খাওয়াদাওয়ার সাথে নস্টালজিয়ার একটা গভীর ও ব্যাপক আত্মীয়তা আছে। তবে আমি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানসন্মত ও সেকুলার সমীক্ষা করে দেখেছি নস্টালজিয়ার যেমন একটা লোয়ার লিমিট (বছর কুড়ি) রাখা উচিত তেমনই আপার লিমিটও। না হলে পঞ্চাশোর্ধ্বে ক্রমশই ওটা টেনিদার মতন হয়ে যায়, আর ষাটের উপর পুরো ঘনাদা কেস। বিগত দিনের স্মৃতির মাছের সাইজ ক্রমশই বড়ো হতে থাকে, ফুলকপি তো সুগন্ধে রজনীগন্ধাকেও হার মানায়, টমেটোর লালত্ব আর গোলত্বের আর সীমা থাকে না—এইরকম কত কী। আবার আরও বেশি বয়সের হলে খাওয়াদাওয়ার কথা বলতে গেলে চোখদুটো জ্বলজ্বলিং কিন্তু অসাড়েই লালে-ঝোলে একশা। বলুন, গলায় বিব ঝুলিয়ে স্মৃতি রোমন্থনের কোনো মানে হয়?
মায়ের রান্না বলতে গেলেই চোখের জলে ভেসে যান কতজনায়। অথচ দেখুন সুদূর অতীতে পিছন ফিরে দেখি বেশ কিছু বাড়িতে নানাবিধ খাবার খেয়ে যথেষ্ট বিতিকিশ্রি লেগেছিল। ডেফিনিটলি কিছু বাড়ির রান্নার তেমন সুবাদ কিছু ছিল না। পাড়ার এক মাসিমাকে চিনতাম তিনি তার ছেলেকে সকালে চ্যবনপ্রাশ দিয়ে পাঁউরুটি, স্কুলের টিপিনে মুড়ি আর চ্যবনপ্রাশ আর রাত্রিবেলা ভাত আর চ্যবনপ্রাশ দিতেন। অতি বাধ্য স্বামী আর ছেলে চেটেপুটে খেয়ে তারিফও করত, “বাঃ, আজকের ভাতটা বেশ ঝরঝরে হয়েছে, খুব টেস্টি।”
এ ছাড়া সবার পরিবারেই ছিলেন অলৌকিক পিসিমারা। তাঁরা তো রাঁধুনে নন সাক্ষাৎ ম্যাজিশিয়ান। তাঁরা বাজারে যেতেন না। কিন্তু অম্লানবদনে দেরাজ, ভাঁড়ারঘর আর পিছনের বাগান হাটকে যে দু-একটা পাতা, ফল, ডাঁটাশাক—যা পেতেন তা দিয়েই, ওঃ সে কী রান্না। অমৃত মশাই অমৃত। এই গল্প কতবার শুনেছেন? আর কী সব উপকরণ ছিল পিসিদের হাতে। লইট্টা ফল, বরবটির বিচি, গাঁদাল পাতা আর বাসী মোয়া। সেসব দিয়েই হুলিয়ে রেঁধে দিতেন দারুণ সব পদ। এইসব কত যে রূপকথা। না বাবা, বেশি বলাও যাবে না। এখন তো পিসি-ভাইপোদেরই যুগ। শেষে কেস খেয়ে যাব।
বয়সের ধর্মই যে ধীরে ধীরে টেস্ট বাড আর ঘ্রাণশক্তি ক্রমশই মিইয়ে আসে। তাই অল্পবয়সের খাবারের স্বাদ অনেক বেশি জমজমাট থাকে। স্মৃতিও তাই খুব ঝলমলে হয়।
আর এখন হয়েছে, বয়স হলেই সবাই প্রায় কোনো না কোনো ডায়েট করে। চিনি না, নুন না, ঝাল নয়। মশলা বাদ, রেড মিট তো উরেঃ বাবা, দুধ খাব না, চিনেবাদামও না। কার্ব বাদ দিন, সোডিয়াম চাই না, Gluten (সেটা আবার কে রে বাবা?) থেকে দূরে থাকুন। মাখন, ঘি সব ঝুট হ্যায়। আর কতরকমের যে ডায়েট! হরিহরি। ভিগান, কেটো, মাইন্ড, টিএলসি। নাঃ, এর শেষ নেই। অস্পৃশ্য খাবারের এক দীর্ঘ মিছিল। সব কাটাকুটি করে হাতে থাকল কিছু পক্ষীভোগ্য শস্যদানা আর সজনেডাঁটা। ব্যাস। শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে কবে? যেমন ধরুন ডিম। বছর দশেক আগে ফতোয়া চলে এল ডিম এক বিষমাত্র। লোকে পাগলের মতন এক ডিমত্যাগী জীবন শুরু করে দিল। “মাসে দেড়খানা ডিম অ্যালাউ করেছে ডাক্তারে”, এক বিষণ্ণ বন্ধু আমায় জানান, “সে-ও কুসুম বাদ দিয়ে।” “তো দেড়খানা কুসুম কী করিস?” আমি উৎকণ্ঠিত হই। “বউ ওগুনো মুখে মাখে, শসা আর গাজর দিয়ে চটকে।”
তারপরে আবার শুনি ডিম এখন আবার জলচল হয়েছে। ওতে নাকি ইদানীং আর বিষক্রিয়া হয় না। দুন্দুভি আবার বেজে উঠেছে ডিমডিম রবে।
ভালো কথা, ডিমের কথায় মনে পড়ল। দেখুন তো একবার চেষ্টা করে, ‘ঔফঅউম্লেত্তে’ বলতে পারবেন কি না? নাঃ, আমিও কখনও সামনাসামনি শুনিনি। তবে ডিমের ওমলেটের ওটাই নাকি ফরাসি নাম। ফরাসিরা খুবই খুঁত্খুঁতে রাঁধুনি। অমলেট আদৌ ওদের কাছে হেলাফেলার খাবার নয়। একটা রেস্তোরাঁ তো শুধু অমলেট রেঁধেই ভুবনবিখ্যাত হয়ে গেল। না, না, আমি আর বাংলা হরফে লিখবার চেষ্টাও করব না, রোমান হরফে নাম, ‘La Mere poulard’—একেবারে UNESCO Heritage পদক পাওয়া—যারা বিশদে জানতে চান তাঁরা নিজে নিজেই উইকি দেখে জেনে নিন। তবে আপনাদের বিশ্বাস নেই, হয়তো গিয়ে অলরেডি খেয়েও এসেছেন। সারা দুনিয়ার রাজাগজা, প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রীমশাই ওই দোকানের অমলেট খেয়ে এসেছেন। সেই অমলেটের এমনই হম্বিতম্বি। পরিবেশনা (প্লেটিং মশাই, প্লেটিং) করবেন বিশাল চৌকো থালায়, তার এককোণে একটি করমচা ও একটুকরো ঝাউপাতা আর আর-এক কোণে টমেটোকে চাপ দিয়ে একটি হ্যাশট্যাগ বা জাস্ট তিনটে টিপ এঁকে দিলে তো কথাই নেই, ভারতীয় টাকায় তিনহাজার টাকা দাম স্বচ্ছন্দে হাঁকাবেন।
রেসিপিটাও খুব সিক্রেট, তাও নেট ঘেঁটে দেখলাম বেশ কঠিন ব্যাপার। আর সেটা শুধু মালমশলার গুণেই নয়, রাঁধবার কৌশলও বিস্তর।
তবে যদি পাতি সাহেবি অমলেট খেতে চান তো ডিম ফেটিয়ে প্যানে মাখন গলিয়ে মিনিট কয়েক মাঝারি আঁচে ঢাকা দিয়ে রাখুন। আর ডিমের মধ্যে দিয়ে দিন গ্রিলড মাশরুম, ক্রিস্প বেকন, হ্যামের টুকরো আর চিজ । আরে দাঁড়ান, কী ভাবছেন? ফ্রিজ থেকে ঝট করে পিজ্জা চিজ বার করে ঘেঁটে দেবেন? না মশাই। অমলেটের জন্য, শুধু অমলেটের জন্যই চিজ হচ্ছে Morbier, Gruyere বা Comte। আরও দু-একটা আছে। তবে দেশেই যদি থাকেন আর নিতান্ত নিরীহ ছাপোষা বন্ধু বা খুড়শ্বশুরকে ইম্প্রেস করতে চান তো স্রেফ মোজেরেল্লা দিয়ে দিন, আর লাস্ট যে পিৎজা বাড়িতে খেয়েছিলেন সেগুলোর সাথে যে মশলার প্যাকেট ছিল, সেগুলোও। দেখবেন সেই অমলেট বাটার মসল্লা খেয়ে তাদের চোখ দুটো দিস কাইন্ড অব বিগ হয়ে গেছে।
বা নিছক দিশি এবং ঘরোয়া অমলেট খান। সাদা তেলে ডিম, লঙ্কাকুচি, টমেটোকুচি আর নিতান্ত সখ চাগলে রসুনকুচি দিয়ে ডিমের অমলেট। গোলমরিচ অবশ্যি দিবেন।
বা মামলেট খান। ১০০% দিশি। নস্টালজিয়া যদি খুবই কামড়ায় তো মামলেটই প্রশস্ত পথ্য। জানি না এখনও পাওয়া যায় কি না। খুব ভিড়ভাট্টা ফুটপাথে রীতিমতন উনুন জ্বালিয়ে কড়াইতে ছ্যাঁকছোঁক মহাসংগীতের মধ্যে যথেচ্চ ভেজাল তেলে হাঁসের ডিম ফেটিয়ে, গুচ্ছের লঙ্কা আর প্যাঁজ আর একটা সিক্রেট মশলা থাকে—খেলেই কারেন্ট লাগবে—সেটা দিয়ে ফাটা চিনেমাটির প্লেটে সাজিয়ে দেবে। তার সাথে অ্যানোডাইজড টিনের চামচ, সে এমনই ললিত লবঙ্গলতা যে মামলেট কাটতে গেলেই বেঁকে যায়। তবে কাটতে পারলেই দেখবেন ভিতরটা লঙ্কায় সবুজ হয়ে আছে। ওঃ! সে কী স্বাদ। রাস্তার পেটরোগা লোকেরা লোলুপ তাকাবে, স্বাস্থ্যবাতিকের লোকেরা সভয়ে দূরে সরে যাবে, দু-একটা কুকুর খুব আহ্লাদি ভাবে কাছে ঘেঁষতে চাইবে, কিন্তু আপনি শেষ অ্যাটমটুকুও চেটেপুটে খেয়ে ফেলবেন। হায়, আজকে কোথা সেই মায়াঘেরা ফুটপাথ? সেই ডিজেলগন্ধী রান্নার তেল, সেই ধূলিবাতাস ও কোটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের ভ্রূপল্লবে ডাক দেওয়া ডিমেল হাওয়া?
বা ধরুন আলু সেদ্দো? না, আপনাদের বিশ্বাস নেই। হয়তো বলবেন বেলজিয়ামের এক এক্সক্লুসিভ আলুসেদ্দোর দোকানের সংবাদ। বা ভেনিসে। অথবা বালতির মোড়ে।
তাও ও, জেনে রাখুন সাহেবদের আলুসেদ্দোও হয় খুব যত্ন নিয়ে। খুব পছন্দের আলু ‘Yokon Gold’। প্রাক্-করোনা যুগে, আমাদের দেশেও পাওয়া যেত দু-একটা কেৎ-এর দোকানে। তার সাথে পারমেসিয়ান চিজ দিন, সাওয়ার ক্রিম, নানান হার্ব, এমনকি ব্লেন্ডারে ঢুকিয়ে একেবারে ফর্দাফাঁই করে একটা সাদাটে চাদরের মতন করে দিতে পারেন। যাকে বলে রেস্টুরেন্ট স্টাইল ম্যাশ্ড পটাটো। মাটির মানুষদের এই জিনিস খাওয়ালেই ধন্য ধন্য পড়ে যাবে।
আসলে আলুসেদ্দো কোনোদিনই জাতে ওঠেনি। খেতে যতই ভালোবাসুন না কেন। জামাইষষ্ঠীতে কোনোদিন শুনেছেন মহামান্য অতিথিকে আলুভাতে দেওয়া হচ্ছে? বা শেষপাতে দুধভাত? সুঠাম অপিচ কুসুমকোমল চন্দ্রমুখী আলু সর্ষের তেল দিয়ে চটকে মেখে কাঁচালঙ্কা কুচিয়ে মায়াবী হাতে টেনিস বলের মতন গোল্লা পাকিয়ে দিলে, আপনারাই বলুন, কোন্ পাষণ্ড আছে যার চোখে জল আসবে না?
সারা দুনিয়া দেখা পরিযায়ী এক প্রাজ্ঞকে ওই জিনিসই সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়ে স্রেফ গুল মেরেদিলাম, ইটি একটি স্প্যানিশ রান্না, পটাটাস মাতাদোর। উনি খেয়ে খুশি হয়ে বললেন “মাস্টার্ড সস তো? বেশ হয়েছে। টেক্সচারও ফাইন। তবে ইটি বোধহয় সাউথ স্পেনের রেসিপি। একটা আন্দুলিসিয়ান টেনডেন্সি আছে।” আমিও হেঁ-হেঁ-হেঁ করে দিলাম।
সে যাগ্গে। আপনেদের খিদে পায়নি এখনও? এবারে না হয় খান চিকেনের বনলতা।
এটার একটা প্রেক্ষিত আছে। অতীতে রোবুবাবু আগে এই পাড়ায় গতায়াত করতেন, ইটি ওনারই পারিবারিক রেসিপি। তবে আদতে এটি ছিল মাটনের। আলু ফালু দিয়ে। কিন্তু আমি এই সরল গোলগাল রেসিপি ট্রাই করে দেখলাম এটির ব্যক্তিত্ব মুরগির সাথেই খোলে ভালো।
মেরিনেড করুন প্যাঁজ আর কাঁচালঙ্কা বেটে, দই, লাল লঙ্কাগুঁড়ো, গোলমরিচ আর নুন।
তারপরে তেজপাতা ফোড়োন দিয়ে দিন রসুনকুচি আর গুচ্ছের ছোটো এলাচ।
এইবারে মুরগিটা দিয়ে ভাজুন জমিয়ে। এবার সেদ্দো করুন। ব্যাস। হয়ে গেল। বলেছিলাম না, এটি একটি সরল গোলগাল রেসিপি।
আমি মাঝেমধ্যে নামানোর সময় একটু ফ্রেশ (মানে ফ্রিজের কোনায় খুঁজে পেলে) ক্রিমও দিয়ে দেই। তাতে একটু সখী সখী ভাব হয়ে ঠিকই, তবে রংটাও ফরসা হয়, অনেকেরই সেটাই ভালোলাগে। যেন পথভ্রান্ত এক স্যুপ। এলাচের সফেন সাগরে এক দিশাহারা মুরগির কাহিনি।
দুর্দান্তস্কি!
ইয়ে ...পোস্ট রান্নার কোনো ছবি হতে পারে কি?
চমৎকার তো !!!
ডিডি মাঝে মাঝে বৈকুণ্ঠ থেকে নেমে লর্ড বিষ্ণুর ক্ল্যাসিফায়েড রেসিপি থেকে কিছু ঝেড়ে দিয়ে আবার ফিরে যান।সবই দৈবী মায়া .... !! :-))
ডিডিদার এই কলম দিন-কে-দিন বেহেতর থেকে বেটার হচ্ছে। এই লেখায় কত যে ডিডিদ্ধৃতি তৈরি হল।
'দুন্দুভি আবার বেজে উঠেছে ডিমডিম রবে।"
ডিডিদার লেখা একেবারে মামলেটের মতো জিভে জল আনা। আর ফ্রেঞ্চ অমলেটের কথা পড়ে ডেক্সটারের অমলেট দ্য ফ্রমাজ মনে পড়ে গেল :d
মনোনীতার অলঙ্করণ চমৎকার লাগলো!
:-), দারুণ।
আলুর কথায় কথায়, ইউকন গোলডের কথা লিখলেন বলে, সাহেবের আলু নিয়ে খুঁতখুঁতে ভাব চর্চার বিষয়। আমি নিউজিল্যাণ্ডের সবজির দোকানে অন্তত গোটা দশেক বিভিন্ন "জাতের" আলু দেখেছি, একেক জাতের আলু নাকি একেক রকম রান্নায় দিতে হয়। যে আলু রোস্টের, আর যে আলু স্যালাডের, তারা ভিন্ন গোত্রের। এখানকার মেলায় (Agriculture & Produce) দেখেছি একেবারে নিটোল গোল আকৃতি না হলে এবং সোনার রঙ না ধরলে সে নাকি আলু ফলনের প্রতিযোগিতার বাজারে আলু পদবাচ্যই নয় ।
"সুঠাম অপিচ কুসুমকোমল চন্দ্রমুখী আলু সর্ষের তেল দিয়ে চটকে মেখে কাঁচালঙ্কা কুচিয়ে মায়াবী হাতে টেনিস বলের মতন গোল্লা পাকিয়ে দিলে, আপনারাই বলুন, কোন্ পাষণ্ড আছে যার চোখে জল আসবে না?"
এটা কীরম হল ডিডিদাভাই? নো পেঁয়াজকুচো? ওটা মাস্ট। জামাই খাবে কী, ঝাঁজেই মরে যাবে।
ওঃ, কী জিনিস! ডিডি , ডিডি, ডিডি। ঝিঙ্গালালার সেই ভাসন্ত ছায়ার উপরে দাঁড়িয়ে রান্না মনে পড়ে যায়। :-)
ভিমড়িও যে একটি সুখাইদ্য ডিডির রেসিপি পইড়া মনে হৈল। কাম সারছে :))
বেশি ছোট এলাচ দিলে কেমন একটা পায়েসগন্ধ হবে না?
আরে বেশী এলাচ দিলে চিকেন তো বটেই গলদা চিংড়িও পায়েসের মাতান লাগবে। সেই জন্যেই তো স্পেসিফিকালি বলে দিয়েছি এলাচ বেশী দিবেন না জাস্ট গুচ্ছের দিন।
ওহো ! কি লেখা ! কী লেখা !
পায়ের ধুলো দিন মাইরি !
একেবারে ডি লা গ্রান্ডি !!!!