ইন্দ্রাণী দত্তের গল্পের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় প্রায় দেড় দশক আগে, গুরুচণ্ডালীর পাতায়। গল্পটির নাম “খুঁটে খাওয়ার গ্রাফিতি”। প্রথম পাঠের পর খানিকক্ষণ আচ্ছন্নের মত চুপচাপ বসে থেকে আবার পড়তে শুরু করেছিলাম। কারণ ওঁর লেখা বিশেষ মনোযোগ ও অভিনিবেশ দাবি করে। তারপর গল্পটি ধীরে ধীরে তার সমস্ত সৌন্দর্য পরতে পরতে পাঠকের কাছে তুলে ধরে।
আমি ইন্দ্রাণীর গল্প দুনিয়ার আঙিনায় সন্তর্পণে পা ফেলি এবং বিব্রত বোধ করি। কারণ ওঁর লেখা গল্প পাঠের সময় আমার নিজের লেখার সীমা ও অসম্পূর্ণতার উপলব্ধি হয়। ঠিক যেন স্কুলের ম্যাগাজিনে হাত মকশো করতে শুরু করা ছেলেটি সিদ্ধিপ্রাপ্ত কোন লেখকের গল্প পড়ছে।
হ্যাঁ, ইন্দ্রাণীর কলম বর প্রাপ্ত। একটু ভেঙে বলি।
আমার গল্পে খুব স্পষ্ট সাদা কালো চরিত্র, প্লট ও নাটকীয়তা এবং মেলোড্রামা থাকে, অনেকটা টিভি সিরিয়ালের জাতের। ওটাই আমার সীমা।
ইন্দ্রাণীর লেখা মেলোড্রামা বর্জিত, চরিত্রগুলো অমন সাদাকালো নয়, এই দুনিয়ার ঘুরন্ত নাগরদোলায় তারা অনেক সময়ই দিশা হীন, কারণ ওরা পুরোপুরি বুঝতে পারেনা তাদের চারপাশের পরিবেশকে, চেনে না মানুষজন বা নিজের ঘরের লোকজনকে, হয়ত নিজেকেও পুরোপুরি।
আর লেখক ইন্দ্রাণী নিজে? উনি দ্রষ্টা হয়ে দেখেন পরিস্থিতির চাপে অসহায় মানুষজন। এবং নির্মমভাবে ছেঁটে ফেলেন ‘সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন’ সমাপ্তির সম্ভাবনাগুলোকে। কোন ইচ্ছাপূরণের চেষ্টা চোখে পড়ে না। হিংসা ঝলসে ওঠে নীল আকাশে অকস্মাৎ। না একটু ভুল হল। ইন্দ্রাণীর বিশ্বে হঠাৎ করে কিছুই ঘটেনা। বজ্রগর্ভ মেঘের প্রস্তুতি চলে সন্তর্পণে। সমতলের নীচে টেক্টোনিক প্লেটের নড়াচড়া সহজে চোখে পড়বে না। কিন্তু ঈশান কোণে জমতে থাকা মেঘ মনোযোগী পাঠকের রাডারে ধরা পড়বে।
এহ বাহ্য। ইন্দ্রাণীর কলম সূক্ষ্ম আঁচড়ে এঁকে ফেলে রূপ রস গন্ধের এই জগতকে। কিন্তু একেবারেই রোম্যান্টিক রঙ চাপান না উনি। অথচ ওঁর গল্প ভীষণ সেন্সুয়াল। কোন কোন গল্প আমাদের দমবন্ধ করে দেয়। কিন্তু সবশেষে বুঝতে পারি ইন্দ্রাণীর চোখে মানুষের জীবন, এবং প্রাণপণে বেঁচে থাকা কত দামি, কত জরুরি।
এসব কথাই মনে হোল গুরুচণ্ডালী প্রকাশিত ইন্দ্রাণী দত্তের দশটি গল্পের গল্প সংগ্রহটি পড়তে গিয়ে, নাম দিয়েছেন –“পাড়াতুতো চাঁদ”। এটি এই সংগ্রহের নবম গল্পের শীর্ষকও বটে। না, আমি স্পয়লার দেব না। কিন্তু স্বাদ গন্ধের কিছু আভাস দেব।
আগে গন্ধের দুনিয়ায় নিয়ে যাই।
প্রথম গল্প ‘রোব্বারের পরদিন’ এর এই লাইনটা দেখুন-
গ্রিলের ওপরে নাক নিলে রোদের গন্ধ ওঠে।
সেদিন গলিটা অন্যরকম ছিল-লুচির গন্ধ, পেঁয়াজ রসুন গরম মশলা, রজনীগন্ধার গন্ধ মিশছিল একসঙ্গে, বাঁশের ম্যারাপ, রঙিন কাপড়, সানাই। (পাড়াতুতো চাঁদ)
ঘরের দেওয়াল নীলচে সবুজ, বড় ঘর। একটাই টিউব জ্বলছে- মাকড়শার জাল আর কালো ঝুল টিউবের সর্বাঙ্গে-ঘরের সব কোণে আলো পৌঁছচ্ছে না। আধো অন্ধকারে দুটো রসগোল্লা চামচ দিয়ে কেটে কেটে খাচ্ছিল পবিত্র। খুব ঠান্ডা রসগোল্লা-শতদল মেসো ফ্রিজ থেকে বের করে দিয়েছে। চামচে সামান্য আরশোলার গন্ধ। (ক্রায়োনিকস)
এবার দেখুন রোদ হাওয়া আর রঙের অনুভূতি -“এই সময় মেঘের পিছন থেকে সূর্য বেরলে স্বপ্না জলের ধারা আলোর গতিপথে উঠিয়ে আনে- দেখে নীল, দেখে সবুজ, কমলা। রঙেরা ঈষৎ কাঁপে, মিলেমিশে যেতে থাকে, একসময় রোদ আর জল আলাদা হয়ে যায় ফের”। ‘রোব্বারের পরদিন’
বাতিঘর বলতে কালচে ইটের একটা লম্বাটে গাঁথনি। নিচের দিকটা নীল রেলিং দেওয়া ঘেরা। তার ওপরে দুটো তলা দেখা যাচ্ছে। ছবিটা ঐ খানেই শেষ হয়ে গেছে। ঢেউয়ের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। সাদা আর সবুজ সমুদ্র সম্পূর্ণ ঘিরে নিয়েছে বাতিঘরকে। নীল রেলিঙের একটু নিচে ঢেউ আছড়ে পড়ে ওপরের দিকে উঠছে। (কুপরিবাহী)
রোদ বড় গুরুত্বপূর্ণ লেখিকার কাছে। বারবার ফিরে ফিরে আসে রোদের বর্ণনা, রোদ যেন জীবনের ওমে’র প্রতিমান।
শীতের দিনে অশক্ত মানুষ যেমন রোদে পিঠ দিলে আরাম পায়, সমস্ত দিন রোদ নিয়ে থাকতে চায়, আর রোদ না উঠলে মৃত্যুভয়ে আর অসহায়তায় লেপের তলায় কুঁকড়ে থাকে, রোদকেই বেঁচে থাকার একমাত্র উপকরণ ভেবে নিয়ে নিতান্ত কাঙালপনা করে যেন, সমরেশেরও সেইরকম কাউকে ভীষণরকম আঁকড়ে ধরে বাঁচা। (সমরেশের জীবনদেবতা)
আর একটি সেন্সুয়াল ছবি দেখুন।
‘ফড়িং, জলের খুব কাছ দিয়ে নির্দিষ্ট উচ্চতায় উড়ছিল। পুলের এক দিক থেকে অন্য দিকে উড়ে যাচ্ছিল আবার ফিরে আসছিল, যেন জলের সমান্তরাল কোনো বাতাসের তরঙ্গে সাঁতার দিচ্ছিল’।
‘মাঝরাত নাগাদ বাথরুমে ঢুকে আলো জ্বালাতেই, কমোডের সিস্টার্নের ওপর অসম্ভব সুদর্শন, শান্ত পাইথনটিকে দেখতে পায় মায়া। মোবাইলে ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার করে সঙ্গে সঙ্গে’।
সেই সকালে, মায়ার সুখ ভরা মনে পোষা সাপ, ডিভোর্স আর অ্যালিমনি শব্দগুলো খচ খচ করে ঢুকেছিল। এ’বাড়িতে সাপ ছিল একদা, এ’বাড়িতেই বিচ্ছেদ হয়েছিল নবীন দম্পতির-এই সব মেনে নিতে অসুবিধে হচ্ছিল মায়ার। (নাইদার নাইট নর ডে)
এই পরিযায়ী এন আর আই দুনিয়ার সঙ্গে ইন্দ্রাণী খুব পরিচিত, আমি নই। তাই দু’চোখে গিলি ওঁর দুনিয়ার বর্ণনা, কিন্তু টের পাই সম্ভাব্য মৃত্যুর গন্ধ।
কবির কল্পনার উড়ান এবং মায়াকাননের সৃজন:
শুনুন, সুলতান নামের ফেলে যাওয়া এক অন্ধ ঘোড়ার গল্প।
সুলতান আমার কথা বোঝে। আসল কথা কি জানেন স্যার, সুলতানের সঙ্গে একটা কানেকশন হয়ে গেছে। অকস্মাৎ সুলতান তার লুক্কায়িত দুই পক্ষ বের করে আনে, বিস্তার করে, ঝাপটায়। তারপর উড়ান দেয়। সিতাংশুর মা দু’চোখ ভ’রে পক্ষীরাজ দেখে চাঁদের আলোয়। দেখতে থাকে, পক্ষীরাজ পিঠে মানুষ নিয়ে ইছাবটের দিকে উড়ে যাচ্ছে।
সেই সময়, বল্লভপুরের হরিণের বন পেরিয়ে এক বিশাল গজরাজ আম্র কুঞ্জের দিকে ধাবিত। সে ঐরাবতের সর্বাঙ্গে অলংকরণ, পৃষ্ঠে সুসজ্জিত হাওদা। (সমরেশের জীবনদেবতা)
হাল্কা সাদা মেঘের ওপর একখণ্ড কালো মেঘ, তার ফাঁক দিয়ে বিকেলের রোদ-হাওয়ায় হাওয়ায় কালো মেঘে মুখ তৈরি হল, তারপর নাক, কোঁকড়া চুল- যেন মোমের আলোয় উত্তমকুমার ওথেলো হল, তারপর হাত দিয়ে আড়াল করে চুমু খেল সুচিত্রা সেনকে। তারপর আবার বাতাস বইল। উত্তমকুমার কুঁজো মত বুড়ো মানুষ হয়ে গেল তারপর উট। (কল্প)
“ব্যালকনির সমস্ত টুনি বাল্ব যেন একসঙ্গে জ্বলে উঠেছিল- দিন হোক রাত হোক, তারা জ্বলেই রইল বারান্দায়, সুইচ অফ করতে যেন সবাই ভুলে গিয়েছে”। (পাড়াতুতো চাঁদ)
এখন আমি যদি বলি ইন্দ্রাণীর গল্প গুলোয় পরতে পরতে কবিতার আমেজ তাহলে কি খুব ভুল হবে?
নীল আকাশে ঝলসে ওঠা হিংসা:
বিকেলে গেট খুলে বারান্দায় উঠেছি, দেখি- কালীচরণ পাগলের মত সঙ্গম করছে খেলনাটার সঙ্গে। কান মাথা ঝাঁঝাঁ করে উঠল আমার। খেলনাটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললাম এক কোণে। কালীচরণ দৌড়ে কুড়িয়ে আনল। আমার সামনে ধড় আর মুণ্ডু আলাদা করল এক কামড়ে, তারপর কবন্ধ মুখে করে বসে রইল বারান্দায়। (আকর্ষ)
সেই সকালে, মায়ার সুখ ভরা মনে পোষা সাপ, ডিভোর্স আর অ্যালিমনি শব্দগুলো খচখচ করে ঢুকেছিল। (নাইদার নাইট নর ডে)
কথিত আছে, সন চোদ্দশ’বাইশ বঙ্গাব্দে আশ্বিনের সকালে বড় রাস্তা ধরে এক দল হরিণকে দৌড়তে দেখা গিয়েছিল। যানবাহন রুদ্ধগতি, এবং পথচারীরা থমকে দাঁড়িয়েছিল। অজস্র টুরিস্ট আর স্থানীয় বাসিন্দা সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছিল। সেল্ফি তোলার সাহস করেনি কেউই। তীব্র গতিতে ছুটে যাওয়া সমস্ত হরিণের চোখ রক্তবর্ণ, গ্রীবাভঙ্গি গর্বিত এবং শৃঙ্গ উন্নত ছিল। (মৃগ-দাব)
পয়লা আষাঢ়ের মেঘলা দুপুরে, দীপ্তি, উমা, ঝিমলি, সিটি সেন্টারের মানুষজন, আলো, বেলুন, দোকানপাট, ম্যানিকুইন চোখ কচলে দেখল কে এফ সির সামনে কমলা কালোয় ডোরা কাটা বিশাল বাঘ ল্যাজ আছড়াচ্ছে আর মুহুর্মুহু গর্জন করছে। (পয়লা আষাঢ়)
গোটা বইটার সবগুলো গল্প পড়ার পড়ে আমার কাছে স্পষ্ট হল ইন্দ্রাণী কী চান। উনি চাইছেন ‘কানেকশন; গড়ে উঠুক- লেখক হিসেবে পাঠকের সঙ্গে এবং একজন মানুষের আরেকজনের সঙ্গে। কারণ ওঁর এক্স-রে আই ধরে ফেলেছে আজকের মানুষ বড্ড একলা, কারণ তাদের কানেকশন নেই– এক ছাতের নীচে থেকেও নেই, পাশাপাশি বাড়িতে থেকেও একই অবস্থা।
পুনশ্চ:
কেন লেখ প্রশ্নের উত্তরে একজন পাকিস্তানি মহিলা কলকাতা থেকে আমেরিকায় এসে পায়ের নীচে জমি খুঁজে বেড়ান মেয়েটিকে জানায়:
“আসলে, একটা নদী আছে কোথাও, দেখা যায় না, তবে আছে। সেই নদীর ধারে, সন্ধ্যার পরে অদ্ভুত এক হাট বসে। সেখানে দুঃখের বেচাকেনা হয়। ঐ নদী যেদিন দেখতে পাবে, লেখা ছাড়া গতি থাকবে না।” (নাইদার নাইট নর ডে)
আরে এটাই তাহলে ভাল লেখার চাবিকাঠি! ইন্দ্রাণী অনেক আগেই পেয়ে গেছেন। আমি এখনও হাতড়ে চলেছি।