারির পরে নিজামত ইমামবাড়া প্রাসাদটিই সবার নজর কাড়ে। ইমামবাড়া হল শিয়া মুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের ভবন। কেল্লার ভেতরে আরও কয়েকটি ইমামবাড়া থাকলেও নিজামত ইমামবাড়াটিই ছিল প্রধান। এখানে সরকারি তত্ত্বাবধানেই সমস্ত অনুষ্ঠান পালিত হত নবাবী আমলে। আজও পুরোনো ঐতিহ্য মেনে বহু অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে মুর্শিদাবাদ এস্টেটের তত্ত্বাবধানে। এই সব বিভিন্ন অনুষ্ঠান গুলির মধ্যে মহরম ও নওরোজ খুব জাঁকজমক ভাবে পালিত হয়ে আসছে ইমামবাড়ায়। এছাড়াও বেরা উৎসবের পূর্বে বেরা ভাসানের যাবতীয় কাজও সম্পন্ন হয় ইমামবাড়ার ভেতরেই।
হাজারদুয়ারির সামনে অবস্থিত ইমামবাড়া পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হলেও বছরের সবসময় তা সবার জন্য ইমামবাড়ার দরজা উন্মুক্ত থাকে না। ইমামবাড়ার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে আরবি মহরম মাসের প্রথম দশদিন। এই দশদিনের মধ্যে গেলে তবেই ইমামবাড়ার ভেতরে প্রবেশের সুযোগ মিলবে। শুধু মহরম মাসের প্রথম দশদিন বাদেও এই কয়েকদিন ছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময় বহুবার ইমামবাড়ার ভেতরে প্রবেশের আমার সৌভাগ্য হয়েছে মুর্শিদাবাদ এস্টেটে চাকুরিরত সৈয়দ আতাহার আলি এবং নবাব পরিবারের প্রবীণ সদস্য সৈয়দ রেজা আলি মির্জার সৌজন্যে।
২০১৬ সালে একটি ভ্রমণ ম্যাগাজিনে ইমামবাড়া নিয়ে লেখার জন্যই ইমামবাড়ার ভেতরে প্রবেশের প্রয়োজন পড়েছিল। ইমামবাড়ার ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলে ইমামবাড়ার বিস্তারিত বর্ণনা লেখা অসম্ভব হয়ে পড়ত; ফলে আমি আমার ফেসবুকে আলাপ হওয়া ইমামবাড়ায় কর্মরত আতাহার ভাইকে আমার সমস্যার কথা জানাতেই তিনি আমাকে জানালেন, কোনো সমস্যা নেই - আপনি ইমামবাড়ায় এসে আমাকে ফোন করবেন, আমি আপনাকে পুরো ইমামবাড়া ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব। সেই মত আমিও একদিন সময় করে গিয়ে পৌঁছলাম ইমামবাড়ার মূল দরজার সামনে। ইমামবাড়ায় প্রবেশের আগে, এই বিশালাকৃতির ইমামবাড়া তৈরির ইতিহাস আপনাদের একটু জানিয়ে রাখি।
ইমামবাড়া শব্দটির অর্থ হল ইমামদের বসবাসের জন্য নির্মিত বাড়ি। বর্তমানে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সামনে, যেখানে মুর্শিদাবাদ নিজামত ইমামবাড়া অবস্থিত, সেখানেই পূর্বে নবাব সিরাজ- নির্মিত একটি কাঠের ইমামবাড়া ছিল। কিন্তু নবাব ফেরাদুন জাঁ-এর সময়ে হঠাৎ করেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়। ১৮৪২ সালের কোনো একদিন, নবাব পরিবারের একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে সন্ধ্যাবেলায় আয়োজিত আতসবাজির আগুনে নবাব সিরাজ নির্মিত ইমামবাড়ার একটি অংশ পুড়ে গিয়ে ভেঙে পড়ে। এই ঘটনার কয়েকবছর পর, ১৮৪৬ সালের ২৩শে ডিসেম্বর মধ্যরাতে ইউরোপিয়ানদের পার্টি চলছিল ইমামবাড়ার পাশে। অসাবধানতাবসত ঐ সময় সেখান থেকে আগুন এসে ইমামবাড়ার বাকি অংশে ধরে গেলে এবার সম্পূর্ণ ইমামবাড়াটি পুড়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সাথেই নষ্ট হয়ে যায় ইমামবাড়াতে থাকা সমস্ত দলিল দস্তাবেজ সহ বহু মূল্যবান কাগজপত্র। ইমামবাড়া ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে পরবর্তী সময়ে নানান ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বেশ সমস্যা দেখা দেয়, ফলে নবাব ফেরাদুন জাঁ এই সমস্যার সমাধান করতে ১৮৪৮ সালে হাজারদুয়ারির সামনেই একটি নতুন ইমামবাড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তিনি দেওয়ান নিজামত, সৈয়দ সাদিক আলি খানকে নতুন ইমামবাড়া তৈরির সমস্ত দায়িত্ব দিলে সৈয়দ সাদিক আলি খান মাত্র ছয়-সাত মাসের মধ্যে, প্রায় ছয় লক্ষ টাকা খরচ করে নির্মাণ করেন ৬৮০ ফুট দৈর্ঘ্যের বর্তমানের এই সূরম্য ইমামবাড়াটি। কথিত রয়েছে, নবাব ফেরাদুন জাঁ এই নির্মাণকার্যে এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, এই নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত ছোট, বড় প্রত্যেকটি মিস্ত্রিকে উপহার হিসেবে একটি করে মূল্যবান কাশ্মীরি শাল প্রদান করেছিলেন।
যাইহোক, আমি ইমামবাড়ার বাইরে দাঁড়িয়েই আতাহার ভাইকে ফোন করলাম। আমার ফোন পেয়ে তিনি নিজে ইমামবাড়ার বড় লোহার দরজা খুলে আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিলেন। আমি সেখানে প্রবেশ করেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়লাম। আতহার ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন ইমামবাড়ার দারোগার কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে উনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। খুব সম্ভবত দারোগার নাম ছিল সৈয়দ জামিল মির্জা। যাইহোক, আমিও দারোগা সাহেবকে আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানালাম। তিনিও অনুমতি দিলেন ইমামবাড়ার ভেতর ঘুরে দেখার। তখন আতাহার ভাই আমাকে সঙ্গে নিয়ে সমগ্র ইমামবাড়া ঘুরে দেখাতে শুরু করলেন।
প্রবেশপথের ঠিক সামনেই রয়েছে ইমামবাড়ার কেন্দ্রীয় কক্ষ। অনেকে এটিকে মদিনাও বলে। এর চারপাশে খোলা বাঁধানো চত্বর, এই চত্বরেই একদিকে রয়েছে কষ্টি পাথরে বাঁধানো একটি বিরাট, তবে তুলনামূলক ভাবে কম গভীরতার একটি জলাধার। খুব সম্ভবত এখানে ওযু করার জল থাকত, যাতে করে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে ইমামবাড়ায় আগত সবাই ওযু করে পবিত্র হতে পারে। কেন্দ্রীয় কক্ষে মদিনা থেকে আনা মাটি রয়েছে। এই কেন্দ্রীয় কক্ষকে বেষ্টন করে কক্ষের চারপাশে রয়েছে লম্বা পিলার যুক্ত মার্বেলে মোড়ানো বারান্দা। আমি এবার এই বারান্দায় উঠে হাঁটতে শুরু করতেই দেখলাম বারান্দার পাশেই রয়েছে বহু বড় বড় ঘর। সেই সব ঘরের বেশ কয়েকটিতে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালনের দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী। আজকাল কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় ইমামবাড়ার বিরাট বারান্দার একটি অংশে রান্নার কাজ হলেও নবাবী আমলে ইমামবাড়ার ভেতরে লঙ্গরখানার জন্য আলাদা কক্ষ নির্দিষ্ট ছিল। বারান্দা ঘুরে এবার বাকি অংশগুলি দেখার জন্য এগোতে থাকলাম আতহার ভাইয়ের সাথে। তিনি জানালেন এখানে কেন্দ্রীয় কক্ষের দুই পাশে সবুজ ঘাসে মোরা বড় খোলা চত্বর রয়েছে। কথা বলতে বলতেই আতাহার ভাই এবার এক গলিপথ দিয়ে নিয়ে যেতে থাকল আমি তাকে অনুসরণ করে এগোতে থাকলাম। সামান্য কিছুটা এগোতেই কেন্দ্রীয় কক্ষের দুই পাশের দু'টি খোলা চত্বরের একটিতে চোখে পড়ল। দেখলাম শুধু ঘাসে মোড়াই নয়, বরং নানারকম গাছ দিয়েও সাজানো রয়েছে। খুব সম্ভবত নবাবী আমলে এই খোলা চত্বরগুলিতে মহরমের কিছু মাতম পালিত হত। এবার খোলা চত্বরের সামনে চোখ পড়তেই দেখলাম, একটি মসজিদ রয়েছে। মসজিদটি আকারে খুব একটা বড় না। আতাহার ভাই আমাকে মসজিদে ওঠার সিঁড়ির নীচে এনে একটি পাথরের বেদি দেখিয়ে বললেন, নবাবী আমলে কোনো নবাবের কিংবা নিজামত পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মৃত্যু হলে তাঁর মৃতদেহ ইমামবাড়ায় এনে রাখা হত এবং এই পাথরের বেদীতে রেখেই মৃত লাশ ধোয়ান হত। মুর্শিদাবাদের নিজামত পরিবারে আজও এই রীতি চালু রয়েছে। ইমামবাড়ার ভেতরের চারদিকে দেখছি লম্বা পিলার যুক্ত বারান্দা এবং বারান্দার পাশেই সারি দিয়ে বড় বড় ঘর। আমার মনে প্রশ্ন জাগল ইমামবাড়া যেহেতু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের জায়গা, তবে এর ভেতরে এত ঘর কেন? পরে এই বিষয়ে আতাহার ভাই সহ নিজামত পরিবারের কিছু প্রবীণ মানুষদের কাছে জেনেছিলাম যে এই সব ঘরে মহরমের সময় ধর্মীয় মজলিশ হত। ছেলে মেয়েদের জন্য পৃথক ঘরের ব্যবস্থা ছিল। সেই সময় মুর্শিদাবাদ শহরে শিয়া মুসলিমের সংখ্যাও বেশি ছিল তা ছাড়া দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের বহু মানুষ মহরমের সময় মুর্শিদাবাদের নিজামত ইমামবাড়ায় মহরমে যোগ দিতে আসত এবং এখানেই সমগ্র মাস অতিবাহিত করত। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত জনগণের থাকার জন্যও তাই ইমামবাড়ার ভেতরে অতিথিশালাও ছিল। শুধু থাকা নয় এই সব মেহমানদের খাওয়ার দায়িত্বও নিতেন নবাব নাজিম। ইমামবাড়ার ভেতরেই লঙ্গরখানায় রান্না হত সব শাহী খানাপিনা। এসবের মধ্যে প্রধান ছিল পোলাও, এছাড়াও রুটি, পরোটা, কাবাব সহ মাংসের কোর্মা, রেজালা, কিমা সবই থাকত।
এবার আতাহার ভাই আমাকে ইমামবাড়ার দোতলায় যাওয়ার কথা বললেন এবং সেই সবুজ চত্বরের চারদিকের চারটি বারান্দার মধ্যে একটি বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে রয়েছে দোতলায় ওঠার এক খাঁড়া ও দীর্ঘ সিঁড়ি পথ। সেই পথেই আমড়া দোতলায় উঠলাম। সিঁড়িটি এতটাই লম্বা ছিল যে দোতলায় উঠতেই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। উপরে উঠে দেখলাম সেখানেও প্রচুর ঘর ও কাঁচ দিয়ে ঢাকা বারান্দা। ওপরে বহু হল ঘর রয়েছে কিন্তু সবগুলিতেই তালা লাগান রয়েছে। এবার আতাহার ভাই আমাকে নিয়ে ইমামবাড়ার ছাদে উঠলেন। ছাদে উঠে আমার মন পুলকিত হয়ে উঠল। এত বিশাল ছাদ আমি আগে কখনও দেখিনি। প্রথমেই চোখে পড়ল ইমামবাড়ার কেন্দ্রীয় কক্ষের বিরাট গম্বুজ। ছাদ থেকে ইমামবাড়ার কেন্দ্রীয় কক্ষের বিরাট গম্বুজের সৌন্দর্য মুগ্ধ করছিল। এবার আতাহার ভাই ছাদের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যেতে যেতে ইমামবাড়ার নানান গল্প শোনাচ্ছিলেন, তাঁর ছোট বেলার অভিজ্ঞতা, ইমামবাড়ায় দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা, ইমামবাড়ায় রাতের বেলায় ভূত দেখার অভিজ্ঞতা সহ আরও অনেক অনেক কথা। যাইহোক আমরা ছাদের বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে ঘুরতে চোখ পড়ল হাজারদুয়ারির উপর, পাশেই বয়ে চলেছে ভাগীরথী, এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য ক’জনেরই বা হয়ে থাকে ভেবে ভাল লাগছিল। নিজেকে খুব ভাগ্যবান বলেও মনে হচ্ছিল। আতাহার ভাই আঙ্গুল দিয়ে ছাদের এক প্রান্ত দেখিয়ে বললো এইদিকে রয়েছে নহবতখানা। আমি অবাক হলাম কারণ ধর্মীয় স্থানে বাজনা বাজান নিষেধ তবে ইমামবাড়ার মত এমন জায়গায় নহবতখানা কেন? তাই আমার কথার উত্তরে তিনি জানালেন বছরের শুধুমাত্র মহরমের সময়েই এই নহবতখানা চালু থাকত। এখানে বসে কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে যন্ত্রশিল্পীরা করুণ সুর বাজাতেন। সেই সুর ইমামবাড়া সহ আশেপাশের এলাকায় একটি শোকের আবহ তৈরি করত কিন্তু আজ সবই অতীত। ইমামবাড়ার পুরোনো সেই জৌলুস এখন আর নেই। কিন্তু তবুও ইমামবাড়ার সৌন্দর্যে আজও পর্যটকরা মুগ্ধ হন।