আগন্তুক থেমে গেছল, কিন্তু এখন হাঁটি -হাঁটি -পা -পা করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে; কারণ না এসে উপায় নেই। গাছের আড়াল থেকে কালো পোশাকে এই অন্ধকার জঙ্গলের সঙ্গে মিশে যাওয়া ছ’জন বন্দুকধারী ওর দু’পাশে। একজন পেছন থেকে পিঠে আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে ক্রমাগত সামনের দিকে ওকে ঠেলছে।
আগন্তুকের দুটো খালি হাত এখনও মাথার উপরের দিকে, তবে আগের মতন উঁচুতে নয়, বরং কনুই ভাঁজ করে মাথার পেছনে হাতের পাতা রাখা।
আগন্তুক? পুরনো চেনা কাউকে আগন্তুক বলা যায় কি?
কী জানি, কিন্তু ছোটবেলায় ক্লাস এইটে কম্পালসারি সংস্কৃতের ক্লাসে পণ্ডিত স্যার ‘আগন্তুক’ অভিধাটির একটা ডেফিনিশন শিখিয়েছিলেন। প্রথম লাইনটা মনে পড়ছে না। তবে দ্বিতীয় লাইনটা ছিল ‘অকস্মাৎ গৃহমায়াতি’, অর্থাৎ যে হঠাৎ করে আমার ঘরে হাজির হয়েছে।
সে হিসেবে গুলাব পাসোয়ানকে আগন্তুক বলা যেতেই পারে। তিনবছর আগেই ওর সঙ্গে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছল।
ও ছিল আমাদের সেন্ট্রাল কমিটি মেম্বার। বিহার-ঝারখন্ড এবং পূর্ব ছত্তিশগড়ের একটা জোনের দায়িত্ব ও নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের কাছে খবর এল যে ও নাকি গোপনে ‘বিপ্লবী একতা কেন্দ্র’ নামের উপদলটির দিকে ঝুঁকছে, হয়তো বা হাত মিলিয়েছে।
তখন ওদের সঙ্গে আমাদের পুরোদস্তুর টার্ফ ওয়ার চলছিল। কে কাকে উৎখাত করে এলাকার দখল নিতে পারে বা নিজের এলাকা কয়েক মাইল বা কয়েকটি জনপদের সীমানা অব্দি বাড়াতে পারে। সেই পড়শিদের বাগানের বেড়া এগিয়ে দিয়ে কয়েক ইঞ্চি জমি দখলের মানসিকতা।
আমার এসব একেবারেই পছন্দ নয়, কিন্তু বুঝেছিলাম বাঘের পিঠে চড়ে বসেছি, নামা বড় কঠিন।
আর ওরা ছিল একেবারে নির্দয়, কখনও কাউকে বন্দী করত না। সোজা গলা কেটে দিত, নিজেদের প্রাক্তন কমরেড হলেও। গুলাব সেন্ট্রাল কমিটির বৈঠকে ওদের সঙ্গে একসাথে কাজ করার লাইন পেশ করল। আমি বিরোধিতায় গলা চড়ালাম। মেজরিটি আমার মতে সায় দিল।
গুলাব এই হার মেনে নিতে পারে নি, ব্যক্তিগত ইস্যু তৈরি করল। কমিটিতে আমার নামে ফান্ডের টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ আনল।
স্বীকার করছি, আমি সব খরচার হিসেব ঠিকমত দিতে পারি নি। তবু যতটুকু পেরেছি গুছিয়ে হিসেব পেশ করেছি। তাতে আমাকে খুব সাহায্য করেছিল কমরেড পিউলি। ও অ্যাকাউন্টসের ব্যাপারটা ভাল বুঝত। আর আমার সততা ও ডেডিকেশন নিয়ে ওর মনে কোন খিঁচ ছিল না।
যেখানে পারি নি, সেখানে না পারার কারণ ও পরিস্থিতি ভালভাবে ব্যাখ্যা করেছি। যেমন ওই মিটিঙের আগের দু’বছরে কোবরা ব্যাটালিয়ন ও কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশের দল অতর্কিত হামলায় সাতবার আমাদের ক্যাম্প ভেঙে দিয়েছে। মারা গেছে আমাদের কিছু সাথী, পালানোর সময় নষ্ট হয়েছে কিছু হিসেবের কাগজ পত্র। বেশির ভাগ পুলিশের হাতে পড়ার ভয়ে নিজস্ব কোডে লেখা। অনেক জায়গায় যার হাতে রসদের বা শস্ত্রাগারের দায়িত্ব ছিল , যে হিসেব রাখছিল, সেই মারা গিয়েছে বা ধরা পড়েছে।
আমি আমার বক্তব্য এই বলে শেষ করেছিলাম যে কমরেডরা ভাল করে বুঝুন -- আমরা বিশেষ অবস্থায় বেঁচে আছি। প্রতিনিয়ত প্রাণ হাতে করে চলাফেরা করতে হয়। এই সময়ে সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানির মত চার আনা , দু-আনার হিসেব রাখা সম্ভব নয়। সততার পরীক্ষা শুধু টাকা-আনা-পাইয়ের হিসেব দিয়ে মাপা উচিত নয়। বড় পিকচারটা দেখতে হবে। সমগ্র লড়াইয়ে কে কী ভূমিকা পালন করছে, কে বুক চিতিয়ে বিপদের মোকাবিলা করছে আর কে ঘাঁটির মধ্যে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জীবন যাপনে বেশি সময় দিচ্ছে -এটাও দেখা দরকার।
সেন্ট্রাল কমিটির বৈঠকে তখন ১১ জন উপস্থিত ছিল। চারজন আসতে পারে নি। দু’জন জেলে, ৫ জন মারা গেছে। ৪ জন অ্যাকশনে, ১ জন ম্যালেরিয়ায়।
ভোটাভুটি এড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম, কারণ ফলাফল আন্দাজ করতে পারছিলাম। আমার বক্তব্যের বিপক্ষে ভোট দিল দু’জন, গুলাব সিং নিজে এবং নাগাপ্পা। দ্বিতীয় জন হল সেই কমরেড যে আমার আর পিউলির বিয়েতে গড়চিরৌলি আসেনি।
আমি ও নাগাপ্পা কেউ কাউকে পচ্ছন্দ করি না -এটা সবাই জানে। ও ছত্তিশগড়ের রায়পুর থেকে ইকনমিক্সে মাস্টার্স এবং ল’ পাশ করেছে। বইয়ের পোকা; কথায় কথায় মার্ক্সের এইটিন্থ ব্রুমেয়ার, গোথা প্রোগ্রাম আর মাওয়ের ইয়েনান ফোরামের লেকচার শোনায়। হেগেল, ডায়লেক্টিস এসব নিয়ে বড় বড় বুকনি দেয়।
কেন জানি ভারতের কম্যুনিস্টরা ইকনমিক্স ও আইন পাশ করা লোকদের বড্ড বেশি লাই দিয়ে মাথায় তোলে। আমার ইয়ে জ্বলে যায়।
একদিন মিটিং এর শেষে সবার সামনে জিজ্ঞেস করলাম—বলুন তো কমরেড, ডিম আগে না মুরগী আগে?
ও ভীষণ রেগে তোতলাতে শুরু করল। এই সব ছ্যাবলা প্রশ্নের মানে কী? আমাদের প্র্যাক্সিসের সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক?
রেগে যাওয়ার আরেকটা কারণ ও দেখতে পেল কমরেড পোচাম্মাও হাসছে। সেই সময় পোচাম্মা ওর পার্টনার ছিল।
একদিন দেখলাম নদীর ধারে চানের সময় পোচাম্মা ওর পিঠ সাবান দিয়ে রগড়ে দিচ্ছে। আমার হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। পোচাম্মাকে আলাদা করে বললাম—এসব তুমি নিজে থেকে করছ? নাকি নাগাপ্পা বলেছে?
পোচাম্মা অবাক। ইতস্ততঃ করে বলল—পিঠে কারও হাত ঠিকমত পৌঁছয় না তো, তাই।
--বেশ কথা, তোমার পিঠে ও সাবান ঘষে দেয়?
--তা কেন? আমি গামছা দিয়ে দু’হাত দুই মুড়ো ধরে রগড়ে নিই।
--ঠিক, নাগাপ্পাকেও কায়দাটা শিখিয়ে দিও।
এরপর নাগাপ্পা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। মিটিং এর সময় ভাববাচ্যে কথা বলত, যেন আমি উপস্থিত নেই।
গুলাব পাসোয়ান কিন্তু হাল ছাড়ে নি। সেই আর্থিক অভিযোগ আনার কিছুদিন পরে ও আর নাগাপ্পা মিলে সেন্ট্রাল কমিটির কাছে একটি দলিল পেশ করল, আলোচনার জন্য।
দলিলটার মূল বক্তব্যঃ যে যায় লংকায়, সেই হয় রাবণ। আমরা দলের ভেতরে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পদ্ধতি হিসেবে ডেমোক্র্যাটিক সেন্ট্রালিজমকে শ্রেষ্ঠ বিকল্প মনে করি। বলি-- এর চেয়ে ব্যাপক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে এই পদ্ধতির ফলে অধিকাংশ বাম পার্টিতে ক্ষমতা কিছু উপদল অথবা গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। এর কোন ক্রসচেক বা ইন-বিল্ট সেফগার্ড কিছু হতে পারে কি?
বেশির ভাগ কমরেড খেপে গেল। বলল এসব আগড়ম বাগড়ম হল কেন্দ্রীয় অথরিটি বা দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা ছড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত। এই দু’জনকে পার্টিবিরোধী কাজের জন্য বের করে দেওয়া হোক।
আমি কিন্তু ওদের সমর্থন করে বললাম— এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এ নিয়ে পার্টির সর্বস্তরে আলোচনা হওয়া উচিত।
ওরা দুজন এটা আশা করেনি। সে যাই হোক, দলিল নিয়ে আলোচনা সেন্ট্রাল কমিটির মধ্যেই শুরু এবং শেষ হয়ে গেল।
ক’দিন পরে কমরেড গুলাব জানাল যে ওর এখানে পোষাচ্ছে না, আমাদের সদস্যপদ ছেড়ে ও ‘বিপ্লবী একতা কেন্দ্র’ দলের সঙ্গে বিহার-ঝারখণ্ড অঞ্চলে কাজ করতে চায়। আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় থাকবে। ও চেষ্টা করবে যাতে আমাদের সঙ্গে ‘একতা কেন্দ্রে’র সম্পর্ক ভাল হয়। হানাহানি দুশমনি খতম হয়।
কেউ কেউ অবাক হল, অনেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আগামী সপ্তাহে ও চলে যাবে। ও চাইছে ওকে যেন ঝারখণ্ড সীমান্ত পর্য্যন্ত সেফ প্যাসেজ দেওয়া হয়।
যাবার আগের দিন রাতে ও আমার কামরায় এল।
--কাল ভোরে চলে যাচ্ছি। আমাকে নিয়ে তোদের বড্ড অসুবিধা হচ্ছিল। বিশ্বাস কর আমি গিয়ে একতা কেন্দ্র আর তোদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি আকচা-আকচি সব খতম করে দেব।
আচ্ছা, এর মধ্যেই ‘ওরা -আমরা’ ছক তৈরি? আমি এখন ওর জন্যে আর ‘আমাদের’নই, সোজা ‘তোদের”? আমার ডেরায় এখন পর্য্যন্ত মিটিং এর ‘আপনি’ ছেড়ে আগের দিনের মত ‘তুই-তোকারি’ করছে এর জন্যেই বোধহয় আমার ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
--কী করে বিশ্বাস করব বল? উড়িষ্যার সুন্দরগড়ে আমাদের দু’জন কমরেড পট্টনায়েক আর সাহু আলোচনার জন্যে ওই ‘একতা কেন্দ্রের’ ঠেকে গিয়ে খুন হয়ে গেল। বিহারের লাতেহারে ওদের শেল্টারে থাকা অবস্থায় সনহু প্রসাদ পুলিশের হাতে চড়ল। একের পর এক ঘটনা ঘটলে—
--বললাম তো, একবার আমি গিয়ে হাল ধরি, তারপর দেখিস।
--তুই গিয়ে ওদের কী হবি? পলিট ব্যুরো মেম্বার? সেই কংগ্রেসের এম এল এ’র বিজেপিতে গিয়ে মন্ত্রী হওয়ার মত?
-- শেষে তুই আমাকে একথা বললি লাল? বলতে পারলি? আজ লাইন আলাদা বলে আমাদের পুরনো বন্ধুত্বও শেষ?
আমার ভিতরে কিছু একটা ঘটে যায়। ওই ‘লাল’ ডাকটা কি ট্রিগারের কাজ করল? আমি দু’পা এগিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি। হ্যাঁ, লাল মুহম্মদ নামটা ওরই দেওয়া। কত বছর আগে যেন?
সেই যে কোলকাতায় মেডিক্যাল কলেজের পালা চুকিয়ে ছোটনাগপুর এলাকায় হোলটাইমার হয়ে গেলাম, তখন দুমকা ইউনিটের দায়িত্বে ছিল নতুন ছেলে গুলাব পাসোয়ান।
আমি থাকতাম পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের কাছের এক গ্রামে। সেখানে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। প্রচারের কাজে ওর সাহায্য নিতাম। সাঁওতালি কথ্যভাষা, নানান উপকথা, পরব, গান ওর আয়ত্বে ছিল। আর খুব ভাল ম্যাপ বানাতে পারত।
একবার ঘোর বর্ষায় পুলিশ ও জোতদারের গুণ্ডাদের তাড়া খেয়ে আমরা জোরিয়া নদী সাঁতরে পেরোচ্ছিলাম, তখন গুলাব আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিল। আমি কোলকাতার শহুরে ছেলে। কখনও পাহাড়ি নদীতে বর্ষার চোরাস্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটি নি। ভেসেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু গুলাব অঘটন ঘটতে দেয় নি। পাড়ে উঠে জামা প্যান্ট চিপে জঙ্গলের গাছের ডালে মেলে দিয়ে প্রায় আদিম পোষাকে ছিলাম।
গুলাব ভুরু কুঁচকে আমায় দেখতে দেখতে হেসে উঠল।
--তুই মুসলমান নাকি?
আমি অবাক, হঠাৎ এই কথা! জোরে জোরে মাথা নাড়ি, শ্বাস এমনিতেই ভারি হয়ে গেছল।
--তাহলে খৎনা করিয়েছিস যে! সত্যি কথা বল, লুকোস না কমরেড।
ওঃ এই ব্যাপার। মেডিক্যাল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই ধরা পড়ল আমার ফাইমোসিস আছে। পুরুষাঙ্গের মুখের চামড়া সবটা সরে না, পেচ্ছাপের সময় অসুবিধে হয়। ফুলে লাল হয়ে গেছল, খুব ব্যথা। তখন সার্জারির ফাইনাল ব্যাচের এক সিনিয়র দাদা ছোট্ট অপারেশন করে সব ঠিক করে দেয়। পাসোয়ানকে সব বললাম, ও গোল গোল চোখে সব শুনল।
একটু পরে হেসে বলল—এটা তো দারুণ! সবাই কনফ্যুশনে থাকবে –তুই হিন্দু না মুসলমান? আর কোনটা তোর আসল নাম—এই নিয়ে। এটা বিরাট অ্যাডভান্টেজ। আজ থেকে আমি তোর নাম দিলাম কমরেড লাল , কমরেড লাল মুহম্মদ।
আমি এখন মিলিটারি কমিশনের হোমরা চোমরা। ওকে বলি যে ভোর তিনটে নাগাদ রওনা হতে, তার আগে নয়। ততক্ষণে আমার নির্দেশ সবগুলো চেক পয়েন্টে পৌঁছে যাবে। ফলে ও নিরাপদে আমাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে একতা কেন্দ্রের এলাকায় পৌঁছে যেতে পারবে।
কমরেড গুলাব পাসোয়ান দলত্যাগী, কিন্তু ওকে আমি অন্যদের মত রেনেগেড ভাবতে পারছি না। আর ওদের দেওয়া ‘যে যায় লংকায়—‘ দলিলটাকে লিকুইডেশনিস্ট এইসব লেবেল এঁটে সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দেখা যাক, ও কী করে। আমি বিশ্বাস করি—ভাল কাজের ফল ভালই হয়।
ও কথা রেখেছিল। গত দু’বছরে একতা কেন্দ্র আর আমাদের দলের আর্মড স্কোয়াডের মধ্যে কোন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে নি।
কিন্তু আজ হঠাৎ কোত্থেকে হাজির হল? কী চায় ও? কী করে খবর পেল যে আমি এখানে আছি?
ওকে ভাল করে সার্চ করে একটা খোড়ো চালায় আটকে দিলাম। পাহারায় চারজন, দুটো ইনশাস রাইফেল , একটা ভল্ল, একটা রামদা’। গুলাব নির্বিকার, যেন এরকমটাই হবার কথা। থালা ভরে ভাত খেয়ে টেনে ঘুম লাগাল। সন্ধ্যেয় আমাদের কথা হবে।
প্রথমেই চারদিকের স্কাউটদের সতর্ক করে দিলাম। গুলাবের পেছন পেছন বড় পুলিশ বাহিনী আসছে কিনা কে জানে! কমরেড ভীমাকে বললাম –সেন্ট্রাল কমিটির ঠেকে না গিয়ে মণ্ডাবীর সঙ্গে বীজাপুর এলাকায় চলে গিয়ে দু’তিন দিন ঘাপটি মেরে থাকতে। আমার থেকে অল ক্লিয়ার পেলে তবে অন্য রুটে অবুঝমাড় রওনা দিতে। সেন্ট্রাল কমিটির কাছে খবর পোঁছে যাবে, সে ব্যবস্থা আমার আছে।
সন্ধ্যে বেলা। সারাদিন আমার লোকজন রেকি করেছে। না, কোথাও কোন অস্বাভাবিক ফোর্স মুভমেন্ট নেই। যা হচ্ছে তা রুটিন যেটুকু না হলেই নয়।
এবার ওই ঘরে একটা টেমি বা তেলের কুপী জ্বালিয়ে আমরা সতরঞ্চিতে মুখোমুখি বসলাম, হ্যাঁ, শুধু আমরা দু’জন।
আমার অনেক প্রশ্ন, কিন্তু আসল প্রশ্ন তিনটি।
এক, কমঃ পাসোয়ান কী করে টের পেল যে আমি এখন সুকমা এলাকায় আছি?
দুই, ও কেন বিপদ মাথায় করে এখানে এসেছে? কী চায়? কী শর্তে?
তিন, ওর প্রস্তাবে রাজি হলে কার কী লাভ?
ও মুচকি মুচকি হাসে।
--প্রথমেই বলে রাখি, আমি তোকে আমাদের দলে ভেড়াবার মতলব নিয়ে এখানে আসি নি। তোকে ভাল করে চিনি। যদিও ইদানীং তোদের একের পর এক চোট খাওয়ার খবর আমি রাখি। সংগঠন দুর্বল হয়েছে এটা তো মানবি? তারপর ভেতরে ভেতরে পুলিশের লোক ঢুকেছে। অনেক ঝাড়াই বাছাই করে আবার দাঁড় করাতে হবে।
খোঁচাগুলো নির্বিবাদে হজম করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। হ্যাঁ, ওদের সং গঠনের উপর কোন বড়সড় পুলিশি হামলা হয় নি। সাংগঠনিক ক্ষতি নামমাত্র। কিন্তু কেন হয়নি, সেটাই তো লাখটাকার প্রশ্ন।
বিপ্লবী একতা কেন্দ্রের সংগঠন বেশি আঁটোসাটো মজবুত বলে? পুলিশের ইনফিল্ট্রেশন বিশেষ হয় নি বলে? নাকি ওদের নেতারা তলে তলে পুলিশকে মদদ জোগাচ্ছে, তাই?
--ওসব বুঝলাম, কিন্তু আমি এই এলাকায় আছি সেটা কে বলল?
--আমি তোকে চিনি। তোদের বাংলা -বিহার-ঝারখণ্ড-উড়িষ্যা রিজিওনাল কমিটির সম্মেলনের কাছাকাছি আমি ছিলাম। ইনফ্যাক্ট, সম্মেলনের কিছু লজিস্টিক প্রবলেমস আমরাই সামলে দিয়েছিলাম। ওই এলাকায় আমাদের খুব পোক্ত সংগঠন রয়েছে, সেটা তো জানিস। টের পেলাম, তুই নয় তোর প্রক্সি ওখানে হাজির হয়েছিল। তারপর তোকে দু’তিনটে রুটে না পেয়ে শেষে এখানে এলাম। হ্যাঁ, খানিকটা আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া বটেই। কিন্তু ঢিল লেগে গেল।
--কী চাস?
--বিলাসপুর ডিভিশনে আমাদের সংগঠন দানা বাঁধছে, তোদের কাজকম্ম মাত্র কয়েকজন অ্যামেচারের উপর নির্ভরশীল। গ্যারান্টি চাইছি তোরা ওখানে কোন হাঙ্গামা করিস না, অন্ততঃ আগামী ছ’মাস। তাহলে পুলিশের নজর- তোদের বা আমাদের-- কারও ওপর পড়বে না।
তোদের মধ্যে পুলিশের লোক রয়েছে। আমরা জানি, প্রমাণ পেয়েছি। তোদের আনাড়িপনায় আমাদের বিপদ বাড়ছে, বুঝলি?
--কে সেই খোচর? নাম চাই।
--তোদের বিলাসপুর ইউনিটের গুরু, সেক্রেটারি সোনালি মিশ্রের বয়ফ্রেন্ড লোকেশ বিদ্রোহী। ও পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
--সোনালি জানে?
--না, কিন্তু কিছু একটা সন্দেহ করছে।
খানিকক্ষণ নীরবতা।
--তোর কথা মেনে নিলে আমাদের কী লাভ? আর তোদের ওখানে ভাল নেটওয়ার্ক রয়েছে তার প্রমাণ কী?
--দুটো প্রশ্নের একটাই উত্তর। তোদের ভেতর ওই পুলিশের খোচরটাকে সরিয়ে দেব। ঘাবড়াস না, কাজটা এমনভাবে হবে যে পুলিশের মনে হবে ওটা অ্যাকসিডেন্ট। তার চেয়েও বড় কথা পুলিশের নজর তোদের দিকে যাবে না। তখন বুঝবি আমাদের নেটওয়ার্কটা কেমন মজবুত।
কমরেড লোকেশ জাঙড়ে ওরফে ‘বিদ্রোহী’র অবিচুয়ারি লেখা হয়ে গেল।
মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করছে—যদি লোকেশ নির্দোষ হয়? যদি একতা কেন্দ্রের তদন্তে কিছু ভুল হয়ে থাকে? নাঃ , এই ডিসিশন একা নেব না।
কমঃ গুলাব পাসোয়ানকে বিদায় করার সময় বললাম, অন্ততঃ দশ দিন অপেক্ষা করতে। আমি এই সিদ্ধান্তটি সেন্ট্রাল কমিটিতে পাশ করাতে চাই, তারপর।
***************************************************************************
সৌরভ
আজ অফিসে এসেই দেখি স্যারের মেজাজ সপ্তমে চড়ে রয়েছে। উস্কোখুস্কো চুল, চোখ লালচে, ওঁর নিজস্ব রুমের টেবিলে দাবার ছক কেতরে রয়েছে। একটা উট আর একটা হাতি চেয়ারের কোণায় ছিটকে চলে গেছে। আমি গিয়ে হাতড়ে তুলে টেবিলে রাখার সময় চোখে পড়ল একটা বোড়ে টেবিলের নীচে ঢুকে গেছে। সেটাকে তুলে টেবিলে বোর্ডটা সোজা করে বিছিয়ে তারপর দুদিকের সাদা-কালো ঘুঁটীগুলো ঠিকমত সাজিয়ে দিলাম।
কিন্তু হটাৎ স্যারের হুংকারঃ স্টপ ইট!
আমি চমকে ওঠায় আবার ঘুঁটিগুলো হান্ডূল পাণ্ডুল হয়ে গেল। আমি সেসব ভুলে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম, হল কিরে বাবা! আজ কি শিবঠাকুর খেপেছেন?
একটু শ্বাস টেনে নিলাম, তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম—কী হয়েছে স্যার?
--কী হয়েছে? তুই জানিস না কী হয়েছে? এখন জানতে চাস?
স্যার এভাবে কথা বলছেন কেন? ভেরি আনলাইকলি আওয়ার বস্।
হঠাৎ ওনার গলার স্বর খাদে নেমে এল।
-তোদের দুজনকে কাঁড়ি কাঁড়ি মাইনে দিয়ে পুষছি কেন? দাবা খেলার জন্যে?
--না মানে, খুলে বলুন না কী হয়েছে?
--হবে আবার কী? তোরা হচ্ছিস ইনকম্পিটেন্ট, ফাঁকিবাজ, কাজ না করে বসে বসে খেতে চাস।
আমি সিমরনের ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকাই। ও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন স্ট্যাচু স্ট্যাচু খেলছে। নাঃ আমাকেই স্ট্যান্ড নিতে হবে। এসব ফালতু কথা এই প্রকারান্তরে আমাকে হারামখোর বলা –এসব মেনে নেব না, কোসলে স্যারের মত বস্ বললেও না।
--স্যার, যা বললেন প্রমাণ করতে পারবেন? এতদিন যদি কাজ না করে থাকি, যদি ইনকম্পিটেন্ট হই তাহলে আমাকে ইনক্রিমেন্ট দিচ্ছেন কেন? বাড়ি পাঠিয়ে দিলেই পারেন!
--ঠিকই বলেছিস, তোদের মাইনে বাড়িয়ে মহা ভুল করেছি। ভেবেছিলাম তোদের কোয়ালিটি বাড়বে, কাজের প্রত অ্যাটিচুড বদলে যাবে। কোথায় কী! ঠিক আছে, ভুল শুধরে নিচ্ছি। এই লিফাফাটা ধর। এই ভাঙা মাসের পুরো মাইনে আর একমাসের নোটিস পে। আমি আর তোদের বসিয়ে খাওয়াতে পারব না।
আমার শ্বাস আটকে যাচ্ছে, কানে আগুনের হলকা। গলা ধরে আসে। বোধহয় ‘ওয়াচ অ্যাণ্ড সিকিউরিটিজ’ ফার্মকে ভালোবেসেছিলাম। না, শুধু আমার জীবনের প্রথম চাকরি বলে নয়, কাজটাই খুব ভালো লাগছিল। নিজেকে লাকি ভাবছিলাম।
--যাচ্ছি স্যার। কিন্তু বলবেন কি হঠাৎ কী ভুল করে বসেছি?
--গত সপ্তাহের শেষে সোনালী মিশ্রের সঙ্গে কথা বলতে তোদের পাঠিয়েছিলাম। এটাও জানতে চাইছিলাম আর কতদিন পুলিশ প্রটেকশনের দরকার?
--হ্যাঁ স্যার। আমি ও সিমরন গেছলাম তো! সোনালী বাড়িতে ছিল না। ওর মা বললেন ও কলেজ থেকে একটা ফিল্ড স্টাডি করতে গেছে , কবে ফিরবে বলে যায়নি। ওর মা শকুন্তলা দেবীর সেদিনের স্টেটমেন্টের অ্যাবস্ট্রাক্ট জমা করেছি। বলেছি সোনালী ফিরে এলে আমাদের ফোন করতে, জরুরি কিছু কথা বলার আছে।
--আচ্ছা, কোন শহরে ওই স্টাডি করতে গেছে? টপিক কী? নাকি সেটা জিজ্ঞেস করিসনি?
--কেন করব না? মহারাষ্ট্রের অমরাবতী। বিষয়ঃ ওই এলাকায় দুটো ব্লকে আঙুর আর কললেবুর চাষীদের গত দুবছরের আর্থিক অবস্থার খতিয়ান।
--ওই লিফাফা তুলে নে আর বাড়ি যা। যত্তসব!
আমি স্যারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। যেন ট্রিগোনোমেট্রির অংক বোঝার চেষ্টা করছি।
-- সিমরন অন্ততঃ কম্পিউটারের কাজগুলো ঠিকমত করছে, ওটাই ওর বেসিক কাজ। কিন্তু তুই? একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারতি যে অমরাবতী কেন, এ মাসে ওর কলেজ থেকে কোথাও ফিল্ড স্টাডি করতে কাউকেই পাঠানো হয়নি।
রাত্তির এগারটা হবে। টের পেলাম দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বিরক্ত মুখে দরজাটা খুলে অবাক। চৌকাঠে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কোসলে স্যার। বোবা একটা অবোধ রাগ মাথায় চনমনিয়ে উঠল।
--কী রে! বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি? ভেতরে ঢুকতে দিবি না?
(চলবে)