এল সালভাদরের শিশুরা
ততদিন এঁরা খানিকটা খাঁচার বন্দির মত বাস করবেন , কাজ করে আয় করার অনুমতি নেই ‘। সালভাদরিয়ানদের বাইরে বেরুনোর ব্যাপারে কড়াকড়ি -তাই ফোনে তাদের যা কিছু প্রয়োজন জেনে সাধ্যমত পৌঁছে দিয়ে আসি।
উওকিং কাউনসিল আরেক শরণার্থীর সংবাদ দিলেন। আফঘান যুবক শামস- দশ বছর আগে প্রাণের তাগিদে কান্দাহার থেকে ইউক্রেনের খারকিভে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ইলেকট্রনিকের ব্যবসা গড়ে তোলেন, বিয়ে করেন। এবার আবার যুদ্ধ আবার ধ্বংস । আজ তিনি আবার গৃহহারা , এখন সঙ্গে স্ত্রী পুত্র কন্যা। অভাগা যেদিকে চায়!
ষ্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ফ্রাঙ্কফুর্টে আমার এক সহকর্মী ছিলেন দিতরিখ লেমান । তাঁর আদি বাড়ি গ্লাতস , শ্লেজিয়েন ( সাইলেসিয়া ), জার্মানি -সেটা আমার দেখা। পূর্ব ইউরোপের ডায়েরিতে তার উল্লেখ করেছি ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে গোটা সাইলেসিয়া পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হলে পর সকল জার্মানকে নোটিস জারি করা হল – অবিলম্বে দেশত্যাগ করুন । যাবার সময়ে অবশ্য বাড়ি, গাড়ির চাবি স্থানীয় পৌরসভা অফিসে জমা দিয়ে যাবেন । গায়ের গয়না আর গোয়ালের গোরু সঙ্গে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন না।
দিতরিখের পিতা মাতা দুটি বিশ্বযুদ্ধের ভুক্তভোগী । তাঁরা স্থির করলেন এই পোড়া দেশে আর নয় , পশ্চিম জার্মানির প্রলোভন ভুলে অনেক দূর দেশের জাহাজ ধরলেন – গেলেন পূর্ব আফ্রিকায় , মোজাম্বিক! সে দেশ তখন পর্তুগিজ উপনিবেশ, আফ্রিকানদের অবস্থা যাই হোক না কেন পর্তুগিজ সহ অন্য ইউরোপীয় সুখে স্বচ্ছন্দে বসবাস করেন । গোয়া থেকে আগত ভারতীয়রা দোকানে বসেন । সাগর কিনারের শহর লরেনসো মারকেস (আজকের রাজধানী মাপুতো, পেরি পেরির জন্মভূমি – আমার আফ্রিকা বইতে এর গল্প পাবেন ) গিটারের সুরে আর মাছের রান্নার গন্ধে গমগম করছে ! বিশ বছরের মধ্যেই সেখানে শুরু হলো রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম , চলল দশ বছর । সালাজার মারা গেলে মোজাম্বিক মুক্ত হলো।
দিতরিখ লেমান ( সাদা শার্ট ) এস বি আই অফিস পারটি ১৯৮১
লেমানের বাবা ততদিন মারা গেছেন । তাঁর মা বললেন দিতরিখ , লড়াই এড়াতে এতো দূর দেশে এসেছিলাম কিন্তু কি ভাগ্য দেখো আবার সেই খুনোখুনি ! মোজাম্বিক ছেড়ে লেমানরা গেলেন পাশের দেশ – দক্ষিণ আফ্রিকায় । কয়েক বছর ভালো কাটল কিন্তু বাদ সাধলেন নেলসন ! কালো মানুষরা স্বাধীনতার দাবি জানালেন- অশান্তি, স্যাঙ্কশন , নিরাপত্তার অভাব । দিতরিখ পর্তুগিজ শিখেছিলেন মোজাম্বিকে এখন ইংরেজি শিখতে হলো জোহানেসবুরগে ! একদিন দিতরিখ মাকে বললেন অনেক হলো, চলো যাই আপন দেশে ! ১৯৮০ নাগাদ লেমান পরিবার এলেন ফ্রাঙ্কফুর্ট , জার্মানি - যেখানে আসার কথা ছিল ৩৫ বছর আগে।
কে বলেছিল লাইটনিং স্ট্রাইকস টোয়াইস ?
সারের স্কুলে যখন বিভিন্ন বয়েসের ইউক্রেনিয়ান ছেলে মেয়েরা ভর্তি হয়েছে- মায়েদের আশঙ্কা ছিল কতদিন লাগবে এই বিদেশি ভাষায় সড়গড় হতে। আমরা অনেককে বলেছি , আপনাদের সময় লাগবে কিন্তু এদের নয় ! ছ মাস বড়জোর !
আমাদের মেয়ে মায়া আড়াই বছর বয়েস অবধি বাড়িতে শুধু রোমানিয়ান বলেছে। কিনডার গারটেনে তিন মাস কেটেছে কি কাটেনি, দিব্যি সায়েবি উচ্চারণে যে ইংরেজি বাক্যি বলা শুরু করলো , চল্লিশ বছরে সে অ্যাকসেন্ট আমার আয়ত্ত হয় নি ! বারো বছরের ছেলে ব্রানিস্লাভ ডিনামো কিভ আর শাখতার দনেতস্ক নিয়ে ইংরেজিতে পাঁচ মিনিট আলোচনা করতে পারে, এমনকি এডুর গল্পটাও জানে !
ডানদিকে ফুটবলের ভক্ত বনিস্লাভ
এডু নামে আর্সেনালের এক প্রাক্তন খেলোয়াড় শাখতারের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেলায় এমিরেটস মাঠে পুরনো দলের বিরুদ্ধে গোল করলে সমর্থকরা তাকেই সম্বর্ধনা জানায় – আহা, আমাদেরই মাঠে তৈরি খেলোয়াড় তো !
ইউক্রেনের স্কুলে গরমের ছুটি পুরো তিন মাসের। কিছু মায়েরা চিন্তিত ছিলেন – ছেলে মেয়েরা এতদিন বাড়িতে থাকলে তাদের সামলাবেন কিভাবে ! জেনে আশ্বস্ত হয়েছেন ইংল্যান্ডে স্কুলের ছুটি এই দেশের গ্রীষ্মের মতন সীমায়িত , মাত্র ছ সপ্তাহের।
ষোল বছর অবধি বয়েসি ছেলে মেয়েদের নিয়ে এ দেশে এসেছেন ইউক্রেনিয়ান মায়েরা, কোন কোন পরিবারে দাদু দিদিমা সহ। আঠারো থেকে ষাট বছরের পুরুষেরা থেকে গেছেন দেশ রক্ষার দায়িত্বে। বিগত মাস চারেক ছেলে মেয়েরা এবং স্ত্রীরা পিতা ও স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছেন মোবাইল ফোন , হোয়াটসঅ্যাপ এবং স্কাইপের মাধ্যমে। ইউক্রেন যুদ্ধে ( রাশিয়ান মতে বিশেষ সামরিক অভিযানে) ওয়াই ফাই নামক নিখরচায় যোগসাধনের সেতুটি ভেঙ্গে পড়ে নি- আমরা অনেকের সঙ্গে তাঁদের ইউক্রেনিয়ান টেলিফোন নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলি।
রাতারাতি সপরিবারে দেশ ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ , দুনিয়াতে তার উদাহরণ অজস্র । আমি এই বাংলার ঘটি। পদুমা গ্রামের ভিটে আমার পূর্ব পুরুষের মতো আমিও আবাল্য এসেছি , অন্য লোকে চলে যাবো একদিন , সে ভিটে থেকে যাবে। দেশ ভাঙ্গা বা দেশ ছাড়ার বিষয়ে মন্তব্য করার কোন হক আমার নেই । তবু মনে হয় দেশ ছাড়তে যারা বাধ্য হন তাঁরা হয়তো আর পিছন ফিরে দেখেন না। যা গেছে তা যাক । প্রবাসীরা সবসময় মুড় মুড়কে দেখেন – তাঁরা স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করেছেন ।
ইউক্রেনের শরণার্থীরা অন্য রকম - এঁরা সপরিবারে বা স্বেচ্ছায় দেশান্তরে আসেন নি । আধখানা সংসার রয়ে গেছে ইউক্রেনে । পুরুষেরা আপন দেশে। কারো বাড়ি ঘর আছে, অনেকের নেই - দেওয়াল আছে , জানালা উড়ে গেছে বোমায়। প্রসঙ্গ কঠিন কিন্তু অনেকেই বলেছেন আমরা এ দেশে থাকতে আসি নি। অবস্থা ভালো হলেই ফিরে যাব। আজ পাশের গ্রামের ইরিনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিলাম। তিনি বললেন ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহেও ভাবি নি যুদ্ধ হবে। যুদ্ধ শুরু হলে ভেবেছি এ আর কতদিন চলবে। পাঁচ মাস কেটে গেলো – সব সময় ভাবি একদিন ফিরে যাবো।
বুচা শহরের ভিক্টোরিয়া বললেন ছেলে মেয়েকে নিয়ে দু দিনের জন্যে হলেও ট্রেনে করে পোল্যান্ড যাবেন । ইংরেজ আশ্রয়দাতা বহন করবেন টিকিটের ব্যয় । তাঁর স্বামী ইয়ারোস্লাভ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছুটি নিয়ে পশ্চিম সীমান্তের লভিভে এসে স্ত্রী পুত্র কন্যার সঙ্গে দেখা করে যাবেন । সেই সংক্ষিপ্ত মিলন ও বিরহের দৃশ্যটি মনে করতে চাই না । শুধুমাত্র চোখের দেখা দেখে পিতা ,স্বামী ফিরে যাবেন রণাঙ্গনে।
ইয়ারোস্লাভ বিদ্যালয়ে ভূগোল পড়াতেন । কখনো বন্দুক হাতে ধরেন নি ।
অতি অল্প বয়েসে দেখা চন্দ্রধর শর্মা গুলেরির হিন্দি গল্পের ওপর আধারিত মণি ভট্টাচার্যের উসনে কহা থা ছবিটির কথা মাথার মধ্যে ঘুরে চলেছে সারাদিন । মনে পড়ে রেলওয়ে স্টেশনের সেই দৃশ্য- স্ত্রী পুত্র কন্যাকে প্লাটফরমে একবার দেখেই ফ্রন্টের ট্রেনে উঠছেন সৈন্যেরা। পটভূমিকায় বাজে মান্না দের কণ্ঠে সেই অমর গান – জানেওয়ালে সিপাহি সে পুছো , ওহ কহাঁ যা রহা হ্যায় ।
২৮শে জুলাই ২০২২