“তোকে যোগী ভেবেছি ভাই,
লংকাপতি ঠগী রাবণ,
তোকে সাধু ভেবেছি রে”।
ঠিক বারো দিন পরে, দন্তেওয়াড়ায়
সৌরভ
আজ আমার ফিল্ড স্টাডির চতুর্থ দিন।
কাল থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিল। খুব একটা গা’ করি নি। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে আজ গা -ম্যাজম্যাজ জ্বরজ্বর ভাব।
সোনালী এসে কপালে হাত দিয়ে দেখল, তারপর দুটো প্যারাসিটামল দিয়ে বলল—আজ আর বেরোতে হবে না। চারটে ব্লকের মধ্যে দুটোর ডেটা কলেকশন প্রায় হয়ে গিয়েছে। বাকি দুটোর জন্যে দুশ’ ফর্ম আমাকে দিন । আমি ব্লকের আর পঞ্চায়েতের স্টাফকে দিয়ে তিনদিনের মধ্যে সব ফর্ম ফিল আপ করিয়ে দিচ্ছি।
--আচ্ছা? ওরা যদি আমার মতই ঘর থেকে না বেরোয়? বিছানায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনগড়ন্ত ডেটা দিয়ে ফিল আপ করে দেয়?
সোনালী হাসে, বলে তা’হতেই পারে।
--বাঃ ! তাহলে আমার রিসার্চের ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ হয়ে যাবে না?
--আমার উপর ভরসা রাখুন। ওদের বলে রেখেছি যে রায়পুর থেকে আসা সাহেব, মানে আপনি শেষ চারদিনে চারটে ব্লকে গিয়ে সরেজমিনে ওই ফর্মগুলোর ভেরিফিকেশন করবেন। আর যদি ফেক ডেটা ধরা পড়ে তাহলে দোষীর নেক্সট ইনক্রিমেন্ট আটকে যাবে।
মনে মনে ওর তারিফ করি।
ও আমার জন্যে সরকারি গেস্ট হাউসে একটা রুম পনের দিনের জন্যে বুক করিয়ে দিয়েছে।
এর জন্যে চিঠি লিখিয়ে আনতে প্রথম দিনই আমাকে নিয়ে প্রফেসর প্রভা মিত্তালের অফিসে গেল। বলল, পনের দিনের জন্যে আমাদের রিসার্চ অফিসার মিঃ সৌরভ বিশ্বাসের জন্যে সার্কিট হাউসে একটা রুম বুক করিয়ে দিতে। যা সরকারি চার্জ সেটা আমরা পে করে দেব।
দেখা গেল, ম্যাডাম মিত্তাল সোজা কথার মানুষ নন। আমাদের জন্যে চা-সিঙারা আনালেন, নানান গল্প জুড়ে দিলেন। কিন্তু হতাশ মুখে হাত উলটে বললেন –রুম এখন খালি নেই। আপনারা আপাততঃ প্রাইভেট হোটেলে উঠুন, খালি হলে খবর দেব।
আমি উঠে পড়তে চাইছিলাম। কিন্তু সোনালী চোখের ইশারায় বসে থাকতে বলে মোবাইল টিপতে টিপতে আশকথা পাশকথা চালিয়ে গেল।
এমন সময় একটা ঘটনা ঘটল।
পর্দা ঠেলে ঢুকে পড়েছে একজন বছর পঞ্চাশের গ্রাম্য মহিলা।
ময়লা গায়ের রঙ, গড়ন একটু মোটার দিকে। পরনে হাতে -কাচা শস্তা ছিটের সালোয়ার কামিজ। মাথার কাঁচাপাকা চুলে ঠিকমত চিরুনি পড়েনি। সে আমাদের দিকে তাকিয়ে আলগোছে একটা নমস্কার করে টেবিলের ওপারে চেয়ারে বসে থাকা প্রফেসর সাহিবার কাছাকাছি চলে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—গত দু’মাসের বাকি টাকাটা?
প্রভা চমকে তাকালেন।
মুখ শুকিয়ে গেছে। আমাদের দিকে আড়চোখে দেখলেন। আমরা দু’জনেই ওনার অস্বস্তি দেখে চোখ সরিয়ে নিলাম।
কিন্তু চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম --উনি ড্রয়ার খুলে দুটো পাঁচশ টাকার নোট ওই মহিলাকে ধরিয়ে দিলেন। তারপর আমাদের বললেন –উনি অমুক গ্রাম পঞ্চায়েতের মহিলা সরপঞ্চ।
তো সেই মহিলা বললেন—দাঁড়ান, রসিদ কেটে দিচ্ছি।
শিউরে উঠলেন প্রভা, না না, রসিদের কী দরকার? আপ লে জাইয়ে!
বুঝলাম, এর মানে আপনি এখন ইহাঁ সে জাইয়ে!
মহিলা নাছোড়বান্দা, রসীদ কেটে ধরিয়ে দিয়ে বলল—আমরা বিনা রসীদ কারও থেকে কিছু নিই না। এবার আপনি চাইলে ওগুলো কুটি কুটি করে ডাস্টবিনে ফেলে দিন , আমি কিছু মনে করব না।
তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে চলে গেলেন। খেয়াল করলাম ওনার ওপরের পাটির সামনের একটা দাঁত কালচে মত।
প্রভার মুখের রঙ ফিরে আসতে মিনিট খানেক লাগল। তারপর একটা স্লিপে খস খস করে কিছু লিখে দিয়ে বললেন—ভি আই পি রুম খুলে দিচ্ছি। কিন্তু কোন মন্ত্রী বা সাংসদ এলে প্লীজ খালি করে দেবেন, নইলে আমার চাকরি থাকবে না।
সোনালী যেন গলে জল। খুব করে ধন্যবাদ দিল। কিন্তু সুর কেটে গেছে। প্রভা একটা ফাইল খুলে তাতে ডুবে গেলেন। আমরা চটপট উঠে পড়লাম।
আচ্ছা, সোনালী কি জানত যে অমুক গাঁয়ের তমুক সরপঞ্চ ঠিক ওই সময়েই ওই অফিসে ঢুকবে? মহিলাটি কি সোনালীর চেনা? স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম্ নাকি অন্য কিছু?
চিন্তাটাকে মন থেকে তাড়াতে পারছি না।
আমি গেস্ট হাউসের বেয়ারা রামনিবাসকে ডেকে দুটো কফি দিতে বলে সোনালীর সঙ্গে আগামী দিনের প্রোগ্রাম নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। বোধহয় জ্বরো শরীরে মন চাইছিল ও আর একটু বসুক, কথা বলুক--কাজের কথা, অকাজের কথা।
হ্যাঁ, চারটে মাওবাদী ব্লকে চারশ লোকের ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে। প্রতি ব্লকে একশ’ জন করে। তার মধ্যে ৫০ জন -যারা আমাদের প্রৌঢ় শিক্ষা কেন্দ্রে যোগ দিয়েছে। আর ৫০ জন -যারা কোন লিটারেসি কেন্দ্রে নাম লেখায়নি। শিডিউল একটু লম্বা। তাতে দুটো ভাগ, একটাতে রয়েছে কোয়ান্টিফায়েড এইসব ডেটা—কত ঘন্টা পড়েছে, বইপত্তর পেয়েছে কিনা, ঘর থেকে কতদূর –এই সব ।
অন্যটিতে রয়েছে-- টিচার ভাল ব্যবহার করে কিনা, ওরা খাবার জল ঢেকে রাখে কিনা, খাবার আগে হাত ধোয় কিনা, অসুখ হলে ওঝা না ডাক্তার --কার কাছে যায়, বাড়িতে কারা আগে খাবার পায়, পুরুষের দল নাকি মহিলারাও একসাথে খেতে বসে, পরিবারের টাকাপয়সা খরচের ব্যাপারে কে সিদ্ধান্ত নেয় –শ্বশুর স্বামী? নাকি সবাই মিলে, পরিবারের বাচ্চারা স্কুলের মুখ দেখেছে কি—এইসব।
তো সোনালীর হিসেবে আগামী তিনদিনের মধ্যে এসব ডেটাশিট কমপ্লীট হয়ে যাবে।
শেষ চারদিনে আমার কাজ—প্রতি ব্লকে গিয়ে ওই লোকেদের সঙ্গে বসে জিডি বা গ্রুপ ডিসকাসন করা—এতে ডেটা ভেরিফিকেশনও হবে, অন্য কিছু প্যারামিটারের ফীডব্যাকও পাওয়া যাবে।
এগারদিন আগে, রায়পুরে
রায়পুরে ফিরে এসেছিলাম ডায়রেক্টর জেনারেলের কাফিলার সঙ্গে।
সোনালী রয়ে গেল দন্তেওয়াড়াতেই। ফেরার সময় ওকে দেখতে পাই নি। ইচ্ছেও ছিল না।
শেষদিনের ওর মুখ ফসকে বেরিয়ে যাওয়া একটা কথা আমার মুখের স্বাদ বদলে দিয়েছিল। সলওয়া জুড়ুম নতুন শিক্ষাকেন্দ্রে বইয়ের প্রদর্শনীর সময় ও আমার উপর নজর রাখছিল! ওদের ওই কমরেড লাল মুহম্মদের নির্দেশে?
মানুষকে চেনা কত কঠিন, বিশেষ করে মেয়েমানুষদের। ভালরকম শিক্ষে হল।
রায়পুরে অ্যাডাল্ট এডুকেশন স্টেট রিসোর্স সেন্টারে সপ্তাহের প্রথমদিন হলঘরে মিটিং। অফিসের সমস্ত স্টাফকে চেয়ার লাগিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। একরাউন্ড চা পর্ব চুকলে ডায়রেক্টর এম ভেঙ্কটগিরি এসে ওঁর স্পেশাল চেয়ারে বসলেন। শুরু হল রিভিউ মিটিং।
বস্তার ও দন্তেওয়াড়া জেলায় যারা দিল্লি থেকে আসা ডিজি সম্পতকুমারের কাফিলায় সঙ্গী হয়েছিল তারা এবার সবার সামনে তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলুক।
প্রথমে বলতে উঠল শবনম নামের চুলবুলি প্রগলভ মেয়েটি। হুঁ, যাবার সময় সাক্ষরতার গানগুলো জানি না এবং সফদর হাশমি বলে কারও নাম শুনি নি বলায় অনেক খিল্লি করেছিল বটে।
কিন্তু ডায়রেক্টরের সামনে দেখি একেবারে অন্য চেহারা, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে শেখে নি। বেশ গুছিয়ে বক্তব্য রাখল, একেকটা দিন ধরে ধরে কী কী করা হয়েছে এবং আমাদের সেন্টারের প্রতিনিধিরা কী করেছে তার ফিরিস্তি দিল। শেষে সৌরভ স্যারের সুযোগ্য নেতৃত্বের ফলে আমাদের দলের থাকাখাওয়ার এবং কো-অর্ডিনেশনের কোন সমস্যা হয় নি, তা ও জানাল। এটাও বলল যে সৌরভ স্যার মেয়েদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। আর দন্তেওয়াড়ার ম্যাডাম সোনালীর সঙ্গে মিলে লজিস্টিক প্রবলেমগুলো সময়মত অ্যাড্রেস করেছিলেন।
মেয়েটা তো মহা বিচ্ছু! সেদিন রাত্তিরে আমাদের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছিল কি?
পেছনের লাইনে বসা মেয়েদের থেকে কি একটু চাপা হাসির স্বর ভেসে এল? নাকি আমারই মনের ভুল।
এবার যে দু’জন আগেভাগে গীদম সলওয়া জুড়ুম শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে ভাল করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিল এবং আমাদের কেন্দ্রের তৈরি লিটারেচারগুলো নিয়ে ছোটখাট প্রদর্শনীর মত করেছিল তাদের পালা।
ওদের মধ্যে যে বলতে উঠল তার নাম শ্রবণ।
তার রিপোর্টে একটু অভিযোগ ছিল যে দন্তেওয়াড়া শিক্ষাবিভাগের তরফ থেকে যে মহিলা প্রফেসর দায়িত্বে ছিলেন, তিনি কোন সাহায্য করেন নি। ওদেরই সব জিনিসপত্র জোগাড় করে দু’দিনের মধ্যে কোনরকমে সাজাতে হয়েছে। নইলে আরও ভাল হতে পারত।
আর তার চেয়ে খারাপ ব্যাপার হল উনি ফাঁকি দিয়ে দিল্লির বসদের সামনে ফুটেজ খেলেন। নিজের কথা মাইকে সাতকাহন করে বললেন। একবারও বললেন না যে এই স্টলটাকে সাজিয়েছে রায়পুরের রিসোর্স সেন্টারের দু’জন স্টাফ, এবং বইপত্তর সব ওরা রায়পুর থেকে এনেছে।
আমি মনে মনে নোট করি –ওই মহিলাটির নাম প্রফেসর প্রভা মিত্তাল।
এবার আমার পালা।
মরেছে, অন্যদের মত লম্বা করে বক্তৃতা দেওয়ার কায়দা আমার জানা নেই।
প্রথমেই বললাম শ্রবণ এবং তার সঙ্গের কমলেশ বলে ছেলেটির কথা। ওরা অনেক অসুবিধার মধ্যেও ওখানে আগেভাগে গিয়ে যে কাজ গুছিয়েছে তার ফলে আমাদের রিসোর্স সেন্টারের নাম ডিজি সাহেবের নজরে এসেছে।
বললাম দন্তেওয়াড়ার প্রতিনিধি সোনালী মিশ্রের কথা। সবাইকে জানিয়ে দিলাম যে প্রভা মিত্তাল যতই নিজের কোলে ঝোল টানার চেষ্টা করুন না কেন, ডিজি জেনে গেছেন আসলে গ্রাউন্ড লেভেলে পরিশ্রম কারা করেছে—থ্যাংকস্ টু সোনালী।
তারপর বললাম যে মেয়ের দল খুব ডিসিপ্লিন্ড ছিল, ফলে আমাকে বিশেষ কিছুই করতে হয় নি। আর ডিজি সাহেব যতটা খরচ মঞ্জুর করেছিলেন তার থেকে ৫৯৭ টাকা কম খরচা হয়েছে। বিলস্ এবং স্টেটমেন্ট আমি আজই অ্যাকাউন্টস সেকশনে জমা করে দিচ্ছি।
সবাই বেশ ক্ল্যাপ ক্ল্যাপ করল, কয়েকজনের মোবাইল ঝলসে উঠল।
লাঞ্চের পর ডায়রেক্টর ভেঙ্কটগিরি সাহেবের চেম্বারে মিটিং।
জানলাম সাতদিন পরে আমায় দন্তেওয়াড়া গিয়ে ফিল্ড রিসার্চ শুরু করতে হবে।
হ্যাঁ, আমাকে একাই যেতে হবে।
দু’দিনের মধ্যে আমাকে শবনমের সঙ্গে মিলে রিসার্চের মেথডলজি, কোশ্চেনেয়ার , টার্গেট গ্রুপ, স্যাম্পল সাইজ, এরিয়া সব তৈরি করে ভেঙ্কটগিরি স্যারকে দেখাতে হবে। বাজেট এস্টিমেটও দিতে হবে। উনি ফাইনাল অনুমোদন দিলে স্টেশনারি এবং অন্য সব প্রিন্ট আঊট আর দুটো পেনড্রাইভ রেডি করে সাতদিনের মাথায় বেরিয়ে পড়তে হবে।
আর দন্তেওয়াড়ায় সমস্ত লজিস্টিক্যাল প্রবলেম, বড় বড় সরকারি আমলাদের ইন্টারভিউ এবং টার্গেট গ্রুপের আদিবাসীদের থেকে গ্রুপ এবং ব্যক্তিগত সার্ভে করা –সব ব্যাপারে আমার গাইড হবেন সুশ্রী সোনালি মিশ্র, যিনি ইউনিভার্সিটিতে এম ফিলের ফাইনাল পেপার জমা করেছেন।
মা গো! আবার সেই সোনালী?
আমি কিছুতেই কমঃ লাল মুহম্মদের সঙ্গে একটি বন্ধ ঘরে মোলাকাত আর টাঙি হাতে মহীপালের ক্রুর চেহারা ভুলতে পারছি না। আর আমার ওই ইঁদুর কলে ঢোকার ব্যাপারে সোনালীর সন্দিগ্ধ ভূমিকা?
নাঃ , এসব মিঃ এম ভেঙ্কটগিরি স্যারকে বলে লাভ নেই। কোসলে স্যারের নির্দেশ-- ওই রিসার্চের অ্যাসাইনমেন্টে নিতে মানা করলে চলবে না।
কিন্তু রওনা হওয়ার দুদিন আগে ফের ডিরেক্টরের চেম্বারে ল্যান্ডলাইনে আমার বাবার ফোন এল। এবার ওই চেম্বারে কেউ নেই। স্যার এডুকেশন মিনিস্টারের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। আমি
চেম্বারে ঢুকলে চাপরাশি দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে টুলে বসে রইল।
--কোসলে বলছি। রিসার্চে দন্তেওয়াড়া যাচ্ছিস তো? কবে?
--হ্যাঁ বাবা; পরশু দিন ।
--মন দিয়ে শোন। তোকে দু’তিনটে জিনিস কিনতে হবে। আজকেই যা।
--বলুন।
--মালবীয় রোডে সদর কোতোয়ালি থানার পাশে একটা মোবাইলের দোকান আছে। দাহিয়া অ্যান্ড সন্স। ওখানে গিয়ে একটা চাইনিজ রেডমি স্মার্টফোন এবং এয়ারটেলের একটা প্রি-পেইড সিম কিনে নে। ওই ফোনে ডাবল সিমকার্ডের জায়গা আছে। একনম্বরে তোর পুরনো কার্ড লাগিয়ে নে, নতুনটাও অ্যাক্টিভেট করে নে। ওটা ব্যবহার করবি না। ওতে তোর ফোনে আমরা ট্র্যাকার লাগিয়ে দেব।
আমার গা সিরসির করে উঠল।
--ঠিক আছে, বাবা। আর কিছু বলবেন?
--হ্যাঁ, খাদি বস্ত্রালয় থেকে দুটো সবুজ পাঞ্জাবি কিনে নে। এবার মন দিয়ে শোন। তোর এবারে ফিল্ড থেকে ডেটা কলেকশন এগারদিনের কাজ। তুই দশম দিন থেকে জিন্সের সঙ্গে ওই সবুজ পাঞ্জাবি পরবি, রায়পুরে ফিরে আসা পর্য্যন্ত।
--স্মার্টফোনের অনেক দাম, অত টাকা আমার কাছে নেই।
---আরে নিরা মুরখ! তেরে আকল ক্যা ঘাস চরনে গয়ে? মূর্খ কোথাকার? তোর বুদ্ধিশুদ্ধি কি একেবারে লোপ পেয়েছে? ফিল্ডে ডকুমেন্টেশনের জন্য ফোটো তোলা দরকার। এভিডেন্স। তোর নোকিয়ার কম্মো নয়। তার জন্যে স্মার্টফোন চাই।
মানে এটার খরচ তোর রিসার্চ বাজেটেই ধরা থাকবে।
শোন, ভয় পাস না। কোন সমস্যা হলে সোনালীকে বলবি, আমাকে ফোন করবি না।
--ঠিক আছে, বাবা। আপনি ভাল থাকুন।
--ভয় পাস না। জানবি, আমরা তোর আশেপাশেই আছি। আবার বলছি, দশম দিন থেকে রায়পুরে ফিরে আসা পর্য্যন্ত খাদি দোকানের সবুজ পাঞ্জাবিই পরে থাকবি, ভুলে যাস না। ওইজন্যেই দুটো কিনে নিয়ে যেতে বলছি।
*******************************************************************
দশম দিবসঃ দন্তেওয়াড়া এবং গীদমের সলওয়া জুড়ুম ক্যাম্প
এবার লাটাই গোটানোর পালা।
ডেটাশীট গুছিয়ে নিয়েছি। ফিরে গিয়ে রায়পুর অফিসে সেন্টারের টেকনিক্যাল টিম আমার দেওয়া ডেটা এক্সেলের খাঁচায় ভরে তার থেকে কিছু স্ট্যাটিস্টিক্যাল প্যারামিটারের ভ্যালু বের করে আমায় দেবে। তখন আমার রিপোর্ট লেখা শুরু হবে।
কালকে শেষ দিন, সাত সকালে যেতে হবে বীজাপুর, বিকেলে সুকমা এলাকায়। দুটোই ঘোর মাওবাদী এলাকা। রাত্তির হবার আগেই ফিরে আসতে হবে দন্তেওয়াড়ায়। পরের দিন সকালে বাস ধরে সোজা রায়পুর।
আজ দুটো গ্রুপ ডিসকাশন হবার কথা। একটা দন্তেওয়াড়া থেকে দশ কিলোমিটার দূরের গাঁয়ের পঞ্চায়েত ভবনের হলে, পরেরটা সেই সলওয়া জুড়ুম ক্যাম্পে।
কিন্তু আজ যাকে হিন্দিতে বলে --প্রথম গ্রাসে মক্ষিকাপাত। মানে ভাত মেখে খেতে বসেছি , প্রথম গরাস তোলার সময়েই মাছি এসে উড়ে বসল।
হলঘরে সতরঞ্চি বিছিয়ে কাগজপত্র নিয়ে বসে আছি তো আছিই। যে কুড়িজনের আসার কথা তাদের থেকে মাত্র বারোজন এসেছে। কারণ, কাল রাত্তির থেকে অঝোর ধারে বৃষ্টি পড়ছে। বেশ কিছু গাঁ নাকি নদীনালা জলে উপচে পড়ায় দন্তেওয়াড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
ধেত্তেরি! ব্যাজার মুখ করে যে ক’জন এসেছে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করি। কাজ শেষ করতে হবে যে!
কিন্তু মহিলা সরপঞ্চটি ঘোমটা খুলেছে, মুখ খুলছে না। এককথা বারবার জিজ্ঞেস করতে করতে ধৈর্য হারাই, গলার স্বর চড়ে ।
তখন ওখানকার অ্যানিমেটর স্কুলের সমাজবিজ্ঞানের গুরুজি বললেন যে মহিলাটি নিরক্ষর, অংগুঠা ছাপ। কিস্যু জানে না।
আপনার প্রশ্নগুলো সফারি স্যুট পড়া হাসিমুখের ওই কোণের ভদ্রলোকটিকে করুন। সব উত্তর পাবেন।
লোকটি এগিয়ে এসে আমার সামনে বসল, এবং সব ইনফর্মেশন ঠিকমত দিল।
আমি বুঝভম্বুল। এটা কী করে হয়? একটা বাইরের লোক পঞ্চায়েতের এতসব কী করে জানে?
গুরুজি মুচকি হেসে বললেন—উনি যে সরপঞ্চ-পতি। মহিলাটির স্বামী। সব কাজ উনিই করেন। মহিলাটি শুধু নানান কাগজে স্বামীর কথা মেনে বূড়ো আংগুলের টিপছাপ দেন।
চলে আসার সময় দেখলাম ওই সরপঞ্চ পতি সবাইকে হুকুম দিচ্ছে – জানলাগুলো টেনেটুনে বন্ধ কর, ভেতরে জল না ঢোকে। পাখা-লাইট বন্ধ হয়েছে কিনা চেক কর, বাপস্ ।
আমি ওর কাছে জানতে চাই –এই গ্রামে একটা ইস্পাত কারখানার ভিত পুজো হবার কথা ছিল। তার কদ্দূর?
--ইস্পাত কারখানা শুরু হবে না।
--কেন?
--আমরা চাই না বলে। সরকার স্কুল খুলুক, আমরা হাত লাগিয়ে দেব। এতে আমাদের সমাজের ছেলেপুলেদের আখের ভালো হবে।
কিন্তু ইস্পাত কারখান? ওতে আমাদের কী লাভ? চাকরি পাবে বাইরের পড়িলিখি ছেলেমেয়েরা। লাভের গুড় খাবে বড় বড় কারখানার মালিক, দিল্লি বা মুম্বাইয়ে বসে।
আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা? ওরা হবে ওদের চৌকিদার অউর কামওয়ালি বাঈ । কাজেই আমরা আপত্তি করেছি।
-- ‘আমরা’ মানে?
--‘আমরা’ মানে আমরা’ । ব্যস, এখানে আমরা না চাইলে কিছু হতে পারে না।
সোনালী ইশারা করে কথা না বাড়াতে। আমরা ফটাফট সব গুছিয়ে নিয়ে সলওয়া জুড়ুম ক্যাম্পের জন্যে রওনা হয়ে যাই ।
ক্যাম্পে পৌঁছে চোখে পড়ল কাঁটাতারের প্যাঁচানো বেড়াগুলো অনেকটা বড় এলাকাকে ঘিরে রয়েছে, কোথাও ধানখেত বা মাঠের ওপর দিয়েও গেছে। ওখানে শিক্ষাকেন্দ্রে খানিকক্ষণা আলোচনার পর আমার হাই উঠতে থাকে, জ্বর আসছে বোধহয়।
সোনালীকে বলি –এসব তো নিয়মরক্ষা মাত্র, আপনিই সামলে নিন। আমি একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরে আসি।
--বেশি দূর যাবেন না যেন!
তা যাব না। গতবারের সেই গা শিরশিরানো ঘটনা এত তাড়াতাড়ি ভোলা যায় না। এছাড়া বেশ ক্লান্তি লাগছে। ভাইরাল ফিভারের রেশ এখনও রয়ে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে সলওয়া জুড়ুম ক্যাম্পের অবস্থাটা জরিপ করতে থাকি। আমার ছোটবেলার রায়পুর-মানা রিফিউজি ক্যাম্পে বাড়িগুলোর সঙ্গে খানিকটা বাগান করার জমি দেওয়া হয়েছিল। কলাগাছ, পেঁপে, পেয়ারা আর ডালিম গাছ ছিল। তবে বাড়িগুলো পুরোপুরি পাকা ছিল না।
এদের দেখছি পাকা বাড়ি, কিন্তু বড্ড ছোট, গায়ে গায়ে কুলি ব্যারাকের মত। আলাদা করে বাগান-টাগান নেই। তবু সব কৃষক পরিবার তো! এরমধ্যেই দরজার পাশের একফালি বারান্দার থেকে উঁকি মারছে পুঁই, লংকাচারা, নয়নতারা ফুল। এদের ঘরের মধ্যে পাখা নেই, জানলাগুলো ছোট, ছাদ একটু নীচু। দুয়েকজন বুড়ো আলোহাওয়ার আশায় দোরগোড়ায় বসে আছে।
জিজ্ঞেস করে জানতে পারি— ওদের নদীর ওপারে ছিল বাস্তুভিটে, অনেকখানি একফসলি জমি এবং বেশ কিছু গাছগাছালি। এখন এখানে ব্যারাক বাড়িতে দিন কাটে, ছেলে যায় সরকারি প্রকল্পে জন খাটতে।
ব্যারাকবাড়ির পাড়া ছাড়িয়ে খানিকটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল একটা লম্বা পাকা বাড়ি, সামনে দুটো ভলভো বাস দাঁড়িয়ে , বাইরে খাটিয়া পেতে গল্প করছে একজন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মানুষ। তার কাছাকাছি কালো পোষাকে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্ততঃ দশ বারোজন কম্যান্ডো, হাতে ইনশাস রাইফেল।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি, ইনি কে? কোন কেষ্টবিষ্টু?
লোকটা আমাকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়ায়, হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দেয়।
--আইয়ে, সাহাবজী। আপনিই তো আমাদের লিখাপড়ার ব্যাপারে রিসার্চ করতে এসেছেন। আমার কথাটাও শুনে নিন। আমার নাম চেতরাম অটামী।
আমি অবাক হতেও ভুলে যাই। প্রায় কয়েক বছর আগে মাওবাদীরা জিরম ঘাঁটিতে কংগ্রেস কনভয়ে হামলা করে সলওয়া জুড়ুম নেতা মহেন্দ্র কর্মা , তার ছেলে এবং বিদ্যাচরণ শুক্লা সমেত ২৭ জনকে মেরে ফেলে। তারপর থেকে মাওবাদীদের হিট লিস্টে এক নম্বর নাম -- চেতরাম অটামী, সলওয়া জুড়ুম সশস্ত্র দলের কম্যাণ্ডার। আমি না জেনে ওর ঘরের সামনে ! এখন বুঝতে পারছি, সরকার ওকে হাই সিকিউরিটি দিয়ে রেখেছে।
কেটে পড়লে হয়! আরে, আজ দশ নম্বর দিন। এদিকে আমি তো স্যারের নির্দেশ মত সবুজ পাঞ্জাবি পড়তে ভুলে গেছি। একটু বুক ঢিপ ঢিপ।
অটামী আমার হাত ধরে টেনে খাটিয়ায় ওর পাশে বসিয়ে বলে—আমার বয়ানটাও শুনে নিন। তাহলে বুঝবেন মাওবাদীরা বস্তারে শিক্ষার কত ক্ষতি করেছে। কতগুলো স্কুলবাড়ি বারুদ লাগিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে।
চা আসে। আমি কোন কথা না বলে মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকি।
-- আমি রাতের পর রাত ঘুমুতে পারতাম না, বুঝলেন? জেগে পাহারা দিতাম। ওরা আক্রমণ করত ঝড়ের মত, দেড় দু’শো গেরিলা একসঙ্গে। আসত ওই জঙ্গলের দিক থেকে মাঠ আর খেত পেরিয়ে। ওরা হয় মাঝরাতে, নয় ভোর নাগাদ।
গোড়ায় আমরা এঁটে উঠতে পারিনি। প্রাণ বাঁচাতে ওই গাছে উঠে বা শুকনো নালায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকতাম। আঠের মাস লাগল ওদের ঠেলে পেছনের দিকের জঙ্গলে সরিয়ে দিতে।
--এখন?
--এখন ওরা পালাচ্ছে। এখানে পড়াশুনো হচ্ছে, কাজকম্ম হচ্ছে। তবে তো আপনারা এসেছেন। সরকার আমায় সুরক্ষা দিয়েছে। রায়পুর গেলে মুখ্যমন্ত্রী আমার সঙ্গে দেখা করেন। এই বাসগুলো ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কিনেছি। একরকম চলে যাচ্ছে।
সন্ধ্যেবেলা ফেরার সময় সোনালী বলল—অটামীর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন? চা খাচ্ছিলেন? ভাল করেন নি। এখানে দেয়ালেরও কান আছে।
আমার জ্বরো শরীরে মেজাজ গরম হয়ে যায়।
--সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
শুনুন, কালই আমাদের শেষ দিন। পারলে কাল রাতেই রায়পুর রওনা দেব। কিন্তু যাওয়ার আগে আপনার মুখ থেকে একটা কথা জেনে নিতে চাই।
লোকেশ বিদ্রোহীকে কে বা কারা মেরেছিল?
আমার মনে হয় এর উত্তর আপনি জানেন। আমাকে বলতে আপনি বাধ্য। কারণ আপনাদের জন্যই আমার বিনাদোষে চাকরি গেছে।
সোনালী খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে—ব্যাপারটা ঠিক এককথায় বললে আপনি বুঝবেন না।
কাল আমাদের সকাল ছ’টায় বেরিয়ে পড়তে হবে। বীজাপুর প্রায় ৯০ কিলোমিটার। আসা যাওয়া ৪ ঘন্টা। মিটিং দু’ঘন্টা। আমরা ফিরে এসে এখানে লাঞ্চ করে ফের যাব সুকমায়, সে’ও ৮০ কিলোমিটার। সন্ধ্যে ছ’টা থেকে সাতটার মধ্যে আমরা দন্তেওয়াড়ায় ফিরে আসবো।
কাল আমাদের একসঙ্গে প্রায় ৮ ঘন্টা গাড়িতেই কাটবে। তখন এ'নিয়ে খোলাখুলি অনেক কথা বলা যাবে। আজ রাতে তাড়াতাড়ি ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়বেন। অ্যালার্ম দিয়ে উঠবেন।
আমি ঠিক ছ’টায় সার্কিট হাউসে গাড়ি নিয়ে হাজির হব।
(চলবে)