ফ্রাঙ্কফুর্ট ১৯৪৫
এ বছর কলকাতায় বই মেলার মাঠে বসে যুদ্ধ আরম্ভ হবার খবর পেয়েছিলাম। তারপরেই রোদিকার ফোন- আমরা কি আমাদের বাড়িটা ইউক্রেনের ত্রাণ এবং বণ্টন কেন্দ্র করে তুলতে পারি ? কলকাতা যখন বাড়ি ফিরলাম দেখি তিলধারণের স্থান হয়তো আছে , আমার ও মায়ার নেই ! আমাদের কুকুরটা নিতান্ত বিভ্রান্ত হয়ে এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করে। স্থানীয় জনগণ মুক্তহস্তে ত্রাণ দিয়ে গেছেন আমাদের বাড়িতে।
ছ মাস কাটল । সারে জিলায় আসার জন্য দু হাজার শরণার্থী ভিসা পাবেন বলে ঘোষিত হয়েছে। আমাদের এলাকায় সাতশ। ইন্টারনেট এবং স্থানীয় ইউক্রেনিয়ান হাবের মারফত খবর পেয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছেন অনেকে। এক বস্ত্রে এ দেশে এসে তাঁদের প্রয়োজন ছিল সবেরই। ইউক্রেনে তাঁদের সংসার ছিল, যা হোক কোন কাজ ছিল, ছেলে মেয়েরা স্কুলে গেছে, বাড়ির বেড়া ধরে বয়স্কা মহিলারা সুখ দুঃখের গল্প করেছেন। সর্বহারা হয়ে এখানে ওখানে , আমাদের বাড়িতে জামা জুতো মোজা কোট বই সাইকেল পেরাম্বুলেটর কম্বল বালিশ প্লেট ছুরি কাঁটা খেলনা বিছানা টিনের খাবার আবশ্যিক ওষুধ খুঁজেছেন। কিছু পেয়েছেন । এই পরদেশে তাঁদের স্টারটার কিট । মায়ার শোবার ঘর ছিল সার্বজনীন ট্রায়াল রুম।
নব আগমনের ধারা ক্ষীণ । তেরনোপিল হতে আজ এলেন অকসানা , ভিসা পেয়েছেন অতি বিলম্বে। বড়ো ছেলে চব্বিশ বছরের। লড়াই করছে ইউক্রেনে তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে। ছোট ছেলেটি আঠারো বছরের। সে দেশ ছাড়ার অনুমতি পেয়ে মায়ের সঙ্গে এসেছে। তেমনি এলেন আনাসতাসিয়া, ইরা ।
গ্যাস ও তেলের ব্যবসা স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক ইরিনার পতি সাইমন ক্রিগার । সাইমনের দাদু ব্রিটিশ আর্মিতে ছিলেন । তাঁর বাবার জন্ম মুসুরিতে । সাইমনের ছোট বেলায় তাকে ঘুরিয়ে এনেছেন। ছোট সাইমনের মনে আছে রাতের বেলায় মুসুরি থেকে অনেক নিচে দেখা দেহরাদুনের আলো- একটা থালার মতন । অর্থনীতি, ফরাসি ও জার্মান শিক্ষা লাভের শেষে সাইমন বার্লিনে তেল ও গ্যাসের বিষয়ে রিসার্চ করতো কোন ব্যাঙ্কে। তার কাজে খুশি হয়ে ব্যাঙ্কের এক কর্তা বললেন এ বিষয়টার ভূত ভবিষ্যৎ যখন এত ভালো বোঝো যখন তেল ও গ্যাসের ট্রেডিং করো না কেন ? আজ সে তাই করছে। লন্ডনে। মাঝে মাঝে দেখা হয় এক পাত্র হাতে নিয়ে পাঁচটা গল্প হয় । সেদিন দেখা ।
গরমের ছুটি কেমন কাটল ?
আগুনে পুড়ে , বৃষ্টিতে ভিজে, বন্যায় ভেসে ।
???
দক্ষিণ ফ্রান্সে বোরদোর কাছে সেসটার সুন্দর অরণ্যে কটেজ ভাড়া করেছিল তারা দু সপ্তাহের জন্য। আগস্টের শেষে স্পেন ফ্রান্স গ্রিসে যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল তাতে সেই কটেজ ভস্মীভূত হয় । কোনমতে আপন মালপত্রের অর্ধেক নিয়ে ক্যালে পৌঁছেছে তারা। উওকিঙ্গের বাড়িতে এসে দেখে পাইপ ফেটে রান্নাঘর জলে ভেসে যাচ্ছে। সেটার ব্যবস্থা ও ইন্সিউরেন্সের কাছে দাবি দাওয়া পেশ করার পরে তারা স্থির করলে হাতে ছুটি আছে - কর্ণওয়াল যাওয়া যাক। সারা ইংল্যান্ড যখন রৌদ্র তপ্ত, কর্নওয়ালে বৃষ্টি চলল একটানা সাতদিন।
ইংরেজিতে যাকে রাই হিউমর বলে তার বাংলা সঠিক কি জানি না। তির্যক কৌতুক ? সাইমন ব্যাখ্যান করলো এমন ভাবে যেন এসব কোন ব্যাপার নয় !
আর কিছু ?
সাইমন বললে আমাদের ট্রেডিং ডেস্কে আজকাল খুন খারাবির গল্প বেশ চালু হয়েছে। কান টানলে মাথা আসে, গ্যাস টানলে রাশিয়া । তুমি তো এককালে গাজপ্রমের সঙ্গে কারবার করেছো । জানো তাদের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কতজন গণ্য মান্য রাশিয়ান এ বছরে মারা গেছেন ?
তেল ও গ্যাস বেচে ধন কুবের মিখাইল ওয়াটফোরড (আসল নাম মিখাইল তলস্তশে -পুতিনের সমালোচক ) আমাদের নিকটবর্তী গ্রাম ভার্জিনিয়া ওয়াটার্সে তাঁর মহার্ঘ্য বাসভবনের গ্যারাজে গলায় দড়ি দিয়েছেন ফেব্রুয়ারি মাসে । সেটা জানতাম । দূরে কোথায়ের এক কিস্তিতে সেটি লিখেছি। যেটা জানতাম না তা হল গ্যাস ও তেল সংশ্লিষ্ট একাধিক রাশিয়ান ধনী অথবা উচ্চপদস্থ মানুষের আকস্মিক মৃত্যু।
সংবেদনশীল পাঠকের কাছে আগাম মার্জনা চেয়ে নিয়ে সাইমন কথিত দুঃসমাচারের ফিরিস্তি দিই:
রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহৎ তেল কোম্পানি লুক অয়েলের চেয়ারম্যান রাভিল মাগানোভ হৃদযন্ত্র সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসার জন্য মস্কোর সেন্ট্রাল ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলেন আগস্টের শেষে। গরবাচভের চিকিৎসা হয়েছে এখানে। হাসপাতালের ঘরের পাশে একটি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন -সেখান থেকে হঠাৎ পা পিছলে পতন এবং মৃত্যু। সাক্ষী নেই তবে ব্যালকনিতে একটি সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া যায়। বয়েস ৬৭। জন্মে তাতার ( বাবার নাম ছিল উলফত হিন্দি সিনেমার দরুন শব্দটা আমাদের বেশ চেনা ) , মস্কো স্টেট ইউনিভারসিটি থেকে তেল এবং গ্যাসের ডিগ্রি প্রাপ্ত রাভিল মাগানোভ ইউক্রেনে মহামতি পুতিনের বিশেষ সামরিক কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্য সমালোচনা করে বলেন এটি একটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা, ট্র্যাজেডি। যুদ্ধে মৃত মানুষের জন্য তিনি শোক জ্ঞাপন করেন । লুক অয়েল তাদের বিবৃতিতে জানায় কিছুকাল রোগভোগের পর রাভিল মাগানোভ মারা গেছেন। হাসপাতালের খাটে শুয়ে না ধূমপান করতে গিয়ে , সেটা তারা জানায় নি।
রাভিল মাগানোভ
জুলাই মাসে সেন্ট পিটারসবুরগের একটি সুইমিং পুলের জলের তলায় ইউরি ভরোনোভের (৬১) মৃতদেহ পাওয়া যায় । পুলের পাশে একটি পিস্তল মেলে । তাঁর স্ত্রী জানান ব্যবসার কিছু অংশীদারের সঙ্গে ফোনে তর্কাতর্কি হবার পরে ইউরি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান । যেখানে মারা গেছেন সেটি কার বাড়ি কার সুইমিং পুল জানা যায় নি । ইউরি ভরোনোভ একটি লজিস্টিক সংস্থার ডিরেক্টর ছিলেন- যার প্রধান ব্যবসা ছিল গাজপ্রমের সঙ্গে।
ইউক্রেন অভিযানের দু দিন বাদে ফেব্রুয়ারি মাসে গাজপ্রমের উচ্চপদস্থ অফিসার আলেকসান্দার তুইলাকোভেকে সেন্ট পিটারসবুরগে তাঁর আপন গৃহে সিলিং থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করেন তুইলাকোভের বান্ধবী। ময়না তদন্তে তাঁর শরীরে বহু আঘাতের দাগ দেখা গেছে। তাঁর বয়েস হয়েছিলো ৬১ ।
জানুয়ারি মাসে গাজপ্রম ইনভেসটের লজিস্টিক অফিসার লেওনিদ শূলমানের (৬০) রক্তাক্ত মৃতদেহ তাঁর বাথরুমে পাওয়া যায় । বেশ খানিকটা দূরে একটা রান্নার ছুরি। পাশে একটি মৃত্যু কালীন জবান বন্দি - কিন্তু সেখানে ঠিক কি লেখা ছিল তা জানানো হয় নি ।
গাজপ্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট , ক্রেমলিনের প্রাক্তন অফিসার ভ্লাদিস্লাভ আলায়েভকে ( ৫১) তাঁর পেন্টহাউসে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। পাশে স্ত্রী এবং কন্যার মৃতদেহ - দু জনেই পিস্তলের গুলিতে মৃত । ।
এর কয়েকদিন আগে নোভোটেক কোম্পানির ডেপুটি চেয়ারম্যান সেরগেই প্রোতোসেনিয়াকে (৫৫) তাঁর স্পেনের বাড়িতে মৃত অবস্থায় ঝুলতে দেখা গেলো। পাশে তাঁর স্ত্রী (৫৩) এবং কন্যা,(১৮) গুলিতে নিহত। ছেলে বাড়িতে ছিল না।
লেওনিদ শূলমান বাদে কারো মৃতদেহের আশেপাশে ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নহে’ বা ‘ মহামতি পুতিনের দুর্মতির কারণে আমার মৃত্যু ঘটিল’ এমন কোন চিঠি রাশিয়ান বা অন্য কোন ভাষায় পাওয়া যায় নি।
গল্প শেষ করে সাইমন বললে এবার কি ট্রেডারদের পালা ? সবই কো ইনসিডেনস ? সব ঘটল ইউক্রেনের লড়াইয়ের আশে পাশে । কানেকশনটা দেখো – সবাই তেল গ্যাস গাজপ্রমের সঙ্গে জড়িত। মাগানোভ পুতিনের নিন্দে করেছে যেমন মিখাইল ওয়াটফোরড । সেটা ক্রেমলিনের পছন্দ হয় নি । কিন্তু বাকিরা ? তাই বলছি সাবধানে থাকো। এককালে গাজপ্রমের সঙ্গে ওঠাবসা করেছো! রাশিয়ানদের হাত খুব লম্বা- ট্রটস্কিকে খুঁজে বের করেছিল মেক্সিকোতে ! তাদের স্মৃতি প্রখর!
কথাটা সাইমন নিতান্ত ঠাট্টা করে বলেছে জানি । সে কবেকার গল্প। ডিলের জন্য সিটিব্যাঙ্ক পেয়েছিল জুতসই ফি , আমাদের জুটেছিল কিছু সাম্মানিক। গাজপ্রমের সঙ্গে আমাদের প্রেম প্রীতি প্রণয় ধুলায় হয়েছে ধূলি, পঁচিশ বছর আগে!
তবু সাইমনের গল্পটা রোদিকাকে বলার সাহস হলো না।
৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ ছবির কৃতজ্ঞতা স্বীকার মানুষের মৃত্যু হলে - প্রথম ছটি - ইরপিন অদ্য