ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি (রহস্য গল্প)
প্রথম অধ্যায়
(১)
নগ্নপদ রহস্য
মার্চ মাসের দ্বিতীয় শনিবারের বিকেল। তোফা এক দিবানিদ্রার পর বিছানায় উঠে বসেছেন মিঃ কোসলে। হ্যাঁ, উনিই বিলাসপুরের ‘ওয়াচ অ্যান্ড সিকিউরিটিজ’ সংস্থার ডায়রেক্টর দলগঞ্জন সিং কোসলে, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার, একসময় বিলাসপুরের ডিএসপি ছিলেন।
হাই তুলতে গিয়ে প্রথমে নজর গেল দেয়াল ঘড়িতে, সাড়ে চারটে বেজেছে। টানা দু’ঘন্টার মত ঘুম হয়ে গেছে। হবে নাইবা কেন? কাল রাত্তির তিনটে অব্দি বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে কাজের কাজ কিছুই হয়নি, শুধু ঠান্ডা লেগেছে ভাল করে।
কোসলের পুলিশ জীবনের পুরনো বন্ধু শ্রীবাস্তবজি এখন প্রমোশন পেয়ে বিলাসপুর রেঞ্জের ডি আই জি—ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল। উনি কাল সন্ধ্যের দিকে ডেকে পাঠিয়ে ছিলেন কোসলেজিকে। না, অফিসার মেসে রামি খেলতে নয়-- বরং একটু সাহায্য চেয়ে।
খবর ছিল একজন মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিন্যাল রায়পুর - বিলাসপুর হাইওয়ে দিয়ে পাস করবে। আসলে ব্যাপারটা অত সরল নয়। টার্গেট রওনা হয়েছে মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি থেকে। কিছুদিন আগেই গড়চিরৌলির মাওবাদী এলাকায় পুলিশের অ্যান্টি গেরিলা স্কোয়াডের একটা বড় অপারেশন হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দু’পক্ষেই, তবে মাওবাদীদের অনেক বেশি। মৃতদেহগুলো আইডেন্টিফাই করতে সময় লেগেছে, কিন্তু না, তাদের মধ্যে বিক্রম নেই।
বিক্রমের উপর মহারাষ্ট্র সরকার ২ লাখ, মধ্যপ্রদেশ ১ লাখ এবং ছত্তিশগড় ২ লাখ পুরষ্কার ঘোষণা করেছে – সে ও প্রায় তিন বছর। এরমধ্যে বেশ কিছু অ্যামবুশ হয়েছে। প্রত্যেকবারই ইন্টেলিজেন্সের পাকা খবর ছিল যে এখানে বিক্রম আছে, গতকাল শেল্টার নিয়েছে , আগামী কাল সন্ধ্যেয় ২ কিলোমিটার দূরের বনগ্রাম সিকোলায় মিটিং করবে ইত্যাদি। কিন্তু বিক্রম প্রত্যেকবার পুলিশের জাল কেটে বেরিয়ে গেছে।
এবারের খবর ছিল যে বিক্রম মহারাষ্ট্রের নাগপুর পৌঁছে গেছে। কিন্তু সেখান থেকে দিল্লির দিকে না গিয়ে ছত্তিশগড় হয়ে কোলকাতার দিকে যাচ্ছে। ওখানে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সীমান্তের জেলাগুলো নিয়ে নতুন করে ছোটনাগপুর জোনাল কমিটি গড়ে তুলবে। আর কিছুদিন বেঙ্গলে গা ঢাকা দিয়ে থাকবে।
পরের পর নতুন নতুন খবর আসতে লাগল । শোনা যাচ্ছে বিক্রম রায়পুর থেকে কোলকাতা যাবার জন্য ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে ছত্তিশগড় উড়িষ্যা বর্ডার বরগড়ে ক্রস করবে। তারপর সম্বলপুরের দিক থেকে টাটানগর হয়ে কোলকাতা যাবে। সরাইপালী ও বরগড়ের এলাকা সাদা পোষাকের পুলিশে ছেয়ে গেল। প্রত্যেকটি টোল ট্যাক্সের চৌকি সতর্ক, পেট্রল পাম্প এবং সমস্ত ঢাবায় কড়া নজর। হোটেল এবং ধর্মশালায় আঁতিপাঁতি করে খোঁজা হল। তারপর বোঝা গেল বিক্রম এই পথে আসেনি। পুলিশের ওঁত পেতে থাকার খবর ও কেমন করে যেন পেয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি ও রায়পুরে লুকিয়ে আছে? সেখান থেকে বেরোতে পারেনি?
কিন্তু ওকে তো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোলকাতায় পৌঁছতেই হবে। জোনাল কনফারেন্স বলে কথা। তাহলে ওকে বিলাসপুর হয়ে রায়গড়ের দিকে যেতে হবে। সেখান থেকে রাউরকেল্লা, সিংভুম হয়ে ঘাটশীলা দিয়ে খড়গপুর হয়ে কোলকাতা।
তবে রায়পুর থেকে বিলাসপুর আসতেও তিনটে পথ, অবশ্য গাড়িতে আসতে হলে। যতদূর জানা যাচ্ছে যে ও আসছে তিনটে গাড়ি নিয়ে। একটা ওর পাঁচশ’ মিটার আগে চলছে আর একটা পাঁচশ মিটার পেছনে। বিপদের সংকেত পেলে ওরা টক্কর নেবে অথবা ধরা দেবে। বিক্রম গাঁয়ের রাস্তায় ঘুর পথে কেটে পড়বে। আর্মস রয়েছে তিনটে গাড়িতেই।
বলোদাবাজারের রাস্তায় এবং জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাজনন্দগাঁও বা কবর্ধা হয়ে বিলাসপুর যাওয়ার পথে ঘেরাবন্দী করে কোন লাভ হল না। বাকি রইল রায়পুর বিলাসপুর মেন হাইওয়ে। এই রাস্তাটা সোজা বিলাসপুরের নেহরু চৌকে এসে চার ভাগ হয়েছে। বাঁহাতের পথ অমরকণ্টকের দিকে। সেদিকে গেলে গা ঢাকা দেওয়া যাবে, কিন্তু কলকাতা যাওয়া যাবে না। সামনের রাস্তা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ পেরিয়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক রাজধানী রতনপুর বা রত্নপুর থেকে কোরবা হয়ে রায়গড়ের দিকে গেছে। ডানদিকের রাস্তাটিও চাঁপা হয়ে রায়গড়ের দিকে গেছে। এটাই কোলকাতা যাবার সেরা রাস্তা। কোরবা হয়েও যাওয়া যায়, কিন্তু সময় লাগে একটু বেশি।
তাহলে নেহরু চৌকে ঘেরাবন্দী করা যাক। কিন্তু তারপর কোনদিকে? সামনে, নাকি ডাইনে? বাঁয়ের বা অমরকন্টকের রাস্তার প্রশ্নই ওঠে না। ওকে যে কোলকাতা যাবার রাস্তা ধরতে হবে। আর বিক্রম সম্ভবতঃ চৌকে এসে ভালমানুষটির মত পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়বে না। ওখানে যে পুলিশের বড় আয়োজন থাকবে এবং ট্রাফিক চেক করে খানাতল্লাসি সহজ হবে সেটা একটা বাচ্চাছেলেও বোঝে। তার মানে বিক্রম নেহরু চৌকের একটু আগে কোন একটা গলিপথে ঢুকে অরপা নদী পেরিয়ে যাবে। তারপর ডাইনে বা বাঁয়ের একটু সমান্তরাল পথে এগিয়ে গিয়ে হাইওয়েতে এমন জায়গায় উঠবে, যেখানে পুলিশের লোক নেই বা নামমাত্র রয়েছে। অবশ্যি অরপা নদীর উপর বিলাসপুর শহর থেকে চার চারটে সেতু রয়েছে। সবগুলোর দু’পারে পুলিশ পাহারা। বিক্রম একটু ভুল করলে বা অসাবধান হলেই জালে ফেঁসে যাবে।
কম্যান্ড পোস্ট বসেছে নেহরু চৌকে, একটু সরে গিয়ে পোস্ট অফিসের সামনে। মিঃ শ্রীবাস্তবের মতে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা দু’কিলোমিটার দূরের পুল পেরিয়ে নদী পার হওয়ার। তারপর মূল রাজপথ ছেড়ে অনেকগুলো ছোট রাস্তা গেছে গ্রামের মধ্যে দিয়ে। "প্রধানমন্ত্রী মহত্বাকাঙ্ক্ষী যোজনা"র (প্রাইম মিনিস্টার’স অ্যামবিশাস প্ল্যানের) সৌজন্যে অধিকাংশ রাস্তাই পাকা সড়ক। গাড়ি যেতে কোন বাধা নেই। তাই বিলাসপুর এস পি ও অ্যাডিশনাল এসপিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দুটো রাস্তার--সোজা এবং ডানদিকের ।
কিন্তু মাথা নাড়ছেন মিঃ কোসলে। ওনার মতে বিক্রম বাঁয়ের রাস্তা ধরবে। সবার চোখে অবিশ্বাস। তা কি করে হয়! অমরকন্টকের দিকে কেন যাবে? উলটো পথে?
কোসলে মুচকি হাসেন।
--আপনারা নিজেকে বিক্রমের জায়গায় বসিয়ে ভাবুন, আপনি নিজে হলে কী করতেন। যা পুলিশ ভাবছে সেটা কি ও ধরতে পারবে না? ফলে যেদিকে পুলিশ ভাবছে না, সেইদিকেই যাবে। কিন্তু ও অমরকন্টক অব্দি যাবে কেন? ওই পথে বিলাসপুর থেকে তিরিশ কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে ফের অরপা নদী পার হবে। এখন মার্চ মাস, অধিকাংশ জায়গায় অরপা নদীর জল গোড়ালি পর্য্যন্ত। বিক্রম এ’পারে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেঁটে নদী পেরিয়ে ওপারে যাবে। ওর নেটওয়ার্ক থেকে অন্য পারে গাড়ির ব্যবস্থা হবে। এপারের গাড়ি আবার রায়পুরে ফিরে যাবে, তাতে থাকবে একজন ড্রাইভার, একা।
সবার মুখে অপ্রসন্নতা। এই লোকটা শেষ মুহুর্তে প্ল্যান পালটে দিতে চায়। সামনের বা ডাইনের পথে যে বিশাল ফোর্স বিভিন্ন পয়েন্টে ডেপ্লয় করা হয়েছে এত তাড়াতাড়ি তাদের গুটিয়ে নিয়ে ফের বাঁদিকে নানান সম্ভাব্য পয়েন্টে পাঠাতে লজিস্টিক্সের সমস্যা রয়েছে। আর ওর আন্দাজে ছোঁড়া ঢিল যদি না লাগে? যদি বিক্রম এত জটিল জ্যামিতি ত্রিকোণমিতি না ভেবে বাঁধা পথে কেটে পড়ে? তার দায়িত্ব কে নেবে? এই রিটায়ার করা লোকগুলো কেন যে ঘরে বসে থাকে না?
কিন্তু এসব কথা মুখ ফুটে বলা যাবে না। এই ভদ্রলোক যে ডি আই জি সাহেবের বন্ধু। ওনার অতিথি, সাহায্য করতে এসেছেন। ওঁর নাকি এ’লাইনে বিশেষ অভিজ্ঞতা আছে।
কোসলে এসব দেখেও দেখছেন না। শেষে উনি বললেন যে পুলিশের বড়কত্তারা প্রথম দুটো রুট কভার করুন। অমরকন্টক যাওয়ার রাস্তাটায় গাড়ি নিয়ে নজরদারি করবেন কোসলে নিজে এবং ওনার সিকিউরিটি সংস্থার স্টাফ সৌরভ বিশ্বাস, এক বাঙালী ছোকরা। আর ওঁরা পুলিশের লালবাতি বাহন নেবেন না, নিজেদের গাড়িতে যাবেন। নইলে অপরাধীর সতর্ক হওয়ার চান্স আঠেরো আনা।
রাত এগারোটা নাগাদ এঁদের টহলদারি শুরু। গাড়ি চালাচ্ছে জগন্নাথ দামলে, ওদের ম্যানফ্রাইডে। দু’বছর আগে ও মারুতি মোটর ড্রাইভিং স্কুল থেকে গাড়ি চালানো শিখে লাইসেন্স পেয়ে গেছে। শেখার পয়সাটা কোসলেই দিয়েছিলেন। এবং তারপর থেকে দূরে বিশেষ করে রাত্তিরে কোন কাজ পড়লে দামলেই গাড়ি চালায়। ওর মাইনে দু’হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সৌরভ বুঝে গেছে এই লার্নিং ফী এবং মাসে দু’হাজার টাকার বাড়িয়ে দেওয়া – এসবের পেছনে দলগঞ্জন সিং কোসলের পাটোয়ারি বুদ্ধি কাজ করছে। আলাদা করে ড্রাইভার রাখলে মাসে অন্ততঃ দশ হাজার টাকা বাড়তি খরচা হত। তার উপরে নাইট হল্ট হলে এক্সট্রা খরচা রয়েছে। ওভারটাইমের আলাদা রেটও আছে।
তবে জগন্নাথ দামলে হল পার্মানেন্ট অফিস স্টাফ। ওকে এসব দেওয়ার বালাই নেই। সৌরভও রাত্রে বাইরে ডিউটি করলে যা থাকা খাওয়া বা জার্নিতে খরচ হয় তাই অফিস থেকে পায়, আলাদা করে কোন ভাতা পায়না। উনি তিনজন স্টাফকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এটা প্রাইভেট সংস্থা,নতুন শুরু হয়েছে। কোন লাগে- টাকা -দেবে -গৌরী সেন গোছের সরকারি অফিস নয়। একটা ডিটেক্টিভ কাম সিকিউরিটি এজেন্সির জন্যে এসবই হল নিত্যিকর্ম। এতে করলে পুণ্যি নেই, না করলে পাপ।
বলে রাখা ভাল—সৌরভের মাইনে বেড়েছে পাঁচ হাজার টাকা, সেও দু’বছর হল। তবে এখন থেকে প্রতি বছর একহাজার টাকা করে বাড়বে, যতদিন না সংস্থাটি ব্রেক ইভেন অবস্থায় আসে।
রাত দুটো নাগাদ বিলাসপুর থেকে বারো কিলোমিটার দূরে চোরভাট্টি গাঁয়ের কাছে দুটো গাড়ি দেখা গেল। কিন্তু ওরা অমরকন্টকের দিকে যাচ্ছে না। বরং উলটো, ওদিক থেকেই আসছে।
কোসলের ইশারায় ড্রাইভার গাড়িটা রাস্তার মাঝামাঝি দাঁড় করালো। উনি ও সৌরভ নিজেদের গাড়ির একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে টর্চের আলোর সংকেতে ওদের থামতে বললেন। সৌরভকে বলে রেখেছেন যে ওরা যদি পালিয়ে যায় তাহলে চেজ টেজ না করে পুলিশের কম্যান্ড পোস্টে ওয়ারলেসে খবর করলেই হবে। সৌরভের চেহারায় প্রশ্ন ফুটে উঠল।
--শোন, মাঝরাত্তিরে রাস্তার মাঝখানে কেউ থামতে বললেই যে সবাই থেমে যাবে তা’ নয়। আর পালালেই যে অপরাধী তা নাও হতে পারে। অনেক সময় আমাদেরই ডাকাত বা কোন কু-মতলব আছে ভেবে লোকে প্রাণলণে স্পীড তুলে পালিয়ে যায়। আর যাকে খুঁজছি যদি সে হয় তাহলে আরও চিত্তির। ওদের কাছে ফায়ার আর্মস থাকবে। আমরা পুলিশ নই, গুলি চালাতে অথরাইজড নই। আর ভুল করে নিরপরাধকে গুলি করলে বাকি জীবন তোকে আমাকে জেলের ঘানি টানতে হবে।
কিন্তু দুটো গাড়িই স্পীড কমিয়ে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভারের পাশ থেকে একজন গলা বাড়িয়ে প্রশ্ন করল—ক্যা হুয়া? কোই প্রবলেম?
-- ‘পেট্রোল খতম হো গয়া’। সৌরভের চটজলদি জবাব। ওর বক্তব্য পাঁচ লিটার তেল পেলে গাড়িটা কাছাকাছি যে পেট্রোল পাম্প সেখানে গিয়ে ট্যাংক ভর্তি করিয়ে নেবে। গাড়ির তেলের ইন্ডিকেটর খারাপ হয়েছে মনে হয়। তাই এমন ধোঁকা হয়ে গেল।
সামনের গাড়ি পেছনের গাড়ির উদ্দেশে কিছু বলল, সম্ববতঃ তেলুগু ভাষায়। ওখান থেকে ড্রাইভার নেমে একটা জ্যারিকেন আর ফানেল বের করে সৌরভের গাড়ির ট্যাংকে তেল ঢেলে দিল। কোসলে টাকা দিতে গেলেন। কিন্তু ওরা জিভ কেটে না করল। দুটো গাড়িই আসছে অমরকন্টক থেকে নর্মদাজীর দর্শন করে নদীর উদগম স্থলে পুজো দিয়ে। এখন টাকা ছোঁবে না। সৌরভের চোখ নোট করল প্রথম গাড়িটা মারুতি জিপসী, পরেরটা মারুতি ওমনি পুরনো মডেল। গাড়িদুটোর নম্বর সি জেড ৫৫৭৩এবং ২২১৭।
যাই হোক, এভাবে রাত তিনটে বেজে গেল। এমনসময় কোসলেজীর ফোন চ্যাঁ চ্যাঁ করে উঠল। শ্রীবাস্তবজীর মেসেজঃ
‘ফিরে যেতে হবে। রায়পুর থেকে এক্সট্রা ফোর্স এসে গেছে। ওরা খবর পেয়েছে বিক্রম রায়পুর থেকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু কোন রুট ধরে বিলাসপুর আসছে সেটা ঠিক জানা যায়নি। তবে ওরা এসে এদিকটা সামলে দেবে। তাই কোসলেজী অ্যান্ড কোং যেন শেষরাতের হিম না লাগিয়ে ঘরে ফিরে যান। সহযোগিতার জন্য অনেক ধন্যবাদ’।
সকরী গ্রাম আর ডেন্টাল কলেজ এসে গেছে। এবার উসলাপুর ফ্লাইওভার পেরিয়ে গেলে পাঁচমিনিটের মধ্যে নেহরু চৌক হয়ে যে যার ঘরে। আধঘন্টার মধ্যে বিছানার ওম। কোসলেজীর হাই উঠছে। সৌরভও মুখে হাত চাপা দিয়েছে এমন সময় ড্রাইভার দামলে চাপা গলায় বলল-স্যার, ওহ দেখিয়ে!
রাস্তার বাঁদিকে নদীর ধারে একটা সাদা রঙের মারুতি ওমনি অশত্থ গাছের মোটা কান্ডের গায়ে ঢুঁস মেরে ঢালু জমিতে সামান্য কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। লাইট নিভিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছে দামলে। চটপট নেমে পড়েছেন কোসলে ও সৌরভ। দুজনের হাতেই লাইসেন্সড রিভলভার। কোসলেজীর সংকেতে সৌরভ চলে গেল গাড়িটার পেছন দিকে, উনি সামনে ড্রাইভারের দরজার দিকে। তারপর দুজনেই একসঙ্গে চার্জ করলেন। একজন সামনের দরজায়, একজন পেছনে।
গাড়িটার পেছনের সীটে কেউ নেই। ড্রাইভারের সীটে এলিয়ে পড়ে আছে একজন। তার মাথা ও কানের পাশ থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে জমাট বেঁধেছে। কোসলেজী গ্লোব কম্পার্টমেন্ট থেকে গ্লাভস বের করে পরে নিয়ে ওর গলার কাছে শিরা ছুঁয়ে দেখলেন। নাকের নীচে হাত রাখলেন, শ্বাস বইছে, খুব ধীরে। ক্ষীণ পালস্ টের পাওয়া যাচ্ছে। ঘটনাটা অন্ততঃ একঘন্টা আগে ঘটেছে। কোসলে তখনই ডি আই জি শ্রীবাস্তবকে ফোন করে সব জানালেন। মোদ্দা কথা, এক্ষুণি অ্যাম্বুলেন্স দরকার।
সৌরভের চোখ গেল নেমপ্লেটের দিকে। যা ভেবেছিল তাই। সেই পুরনো ওমনি গাড়িটা, নম্বর সি জেড ২২১৭। এবার ও অচৈতন্য ছেলেটাকে টর্চলাইট জ্বালিয়ে ভাল করে দেখে। হ্যাঁ, এই ছেলেটাই জেরিকেন ভরে পাঁচ লিটার তেল দিয়েছিল। সৌরভের মনটা ভিজে ওঠে।
সব ব্যবস্থা হয়ে গেল--বলতে গেলে পনের মিনিটের মধ্যে। এইসব অপারেশনের সময় একটা অ্যাম্বুলেন্স আগে থাকতেই রেডি হয়ে থাকে।
কিন্তু ছেলেটা বিক্রম নয়। ওর পরিচয় আপাততঃ জানা যাচ্ছে না। ওর পকেটে বা গাড়ির গ্লোব কম্পার্টমেন্টে কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স বা আধার কার্ড জাতীয় কোন কাগজ নেই। মুখে মদের গন্ধ রয়েছে। এটা সম্ভবতঃ অ্যাকসিডেন্ট, কিন্তু গাড়ির সওয়ার বাকি সঙ্গীসাথীরা সব গেল কোথায়? আর প্রথম জিপসী গাড়িটা? একে ফেলে পালিয়েছে?
সে যাকগে, কোসলে আর মাথা ঘামাবেন না। এটা এখন বিলাসপুরের সিটি সুপারিন্ডেন্ট অফ পুলিসের অধীনে ক্রাইম ব্রাঞ্চের মাথাব্যথা। বাড়ি গিয়ে গরম জলে হাতমুখ ধুয়ে রামের একটা ছোট পেগ মেরে শুয়ে পড়লেন কোসলে। ঘড়িতে পৌনে পাঁচটা, বাইরে অন্ধকার সামান্য ফিকে হয়ে এসেছে।
কাল রবিবার, অফিস খুলতে হবে না। কিন্তু যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ আসে? কারও ফোন কল?
ন’টা নাগাদ ফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। বিরক্ত মুখে চাদর থেকে হাত বের করে দেখলেন ডি আই জি শ্রীবাস্তব।
--কী ব্যাপার? বিক্রম ধরা পড়েছে?
--না, তবে কাল রাত্তিরের অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া ছেলেটা একটু আগে মারা গেছে। হাসপাতাল থেকে খবরটা এখনই এসেছে। ভাবলাম, তোমাকে আগে খবরটা দিই।
কোসলের ঘুমকাতুরে মুখ থেকে একটা অব্যক্ত ঘোঁৎ গোছের আওয়াজ বেরোল।
শ্রীবাস্তব বললেন—একবার সন্ধ্যের দিকে আসবে? পাক্কা খবর এসেছে বিক্রম বিলাসপুরের আশেপাশেই আছে। আরে না না; রায়পুরের পুলিশ হেড কোয়ার্টারের খবর। ডিজিপি মেহেরোত্রা নিজে হটলাইনে ফোন করেছিলেন। না, আজ রাত্তিরে আর তোমাকে টহলদারি করতে হবে না। বহোত বড়া গুনাহ্ হো জায়েগা। উপর সে খুদা সব দেখ রহেঁ। তুমি এলে পরে একটু ডিসকাসন, একটু অন্য অ্যাঙ্গেল –এই আর কি!
এতসবের পর আর ঘুমোনো যায় না। কোসলে বিছানা ছেড়ে বাটার ও ফ্রুট জ্যাম দিয়ে ছয় পিস টোস্ট এবং ডাবল ডিমের পোচ সাঁটালেন। ফের এক পাতিয়ালা মগ দুধ চা ও একটা ভুসাওলি কলা। তারপর বিছানায় উঠে আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজ খুললেন। সুদোকু না হিন্দি শব্দ শৃংখল? এমন সময় গিন্নির কথা মনে এল। পাঁচদিন হল বাপের বাড়ি গেছে । আরও দুটো দিন? আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। গিন্নি বাড়ি থাকলে ব্রেকফার্স্ট বানিয়ে ওকে খাওয়াতেন। তবে ও লাঞ্চ নিজেই বানাত, কিছুতেই এই পাগলাটে স্বামীদেবতাকে হাত লাগাতে দিত না। গাঁয়ের মেয়ে, পতিদেবকে আপ (আপনি) বলবেই, কিছুতেই ‘তুম’ বলবে না। অনেকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন কোসলে। সেসব কথা মনে করে ওঁর মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। কখন যে ঘুম এসে গেছে, হাত থেকে ‘দৈনিক ভাস্কর’ খসে পড়েছে কোসলে টেরও পেলেন না।‘
***** ************************************************************
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ঘুম ভাঙার পর কোসলে টের পেলেন যে ওঁর খিদে পেয়েছে। কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দেখলেন পাঁউরুটি ফুরিয়েছে, জ্যামের শিশিও তলানিতে। ডিমের ট্রেতে মাত্র একটা বেঁচে আছে। টেট্রাপ্যাকের দুধ আনা দরকার। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে তুলতে চোখে পড়ল উলটো দিকের ফুটপাথে ডেলী নীডস ও পাশের রুটি-তড়কার দোকান দুটোই খুলে গেছে। এবার নীচে নামতেই হবে। টি শার্ট গলিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলেন ওয়ালেট রয়েছে কিনা।
সিঁড়িটা বড্ড সরু আর খাড়া। অবশ্যি ভাড়াটাও কম। নইলে লিংক রোডের উপর দোতলায় ফ্ল্যাট নেওয়া কোসলের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
নীচে নেমে রাস্তা পেরোনর সময় কানে এল একটা কর্কশ ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ।
একটা লোহার চাকাওলা ময়লা ফেলার হুইলব্যারো ঘড়ঘড়িয়ে আসছে। ওটাকে ঠেলে আনছে নেভি ব্লু হাফপ্যান্ট ও শার্ট পরা অল্পবয়েসি রেলের খালাসী। গাড়িটা একটা চট দিয়ে ঢাকা। কিন্তু গাড়িটার উঁচু ধারটায় চটের ফাঁক দিয়ে একজোড়া পা, খানিকটা গোড়ালির মত বেরিয়ে রয়েছে।
কোসলে বুঝলেন—রেলে কাটা পড়া বেওয়ারিশ লাশ হবে। খালাসীরা এভাবেই সরকারী মধুবনের শ্মশানে দাহ করতে নিয়ে যায়। উনি গাড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই খালাসীটা থামল। চট থেকে কড়া কোন ওষুধের গন্ধ নাকে লাগল। ফর্মালিন?
ছেলেটা নরম গলায় বলল—দশঠো রুপিয়া দীজিয়ে না সাব! কাল মালগাড়ি মেঁ কট গয়া থা। কোই পহচান নহীঁ, কোই দাবেদার নহীঁ। লাশের বডি চাইতে কেউ আসেনি পরিচয় জানা যায় নি। এখন আমার ঘাড়ে পড়েছে দাহ করা। কিন্তু ফুল চাই, কাঠ চাই, পুরুতের দক্ষিণা চাই। কিছু টাকা দরকার। আপনি অন্ততঃ দশটা টাকা দিন, কালকের বাসি মড়া।
কোসলে জানেন বেওয়ারিশ লাশের দাহকার্যের খরচা মিউনিসিপ্যালিটির। ছোঁড়াটা টাকা পেয়ে মদ গিলবে। তা হোক গে, কষ্ট করে কার না কার মড়া নিয়ে যাচ্ছে।
কোসলে ওয়ালেট বের করে বললেন—একবার ঢাকাটা সরা, মুখটা দেখি।
ছেলেটা শিউরে উঠল। মত দেখিয়ে সাব। ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা হয়ে গেছে। তাই ঢেকে নিয়ে যাচ্ছি।
কোসলে টাকাটা দিয়ে এগিয়ে গেলেন ব্রেড জ্যাম কিনতে।
একঘন্টা হয়ে গেছে। নিজের ঘরে কফি বানাচ্ছেন কোসলে, গ্যাসের স্টোভে কুকার চাপানো হয়েছে।
এবার কফি নিয়ে সোফায় বসে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে লাগলেন। মনটা খচখচ করছে।
কোথায় কিছু একটা হিসাব মিলছে না।
মানে, কিছু একটা দেখেছেন যা পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে খাপ খায় না। কী সেটা? কোথায় দেখেছেন? কাল রাত্তিরে নাকি আজ? আজকে তো বেরোন হয়নি। সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলেন। তারপর এই তো একঘন্টা আগে নীচে নামলেন। রাস্তা পেরোলেন। একটা ঘ্যাড় ঘ্যাড় ধাতব শব্দ। মুণ্ডহীন বেওয়ারিশ লাশ।
চমকে উঠে দাঁড়িয়েছেন কোসলে, কফি ছলকে পড়েছে পরনের লুঙ্গিতে। ইতিমধ্যে কুকারের সিটি বেজে উঠেছে, কোসলে শুনতে পেলেন না। মনে পড়ে যাচ্ছে ছবিটা। হুইল ব্যারোতে বেওয়ারিশ লাশ, চটের ঢাকা থেকে বেরিয়ে রয়েছে পা, গোড়ালির একটু উপর পর্য্যন্ত।
হ্যাঁ, এইখানেতেই ওনার অস্বস্তি বেড়ে গেল। ওই পায়ের পাতা এবং গোড়ালিতে নিয়মিত মোজা পরার চিহ্ন। ফর্সা পায়ের রঙের শেড আলাদা , তাতে নীল রঙের ছোট্ট উলকি। তাছাড়া কোমল যত্নকরা পা, ফাটাফুটি শুকনো খসখসে নয়। এই পা এবং গোড়ালি আর যারই হোক, কোন বেওয়ারিশ নামগোত্রহীন মানুষের নয়, হতেই পারে না।
কুকারের সেকেন্ড সিটি বেজে উঠল। কিন্তু কোসলে ঘরের অন্য কোণায় ল্যান্ডলাইন থেকে বিলাসপুর স্টেশনের রেলওয়ে প্রটেকশন ফোর্সের কম্যান্ডান্টকে কল করছেন।
না, কাল রাত্তিরে বা আজ সকালে স্টেশনে কোন ট্রেনে কাটা বেওয়ারিশ লাশ পাওয়া যায় নি।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।