৪
ঠিক দু’দিন পর
‘ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারে ঢিল,
চিল কয়-ঢিল নয়, শিল, শিল, শিল’!
সিমরনের কথা
কিছু একটা হয়েছে বা ঘটতে চলেছে। কোসলে স্যার গত ক’দিন ধরে একটু অস্থির। কালকে আবার সন্ধ্যে সাতটা থেকে অফিসের পেছনভাগের ছোট্ট কামরায় দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে বসেছিলেন। একা একাই খেলছিলেন আর বিড়বিড় করছিলেন। আটটা নাগাদ আমাদের অফিস বন্ধ করতে বললেন। কিন্তু উনি নাকি রাতটা অফিসেই কাটাবেন। পাঞ্জাবী হোটেল থেকে রুটি তড়কা ডাল আনিয়ে নিলেন।
ওনার টেনশন খানিকটা বুঝতে পারছি—দুটো কেসের কোনটাই এক পাও এগোয় নি। আমাদের নিজেদের যে কেস, মানে সোনালী মিশ্রের কমপ্লেইন, সেটারও ল্যাজামুড়ো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। লোকেশ জাঙড়ের মৃত্যুর রহস্যের ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি। এরপর রইল আগের কেসটা, ওটা ঠিক আমাদের নয় বটে, কিন্তু আমরা জানি ডি আই জি শ্রীবাস্তব এই কেসটায় স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করছেন, বেশ গুরুত্ব দিয়েই। কারণ, ইন্টেলিজেন্সের পাক্কা খবর থাকা সত্ত্বেও মাওবাদী নেতা বিক্রমকে ধরা যায় নি। প্রশ্ন উঠছে ও কি ফাঁদ পাতার ডিটেইলস্ কোন ভাবে আন্দাজ করতে পেরেছিল? কীভাবে বেড়াজাল গলে বেরিয়ে গেল?
আজ উনি এসেই ওঁর চেম্বারে আমাদের দু’জনকে ডেকে নিলেন। জানি, এবার একটানা ওঁর থিওরি শুনতে হবে। আর মাঝে মাঝে আচমকা ক্রস কোশ্চেন করে দেখবেন আমরা মন দিয়ে শুনছি নাকি চোখ খুলে ঘুমুচ্ছি।
আজ আমি মিটিং এর গোড়ায় কোসলে স্যারকে একটু মজা করে বলেছিলাম—ফালতু দশটা টাকা একটা বেওয়ারিশ লাশের পেছনে গচ্চা দিলেন। আবার আপনাকে রেলওয়ে পুলিশের কম্যান্ড্যান্ট নাকি বলেছেন সেদিন কোন বেওয়ারিশ লাশের খবর তাঁর কাছে নেই?
এসব ব্যান্টার আমাদের অফিসে চলে। এখানে কাজের আবহাওয়া সরকারি অফিসের মত গুমোটধরা নয়। এর আগেও অনেকবার ওনাকে একটু আধটু চিমটি কেটেছি। উনি নিজে মনে করেন এতে বন্ডিং গড়ে ওঠে, টিম স্পিরিট ভালো হয়। কিন্তু আজকে কেন যে অমন খেঁকিয়ে উঠলেন কিচ্ছু বুঝলাম না। তখন থেকে স্যারকে একটু এড়িয়ে চলছি। সামনে পড়লে একদম ফর্ম্যাল বিহেভিয়ার।
কাম সে কাম মতলব রখখো, সিমরন! হাজার হোক, উনি হলেন তোমার বস্, তুমি এখানে একজন সাধারণ ডেটা এন্ট্রি ও ট্যালিতে হিসাব কিতাব রখনেওয়ালি অ্যাসিসিট্যান্ট মাত্র। হ্যাঁ, কখনও কখনও বিশেষ ধরণের দরকার পড়লে-- যেমন কোন মেয়ের স্টেটমেন্ট নেওয়া— আমার ডাক পড়ে বটে, তখন আমার কদর বাড়ে। সেই সময় ওই বাঙালি অ্যাসিস্ট্যান্ট সৌরভের মুখটা এতটুকু হয়ে যায়।
আচ্ছা, ছেলেটা কি একটা মেয়ে একটু ক্রেডিট পায় সেটা সহ্য করতে পারে না? সমস্ত ফুটেজ নিজেই খাবে?
মানছি, কয়েকটা কেসে ওর একটু নাম হয়েছে। স্যার না থাকলে ক্লায়েন্টরা ওর সঙ্গেই যোগাযযোগ করে, আমাকে বোধহয় ক্লার্ক বা অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না। কিন্তু আমি যদি ওর মত সুযোগ পেতাম? কে বলতে পারে?
কাল বিকেলে ও ভাল ঝাড় খেয়েছে স্যারের কাছে।
এদিকে সোনালী আর পারমিন্দরের চোখে নিজেকে খুব হিরো করে দেখাচ্ছিল। আর রোজ সকালে জগিং এবং পার্কে বসে গুলছররে ওড়ানো? ওটা অনেক পাবলিকের চোখে একটু --। তা গত সপ্তাহে পারমিন্দরের দাদা কড়কে দেওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছিল। হিরো একেবারে ভয় পেয়ে জিরো!
কিন্তু কাল সকালে নাকি পারমিন্দর ওর ঘরে গিয়ে বলে এসেছে ভাইয়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে আগের মত চালিয়ে যেতে! ও তো অ্যাডাল্ট! মাথার উপরে মা -বাবা রয়েছেন। বাড়িঘর ব্যাংক ব্যালান্স সব কিছুতেই ভাইবোনের সমান হিস্যে।
এইসব আগড়ম বাগড়ম সাত সতেরো শুনতে শুনতে স্যারের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটল। ওকে খুব ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলেন—তুই কি ইনভেস্টিগেশন করতে গেছিস নাকি বিয়ের সম্বন্ধ করতে? নইলে এসব কি গল্প শোনাচ্ছিস?
সৌরভ চুপ, কিন্তু ওর নাকের পাটা ফুলে উঠেছিল।
ঝাড় খেয়ে আমি মিটিং থেকে উঠে কফি বানাতে গেলাম আর দামলেকে বললাম আনন্দ সুইটস থেকে পকোড়া নিয়ে আসতে।
নাস্তা নিয়ে ফিরে এসে দেখি স্যারের পারা একটু নেমেছে।
আমাকে বললেন—বসে পড়, আর মন দিয়ে নোটস নাও। যেটুকু মিস করেছ সেগুলো আবার ব্রিফ করছি। মার্চ মাসের সেই ফেটফুল রাত্তিরে কোনীর কাছে যে মারুতি ভ্যান অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তাতে ড্রাইভার ছেলেটি সিরিয়াসলি ইঞ্জিওর্ড ছিল, অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু জ্ঞান আর ফেরেনি। ফলে পুলিশের পক্ষে কোন স্টেটমেন্ট নেওয়া সম্ভব হয় নি। গাড়িতে কোন কাগজপত্তর না পাওয়ায় তখন আইডেন্টিফিকেশন সম্ভব হয়নি।
আর টি ও অফিস থেকে গাড়ির নম্বর দিয়ে খোঁজ করায় জানা গেল নেমপ্লেটের নম্বরটি ফেক। কিন্তু গাড়ির চেসিস নম্বর থেকে ফ্যাক্টরিতে খোঁজ-পাত্তা করে যা জানা গেছে সেটা হল—গাড়িটি সেই ঘটনার সাতদিন আগে রায়পুরের কাছের সিলিয়ারি স্টেশন থেকে চুরি যায়। আর ছেলেটি হল বয়েস চব্বিশের কৃষ্ণকুমার বা কিস্টাইয়া। ওদিকের উরকুরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টের একটি তেলুগু পরিবারের বেকার ছেলে। কিন্তু ফুরনে ড্রাইভারের কাজ করে। দু’একটা ছিঁচকে চুরি বা ছোটখাট অপরাধের জন্য ওর নাম স্থানীয় পুলিশের খাতায় উঠেছিল। তবে জেলে যেতে হয়নি।
চিন্তার ব্যাপার হল দুটোঃ এক, ওই অ্যাক্সিডেন্টের পর গাড়িটার ফরেন্সিক রিপোর্ট এসেছে এবং মৃতের পোস্ট মর্টেম রিপোর্টও। এগুলো পুলিশ বিভাগকে এবং আমাকেও চিন্তায় ফেলেছে।
--কেন স্যার?
স্যার এবার ক্লাসরুমে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে অভিজ্ঞ অধ্যাপকের জ্ঞানমুদ্রায় বিরাজমান। আমাদের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু পজ নিলেন। আচ্ছা, লোকটার কি একটু নাটুকেপনা, একটু মেলোড্রামা পছন্দ?
--শোন, ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে গাড়িটার অ্যাকসিডেন্ট হয়নি। মানে ড্রাইভার যদি মদ খেয়ে কন্ট্রোল হারিয়ে স্লিপ কেটে গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা মারত, তাহলে অনেক বড় ইম্প্যাক্ট হত। সেটা দেখা যেত দু’জায়গায়—গাছের গুঁড়ির গায়ে এবং গাড়ির বনেটে। গাছের ছাল অনেকটা উঠে যেত, মারুতি ভ্যানের বনেটের সামনেটা যেত তেবড়ে। এবং মারুতি ভ্যানের ডিজাইনটা লক্ষ কর, একেবারে নাক-চ্যাপ্টা চেহারা। ফলে সোজা ইঞ্জিনের উপর চোট পড়ত। রেডিয়েটর, অয়েল সীল, পাইপ সব ড্যামেজ হত। উইন্ডশীল্ডের কাঁচ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ড্রাইভারের মুখে লাগত। আর আগের মডেলে কোন এয়ারব্যাগ থাকত না। ফলে স্টিয়ারিং সম্ভবতঃ ড্রাইভার ছেলেটির পেটে ঢুকে যেত।
কিন্তু রিপোর্টে কী পাচ্ছি?
এক, গাড়ির গায়ে ছাল ওঠেনি, সামান্য স্ক্র্যাচ দেখা গেছে। উইন্ডশীল্ডের কাঁচে মাকড়সার জালের মত ক্র্যাক, কিন্তু ভাঙেনি। বনেটের সামনেটা সামান্য পিচকে গেছে, তবে রেডিয়েটর ও অয়েল সিল অক্ষত। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – ড্রাইভারের মুখে বা পেটে কোন বড়সড় চোট নেই। কেন?
--কী বলছেন স্যার, সৌরভ যে বলেছিল ওর কানের পাশ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, মাথায় চোট!
--পুরোটা হল-- মুখে বা মাথার সামনের দিকে কোন চোট নেই। মাথার পিছনে মানে খুলির পেছন দিকে চোট রয়েছে।
--স্যার, সেটা কি ইম্প্যাক্টের ফল নয়?
--তাহলে আগে গাড়ির বনেটে এবং ড্রাইভারের মুখে এবং স্টিয়ারিঙয়ে চোট হত। স্টিয়ারিং প্রায় অবিকৃত। তোর কি মনে হয় সৌরভ?
এবার আমি চুপসে যাই, কিন্তু ফুটেজ কেড়ে নেয়ার শেষ চেষ্টা করি।
--স্যার, আমার মনে হয় ছেলেটা পুরো মাতাল ছিল না, শেষ মুহুর্তে ব্রেক মেরে সামলানোর চেষ্টা করেছিল। তাই ইম্প্যাক্ট কম।
-- গুড অ্যাটেম্পট সিমরন, তোর হবে। কিন্তু তোর কথা সত্যি হলে ওর চোট হত মাইনর, এমন অজ্ঞান হত না যে আর ফিরলই না, এর কী ব্যাখ্যা?
আমি আবার নন-স্ট্রাইকার এন্ডে। জানি, এসব টেকনিক্যাল ব্যাপারে স্যারের সামনে মুখ খুললে কী হয়! কিন্তু যাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে সে চুপ কেন? সবজান্তা বাঙালীরও কি এটা আউট অফ কোর্স? আমার কি ওর জন্যে একটু খারাপ লাগছে? ধ্যেৎ, আমার কেন খারাপ লাগবে?
--স্যার, টায়ারের ব্যাপারে ফরেনসিক রিপোর্টে কিছু নেই?
এটা আবার কী কথা হল? ও কি কথা ঘোরাতে চাইছে? কিন্তু এতে কি ভবি ভুলবে?
আরে, স্যারের চোখ যে হাসছে!
--ঠিক ধরেছিস। টায়ার দেখে মনে হচ্ছে না জোরে ব্রেক মারা হয়েছে বা স্কিড করেছে। ঘাসের ওপর যা দাগ তাতে মনে হচ্ছে গাড়ি আরামসে রোল করে গাছে হালকা ধাক্কা মেরেছে। রিপোর্ট বলছে তার মানে—
-- তার মানে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ ছিল; নিউট্রাল গিয়ার। একাধিক লোক ঠেলে গাড়িটাকে ঢালের দিকে নিয়ে গড়িয়ে দিয়েছে?
--সাবাশ! বেটা সাবাশ! ঠিক এটাই রিপোর্টের কনজেকচার।
দ্যাখ কান্ড, আমি আবার এর জন্যে দুঃখ দুঃখ ফীল করছিলাম। তবু জিজ্ঞেস করিঃ স্যার, তাই যদি হয় তো তেলুগু কিস্টাইয়া মারা গেল কী করে?
--হ্যাঁ, এই একটা জায়গায় ধন্দ থেকে যাচ্ছে। ঠিক আছে, ভিসেরা রিপোর্ট আসতে দে, তখন জানা যাবে। হয়ত আজ রাত্তিরেই এসে যাবে।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আপাততঃ আর কিছু করার নেই।
--স্যার, অন্য কারণটি?
--মানে?
--না মানে আপনি বলছিলেন না যে দুটো কারণ আপনাদের ভাবাচ্ছে। দ্বিতীয়টির কথা এখনও বলেন নি তো!
কী যা তা! দুটোর কথাই তো হয়ে গেল। দুটো রিপোর্ট-- ফরেনসিক আর পোস্ট মর্টেম।
--‘ও আচ্ছা, ওটা নিয়ে এক্ষুণি কিছু বলতে চাইছিলাম না। ঠিক আছে, বলছি। সিলিয়ারি পুলিশ স্টেশন থেকে রিপোর্ট এসেছে যে কিস্টাইয়া বা কৃষ্ণকুমার ছিল আগের থানেদার গণেশরামের খবরি, মানে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ওদিকের অপরাধজগতের খবরাখবর পুলিশকে এনে দিত। এখন সে কীভাবে বিলাসপুরের কাছে অরপা নদীর পাড়ে একটা চোরাই গাড়ির মধ্যে সন্দেহজনক ভাবে চোট খেয়ে পড়ে ছিল আর হাসপাতালে মারা গেল- সেটাই সবাইকে ভাবাচ্ছে। ভিসেরা রিপোর্ট আসা অবধি অপেক্ষা করতেই হবে’।
এই খালি সময়টায় সত্যিই কিছু করার নেই? কথায় বলে না—‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। তাহলে এই সময়টা যদি আমরা ডেভিলস্ অ্যাডভোকেট হয়ে যাই তো কেমন হয়? হঠাৎ আমার মাথায় টিউবলাইট জ্বলে ওঠে।
--স্যার, রেগে যাবেন না। একটা আইডিয়া এসেছে। এই সময়টা আমরা তিনজনে যদি একটা গেম খেলি? না, না; আপনার ওই চেস খেলার কথা বলছি না। ধরুন, যদি আমরা এক এক করে এই ঘটনাগুলো আর এখন অব্দি যা এভিডেন্স পাওয়া গেছে তা নিয়ে বিভিন্ন অল্টারনেটিভ হাইপোথেসিস খাড়া করি আর বাকিরা তার যুক্তির মধ্যে ফাঁক-ফোকর খুঁজে বার করি?
স্যারের চোখ হাসছে।
--গুড আইডিয়া ! কিন্তু আমি হব আম্পায়ার বা প্রফেসর। খেলবি তোরা দু’জন। মাথা খাটিয়ে বার কর কিছু, অপনী অপনী কল্পনাশক্তিকো খুলা ছোড় দো! হতে পারে তাতে কিছু হাস্যকর উদ্ভট থিওরি বেরোবে। কিন্তু কে বলতে পারে যা আজ উদ্ভট মনে হচ্ছে তাই কাল দুটো নতুন এভিডেন্স পেলে সবচেয়ে ক্রেডিবল থিওরি হয়ে উঠবে না? লেগে পড় কোমর বেঁধে!
প্রথমে তুই সিমরন। আগে বল তোর চোখে কী কী ফ্যাক্ট সামনে এসেছে, সে যত তুচ্ছই হোক। তারপরে বল তোর ব্যাখ্যা। আমরা দেখব কোন কোন লিংক সত্যিই মিসিং।
এই রে! একবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি। না, স্যার বা সৌরভ কেউ হাসছে না। সবার চোখ জ্বলজ্বল করছে কোন প্রত্যাশায়, একাগ্র হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাৎ খেয়াল হয়, এরা বোধহয় খুব ক্লান্ত, বেরেফট অফ এনি নিউ আইডিয়া। তাই এত সদয় । কিন্তু আমার কপালে ঘাম জমছে। এক গেলাস জল খেয়ে বাহে গুরুর নাম নিয়ে শুরু করলাম।
--ঘটনা হল দুটো, না না তিনটে।
এক, পুলিশের সযত্নে পাতা জাল কেটে মাওবাদী বিক্রমের বেরিয়ে যাওয়া।
দুই, কিস্টাইয়ার রহস্যজনক মৃত্যু।
তিন, কবি অ্যাক্টিভিস্ট লোকেশ ‘বিদ্রোহী’র আত্মহত্যা বা মৃত্যু ।
একটা একটা করে ভাবা যাক।
প্রথমে বিক্রমের কেসটা। কী করে জাল ছিঁড়ল ? দুটো সম্ভাবনা। হয় কেউ ভেতর থেকে ওকে পুলিশের ব্লু প্রিন্ট আগাম জানিয়ে দিচ্ছে; নয় ও জাল কেটে বেরোয় নি। এইখানে জাল ঘেরা এলাকায় , মানে ছত্তিশগড়ের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে আছে। অপেক্ষা করছে কখন পুলিশ হতাশ হয়ে জালটা গুটিয়ে নেয়।
--গ্রেট সিমরন, সিমপ্লি গ্রেট। হোয়াট ক্ল্যারিটি? কোই সওয়াল?
সৌরভ গলা খাঁকারি দেয়। দেবে যে সেটা জানতাম। সব কিছুতে কাঠি করার স্বভাব।
--প্রথম সম্ভাবনার কথা আপাততঃ শিকেয় তুলে রেখে দ্বিতীয় বিকল্পের কথা ভাবা যাক। বিক্রম ছত্তিশগড়ে থাকলে কোথায় থাকবে? রায়পুরে? ভিলাইয়ে?
আমি অস্বস্তি লুকোতে পারিনা। বলি-সেটা আমি কি করে বলব?
স্যার আমার পক্ষে দাঁড়ালেন।
--আমার মনে হয় ও বেশি নড়াচড়া করবে না। কারণ চারদিকে এমন কড়াকড়ি এত সব খবরি যে ও নড়াচড়া করলেই কারও না কারও চোখে পড়বে। তাই আমার অনুমান ও লুকিয়েছে বিলাসপুরেই। সম্ভবতঃ ঘর থেকে বেরোয় না। কেউ না কেউ খাবার এনে দেয়।
দুই নম্বর কেস, অর্থাৎ বিদ্রোহী কবি লোকেশ জাঙ্গড়ে।
কেসটা যে সম্ভবতঃ সুইসাইড নয় তা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমার চোখে সন্দেহের সবচেয়ে বড় কারণ হল যে ভাবে সুইসাইড হয়েছে, যাকে আপনি বলেন মোডাস অপারেন্ডাই। ধরুন, আপনি একজন আমাদের জেনারেশনের ছেলে। সেন্টিমেন্টাল, ইমোশনাল এবং টেম্পারেমেন্টাল।
(এইটুকু বলামাত্র সৌরভের মুখ থেকে একটা চাপাগলায় ‘উফ্’ শোনা গেল। স্যার যেন শুনেও শোনেন নি। কিন্তু আমার ফ্লো কেটে গেল। স্যারের দিকে তাকালাম, উনি ইশারায় বললেন চালিয়ে
যেতে।)
আপনি কোন কারণে উত্তেজিত এবং মনে ব্যথা পেয়েছেন। সেটা এমন যে আপনি জীবন শেষ করে দিতে চান। আপনি কী করবেন? অনেক সম্ভাবনা। সবচেয়ে সহজ যেটা তা হল রাত্তিরে একগাদা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়া। সেন্টিমেন্টাল মানুষ ঘা খেলে তার আঘাত গোপন করবে। গুমরে গুমরে থেকে একটা চরম মুহুর্তে হাতের শিরা কাটবে বা ঘুমের বড়ি খাবে অথবা সিলিং থেকে ফাঁস লাগিয়ে লটকে পড়বে। কখন করবে? সাধারণতঃ রাত্তির বেলায়, যখন চারদিক শুনশান। কেউ নেই বাধা দেবার। কেউ এসে আচমকা কড়া নাড়বে না।
তা না করে লোকেশ ভর সকালে সুইসাইড করার জন্যে একগাদা লোকজনের মাঝখান দিয়ে একটি টাওয়ারের পাঁচতলায় উঠে ঝাঁপ দিল? জরুর দাল মেঁ কুছ কালা হ্যায়। ওই ফ্লোরের সবকটা ফ্ল্যাটে সেই সময় যারা ছিল এবং সেই টাওয়ারের সিকিউরিটি গার্ডদের ভাল করে জেরা করা দরকার।
--ক্যা বাৎ সিমরন! আজ তো ফাটিয়ে দিলি রে! কী রে সৌরভ , তুই কী বলিস?
সৌরভ মুচকি হাসে। স্যার, আপনি আরেকজন কম্পিটেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট পেয়ে গেছেন, থুড়ি তৈরি করে ফেলেছেন। মেরা বিনম্র নিবেদন হ্যায় কি আগামী মাস থেকে সিমরনের মাইনে বাড়িয়ে দিন।
(সত্যনাশ ! শালে বাঙালী আমাকে তারিফ করার অছিলায় ভাল বাম্বু দিচ্ছে। ও ভাল করেই জানে যে মাইনে, পে স্কেল, অ্যালাউন্স, প্রমোশন এসব শব্দ শুনলেই স্যারের মেজাজ খাপ্পা হয়।)
কিন্তু স্যারের খুব একটা হেলদোল নেই। খালি বললেন—হবে , হবে সব হবে। আগে তিন নম্বর কেস নিয়ে ওর থিওরিটা শুনে নিই।
--হ্যাঁ স্যার, কিন্তু সিমরন তো তিন নম্বর কেস , মানে লোকেশ বিদ্রোহীর সুইসাইড কেসটাকেই দুই নম্বর বলে চালিয়ে দিল। আসল দু’নম্বর কেস হল নদীর ধারে গাড়িতে কিস্টাইয়া ড্রাইভারের রহস্যজনক মৃত্যুর ব্যাপারটা। সেটা নিয়ে বোধহয় ওর কোন থিওরি নেই!
--ফালতু কাঠি করিস না তো! আমিই তো বলেছি যে ভিসেরা রিপোর্ট আসা অব্দি অপেক্ষা করতে।
মৃত্যুর সঠিক কারণ জানলে তবে তো কে , কেন এবং কীভাবে—সাসপেক্ট, মোডাস অপারেন্ডাই ও মোটিভ নিয়ে থিওরি খাড়া করা যাবে।
সৌরভ হাল ছাড়ে না।
--কিন্তু স্যার আপনি যে বলেছিলেন-- উদ্ভট লাগামছাড়া কল্পনাশক্তি? সেটা কি—
ওর কথা শেষ হল না। বাইরের বারান্দা থেকে একটা কথা কাটাকাটির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আমরা সবাই বকের মত গলা বাড়িয়ে সেদিকে তাকাচ্ছি, স্যারের ভুরু কুঁচকে উঠেছে। এমন সময় আমাদের অফিসের ম্যান ফ্রাইডে জগন্নাথ দামলে প্রায় দৌড়ে চেম্বারে ঢুকল।
--স্যার, পুলিশ এসেছে। সৌরভ স্যারকে চাইছে।
ওর কথা শেষ হতে না হতেই একজন হাবিলদার ও দুই কনস্টেবল ওকে ঠেলে আমাদের চেম্বারে ঢুকে পড়ল। পেছন পেছন এল জনা চারেকের একটি দল, তাদের থেকে হাট্টাকাট্টা একজন এগিয়ে এসে সৌরভের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল—হাবিলদার সাব, এহী হ্যায় ও বদমাশ! উসকো তুরন্ত হ্যান্ডকাফ লগাকে থানে লে চলিয়ে।
আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। কিছু ভাবতে পারছি না। সৌরভের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছে না। কয়েক সেকেন্ড।
এর মধ্যে কোসলে স্যার নিজেকে সামলে নিয়ে নিজের মূর্তি ধরেছেন। সৌরভকে পেছনে ঠেলে পুলিশের লোকটার সামনে এগিয়ে এসে বললেন—ক্যা বাত হ্যায়? তুম কোন হো?
--হাবিলদার নওল সিং চৌহান, থানা তারবাহার। মামলা গম্ভীর হ্যায়। এই সজ্জন আজ থানায় এসে নালিশ করেছেন যে ওঁর ছোট বোন কাল সন্ধের পর বাড়ি ফেরেনি।
--কে ওনার নিখোঁজ বোন?
--নামটা হল পারমিন্দর কৌর। (চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।