১০
“সিংহ মশাই ! সিংহ মশাই! মাংস যদি চাও,
রাজহংস এনে দেব হিংসা ভুলে যাও”।
সৌরভ
কাল রাত্তিরে দন্তেওয়াড়ায় সার্কিট হাউসে ফিরে চক্ষু চড়কগাছ!আমার সব জিনিসপত্র , ল্যাপটপ মায় সাবান ও টুথপেস্ট গুছিয়ে প্যাক করে বারান্দায় একটা বেঞ্চির উপর রাখা। চৌকিদারকে এসবের কি মানে জিজ্ঞেস করার আগেই ও আমার কামরার দিকে ইশারা করল।
দেখলাম, ওই কামরায় পুলিশের কোন বড় সায়েব আস্তানা গেড়েছেন।
বারান্দায় চারজন সশস্ত্র প্রহরী প্রায় অ্যাটেনশান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কামরার ভেতরে চড়া গলায় কিছু কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
সোনালীকে ফোন করায় ও একটি হোটেলে রুম বুক করে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিল। আমি চুপচাপ রেজিস্টারে সাইন করে গাড়িতে করে ফিরে গেলাম।
সোনালী বলল—এই হোটেলটার সুবিধেগুলো জাস্ট বেসিক, কিন্তু একটা রাত কাটিয়ে দিতে পারবেন। কাল সকাল ছ’টায় এখান থেকে বেরিয়ে গেলেই হবে। বীজাপুর আর সুকমার মিটিং শেষ হলে রাত্তিরে রায়পুর যাবার এক্সপ্রেস বাসে আপনাকে চড়িয়ে দেব।
সকাল সাড়ে ছটা বাজে।
দন্তেওয়াড়া পেছনে ফেলে বীজাপুরের দিকে ছুটছে গাড়ি। বৃষ্টি নেই, কিন্তু খানিকটা কুয়াশার ভাব। শুনশান রাস্তা, দুদিকে কোন জনবসতি নেই।
আজ আর ভুল করি নি। কোসলে স্যারের নির্দেশ মেনে জীন্সের উপর সবুজ পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়েছি।
এখন কি কবি লোকেশ বিদ্রোহীর হত্যা নিয়ে কথাটা তুলব?
নাঃ , সাতসকালে এসব ভাল লাগছে না। ফেরার পথে কথা বলা যাবে। তার চেয়ে বীজাপুরের মিটিং নিয়ে ভাবি, চারদিক দেখি।
ড্রাইভার গাড়ির স্পীড কমাতে বাধ্য হল।
রাস্তায় কেউ একটা ব্যারিয়ার লাগিয়ে দিয়েছে।
সোনালী ড্রাইভারকে স্থানীয় ভাষায় বলল—ভয় পেও না, থামিয়ে দাও। আর কাগজপত্র বের কর।
আমাকে বলল—আপনার আইডি কার্ড বের করুন-- যেটা অ্যাডাল্ট এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট দিয়েছে।
এবার কুয়াশার জাল ছিঁড়ে ব্যারিয়ারের পেছন থেকে প্রেতছায়ার মত বেরিয়ে এল তিনমূর্তি।
কালো পোষাক, মাথায় কালো কাপড়ের ফেট্টি কাঁধ অব্দি ঝুলছে। ওদের টর্চের আলো সোজা আমাদের মুখের ওপর। সংক্ষিপ্ত কিছু বাক্য।
--কঁহা সে? জানা কাঁহা? কাগজ দিখাইয়ে।
একজন টর্চের আলোয় কাগজ দেখল। ছবির সঙ্গে আমাদের চেহারা, গাড়ির নম্বর। দ্বিতীয় জন আলো ফেলে দেখল গাড়ির ভেতর, ড্রাইভারকে নীচে নামতে বলে খুলিয়ে দেখল পেছনের ডিকি।
তৃতীয় জনের কালাশনিকভের নল আমার মুখের দিকে তাক করা, একবারও নড়ল না।
--যাইয়ে!
ব্যারিয়ার পেরোতেই চোখে পড়ল যে সামনে রাস্তাটা ভাঙা, একটা মেশিন ঘুরে চলেছে আর গরম পিচ ঢালছে। বর্ষায় ভেঙে যাওয়া রাস্তা মেরামত হচ্ছে। তবে মেশিনের কাছে একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আরও দুজন, একই রকম পোষাকে।
আর একজনের হাতে মোটা বেল্টে বাঁধা কালো বড়সড় কুকুর—স্নিফার ডগ!
সোনালী বিড়বিড় করল—কোবরা ব্যাটেলিয়নের কম্যান্ডো, এরিয়া ডমিনেশনের অপারেশন শুরু হয়েছে।
গাড়ি আবার ছুটতে লাগল। এবার আকাশে আলো ফুটছে।
ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল—প্রতি দশ কিলোমিটার দূরত্বে একটা করে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশের ক্যাম্প, তাতে ব্যাটালিয়ন নং ৪২সি/ ২এ গোছের কিছু লেখা।
একটা জায়গায় দেখলাম ওই বড় বোর্ডের পাশে একটা ছোট্ট বোর্ড, প্রায় চোখে পড়ে না বললেই হয়। তাতে কালোর উপর সাদা দিয়ে লেখা—“ যারা আত্মসমর্পণ করতে চায়, তারা এখানে যোগাযোগ করুক”।
বীজাপুরের মিটিং মন্দ হল না । কালেক্টর অফিস থেকে লাঞ্চের ব্যবস্থা হয়েছিল। ভদ্রলোক খুব হাসিখুশি। বললেন এখানে শিক্ষাপ্রসার এবং হাসপাতালের উপর জোর দিয়েছি, তাতে আদিবাসীদের সরকারের উপর ভরসা বেড়ে গেছে।
আগে আমরা বারোটা ব্লকে রাতে ঢুকতে পারতাম না। এখন সেটা কমে মাত্র চারটে ব্লক। বন্ধ স্কুলগুলো আবার শুরু হয়েছে।
এবার সুকমা যেতে আরও দু’ঘন্টা।
ভরা পেট । তখনই মনে হল এবার সোনালীকে জিজ্ঞেস করা দরকার। পরে আর সময় পাবো না।
সোনালী সায় দিল। কিন্তু আমি খুঁতখুঁত করি, ড্রাইভার রয়েছে যে!
--ও খালি দুটো ভাষা জানে—গোণ্ডী আর হালবী। তবু সাবধানের মার নেই, আমরা কারও নামটাম নয়া নিলেই হল।
সোনালী বলতে শুরু করে।
দেখুন, কবির মৃত্যুর পেছনে তিনটে কারণ।
এক, ওর কেতাবী আইডিয়ালিজম।
দুই, বিপ্লবী নেতাদের ওর প্রশ্ন শুনে অস্বস্তি বেড়ে যাওয়া।
তিন, দলবাজি এবং বেইমানী।
এক এক করে বলছি।
কবি খেয়াল করেছিল যে এখানে চলছে প্রশ্নহীন আনুগত্য। যে প্রশ্ন করে তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ওর প্রশ্ন ছিল –যে যায় লংকায় সে হয় রাবণ, এটা কী করে আটকানো যায় ?
আর কেবল পুলিশের খোচর এই সন্দেহের বশে কোন গরীব আদিবাসীদের কেন মেরে ফেলা হবে? তাও ওর বৌ-বাচ্চার সামনে? তাহলে সিকিউরিটি ফোর্স আর আমাদের মধ্যে কিসের তফাত ? অথবা চম্বলের ডাকাতদের সঙ্গে?
এবার নেতারা পড়লেন অস্বস্তিতে।
বললেন এখন যুদ্ধ চলছে। আমরা ব্যাটলফিল্ডে আছি। এখানে প্রশ্ন করার চেয়ে অর্ডার মানা বেশি দরকারি, নইলে জেতা যায় না।
আমি মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু কবি মানে নি।
নেতারা ভাবছিলেন ওকে সরিয়ে আমাকে বিলাসপুর ইউনিটের দায়িত্ব দেবেন। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। ওযে আমার গুরু, ওকে যে ভালবেসেছিলাম।
--বেশ, তাহলে এখন তুমি তো হতেই পার; কবি তো আর নেই।
সোনালী চুপ করে যায়, কিছু বলে না। জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে থাকে।
আমি কি কিছু বেফাঁস বলে বসলাম!
ফিরতি পথে আবার সেই সকালের জায়গা্টায় এসে গেছি। রাস্তা মেরামতির কাজ অন্ততঃ আধা কিলোমিটার এগিয়ে গেছে। স্নিফার ডগ দেখছি না। কিন্তু গাছের আড়াল থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছে প্রায় দশজন কোবরা কম্যান্ডো।
এবার ওরা আর এগোয় নি, আমাদের থামতেও বলে নি।
আমি আবার লোকেশ হত্যার প্রসংগ তুলি, জানতেই হবে যে আমাকে কতটা বোকা বানানো হয়েছে আর কারা বানিয়েছে।
--এই নেতারা কারা? লাল মুহম্মদ? বিক্রম?
--উফ, বললাম না, কোন নাম নেবেন না?
--সরি! খেয়াল রাখব। কিন্তু কারা তোমাকে ধমকাতো? কারা মেসেজ পাঠাত? ওরা তোমার থেকে কী চাইছিল?
--বলছি, এটা এক অদ্ভূত ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার গল্প।
বেশ কয়েক বছর আগে পুরনো নক্সাল পার্টি থেকে বেরিয়ে একটা ছোট গ্রুপ, নাম একতা পার্টি, ছোটনাগপুর রিজিয়নে, বিশেষ করে ঝারখণ্ড ছত্তিশগড় বর্ডার এলাকায় কাজ শুরু করেছিল। ওরা বেশ হিংস্র, কথায় কথায় অ্যাকশন।
ওদের আমরা একসময় রায়গড়ের কেলো নদীর ওপার অবধি খেদিয়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু ইদানীং আমাদের দলে পর পর কিছু পুলিশ অ্যামবুশে খুব ক্ষতি হয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহ হল যে ভেতরে কিছু ইনফর্মার ঢুকেছে।
ঝারখণ্ডের দলিত সমাজ থেকে আসা ওদের একটা ধূর্ত নেতা আমাদের নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হল --কবি হল সেই মোল যে নাকি পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের দলকে ভেতর থেকে ভাঙার চেষ্টা করছে!
লীডারশিপ কবিকে সরিয়ে ফেলার দায়িত্ব সেই লোকটাকে দিল। ওদের নাকি বিলাসপুরে গুপ্ত সংগঠন রয়েছে।
--সত্যি? কারা ওরা? আমাদের কাছে তো তেমন কোন খবর নেই।
--আরে বাজে কথা, সংগঠন না হাতি। ওরা পুলিশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের শেষ করার তালে ছিল। এসব রায়পুরে পুলিশের টপ লেভেলের সঙ্গে ওর আন্ডারস্ট্যান্ডিং।
কবিকে ওরা আলোচনার নামে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করে । নিউ আর্য হাউজিং কমপ্লেক্সে বি-২০২ এ আমরা থাকতাম, যেখানে আপনি গিয়েছিলেন। ওদের দু’জন সি-৫০১ ভাড়া নিয়েছিল , পুলিশের হেল্প নিয়ে।
--কিসের আলোচনা?
--আরে ওই যে নেতাদের সেন্ট্রালিজমের বিরুদ্ধে অথবা ‘যে যায় লংকায়’ সিন্ড্রোম নিয়ে একরকম ‘কী কথা, ব্যাঙের মাথা’ গোছের আলোচনা।
ব্যাপারটা হল যে বয়স্ক দম্পতি সি-৫০১ ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন তারাই নাটের গুরু।
ওরা পুলিশকে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে -- কোন প্লাম্বারকে ওরা কল করে নি, কথাটা অর্ধসত্য।
ওরা প্লাম্বারকে ডাকে নি, কারণ ওদের ফ্ল্যাটে কোন জলের কল বা পাইপ খারাপ হয়নি। কিন্তু ওরা কবিকে ডেকে পাঠিয়েছিল আলোচনার জন্য। ও তখন আমার সঙ্গে কথা বলেই ওখানে গেছল।
একজন মহিলাও রয়েছে, কাজেই আমি বা কবি কেউ কোন ফাউল প্লে সন্দেহ করি নি।
--কিন্তু ওরা দুজন জোয়ান ছেলেটাকে ব্যালকনি থেকে ফেলল কী করে?
--মহিলাটি পেশায় নার্স। আলোচনার মাঝখানে ওকে ক্লোরফর্ম শুঁকিয়ে অজ্ঞান করে । তারপর দু’জন মিলে দাঁড় করিয়ে ধরাধরি করে এনে ব্যালকনির রেলিঙ্গের পাশে ঠেকিয়ে দেয়, তারপর সামান্য একটু ঠেলা।
--অন্য কেউ দেখে নি?
--ওই টাওয়ারে প্রত্যেক ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট। বাকি দুটোয় দুটো ব্যাচেলর ছেলে থাকে। ওরা সকাল সাতটায় কাজে বেরিয়ে যায়। সেই সময় দেখেই ওকে ডাকা হয়েছিল। আর পাঁচতলা থেকে কেউ পড়ে গেলে আগেভাগে কী করে কেউ দেখতে পাবে?
--তাহলে কারা আপনাকে থ্রেট করত? মেসেজ পাঠাত?
--ওরাই। ওরা চাইত আমি ওদের দলে যোগ দিই, নইলে পরে পস্তাতে হবে।
--পুলিশ কেন কোন অ্যাকশন নেয় নি?
--কেন নেবে? ওরা সব জানত। ওদের গেমটা ছিল—যা শত্রু পরে পরে!
একটা ব্যাপার আপনি নিশ্চয়ই ভেরিফাই করেন নি—ওই সি ৫০১ ফ্ল্যাটের মালিক কে?
--জানি না তো। আপনিই বলুন।
--উনি রায়পুরের এক পুলিশ অফিসারের ভাইপো। তাই কোসলে স্যারের সৌজন্যে যখন আমরা পুলিশ প্রটেকশন পেলাম তখন থ্রেট আসাও বন্ধ হল। আর ওই ভাড়াটে দম্পতিও ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেল। ওদের কাজ ফুরিয়েছে!
--মানে, পুলিশের ওপর মহলে সবাই জানত, খালি আমরাই বোকা ছিলাম।
--‘আমরা’ নয়, খালি আপনি। যাক গে, এনিয়ে আর কিছু বলব না। সুকমা এসে গেছে। আমাদের শেষ গন্তব্য।
সুকমা
ঘন বনের মধ্যে আমাদের শিক্ষাকেন্দ্রটি, ব্লক বা জেলা হেডকোয়ার্টার থেকে অন্ততঃ কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার দূরে।
এটি একটি মাটির বাড়ি, তাতে খাপরার চাল কিন্তু একের পর এক চারটে ঘর। সামনে টানা বারান্দা। ঘরগুলো ভেতর থেকে যুক্ত নয়, ওই বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়, যেন হোটেল বা ধর্মশালার ঘর।
প্রথমে দুটো জিনিস চোখে পড়ল।
ঘরের সামনেই একটা বড়গাছের পাশে লোহার খুঁটিতে ফিট করা একটি ছোট ট্রান্সফর্মার, অথচ পথে যে ফরেস্ট ভিলেজগুলো পেরিয়ে এলাম সেগুলোতে বিদ্যুৎ এর খুঁটি বা তার চোখে পড়েনি।
সোনালী জানালো যে এই কেন্দ্রের ইনচার্জ ছেলেটি, চনেশরামও তার বৌ, কালেক্টরের সঙ্গে রীতিমত ঝগড়া করে এখানে অল্প ক্ষমতার ট্রান্সফর্মার বসিয়েছে। নইলে এখানে অডিও ভিস্যুয়াল ক্লাস এবং দূরদর্শন চলবে কী করে?
এর ফলে দুটো পাড়ায় প্রত্যেক ঘরে একটা করে কনেকশন গেছে। সবাই ধন্য ধন্য করছে।
--কালেক্টর চনেশরামকে পাত্তা দিল কেন?
--আরে ও তো নিজের বাড়ির দুটো ঘর শিক্ষাকেন্দ্রকে বিনে পয়সায় দান করে দিয়েছে।
হ্যাঁ , একটা ঘরে ক্লাসরুম, অন্য ঘরে পোস্টার, বইপত্র এইসব। আমাকে এই ঘরটায় একটা চেয়ারে বসিয়ে একটা ছোট কাপে লাল চা ধরিয়ে সবাই সরে গেল। বারান্দা থেকে ভারি হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। অনেক নারী পুরুষ আচ্ছে যাচ্ছে, সোনালীও সেদিকে গেছে।
খানিকক্ষণ পরে বোর হয়ে বারান্দায় বেরিয়ে দেখি এলাহি ব্যাপার। বারান্দার আরেক মাথায় দুটো বিশাল মাটির উনুনে দুটো যজ্ঞিবাড়ির হাঁড়ি চড়েছে। একটায় ভাত রান্না হচ্ছে, অন্যটায় মাংস।
কিন্তু আসল ভীড় জমেছে খোলা আঙিনায়।
সেখানে একটা বড় মুখ বাঁধা হাঁড়ি মাটিতে নামানো। সেটা আগলাচ্ছে এক উবু হয়ে বসা তেমুণ্ডে বুড়ো। তার সামনে একগাদা প্লাস্টিকের ডিস্পোজেবল কাপ।
মেয়েপুরুষ সবাই একটা করে কাপ তুলে নিয়ে ওকে ঘিরে ধরছে আর ও একটা এলুমিনিয়ামের মগ ডুবিয়ে হাঁড়ি থেকে কিছু তরল পদার্থ বের করে সবাইকে ঢেলে দিচ্ছে।
মহুয়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ!
চনেশরাম আমাকে দেখতে পেয়ে বলল –আপ অন্দর বৈঠিয়ে সাহাব। আপনার জন্যেও আসছে।
আমি বিরক্ত হয়ে বলি—মিটিং কখন শুরু হবে? বেলা গড়িয়ে আসছে। সোনালী ম্যাডামকে ডাকো।
আমার দাবড়ানিতে ও মুষড়ে পড়ে। মিনমিন করে বলে—আপনি ভেতরে যান, আমি ওনাকে পাঠাচ্ছি।
একটু পরে সোনালী হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতেই আমি ফেটে পড়ি।
--এটা কী হচ্ছে? আমরা কি মাংসভাতের মোচ্ছব দেখতে এসেছি? মিটিং এর কী হল?
সোনালী বিচলিত হয় না।
--আজকে মিটিং হবে না। আজ যে ওদের উৎসব, ‘নয়া খাই’! এটা হল নতুন ধান ওঠার ব্যাপার। উড়িষ্যা বর্ডার থেকে কিছু আদিবাসী এদিকে ঘর বাঁধায় এই উৎসব এখন কয়েকটা জেলায় প্রচলিত হয়েছে। অনেকটা আপনাদের নবান্নের মতন।
--তাতে কী?
--আরে আজ ওরা নতুন চালের ভাত রেঁধে দেবতার থানে মুর্গী নিবেদন করে তার মাংস খাবে। আর সঙ্গে থাকবে মহুয়ার মদ। আপনার জন্যেও আনছে।
--একদম না। ইয়ার্কি পেয়েছেন নাকি?
এবার সোনালী একটু কঠিন মুখে বলে— একদিন দু’ঢোঁক মহুয়া খেলে আপনার জাত যাবে না। তেমনই দু’টুকরো মাংস দিয়ে দু’গরাস ভাত। আপনি চটপট খেয়ে নিন। পাশের ক্লাসরুমে আপনার জন্যে ওরা আসন পেতে অপেক্ষা করছে।
--আর আমার কাজের কী হবে?
--খেয়ে নিয়ে ওই আঙিনায় গাছের কাটা গুঁড়িতে বসে ওদের বৈঠক নিন। আপনি প্রশ্ন করুন, তিরিশের উপর কাউকে, বুড়ো হোক কী বুড়ি! তারপর নোটস নিয়ে ফিরে যান রায়পুরে। খেল খতম!
আমি কথা না বাড়িয়ে চলে যাই পাশের ঘরে।
গোবর নিকানো মাটিতে যত্ন করে পাতা আসন। শালপাতার থালায় ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর পাশে পাতার দুটো বাটিতে অল্প করে ডাল এবং মাংসের ঝোল।
এখন বাজে বেলা তিনটে। বীজাপুরে খাওয়া ভাত ডাল এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় গাড়ির ঝাঁকুনিতে কখন হজম হয়ে গেছে।
খেতে শুরু করি, কিন্তু পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা এক বুড়ি এবং এক ছোকরা হাঁ হাঁ করে ওঠে।
--আরে আগে এটা , আগে এটা! এক চুমুক দিন তারপরে ভাত খাওয়া শুরু করবেন।
আমি খেতে খেতে গল্প করতে থাকি। মাওবাদীদের কথা জিজ্ঞেস করি।
ওরা হাসে। বুড়ি বলে -ওরা? দাদালোগ? ওরা থাকে হুই পাহাড়চুড়োয়।
--তুমি কখনো ওদের দেখনি ঠাকুমা?
বুড়ি আবার হাসে। হ্যাঁ, একবার ওরা এসেছিল। ফসল তোলা নিয়ে আমার আর আমার ভাইপোদের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। ওরা এসে মিটমাট করে দিয়েছিল।
আর তোমাদের থেকে ছাগল বা মুরগী তুলে নিয়ে যায়নি।
--না না, ওরা পয়সা দেয়। কখনও আমরা ভালবেসে দিই, সে কথা আলাদা। এই যেমন তোমাকে খাওয়াচ্ছি। তোমার থেকে পয়সা নেব? রাম রাম!
আমরা গল্প করতে থাকি। ওরা আবার কাপে মহুয়া ঢালে।
আরে তুমি হল গবরু জোয়ান, ওইটুকুতে কী হবে?
জান তো আমাদের মেয়েরা কাকে পছন্দ করে? মেনিমুখোদের একদম নয়। জোয়ান ছেলে ডেঁড়েমুশে খাবে, এক এক পাত্তর মহুয়া বা শালপি গলায় উপুড় করবে। কিন্তু তিরের লক্ষ্য ফসকাবে না।
খাওয়া শেষ হয়।
মহুয়া একটু একটু করে মাথায় চড়ছে, টের পাচ্ছি।
বারান্দা দিয়ে দু’জন যেতে যেতে উঁকি মেরে ডান হাত তুলল, আমি কি ভুল দেখছি?
এমন সময় সোনালী এসে আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেল।
--কী অবস্থা? হেঁটে গাড়ি অব্দি যেতে পারবেন? নাকি ধরে ধরে নিয়ে যেতে হবে?
--আমি ঠিক আছি। এখন উঠোনে গিয়ে ওদের ইন্টারভিউ নেব, অন্ততঃ কুড়ি জনের। আমি কাজে ফাঁকি দিই না, সে কোসলে স্যার যাই বলুক।
--না, ওসব হবে না। আপনি কিছু গড়বড় করেছেন। কে আপনাকে বলেছিল মাওবাদীদের নিয়ে এত কথা জিজ্ঞেস করতে?
--তাতে কী হয়েছে?
--আর য়ু ডাম্ব, অর হোয়াট? বুঝতে পারেন নি যে এখানে সবাই মাওবাদীদের ‘সংঘম’ বা মাস অর্গানাইজেশনের মেম্বার। মেয়েমদ্দ ছেলেবুড়ো সবাই। এমনকি শিক্ষাকেন্দ্রের হোতা চনেশরাম, ওর বৌ কে নয়!
এমনকি আজ এখানে কিছু ‘দলম্’ বা অ্যাকশন স্কোয়াডের সদস্যও রয়েছে। সবাই আপনাকে নজরে রেখেছে।
আপনি এসেছেন শিক্ষাবিভাগ থেকে, মাওবাদীরা কিছু বলবে না। ওদের সমর্থন না থাকলে এই ঘোর জঙ্গলে সরকারের লোক এসে ট্রান্সফর্মার ইন্সটল করতে পারত?
কিন্তু আপনি যেসব প্রশ্ন করছেন তার সঙ্গে শিক্ষাবিভাগের কোন সম্পর্ক নেই।
কাজেই প্রশ্ন উঠছে আপনি কে? শিক্ষাবিভাগের লোক? নাকি ওই বাহানায় ওদের গভীরে ঢুকে পরা পুলিশের স্পাই?
আরে আপনার যা জানার ইচ্ছে সেটা চনেশরামকে জিজ্ঞেস করলেই হত। আর বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে দু’জন আপনাকে মুঠো করা হাত তুলে লাল সেলাম বলল, আপনি কোন রেসপন্স দেননি যে?
--আমি ওসব ছাতার কী জানি? কেউ বলে দেয় নি তো!
--ঠিক আছে, এখন মানে মানে ফিরে চলুন দন্তেওয়াড়ায়। আমরা একটা শর্টকাট রাস্তা দিয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব।
গাড়িতে ওঠার সময় খেয়াল হল আরে, সোনালীও ওর জীনসের উপরের টপ বদলে একটা সবুজ কুর্তি পরে নিয়েছে, এবং সেটা খাদি কাপড়ের।
কখন পোষাক বদলালো? আচ্ছা, বীজাপুর কালেক্টর অফিসের লাগোয়া গেস্ট হাউসে খাওয়াদাওয়ার পর যখন ওয়াশরুমে গেছল, নাকি এখানে ‘নয়া খাই’ উৎসবের মাঝে?
মজার ব্যাপার তো!
ওকে বলায় হেসে ফেলল—যাক, আপনি আমার পোষাকও খেয়াল করতে শুরু করেছেন? তাহলে রাগ একটু কমেছে নিশ্চয়ই।
আর কী জানেন? একযাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে? তাই ম্যাচিং পোষাক পরে নিলাম।
জবাবে হাসলাম বটে, কিন্তু কোথাও একটা অস্বস্তি রয়ে গেল।
রওনা হওয়ার আগে চনেশরাম এল একটা লালরঙা শার্ট পরে।
সোনালী বলল, ও এক মোটর বাইকের পেছনে বসে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাবে। পাহাড়ি বনের মাঝে শুঁড়ি পথ। ওপর থেকে দাদালোগ ঠিক আমাদের দেখতে পাবে, যেমন বাঘ দেখতে পায়।
ওর লালশার্ট অনেক দূর থেকে দেখা যাবে। ওটা সিগন্যাল, যেমন- হু গোজ দেয়ার? ফ্রেন্ডস্ ।
আমরা রওনা দিলাম।
সত্যিই গা ছমছমে নীচু রাস্তা, কিন্তু পিচঢালা। বেলা সাড়ে চারটে, কিন্তু দ্রুত অন্ধকার হতে চলেছে। এর মধ্যে কী করে চনেশরামের জামার লাল রঙ কারো চোখে পড়বে তা খোদাই জানেন।
গাড়ির স্পীড কুড়ি থেকে তিরিশ।
কতক্ষণ ধরে যাচ্ছি? তা প্রায় একঘন্টা হবে।
কোথাও ধুসর একটা খরগোস লাফাতে লাফাতে চলে গেল। একটা উইঢিবির পাশে খেঁকশিয়াল আমাদের দেখে সরে গেল। ছোট্ট শরীরে বিশাল লেজ। এবার চোখে পড়ল রাস্তায় কয়েকটা কাটা জায়গায় সিমেন্ট দিয়ে মেরামতের চিহ্ন।
ড্রাইভার স্থানীয় ভাষায় সোনালীকে কিছু বলল।
সোনালী তর্জমা করল—মাওবাদীরা প্রতিবছর শহীদ দিবস পালনের সময় এখানে রাস্তা কাটে, গাছ ফেলে ব্যারিকেড বানায়। সিকিউরিটি ফোর্স পরে এসে সারিয়ে দেয়। এগুলো তারই চিহ্ন।
এবার আলো অনেকটা কমে গেছে। ড্রাইভারকে হেডলাইট জ্বালাতে হবে। সামনে একটা সরু বাঁক। গাড়ি স্পীড আরও কমিয়ে সাবধানে একটা টার্ন নিতে গিয়ে পুরোপুরি থেমে গেল।
কারণ, আমাদের চমকে দিয়ে বেজে উঠেছে একটা হুইসল, বেশ চড়া সুরে। আর বাঁকের মাথায় দু’দিকের টিলার উপর থেকে নেমে এসেছে অন্ততঃ দশজনের একটি সশস্ত্র দল। তারা কোন কথা না বলে ইশারায় আমাদের গাড়ি থেকে নামতে বলল।
ড্রাইভার আগেই নেমে মাথার উপর হাত তুলে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল—লাল সেলাম!
আমি ও সোনালী নেমে দাঁড়াতেই দুজন করে বন্দুকধারী আমাদের দু’পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর আমার পকেট, কোমর , সব হাতড়ে দেখার পর ইশারা করল ওদের সঙ্গে যেতে।
ওরা রাস্তা ছেড়ে ওপরের দিকে উঠতে লাগল। একটু খাড়া পথ। গাছগাছালি ঝরাপাতা আর পাথরের মাঝে অনভ্যস্ত পায়ে চলা বেশ মুশকিলের। দু’বার হোঁচট খেয়ে কোনরকমে টাল সামলানোর সময় ওরা শক্ত হাতে আমাকে ধরে নিল।
আমার ভাবার ক্ষমতা নিঃশেষ । টের পেলাম শুদ্ধ মহুয়ার বাড়তি এনার্জিও আমাকে ছেড়ে গেছে।
বেশিক্ষণ ভুগতে হল না। মিনিট কুড়ি পরে একটা অপেক্ষাকৃত সমতল জায়গায় পৌঁছলাম।
একটা ছোট আগুনের কুণ্ড, পাশে কিছু লোকজন বসে কিছু খাচ্ছে। আবার সেই গরম ভাত, এবং মহুয়ার উগ্র গন্ধ। এখানেও ‘নয়া খাই’?
কিন্তু অগ্নিকুণ্ডের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে একটি লোক, তার সাদা লুঙ্গির মত করে পরা ধুতি এবং সাদা দাঁতের হাসি এই অন্ধকারেও চোখে পড়ছে।
কমরেড লাল মুহম্মদ!
--ওয়েল কাম! মোস্ট ওয়েল কাম!
আপনি জেনে সুখী হবেন যে আপনারা রওনা দেবার আধঘন্টা পরে ওখানে সিকিউরিটি ফোর্সের বিরাট বাহিনী পৌঁছে গেছল। ওরা তছনছ করেছে শিক্ষাকেন্দ্রের বইপত্তর ও আসবাব মায় টিভি সেট। ভেঙে দিয়েছে উনুন আর গ্রেফতার করেছে এককুড়ি বুড়োবুড়ি ও মেয়েছেলেকে।
আপনাদের শিক্ষাকেন্দ্রের চনেশরামের বৌকেও ওরা তুলে নিয়ে গেছে।
ওয়েল ডান, ছোটে জাসুস!
(আগামী সংখ্যায় শেষ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।