চান্দুর ঠাকুমা সুন্দরবন লােকালে যখন ভােরবেলা ওঠে, তখন ভিড় একেবারেই নেই বললেই চলে। বিশেষ করে লেডিজ কম্পার্টমেন্টে। চান্দুটা আজও খুব বায়না ধরেছিল—
-আমি তাের সঙ্গে কলকাতা যাব। কিন্তু এক বস্তা শাকপাতা ঘাড়ে করে, নাতির হাত ধরে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানাে চাট্টিখানি কথা না। তাই আসবার সময় জিলিপি আনবাে, ব্যাটবল আনবো এই সব প্রলােভন দেখিয়ে কোনােরকমে ঠেকিয়ে রেখে এসেছে। একটানা ভুগতে ভুগতে চান্দুর স্বভাবটাও বড় খ্যান খ্যান হয়ে গেছে। চার মা মােমিনার এক কথা
—প্রতিদিন ঐসব ছাতামাতার শাক-পাতা গিলিয়ে গিলিয়ে ছেলেটার আমের ধাত কাটতে দেয় না বুড়িটা। মােমিনা যখন মুখ ছােটায়, তখন ঠিক একইভাবেই বলে।
শয়তান বুড়ি, ভাতার খেয়েছিস। নিজের জোয়ান ছেলেটারে খেয়েছিস এখন আমার ছেলেটারে না খেলি পর তাের নােলা মিটবে না—না?
আনােয়ারার তখন বড় কষ্ট হয় মনটার ভিতরে। আরও ব্যথা পায় বৌটা যখন হাড় জিরজিরে ছেলেটার পিঠে
—মর, মর মরতে পারিস না বলে গুম গুম করে বিল কষিয়ে দেয়। রােগা ভােগা ছেলেটা মা'র কাছে মার খেয়ে ঠাকুমার কোলে ঝাঁপায়—আর একটানা নাকি সুরে কেঁদে চলে
–ওঁ নাঁনি আঁয়ি তোঁর সঁঙ্গি যাব। মা মারবে।
আনােয়ারা তবু বেটার বৌ'কে কিছু বলে না। অকালে, যৌবনে স্বামী চলে গেলে কোন মেয়ের মাথার ঠিক থাকে। নিজেরও তাে এমন দিন জীবনে একটা সময় গেছে। সে সময় শরীর মনের জ্বালা সেও তাে বুঝেছিল। চান্দুর নানা যখন মরলাে চান্দুর বাপ তখন মাই খায়। মাথার উপর শূন্য আকাশ হাতড়াতে হাতড়াতে শাকপাতাকে আঁকড়ে ধরে চান্দুর নানি, আনােয়ার বেওয়া।
মােমিনার বাপের বাড়ি একবারে যে হা'ঘরে তা নয়। বাপ দাদা, গতরে খাটা মানুষ। শাশুড়ির সঙ্গে ঝগড়া করে, মােমিনা মাঝে মাঝেই বাপের বাড়ি চলে যায়। আর মােমিনা না থাকলে দু'চারদিন বাদেই ডাঙায় তােলা মাছের মতাে ছটফট করে আনােয়ারা। শূন্য খাঁ খাঁ করে তার প্রাণটা। সারাক্ষণ বুকের ভিতর যেন হাপসি কাটে। সংসারের শূন্যতা ঘােলা জলে শােল মাছের মতে, ঘাই দেয় অন্তরে। ছেলের বৌকে খুশি করবার জন্য ইনি! ড্রেসার্স থেকে কুল হপ দেওয়া গােলাপি, বেগুনি, হলুদ কত রকম রঙের শাড়ির ভিতর থেকে একটা বাকিতে কিনে নিয়ে মােমিনার মান ভাঙাতে যায়। স্নেহ যে বিষম দায়। দোকানদার ছেলেটা প্রতিবারই বাকি আর বর্তমানের হিসাব কষতে কষতে হাসিমুখে বলে| -কি গাে নানি, বেটা বৌ-এর মান ভাঙাতে যাচ্ছে বুঝি? সলজ্জ হাসে আনােয়ারা। মোমিনা তো শুধু তার ছেলের বো না, মেয়েও বটে।
চল রেলগাড়িতে সবার জায়গার অভাব না থাকলেও আনােয়ারা দরজা ঘেঁষে একপাশে বসে। বসিরহটি আর ভ্যাবলা স্টেশনে এত ভিড় হয় যে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। শাক পাতার বস্তু নিয়ে সিটে বসলে সকলে বড়াে রাগ করে। অবশ্য দরজার পাশে বসার জন্যও মুখ খেতে হয় যথেষ্ট। চাকরি করা মেয়ে মানুষ ইস্কুলের দিদিমণি, এমনকি স্কুলকলেজের ছুঁড়িও বিজ্ঞ মুখে বলে| -কি গো মাসি দরজা আটকে বসে আছে, উঠবাে কী করে? আবার একটা বস্তাও রেখেছে! কী আছে ওতে—মুরগির ছাঁট উটি নয়তাে? মিন মিন করে আনােয়ারা।
-ও তো শাকপাতা। মুরগির ছাঁট হতি যাবে কেনে?
তবে আজকের দিনটা একেবারে অন্যরকম। নিমদাড়ি ছেড়ে ট্রেনটা অনন্তপুর স্টেশনে আসলে পুজো দিয়ে হাঁসের মতাে লম্বা গলা বাড়িয়ে বাইরেটা দেখে। দুর্গাপুজো, ঈদের পর লেনলে সােনা গলানাে রােদ চারপাশ ঝকঝক করছে। আনােয়ারার কপালে বলিরেখাগুলো যেন জ্যামিতিক আঁকিবুকি হয়ে আছে। নিচের ঠোটের ভাঁজে খইনির টিপটা রাখতে রাখতে চান্দুটার কথা বড়াে মনে হয়।
-ছেলেটার জন্যি ব্যাট বল কিনি নে যেতি হবে! নাকছাবির ছিদ্রটার হা মুখটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড়াে হতে হতে এখন একেবারে খোদল। উঁকিঝুঁকি দিতে পারলে ঈদের চাঁদও দেখা যেতে পারে।
বসিরহাট, ভ্যালাে সেশনের পর থেকে লেডিজ কম্পার্টমেন্টটার চিঁড়ে চ্যাপটা ভিড়ে হরেক রকম শব্দে সে একেবারে খেলার মাঠের পরিবেশ তৈরি হয়। গুমােট গরমে সকলের একেবারে প্রাণান্তকর অবস্থা। কত রকমের জিনিস সাজিয়ে হকার পসরা মেলে ধরেছে। হার টিপ, চুড়ি, পানি, গরম চা, দই, আইসক্রীম, ছােটোদের ধারাপাত, মেয়েদের ব্রতকথা কী নেই সেখানে। যেন একেবারে বিগবাজার শপিংমল। অন্ধ ভিখারি ছােটোমেয়ের হাত ধরে হাজার হরবােলার মধ্যে বেসুরাে বাউলগানের সুর ধরে-খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেনি আসে যায়/তারে ধরতি পারলি মন বেড়ি দিতেম পাখির
চান্দুর ঠাকু্মা সুর করে গলা মে্লায়
নেবে নাকি মায়ের চোদ্দশাকের আঁটি কাল তাে চতুর্দশী, চোদ্দ পিদিম জ্বলবে। চোদ্দ শাক খেতে হবে তবেই তে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোয় মা লক্ষ্মী পেঁচার পিঠে করে আপনার ঘরে আসবেন। নেবে নাকি গাে দিদির চোদ্দ শাকের ডাক শুনে স্কুল কলেজের মেয়েগুলাে বাদে সবাই প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এমনকি বই বিক্রির হকার নির্মল পর্যন্ত বলে --
–দাও তাে মাসি দু'আঁটি।
এক আঁটি তিন টাকা শুনে অনেকেই গাঁই গুঁই করে ওঠে- এত দাম!
–ওরে বাবা বলাে কি মাসি আঁটি তিন টাকা। কালে কালে হল কি। ঘাসপাতারও এত দাম ! নিমর্দাড়ি গ্রামের মৃত মােক্তার গাজির আম্মা, চান্দুর নানি, মােমিনার শাশুড়ি আনােয়ারা বেওয়া মনে বড়াে ব্যথা পায়। ঘােলাটে চোখে মলিন হেসে বলে
—ঘাস পাতা বলতেছে কেন গাে মা। দুদিন ধরি গেরামে গেরামে ঘুরি ঘুরি চোদ্দ রকম শাক বেছে বেছে তুলি আনিছি। আমি কি জানি না চোদ্দ পিদিম জ্বালানাে, চোদ্দ শাক খাওয়ার মাহাত্ম্য কত। মাছের বাজারের মতাে হৈহৈ চিৎকারে কেউ আর চোদ্দ শাকের গুণগান শুনতে চায় না। ইরিগেশন অফিসের বড়দি তবু দরদাম করে যায়।
—পাঁচ টাকায় দু'আঁটি দাও তাে তােমার অর্ধেক শাক এখানেই বিক্রি হয়ে যাবে।
আনােয়ারা মনে মনে ভাবে তাই সই। পাঁচ টাকাতেই দুআঁটি রফা হয়ে গেলে ভােজবাড়ির মতাে শাকগুলাে উবে যেতে থাকে। খুব খুশি চান্দুর ঠাকুমা। অর্ধেক বস্তা এখানেই খালি হয়ে যায়। বহিরা কালীবাড়ির প্রীতিলতা গার্লসের বােটানির শিক্ষিকা আভা
—ও মাসি বললে তাে চোদ্দশাক আছে। দেখাও তাে কোনটা কোন গাছের পাতা। আনােয়ারা তাড়াতাড়ি এসে একটা শাকের তােড়া হাতে নিয়ে চরম উৎসাহের সঙ্গে দেখাতে থাকে
। —এটা হল গে শান্তি শাক। এটা ছােলা। এই পাতাটা রাঙা আলুর। ফোকলা দাঁতে দ্বিতীয় শৈশবের হাসি হেসে বলে
-খুব কষ্ট করি জোগাড় করতি হয়েছে গাে মা।
আভা মৈত্রর কাছাকাছি অনেকেই ঝুঁকে পড়েছে। হামলে পড়ে এটা কী ওটা কী বলে। চেঁচাতে থাকে। আভা মৈত্র সবাইকে থামিয়ে দিয়ে দিদিমণি সুলভ গাম্ভীর্যে বলে ওঠে
-এ্যাই এ্যাই চুপ চুপ সবাই। বললা তাে মাসি ওটা কী? আনােয়ারা আবার বলতে শুরু করে -ওটা হল গে ক্ষুদে ননী।
স্কটিশচার্চ কলেজের ম্যাক্স অনার্সের পারমিতা খিলখিল করে হেসে উঠলে আনােয়ারা একটু চুপ করে যায়। খাদ্য দপ্তরের ইলাদি পারমিতাকে কপট ধমকে ওঠে
-এই খুঁড়ি হাসতাছ কেরে? বলাে তাে বুড়িমা ওডারে কি কয়? আনােয়ারা এবার ঝটপট বলে যেতে থাকে—গাঁদামনি। এটা বৌ টুনটুনি।
পারমিতা আবার হেসে উঠতে গিয়েও আভা মৈত্রর চোখাচোখি হতেই চুপ করে যায়। আনােয়ারা এই গােপন অভিনয় খেয়াল করে না।
| আপন মনে বলতেই থাকে
--তারপর ওটা হল গে সাদানটে, রাঙানটে, গােয়াল নটে। এই পাতাগুলাে তাে সজনের পালং, মটরশাক, তবে এই দুটো কাঁচড়াদাম আর পুনর্নবা।
চোদ্দশাকের চাঁদমারি হয়ে যাওয়ার পর কম্পার্টমেন্টের চারিদিক চোদ্দরকম গুঞ্জনে ভরে যায়। আভা মৈত্র ইলাদিকে বলে
-দেখলে ইলাদি কতরকম শাকের নাম শুনলাম। আমার বাপের বাড়িতে খুব নিষ্ঠা সহকারে চতুর্দশী তিথিটা পালন করা হয়। প্রত্যেকে চোদ্দশাক খাবে। চোদ্দ প্রদীপ জ্বালাবে। এখন অবশ্য প্রদীপ পাওয়া একটা কঠিন ব্যাপার তাই মােমবাতিতেই কাজ চালিয়ে নিতে হয়। তবে আমার শ্বশুরবাড়িতে এসব কিছু মানে না। এসব নাকি কুসংস্কার। সব এক একজন আইনস্টাইন বুঝলে তাে। ইলাদি মৃদু হেসে চোখ দুটো একটু বন্ধ করে। ট্রেনের দুলুনিতে ঝিমুনি এসে গেছে। আভা মৈত্রকে বাধ্য হয়েই চুপ করে যেতে হয়।
দমদম জংশন আসলে শাকের বস্তাটি নিয়ে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে যায় আনােয়ারা। শেষ আশ্বিনের চাঁদিফাটা রােদ। সকাল হতে না হতেই সূর্যটা যেন দিনের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে মাঝ আকাশে চলে এসেছে। অসহ্য ভ্যাপসা গরম। সেই সঙ্গে কুলকুল করে ঘাম। মার্কারির মতাে সাদা আলাের ছটায় ভরে আছে চারিদিক। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা প্লাস্টিকের বােতলের জল বারাসাত আসার আগেই শেষ হয়ে গেছে। শাকের বস্তাটা একপাশে রেখে প্ল্যাটফর্মের কল থেকে পেট ভরে জল খায়। প্লাস্টিকের বােতল ভরে নেয়। তারপর শাকের বস্তা ঘাড়ে তুলে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটতে থাকে ঘুঘুডাঙা পুলিশ ফাঁড়ি বাজারের উদ্দেশ্যে।
কালবাদে পরশু দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো। সে কারণেই বােধ হয় অসম্ভব ভিড় বাজারটায়। ফাড়ির ঠিক উলটোদিকে ফুল বেলপাতা বিক্রি করে লক্ষ্মীমণি, তার পাশেই বসে আনােয়ারা। সপ্তাহে চারদিন করে আসে সে। লক্ষ্মীমণি অবশ্য জানত আনােয়ারার আজকে আসবার দিন না হলেও আজ সে আসবেই। গত বছরে এর অন্যথা হয়নি। এ বাজারেও এখন সকলে জেনে গেছে| এই বুড়িমার কাছে খাঁটি চোদ্দশাক পাওয়া যায়। আনােয়ারা আসলে লক্ষ্মীমণি খুশি হয়ে ওঠে। জিজ্ঞাসা করে
-টেরেন কি লেট ছিল ? আনােয়ার শাকের বােঝা রেখে পিঠ সােজা করে দাঁড়ায়
না গাে লক্ষ্মী। ফাস্ট টেরেনটা পেলাম না। লক্ষ্মীমণি খুব চটপটে মানুষ। পাশের অস্থায়ী চায়ের দোকান থেকে কাঁচের গ্লাসে দু’গ্লাস চা আর বিস্কুট নিয়ে আসে। একটা গ্লাস আর বিস্কুট আনােয়ারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে--
-ও নাও খেয়ে নাও আগে। কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে আনােয়ারা। তারপর আপন মনে বলে— কাইল রাত থেকে চান্দুর মা আমার মােমিনা বিটির মাথার পােকাটা নড়ে উঠেছে।
আমায় গাল দিতেছে। ছেলেটারে পিটলাে। জ্যান্ত হারিকেনটা মাটিতে আছড় দিল। আফশােসের সঙ্গে মুখে চুক চু্ক শব্দ তােলে লক্ষ্মীমণি।
-ই। ওরে বাবার ঘরে পাঠায়ে দাও। মাথা নেড়ে হাসে আনােয়ারা।
গাে বু তা হয় না। কাঁচা বয়সে সােয়ামী হারালে কোন মেয়ের মাথার ঠিক থাকে বলাে। ঠিকঠাক ছেলে পেলি আমি মােমিনার বে’ দেব আবার।
চায়ে চুমুক দেওয়া ভুলে লক্ষ্মীমণি তার বন্ধুর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে-মনে মনে ভাবে।
—এমন করে সে তাে কখনও ভাবতে পারে না। বিক্রিবাটা দুজনেরই ভালাে জমে উঠেছে। লক্ষ্মীমণির সব বাঁধা খদ্দের। বাঁধা খদ্দেররা একমুঠো কুচোফুল বেশি পায়। আনােয়ারা দু'হাতে সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। একবার মনে হয়—চান্দুটাকে নিয়ে এলেই ভালাে হত। বেলা বাড়লে দুজনেরই কথা বলার ফুরসত হয়। আনােয়ারার অল্প কিছু শাক তখনও পড়ে আছে। সে জলের ছিটে দিয়ে শাকগুলাে বস্তায় ভরতে ভরতে বলে
-আচ্ছা লক্ষ্মীবু। প্রতি বছরই তােমারে একটা কথা জিগাবাে মনে করি। তারপর ভুলে যাই। তােমরা এই চতুর্দশী তিথিতে চোদ্দ শাক খাও কেন?
লক্ষ্মীমণির ফুল সবই বিক্রি হয়ে গেছে। এলােমেলাে যেটুকু পড়ে আছে রৌদ্রের খরতাপে তা আর ফুলের চেহারায় নেই। লক্ষ্মীমণি আনােয়ারার পাশে সরে এসে টিফিন বাটির ঢাকা খােলে। আনােয়ারাও বস্তার ভিতর থেকে একটা পানিফলের ঠোঙা লক্ষ্মীমণির হাতে দিয়ে বলে
বাড়ি নে যেও। আমাদের ডােবায় হয়েছে। লক্ষ্মীমণি টিফিন বাটির ঢাকনায় দুটোরুটি আর লাল শাকের উঁটার চচ্চড়ি আনােয়ারার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে হেসে বলে
-চোদ্দ শাক খাওয়ার বেত্তান্ত শুনে তুমি কী করবা? হাসে আনােয়ারা। •
বা’রে, যে চতুর্দশীর কারণে এতগুলাে শাক একদিনে বিক্রি করি, এতগুলাে পয়সা রােজগার করি তার মাহাত্ম্যটুকু জানবােনি। | রুটির টুকরাে গালে দেয় লক্ষ্মীমণি। কমলা সু জুতাের দোকানটার পাশে মুরগি বিক্রি করে রমেন। সে একটা মুরগির টুঁটি ছাড়াচ্ছে। পাখিটা বাঁচবার জন্য আকুল চিৎকারে বিকট ক্যাঁ ক্যাঁ চিৎকার করে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীমণি বলে| যুধিষ্ঠির যখন ভায়েদের আর বৌ-রে নে কাম্যক বনে লুকায়ে ছিল, তখন কৃষ্ণ এসি বলে- “দৌপদী তুমি চতুর্দশীর ব্রত রাখাে। তাইলে তােমাদের জঙ্গলে কোন অমঙ্গল হবে না।” চোদ্দ রকম শাক চোদ্দ রকম ফল ফুল, চোদ্দ পিদিম জ্বালায়ে এই তিথি পালতে হয়। তার একদিন পর অমাবস্যার রাতে মা লক্ষ্মীরে কায়মনে ডাকলে তিনি আসেন। গৃহস্থের ঘরে অচলা হয়ি থাকেন।
সূর্যের খরতাপে লক্ষ্মীমণি-আনোয়ারা দু'জনকেই পাততাড়ি গােটাতে হয়। লক্ষ্মীমণি কাছাকাছি থাকে তাই বাস ধরে চলে যাবে। কিন্তু আনােয়ারা বস্তায় তখনও কিছু শাক থাকায় সে সুরের মাঠের ফ্ল্যাটবাড়িটায় একবার যাবে মনস্থির করে। ফ্ল্যাটবাড়ির পায়রার কোটরের মতো ঘরগুলােতে এক এক করে যায়। কেউ নেই। কেউ বা বলে- নাগো মাসি কেনা হয়ে গেছে।
সবমিলিয়ে গুনে গেঁথে দেখে আনােয়ারা বিক্রিবাটা ভালােই হয়েছে। সামান্য কিছু পড়ে আছে। মনে মনে হাসে সে।
-এটুকু না হয় কাল ভাজা করে খেয়ে নিজেরাই চতুর্দশী তিথি পালন করে ফেলবে। চান্দুর জন্য ব্যাটবল কিনে স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকে আনােয়ারা। চারটে ছত্রিশের ক্যানিং হাসনাবাদ ধারে ফিরতে হবে। ট্রেন ঠিক সময়ই আসলে উঠে পড়ে আনােয়ার। গুনে চোখ দুটো জুড়ে আসে। ক্লান্তিতে হাতপায়ে খিল ধরে যায়। ঝিমােতে ঝিমোতে এক সময় গুমিয়েও পড়ে সে। ঘুমােতে ঘুমােতে কখন যে বারাসাত, বেলিয়াঘাটা স্টেশন পার হয়ে যায় টেরও পায় না। ঘুম ভেঙে চমকে গিয়ে দেখে শ'য়ে শ'য়ে মানুষ রেললাইনের ওপর বসে আছে। চারপাশের অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। জোনাকি মিট মিট করছে। আনোয়ারার মাথায় কিছু ঢোকে না। সে ট্রেন থেকে নেমে আসে। একে ওকে জিজ্ঞেস করে জানাতে পারে। | ডাবল লাইন তৈরি করবার দাবিতে অবরােধ চলছে দু'ঘণ্টা ধরে। কখন ট্রেন ছাড়বে। | -হা খোদা! বাড়ি যাব কেমনি করি, বলে প্ল্যাটফর্মেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। কিছু ঠিক নেই। মনে হচ্ছে খিদেতে তেষ্টায় মরে যাবে সে। বসে বসে ভাবতেই থাকে কিন্তু কোন কুল কিনারা মেলে না। শেষ পর্যন্ত পুলিশ আসলে অন্ধকারে জায়গাটা খণ্ডযুদ্ধের আকার ধারণ করে। ভীষণ ভয় করে আনােয়ারার। অসহায় লাগে। রেললাইনের খাওয়া তুলে অবরোধকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। আনোয়ারাও দৌড় লাগায় ভিড়ের মধ্যে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হতে হতে কখন যে কোমরের গাঁটি থেকে পসার ব্যাগটা পড়ে যায়। বুঝতেও পারে না। যখন বুঝতে পারে তখন জানালা দিয়ে একটা খোয়ার টুকরো উড়ে এসে তার কপালে লাগে। আনােয়ারা টাকার কথা ভুলে কপালে হাত দিয়ে মা'রে বলে বসে পড়ে। আশপাশের যাত্রীরাই আনোয়ারার ন্যাকড়া হয়ে যাওয়া কাপড়টা ছিড়ে কপালে বেঁধে দেয়া। শত চেষ্টা করেও কান্নাটাকে আর আগল দিতে পারে না আনোয়ারা। ডুকরে ডুকরে কঁদিতেই থাকে। সমস্ত দিনের রুজি কিছুতেই মনকে সান্ত্বনা দিতে পারে না।
দুলে ফুলে উঠে সে কাঁদতেই থাকে, কাঁদতেই থাকে। লেডিজ কম্পার্টমেন্টে থাকলে তবু দু’চারজন পরিচিত লোক পাওয়া যেত। কিন্তু জেনারেল কামরা হওয়ায় সে সম্ভাবনাও নেই। তবু অচেনা কেউ কেউ এগিয়ে এসে বলে
–ও বুড়ি কাঁদছ কেন? ব্যথা করছে খুব?
মাঝরাত পার করে ট্রেনটা নিমদাঁড়ি স্টেশনে পৌঁছালে শূন্যহাতে আনােয়ারা যখন স্টেশনে নামে তখন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চিরপরিচিত স্টেশনটাকে কেমন যেন প্রেতপুরী মনে হয়। জীবনে এই প্রথম আনােয়ারার মরে যেতে ইচ্ছা করে। শূন্য হাত আরও শূন্য হয়। কী নিয়ে ঘরে ফিরবে সে। আর তখনই কিছুদূর থেকে টিকিট কাউন্টারের নিচে টিমটিমে কুপির আলােটা ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে। আনােয়ারা স্পষ্ট শুনতে পায় চান্দুর গলা।
-ও নানি, নানি কই গেছিলি তুই? মা কানতেছিল।
ততক্ষণে কুপিটাও সামনে এসে গেছে। কাপা কাপা আলােয় দেখে মােমিনা। মােমিনা কাদছে। কেঁদে কেঁদে বলছে
কই গেছিলা মা? চান্দুকে আমারে ফেলায় থুয়ে কই গেছিলা তুমি? মােমিনার মুখে এমন আকুল করা ‘মা’ ডাকে আনােয়ারার ভিতর বাইরে তােলপাড় করে তােলে। আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে চান্দুর ঠাকুমা, আমাদের আনােয়ারা বেওয়া।
-আমার শাক বেচার সব টাকা হারায়ে গেছে গাে-ও-ও-ও। মােমিনা শক্ত অভিভাবিকার মতাে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে।
-ইস কপাল ফেটি রক্ত গড়ায়ে শুকায়ে গেচে। ঘর চলাে। ট্যাকা গেচে তাে কি হয়েছে। আমি তাে আছি। আমার জমানাে কিছু টাকাও আছে। তােমারে অতদুরে আর শাক বেচতি যেতি দিবােনি। এখানেই দু'জন মিলি যা পারি করবাে। এই চান্দু নানুরে শক্ত করি ধর। বােবা হয়ে যায় আনােয়ারা। কান্নার দলাটা হেঁচকিতে পরিণত হয়ে যায়। আনােয়ারা অশক্ত হাত দুটো দিয়ে মােমিনা আর চান্দুকে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরে শেষ রাতের আকাশে ঈদের চাঁদ খোঁজে। তারপরেই মনে হয় ঈদ তাে না এটা তাে চতুর্দশী তিথি। লক্ষ্মীমণি বলেছিল, চতুর্দশীর পরে মা লক্ষ্মীকে ডাকলে তিনি সাড়া দেন। আনােয়ারা যেন বুঝতে পারে তার ঘরে তার বুকের ভিতরও মা লক্ষ্মী ধরা দিয়েছে।