৫
‘দেখা না দেখায় মেশা’
ঠিক এক সপ্তাহ পর
সৌরভ
কী আর বলব! এমনটা যে হতে পারে স্বপ্নেও ভাবি নি।
আজ আমাকে বিলাসপুর আই জির জুরিসডিকশন থেকে পালিয়ে রায়পুরের মানা ক্যাম্পে ঘাপটি মেরে থাকতে হচ্ছে! পাতি অপরাধীর মতন! এটা মেনে নিতে বড় কষ্ট হচ্ছে। আফশোসের কথা, এসব হচ্ছে বসের নির্দেশ মেনে। উনি নিজে ছ’দিন আগে রাত্তির বেলায় একটা গাড়ি ভাড়া করে আমাকে রায়পুর শহরের বাইরে মানা রিফিউজি ক্যাম্পে , মানে আমার পৈতৃক—কী যেন বলে—ভদ্রাসনে পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করেছেন। আবার কাটাঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে বলেছেন যে এই ছ’দিন আমার জমিয়ে রাখা ছুটি থেকে কাটা যাবে এবং গাড়ি ও ড্রাইভারের ভাড়া দুটো কিস্তিতে আমার মাইনে থেকে আদায় করা হবে। কেননা, এসব নাকি হয়েছে আমার দোষে।
সাত দিন আগে মেয়েটার দাদা এসে আমাদের অফিসে পুলিশ এনে ভাল তামাসা খাড়া করেছিল। সেটা স্যার তাঁর ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সামলে দিয়েছিলেন।
পরের দিন আমরা তিনজন আগের প্ল্যান অনুযায়ী অফিসে বসে ব্রেইন স্টর্মিং করছিলাম। সিমরনের আইডিয়াটা মন্দ ছিল না। তবে আগের দিনই ওর আইডিয়া শেষ হয়ে গেছল।
আমার পালা আসতেই আমি হামলে পড়লাম দ্বিতীয় সমস্যাটি নিয়ে। পোস্ট মর্টেমে দেখা যাচ্ছে কিস্টাইয়ার মৃত্যুর আসল কারণ গাছে ধাক্কা খাওয়া নয়, বরং মাথার পেছনের চোট—যাতে বাইরে রক্ত চাপ বেঁধে গেলেও ভেতরে হেমারেজ হচ্ছিল। সেটা বন্ধ করা ওই হাসপাতালের সাধ্যের বাইরে।
হতে পারে ও একটা ছিঁচকে চোর, চোরাই গাড়ির ধান্দায় যুক্ত এবং পুলিশের খোচর। তবু ওর জন্য আরএকটু ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেত না?
স্যারের বক্তব্য –তার মানে ১২০ কিলোমিটার দূরে রায়পুরে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু ওর হালত এমন নাজুক ছিল যে ডাক্তাররা ওকে বেড থেকে ট্রান্সফার করতে রাজি হন নি। আর তখন তো ও একটা রোডসাইড অ্যাকসিডেন্ট মাত্র। গাড়িতে ওর কোন কাগজপত্র বা ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়নি। আইডেন্টিফিকেশন হয়নি। ও যে পুলিশের খবরি সেটা জানা গেছে ওর মৃত্যুর পরে। ব্যাড লাক!
যাই হোক, আমার মনে পড়ে সেই কালো রাত যখন ও জেরিকেন ও ফানেল এনে হাসিমুখে আমাদের গাড়িতে পাঁচ লিটার তেল ভরে দিয়েছিল এবং লজ্জা লজ্জা হেসে টাকা নিতে রিফিউজ করেছিল।
এরপর আমরা মূল আলোচনায় ডুবে গেলাম।
আমার হাইপোথেসিসগুলো ছিল এ’রকম।
এক, বিক্রমের গতিবিধির খবর পুলিশকে কে জোগাচ্ছিল? যেই হক, তার নিশ্চয় বিক্রমের চেইনের সঙ্গে লিংক ছিল। নইলে ওরা বিক্রমের মুভমেন্ট জানবে কী করে? আর এই লিংকটাই ভাল করে চেক করা দরকার। বিলাসপুর পুলিশের অফিসে কারও বিক্রমের নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগ আছে বলে মনে হয় না।
--শ্রীমানজী, তোমার এবম্বিধ অনুমানের কারণ?
--স্যার, বিক্রমের যত অ্যাক্টিভিটি সবই মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি ও বস্তারের বীজাপুর এলাকায়। বিলাসপুরে এমনিতেই কোন মাওবাদী কার্যকলাপ নেই। যতদূর জানি, গত দু’দশকে একটা ভুল বানানে হাতে লেখা পোস্টারও দেখা যায়নি।
--কী ধরনের পোস্টার?
--এই ধরুন, হিন্দিতে লেখা ‘কমঃ চারু মজুমদার অমর রহে! বা ‘জাহাঁ পে অত্যাচার, ওহাঁ পে প্রতিরোধ'! দেখছেন না, জহাঁ কে জাহাঁ আর খামোখা একটা ‘পে’ জুড়ে দেওয়া। বোঝাই যাচ্ছে কোন বাঙালী লিখেছে, যার হিন্দিটা তেমন সড়গড় নয়।
--তুই এসব কোথায় দেখলি? এত মন দিয়ে? নিজেই লিখতিস না তো!
সিমরন ফিকফিকিয়ে হাসে। আমি ব্যাজার মুখে জানাই যে এসব পোস্টার দু’দশক আগে স্কুলে পড়ার সময় মানা ক্যাম্পের পঞ্চায়েত ও স্কুলবাড়ির দেয়ালে দেখতাম।
--যাকগে স্যার, যেটা বলছিলাম। বিক্রমের গড়চিরৌলি থেকে ওড়িষ্যা হয়ে ছত্তিশগড়ে ঢোকার খবর কোন চেনে এসেছিল? আর সেই যে ওর তিনটে গাড়ির কাফিলার টিপস?
কোসলে স্যারের চেহারা গম্ভীর হয়ে যায়।
--তুই জানিস তুই কী বলছিস? প্রকারান্তরে সেন্ট্রালের অধীনে যে ইন্টারস্টেট ইন্টেলিজেন্সের চেন, সেদিকে আঙুল তুলছিস।
আমি ঘাবড়ে যাই, জানি স্যার পুলিস ফোর্সের ইমেজ নিয়ে কীরকম সংবেদনশীল।
-স্যার, এখন তো আমরা ব্রেন-স্টর্মিং সেশন করছি। আপনিই তো বললেন যা মনে আসে সব বলতে।
--ঠিক আছে, পরের পয়েন্টে আয়।
--স্যার, কিস্টাইয়ার মৃত্যু যদি মাথার পেছনে বাড়ি লেগে হেমারেজ থেকে হয়ে থাকে তাহলে ওটা দুর্ঘটনা নয়, মার্ডার। কারণ গাড়ি গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়েছে সামনের দিকে। তাও হালকা ভাবে, তাহলে মাথার পেছনে অমন ফ্যাটাল হিট? সঙ্গের লোকজনের পাত্তা নেই কেন? আরেকটা গাড়ি ছিল না? অথচ ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে কয়েকজন মিলে ঠেলে ঠুলে গাড়িটাকে আগে গড়িয়ে দিয়েছে।
তারা কারা? অন্য গাড়ির লোক নাকি ওর নিজের গাড়ির? আগে বোঝা যায়নি, এখন মনে হচ্ছে মাথার পেছনে প্রায় ফ্যাটাল হিট করে ওর কাগজপত্র লাইসেন্স সব নিয়ে বাকিরা কেটে গেছে। তার আগে ব্যাপারটাকে একটা অ্যাক্সিডেন্টের মত সাজিয়ে দিয়ে গেছে। আর আমরা ধোঁকা খেয়েছি, ওদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু কী সেই উদ্দেশ্য?
আমার মনে হয় গাড়িদুটোর নম্বর এবং বর্ণনা এবং সেদিনের টাইমিং--এসব জানিয়ে অমরকন্টক থানায় যোগাযোগ করা উচিত। যদিও আমার মনে হয় দুটো নাম্বার প্লেটই ফলস, তবু এখান থেকে অমরকন্টকের মধ্যে তিনটে টোল নাকা রয়েছে। ওদের রেকর্ডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা দরকার—আদৌ গাড়িদুটো অত রাত্তিরে কোত্থেকে আসছিল? আদৌ ওরা অমরকন্টকে নর্মদাজীর মন্দিরে গেছল কিনা।
সিমরনের চোখ চকচক করে।
--স্যার, বিলাসপুর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে ওই পথেই অচানকমারের রিজার্ভ ফরেস্ট শুরু হয়েছে। সেখানে ফরেস্ট নাকা বেশ কড়া। মাইনর ফরেস্ট প্রোডাক্টস , তেন্দু, মহুয়া, কোসম এবং শাল-সেগুন কাঠের চোরা চালান আটকাতে নিয়মিত সব ভেহিকল চেক করা হয়। ওখানে বনবিভাগের দু’রকম বাংলো রয়েছে। একটা বেশ অভিজাত পাকা বাড়ি আর একটা খোড়ো এবং খাপরা ছাওয়া মাটির দেয়ালের। দুটোর রেজিস্টার চেক করা যেতে পারে।
কোসলে স্যার খানিকক্ষণ আমাদের দু’জনকেই পালা করে দেখতে থাকেন।
তারপর বলেন—ক্যা কহনে! দুজনেই সুন্দর বিশ্লেষণ করেছিস। এমন ভাবে চলতে থাকলে আগামী পাঁচবছরের মাথায় তোদের পার্টনার করে নেব। শোন, আমার এই ‘ওয়াচ অ্যান্ড সিকিউরিটিজ’ এজেন্সিটি গোড়া থেকেই একটি প্রোপাইটরি সংস্থা, তোদের ভাবীজির নামে। উনিই প্রোপাইটর। আমি ডায়রেক্টর, বাঁধা রেমুনারেশন বা মাইনে নিই। পাঁচবছর পরে এটা বদলে পার্টনারশিপ ফার্ম করে নেব। শ্রীমতীজি এবং তোরা দু’জন। আমি মাইনে করা ডায়রেক্টর হয়েই থাকব।
একদিন যখন শরীর আর বইবে না, তখন অবসর নেব। তখন তোরা চালাবি। আমি আর নাক গলাবো না। ভরসা আছে, ততদিনে এই এজেন্সি ছত্তিশগড়ের সবচেয়ে বড় ডিটেক্টিভ এজেন্সি হবে।
সিমরন অভিভূত, সিমরনের চোখ ছলছল করে।
কিন্তু আমার মনটা একটু খচখচ করছে। আমি কমার্স গ্র্যাজুয়েট। এটুকু জানা আছে যে পার্টনারশিপ ফার্মে পার্টনার লায়াবিলিটি আনলিমিটেড। অর্থাৎ , দরকার পড়লে ফার্মের সমস্ত দেনদারি যে কোন পার্টনারের থেকে সবটা আইনতঃ আদায় করা যায়।
টিউবলাইট জ্বলে উঠল। প্রাক্তন ডিএসপি মিঃ দলগঞ্জন সিং কোসলে কি আমাদের ইমোশনালি এক্সপ্লয়েট করছেন? (এই কথাটা সিরিয়াল দেখে নতুন শিখেছি)। নইলে নিজে কেন পার্টনার হবেন না? আমাদের পার্টনার বানিয়ে জাহাজ ডোবার সময় কোসলে দম্পতির এস্কেপ রুট খোলা রাখছেন?
নাঃ , উনি যাই বলুন , আমি কোনদিন পার্টনার -টার্টনার হব না। মাইনে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকব। বড় বড় স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।
স্যার কি আমার দো্নোমোনো ভাব বুঝতে পারলেন। বললেন—সেসব তো পাঁচবছর পরে। আপাততঃ দামলেকে দিয়ে সবার জন্য টুটিফ্রুটি আইসক্রিম আনিয়ে দিচ্ছি।
শুনেই সিমরনের চেহারাটা বেশ হাসি হাসি আইসক্রিম আইসক্রিম হয়ে গেল। আর আইসক্রিম দেখলে আমি—ধ্যেৎ কীসব ভাবছি!
স্যার বললেন –তোদের সাজেশনগুলো সব উমদা। কিন্তু এগুলো ঠিক আমাদের কাজের আওতায় পড়ে না। আমি শ্রীবাস্তব স্যারকে বলে দেব। সবগুলো ভেরিফিকেশন দু’দিনের মধ্যে হয়ে যাবে।
সৌরভ, হো যা শুরু! গাড়ি এবং খবর লীক নিয়ে কথা হয়ে গেছে। মাথার পেছনের চোট নিয়েও। কিন্তু আমাদের যেটা ক্লায়েন্টের কাজ, তার কী স্ট্যাটাস রিপোর্ট? আচ্ছা, সৌরভ তুই একটু জল খেয়ে নে। অনেকক্ষণ বকেছিস। সিমরন বল; তোর হলে আবার সৌরভ।
সিমরন উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা ফাইল বের করে আনে। তারপর ফাইলের দিকে চোখ রেখে একটা প্যাডের খালি পাতায় কীসব আঁকিবুকি কাটতে থাকে। অদ্ভুত তো!
স্যারও ওকে মন দিয়ে দেখছিলেন। ইন ফ্যাক্ট, এভাবে কোন কেস নিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্টলি স্ট্যাটাস রিপোর্ট পেশ করার সুযোগ সিমরন আগে পায় নি, এই প্রথম।
আঁকিবুকি বন্ধ হয়, সিমরন চোখ তুলে তাকায়। কপালের ওপর এসে পড়া চুলের গুছি মাথার পেছনে ঠেলে দিয়ে শুরু করে।
--ক্লায়েন্ট সোনালী মিশ্রের কেসে সমস্যা দুটো। কে বা কারা ওকে ধমকাচ্ছে বা আজেবাজে টেক্সট করছে। আর ওর বয়ফ্রেন্ড কবি বিদ্রোহীর রহস্যময় মৃত্যুর জট খোলা।
- প্রথম সমস্যায় একটাই প্রগ্রেস, আমরা নাড়াচাড়া করতে থাকায় নতুন কোন টেক্সট বা ফোন আসা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এর গোড়ায় আমরা পৌঁছুতে পারি নি।
- আমরা অভিযোগকারিণী সোনালী ও তাঁর মা শকুন্তলা দেবীর স্টেটমেন্ট নিয়েছি, এফ আই আরের কপি দেখেছি। সাইবার সেল ও মহিলা থানায় গিয়েছিলাম, খুব একটা লাভ হয়নি। আমার ধারণা সাইবার পুলিশ কমপ্লেইনকে হালকা ভাবে নিয়েছে, নইলে লোকেশন ট্রেস করে এদের ধরা কী এমন কঠিন ছিল? ওরা এটাকে কলেজের ছেলেমেয়ের অ্যাফেয়ার ভেবেছে। তবে ওদের পুলিশ প্রটেকশন দেওয়ায় এবং লোকেশের মৃত্যুর পর আসা ধমকি দেখে ওরা একটু চমক গয়ে। তারপর কিছু একটা করে থাকবে –যেটা আমরা জানিনা—যার ফলে ধমকানো বন্ধ হয়ে গেছে।
- কঠিন এবং রহস্যময় হল লোকেশ বিদ্রোহীর মৃত্যুর কেস। ও যে টাওয়ার থেকে লাফিয়ে পড়েছে সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে ওটা মেইনলি সৌরভ দেখছে। তারপর পারমিন্দর গায়েব হয়ে গেছে। কাজেই ওই ভাল করে বলতে পারবে।
আমি একটু অস্বস্তি বোধকরি। আগের দিনই তো এই কেসের ব্যাপারটা বিশদে বলতে গিয়ে স্যারের কাছে দাবড়ানি খেয়েছিলাম। তারপর পুলিশ নিয়ে পারমিন্দরের দাদা গিলের আচমকা হামলে পড়া।
একটু গুছিয়ে নিয়ে টু দি পয়েন্ট বলতে হবে।
সিমরনের দিক থেকে ফাইলটা টেনে নিলাম, ওর মত নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবার সময় পাওয়া যাবে। চোখ পড়ে গেল সিমরনের স্ক্রিবলিং প্যাডের দিকে, সেটাও টেনে নিই। চোখ গেল ওর কাটাকুটির দিকে। ও এঁকেছে একটা মেয়ের মুখ বাচ্চাদের মত করে। হিজিবিজির মধ্যে দেখছি ‘পারমিন্দর’ , ‘বিদ্রোহী’ আর কিছু কাটাকুটি ও ঢ্যাঁরা। এসবে চোখ পড়ে যাওয়ায় আমার ভাবনাচিন্তা আরও গুলিয়ে গেল।
খেই হারিয়ে বলতে লাগলাম—পারমিন্দর দ্য রেবেল কুছ নাকচড়ী কুছ তুনক মিজাজি লড়কী, কিন্তু বিগড়েল না। বরং অনেস্ট। মনে হয় ওর সঙ্গে আরেক রেবেল প্রয়াত লোকেশ বিদ্রোহীর ভাল আন্ডারস্টান্ডিং ছিল। মেয়েটা হয়ত ওকে নিয়ে একটু পজেসিভ।
দেখুন, ও যখন শুনল যে মিশ্র বলেছে যে লোকেশ ওর বয়ফ্রেন্ড, ওর প্রতিক্রিয়া ছিল যদি ও আপনাকে এরকম বলে থাকে, তাহলে তাই হবে। আরেকটা কথা, পারমিন্দরকে যতটা লোকেশের মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে প্যাশনেট দেখছি, সোনালী কিন্তু সেরকম নয়। বয়ফ্রেন্ড বলেছে বটে, কিন্তু একবারও জানতে চায় নি কাজ কতদূর এগুলো বা খুনি কে হতে পারে জানা গেছে কিনা? ও যেন পুলিশ আর আমরা তদন্ত শুরু করায় নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে।
স্যার মাথা নাড়লেন, --আমার মনে হচ্ছে ওরা মা মেয়ে পুলিশ প্রটেকশন পাওয়ার পর নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে। হয়ত এটাই আসল উদ্দেশ্য। যাহোক, তুই বল; আর ইন্টেরাপ্ট করব না।
--স্যার, তাহলে একটা কথা ওঠে। ওদের আশংকা কি জেনুইন? মা মেয়ে কি সত্যি ভয় পাচ্ছে? যদি পেয়ে থাকে তবে কিসের ভয়? আর যদি অভিনয় হয় , মানে যদি ওরা সাজিয়ে গুজিয়ে আমাদের মিথ্যে কথা বলে থাকে তাহলে প্রশ্ন ওঠে কেন এই শারাড? ওরা কি কিছু চাপা দিতে চাইছে, কী সেটা?
তবে একটা কথা।
লোকেশ বিদ্রোহী, সোনালী মিশ্র,পারমিন্দর কৌর মিলে একটা নিয়মভাঙা নৈরাজ্যবাদী সংগঠন গড়ে তুলছিল। কলেজের একটু উগ্র মেজাজের ইউনিয়ন বোধহয় তারই একটা ফ্রন্ট। এদের থিওরেটিশিয়ান বোধহয় লোকেশ, মেয়েদুটো ওর নিয়মভাঙা মসীহা অ্যাটিচুডে হাইলি ইম্প্রেসড। হয়ত ওরা ভবিষ্যতে একটা কমিউন করে থাকার কথা ভাবছিল।
পারমিন্দর যে বলছিল নারী পুরুষের অধীন হবে না। পরিবার ও সম্পত্তি ব্যক্তিগত থাকা চলবে না? পারমিন্দরের ওই গেন্ডা মত দাদা কি এইসব জানতে পেরেই মহাখাপ্পা হয়ে বোন উচ্ছন্নে যাচ্ছে ভেবে কলেজ ছাড়িয়ে দেবার কথা বলছিল?
সিমরন আঙুল তোলে, ক্লাসের বাধ্য ছাত্রীটি!
--এসব এখন জানা যাবে না। পারমিন্দর ফিরে আসলে বা ওর সঙ্গে কোন যোগাযোগ হলে তবেই জানা যাবে। সে যাই হোক , লোকেশের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে ওরা খুব মুষড়ে পড়েছে মনে হয়। আচ্ছা, লোকেশকে নিয়ে দুই সহেলির মধ্যে কি একটা চাপা প্রতিযোগিতা ছিল?
কোসলে স্যার এবার রেগে গেলেন।
--ফের শুরু হল? এই জন্যেই কচিকাঁচাদের এসব সিরিয়াস চাকরিতে নিতে নেই। কথায় বলে না ‘লৌন্ডোঁ সে ইয়ারি, গধে কী সওয়ারি’! ছেলে-ছোকরার দোস্তি, যেন গাধায় চড়ে মস্তি!
কাজের কথায় আয়! লোকেশ যে ফ্ল্যাটের জলের ট্যাপ সারাতে গেছল সেটার ভাল করে খোঁজ নিয়েছিলি? ধুর! তোদের দিয়ে কিস্যু হবে না।
--বলতেই তো যাচ্ছিলাম কিন্তু একবার আপনি একবার সিমরন—
--আচ্ছা আচ্ছা; নো টোকাটাকি, নো ডিস্টার্বিং ।
কিন্তু একটা মেসেজ ঢুকছে স্যারের স্পেশ্যাল মোবাইলটায়। স্যার সেদিকে একনজর তাকিয়ে চেয়ার থেকে উঠে মোবাইল কানে হুঁ- হাঁ করতে করতে ভেতরে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলেন।
আমি আর সিমরন অপেক্ষা করছি। একবার কড়িকাঠের দিকে তাকাচ্ছি আর চোখাচোখি হতেই হেসে ফেলছি। শেষে বলেই ফেললাম—একটু ওঠ না সিমরন, কফি বানিয়ে নিয়ে আয়। গলা শুকিয়ে গেছে।
সিমরন চোখ পাকায়।
--ধেৎ, স্যার আইসক্রিম আনাচ্ছেন না? এখন কফি-টফি চলবে না।
হুঁঃ সাতমণ তেলও পুড়েছে, রাধাও নেচেছে! আরে স্যারের সব মুখের কথা। কই দামলেকে তো এখনও পাঠান নি আইসক্রিম আনতে। তুইও যেমন, একেবারে স্কুলের খুকিটি! ওই আশায় থাক।
সিমরন পালটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, সুযোগ পেল না।
হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসেছেন স্যার, এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। দশ সেকেন্ড!
--শোন সৌরভ, তুই এখন বাড়ি গিয়ে একটা স্যুটকেস গুছিয়ে নিয়ে আয়। সাতদিনের মত জামাকাপড় নে আর ল্যাপটপের ব্যাগ। গাড়ি আসছে দশ মিনিটের মধ্যে । তোর কতক্ষণ লাগবে?
আমরা হতভম্ব। এসব কী বলছেন স্যার! আমি জানি অন্ততঃ আধঘন্টা লাগবে তৈরি হতে। কিন্তু কোথায় যেতে হবে? সাতদিনের জন্যে? এমন কি এমারজেন্সি অ্যাসাইন্মেন্ট যে দশ মিনিটের মধ্যে আমার জন্যে গাড়ি আসছে?
--স্যার, কী হয়েছে যে আমাকে একা যেতে হবে মানা রিফিউজি ক্যাম্পে? মানে আমার বাড়িতে? একা? কী করব গিয়ে? অ্যাসাইনমেন্টটা কী? তাও আধঘন্টার মধ্যে?
--না, না; আধঘন্টা অনেক । আমাদের হাতে মোটে টাইম নেই। এক কাজ কর। তুই এই পোশাকেই রওনা হয়ে যা। ল্যাপটপ তো এখানেই আছে। কিছু জামাকাপড় মানা ক্যাম্পে কিনে নিবি। তোর ঘরের চাবিটা দামলে মকানমালিকের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসবে। বলবে তুই সাতদিন পরে আসছিস। এসব তো তোর জন্যে নতুন নয়। নে, ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।
এরকম অদ্ভুত কথা বাপের জন্মে শুনি নি। উনি কি আমাকে চাকরি থেকে কাটিয়ে দিতে চান? তা কী করে হবে? এই তো কিছুক্ষণ আগে পার্টনার বানাচ্ছিলেন। আর যদি আমাকে টার্মিনেট করতে চান তো এ’মাসের মাইনে আর এক মাসের নোটিস পে’ হাতে ধরিয়ে তবে তো টা টা! তারপর আমি কোথায় যাব— চাঁদসি ডাক্তার বাপের কাছে পামগড়ে নাকি আরেকটা কাজ জুটিয়ে বিলাসপুরে – সেটা আমিই ঠিক করব। উনি কে যে আমাকে মানা ক্যাম্প পাঠিয়ে দিচ্ছেন, তাও সাতদিনের জন্যে? জরুর দাল মেঁ কুছ কালা হ্যায়!
--স্যার, আপনি আমার বস, যা বলছেন তাই হবে। কিন্তু আমাকে আগে বুঝতে হবে ব্যাপারখানা কী, কেন আমাকে সাততাড়াতাড়ি ভাগিয়ে দিচ্ছেন?
--ধেত্তেরি! যা বলছি শোন; তোর ভালর জন্যেই বলছি। এই নে পাঁচ হাজার টাকা। গুনে নে, ওখানে গিয়ে জামাকাপড় কিনতে কাজে লাগবে। ওখানে তোদের পুরনো বাড়িতে কে কে আছে?
--এখন কেউ নেই। কিন্তু পিসির বাড়িতে দুই বুড়োবুড়ি, আমায় ভাল বাসে।
--গিয়ে বলবি সাতদিনের ব্রেক নিচ্ছিস।
--ওসব কোন প্রবলেম না। কিন্তু কেসটা কী বলুন।
স্যার দু’বার ঢোঁক গিললেন।
--আজ ভোরবেলায় অরপা নদীর পুলের নীচে যেখানে জল কম, সেই বালিয়াড়ির মধ্যে একটি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে, শরীরে কোন কাপড় নেই। ব্রুটালি মার্ডারড, সম্ভবতঃ গ্যাং রেপ কেস।
কোসলে স্যার থামলেন, টেবিল থেকে সিমরনের বোতল তুলে ঢক ঢক করে জল খেয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে গোঁফ মুছলেন। তারপর হাঁফাতে লাগলেন।
সিমরন শিউরে উঠেছে।
--ভেরি স্যাড কেস স্যার। কিন্তু এর জন্যে সৌরভ কেন মানা ক্যাম্প যাবে?
-- বাড়ির লোক শনাক্ত করেছে ওটা পারমিন্দরের বলে। এখন মধুবন শ্মশানে ওর চিতা জ্বলছে। ওর দাদা চিৎকার করে কাঁদছে আর গাল পাড়ছে আমাদের। বলছে এর পেছনে সৌরভের হাত আছে। সেদিনই ওকে অ্যারেস্ট করে নিলে আজ পারমিন্দর বেঁচে থাকত। ও লোককে উস্কে দিচ্ছে , শ্মশানের কাজ পুরো হলেই ওরা এখানে আসবে, বলছে হত্যারা বাঙালী কো ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। এসপি অফিসের খবর --ওদের থানা ঘেরাও করার প্ল্যান আছে। মিঃ শ্রীবাস্তবের অ্যাডভাইস সৌরভ এখন কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকুক। আমি গাড়ি বুক করে দিয়েছি।
খানিকক্ষণ লাগল আমার ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝতে। পারমিন্দর বলে স্বল্প পরিচিত উজ্বল মেয়েটিকে নৃশংস ভাবে মারা হয়েছে এবং গ্যাং রেপ। আর ওর গেণ্ডাছাপ দাদার চোখে এই জঘন্য ঘটনার নাটের গুরু আমি, তাই আমাকে সাতদিন চোরের মত গা’ ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে!
আমার মাথার মধ্যে দীপাবলীর আতসবাজি শুরু হয়। কালীপটকার লড়ি ফাটতে থাকে।
-- আমি কোথাও যাচ্ছি না, স্যার। এখানেই থাকছি।
--মানে? একটু পরেই ওরা আসবে। তোকে পেলে ছিঁড়ে ফেলবে।
-- মামার বাড়ি নাকি? আসুক না; আমি কোন দোষ করি নি। মেয়েটা গায়েব হবার সময় থেকে আমি কোথায় কোথায় ছিলাম তা তো স্পষ্ট। বেশির ভাগ সময় আপনার অফিসে আর রাত আটটার পর আমার ঘরে। যা খুশি বললেই হল! আপনার পুলিশ আছে কী করতে?
--তর্ক করিস না। উন্মাদ ভীড় কোন যুক্তি শোনে না। একটি যুবতী মেয়ে বীভৎস ভাবে খুন হয়েছে। এমন ঘটনা বিলাসপুরে কখনও ঘটে নি। ওদের এখন একটা বলি কা বকরা চাই। পুলিশ প্রশাসন খুব চাপে আছে। তাই আমাদের অফিসের জন্য পুলিশ প্রটেকশন থাকলেও তোর সরে যাওয়াই ভাল। জেলা বদলালে পুলিশ অ্যাডমিনিট্রেশনও বদলে যায়। আমরা কালকেই তোর জন্য অ্যান্টিসিপেটরি বেইলের অ্যাপ্লিকেশন ফাইল করব।
আশা করছি, সাতদিনের মধ্যে অপরাধীকে আইডেন্টিফাই করে গ্রেফতার করা যাবে। এ’ধরণের ক্রাইম হল প্যাশন ক্রাইম। এরা খুব ভেবেচিন্তে আটঘাট ভেবে করে না। তাই প্রচুর ফাঁক ফোকর থেকে যায়।
সাতটা দিন।
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।