বহুদিন বাদে তোমাকে আবার লিখতে বসলাম। মাঝে গোটা একটা বছর চলে গেছে। ডাকে না ফেলা তোমাকে লেখা চিঠিগুলো মূর্শিদাবাদ থেকে কেনা কাঠের বাক্সে সুগন্ধি দিয়ে রেখে দিই। সেগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। অদ্ভুতভাবে একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম। চিঠিগুলোর ভেতর তোমার গায়ের গন্ধ। খুব অবাক হয়ে ভাবছিলাম এও কি সম্ভব। মাঝখানে যে এক বছর পার হয়ে গেল, সেখানে জমাখরচের হিসেবের খেরো খাতায় উপচে পড়ছে হিসাব। মাগো যতদিন পার হচ্ছে ততই জমার ঘর শূন্যে গিয়ে ঠেকছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পা খাদের কিনারে। একটু এদিক ওদিক হলেই ...........................
যাক তোমার খবর পাই। সেই একহারা নির্মেদ চেহারা, ঋজু, টানটান। টিকালো নাক, বড়ো বড়ো চোখ, পাট পাট করে পরা তাঁতের শাড়ি। কোথাও কোনও টাল খায় নি। সময় তোমাকে থাবা বসাতে পারে নি। শুনে গর্বই হয়। কিন্তু আমাকে দেখো। অতিরিক্ত ওজন, সেখান থেকে সুগার, কোলেস্টেরল সবই একে একে হামাগুড়ি দিয়ে আসছে। চোখে তো এখন চশমা ছাড়া দেখিই না। যাকগে এসব তোমাকে বলছিই বা কেন? আসলে কি বুকের ভেতর যন্ত্রণার দলাটা যখন ফুলতে থাকে তখন দমবন্ধ হয়ে আসে। চোখে অন্ধকার লাগে। তখন শুধু তোমার কথা মনে পড়ে।
তোমাকে ভুলতে চাওয়া আমার একটা চলমান প্রক্রিয়া। আর তোমাকে ভুলতে না পারা আমার এক অভ্যাস। এই অভ্যাসের ফলেই কখনও কখনও অন্যকে তোমার গল্প করি। আর সে সময় আমি ছোট্ট খুকি হয়ে যাই। কোনোদিন বুঝিনি অন্যসব বাচ্চাদের ছেলেধরা যেমন চকোলেটের লোভ দেখিয়ে ক্লোরোফর্ম স্প্রে করা রুমাল মুখে চেপে ধরে টুপ করে বস্তার ভেতর ভরে নেয়, ঠিক তেমনি আমার আস্ত একটা জীবনে এই 'নেই তুমি'র আসনকে পূর্ণ করে দেওয়ার ক্রিমে ভরা, রঙিন রাংতায় মোড়া ছোটবেলা দেবে, হারিয়ে যাওয়া বাস্তুভিটে ম্যাজিক করে ফিরিয়ে দেবে বলে এক রাক্ষস ছেলেধরার রূপ ধরে মুখে ক্লোরোফর্মের রুমাল চেপে ধরে বস্তায় ভরে নিয়েছিল। কিন্তু মা তুমি কি সত্যিই আমার জীবনে কোনদিন কোথাও ছিলে না। শুধু বায়োলজিকাল মাদার! আমাকে গর্ভে নিয়ে তোমার কোনও স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা কিচ্ছু ছিল না! যদি নাই থাকে তাহলে তিল তিল করে আমাকে বাড়তে দিলে কেন তোমার শরীরে? যেইমাত্র আমার আগমন টের পেয়েছিলে মুক্ত করে নিলে না কেন নিজেকে? শুধু খেয়াল! কোনদিন কি কখনও মনে হয় নি চারদিকে হলুদ আলো ঝলমলিয়ে আছে শুধু আমাকে দেখবে বলে। আমার মাথার ভেতর চাপ ধরা মশার ঝাঁক। একঘেয়ে পোঁ পোঁ ডানার শব্দ। কিন্তু আজ আমার সকল প্রশ্নের উত্তর তোমায় দিতেই হবে। আমাকে গর্ভধারণ যদি তোমার জৈব তাড়না হয়ও বা জোর জবরদস্তির ফসল তাহলে অঙ্কুর হওয়ার সাথে সাথে সমূলে তুলে ফেললে না কেন? যদি অঙ্কুর হতে দিলে তাহলে এত আগাছাকে প্রশ্রয় দিলে কেন? কেন ভাবলে না ঐ শিশু গাছটাকে একটু বাঁচবার অধিকার দিতে গেলে মাটি, জল, আলো, বাতাস দরকার। এক নীরন্ধ্র পাত্রে রেখে তুমি তাকে পালন করলে, কিন্তু লালন করলে না কেন?
মা আমার জীবনটা গাদি খেলার লবণের মতো হয়ে গেছে। এলেবেলে দুধভাত। সব জায়গায় এক্সট্রা। থাকলেও হয়, না থাকলেও হয়। আমার স্বামী, সন্তান সবার কাছেই আমি দিনে দিনে জ্যামিতির এক্সট্রা হয়ে যাচ্ছি। ব্যর্থ জবুথবু একটা মানুষ, থুড়ি মেয়েমানুষ। আমার মেদবহুল পৃথুলা শরীর যা তোমার পাশে খুবই বেমানান। আমার যাবতীয় চিন্তাভাবনাগুলো আজকাল সব জট পাকিয়ে যায়। আমি ভালো নেই মা, বিগত এক যুগ না দু’যুগ ধরে ভালো নেই। ভালো থাকা কাকে বলে মা?
বইতে পড়েছি যে দিন যায় সে কি একেবারেই যায়? এখানেই আমার সেই প্রশ্ন, আমার কি আদৌ কোনও দিন ছিল? ছেলেবেলা বা বালিকাবেলা সেটা তো পুরোপুরি লোপাট অথবা ফর্মালিনে ভিজিয়ে টাটকা রাখার চেষ্টা। ঠিক যেভাবে ভাগাড় থেকে মরা পশুর মাংস চলে যায় বহুজাতিক আলো ঝলমলে রেস্তোরাঁর টেবিলে। এখন আমি ঠিক তেমন ভাবেই সাজানো–গোছানো ফ্ল্যাটে এক্কা দোক্কা খেলি। আগে ঘুমিয়ে থাকলে অদ্ভুত শান্তি পেতাম, এখন তাও পাই না। মাথার কোণে অবচেতন স্তরে ঘাপটি মেরে থাকা ঘটনাগুলো কাপাস তুলোর মতো ভেসে বেড়ায়। সেখানে তোমার সেই রাগী চেহারা। অমানুষিক মার। আর ভয়ে আমার সিটিয়ে থাকার ছবি। বাবার সাথে তোমার মনোমালিন্য না–ভালোবাসাবাসি সে বয়েসে অতশত বোঝবার ক্ষমতা আমার ছিল না। কিন্তু আমি হয়ে গেলাম তোমাদের দাবার ঘুঁটি। আমার অপরাধ তোমার আনা ডিভোর্সের মামলায় আমি কোর্টে দাঁড়িয়ে যেখানে দুঁদে আসামী অথবা ছিঁচকে অপরাধীরা দাঁড়ায় সেখানে দাঁড়িয়ে বলে ফেলেছিলাম, ‘আমি বাবা, মা দু’জনের সাথে থাকতে চাই’। ব্যস, রায় হল না। মহামান্য হুজুর বললেন, ‘সন্তানের কথা ভেবে আপনারা আর একবার চেষ্টা করুন’। কি করবো মা, সেই ন’দশ বছর বয়েসে আমি যে লভ্যাংশের রাজনীতি শিখতে পারি নি। শিখতে অবশ্য আজও পারি নি। বাবার মুখটার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠেছিল। বাবা যে আমায় পিঠে চাপিয়ে ঘোড়া-ঘোড়া খেলেছিল। অনেক দিন পর্যন্ত ভেবেছিলাম আমাকে ভালো না বাসা, ঘেন্যা করার এটাই তোমার আসল কারণ। কিন্তু এখন বুঝতে পারি তা না। বাবা মরে যাওয়ার পর আমি তো তোমাকে ছাড়া আর কিছুই চাই নি। তবু তুমি তোমার চারপাশে লক্ষণরেখা টেনে রেখেছিলে যেখানে আমি আর কোনোদিন ঢুকতে পারি নি বা তুমি ঢুকতে দাও নি।
সেদিন টিভির খবরে দেখলাম কিছু লোভী খারাপ মানুষ ভাগাড় থেকে জন্তু- জানোয়ারের পচা গলা মাংস সুন্দর করে পিস পিস করে কেটে নিয়ে এসে বিক্রি করছে ছোট- বড়ো-মেজ-সেজ সব ধরনের রেস্তোরাঁয়। সে সব মাংস কখনও তাজা মাংসের সাথে মিশিয়ে চলছে অপূর্ব সব জিভে জল আনা রেসিপি। তারপর থেকে বেশ কিছুদিন ধরে চললো খবরকাগজ, টিভিতে এই ঘটনার কচকচি। সময়ের নিয়মে চাপাও পড়ে গেছে। যেমন পড়ে গেছে পাড়া, প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবীদের কাছে তোমার আমার সম্পর্ক। কিন্তু আমার যেটা হল তারপর থেকেই নিজেকে ঐ পচা-গলা মাংসের দলা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। সারা গায়ে আঁশটে পচা গন্ধ। কিলবিল করছে থোকা থোকা মশা মাছির স্তূপ। খসে পড়ছে মাংস। চাপধরা মশার ঝাঁকের মতো গুনগুনিয়ে ওঠে আমার ভেতর একটাই বাক্য, ‘আমি কোনও মানুষ নই। পচা-গলা মাংস’। সাপের খোলস ছাড়ার মতো মনমরা হয়ে পড়ে থাকি। নিজেই নিজের খোলসকে দেখি। আমার শরীর জুড়ে সর্বক্ষণ খালি কেন্নোর মতো ভয় আর অস্বস্তি। কেন্নো তার বাহান্ন জোড়া পা দিয়ে সর্বক্ষণ আমার শরীরে হেঁটে বেড়ায়। ক্রমশ পায়ের তলায় ঝিমিয়ে আসে কানামাছি খেলা। তবে কি আমি মৃত। কবে মরে গেলাম মা। তোমার জঠরেই, নাকি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর। অথবা তারপর তারপর। কিংবা এমনটা তো হতেও পারে তোমার চেতনায় আমি বরাবরই মৃত ছিলাম। সে জন্য আজ আমি মানে এতদিন ধরে একটু একটু করে ভাগাড়ের পচা-গলা কুৎসিত দেহ। এখন আমাকে দেখলে আর কোনও মানুষ বলে মনে হয় না। একটু একটু করে খসে পড়েছে সমস্ত পচা-গলা মাংস। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমি হয়ে যাব শুধুমাত্র একটা কঙ্কাল। সেটাও বিক্রি হয়ে যেতে পারে কোনও ডাক্তারি পড়া ছাত্রছাত্রীর কাছে। জানো মা, চুপিচুপি তোমায় একটা কথা বলি আমার কঙ্কালের মুখে চোখের কোটরের গর্তদুটোয় যদি চোখ রাখে কোনও যুবক আমার খুব ভালো লাগবে। লোভ। এই যে আগেই বললাম ভাগাড় থেকে যে মরা-গলা পশুগুলো সরাসরি চালান হয়ে যায় খাবার টেবিলে তার পেছনেও তো কাজ করে লোভ। মুনাফার লোভ। কিন্তু সব লোভ কি খারাপ? এই যে তোমাকে আমার ভালোবাসার লোভ। তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভ - সেখানে তো মুনাফা লভ্যাংশের গল্প নেই। তাহলে? – এর উত্তর নেই। না কোনও উত্তর হয় না। কিন্তু আজ যে তোমাকে উত্তর দিতেই হবে মা। কোর্টমার্শাল প্রাঙ্গণে আজ আমি বাদী, তুমি বিবাদী।
টিভির অনুষ্ঠানে সেদিন এক যুক্তিতর্কের সভায় দেখলাম এক অভিনেতা খুব সুন্দর কথা বললেন। বললেন, ‘এই যে ধর্মের জিগির তুলে চারদিকে লাঠালাঠি, হাতাহাতি হচ্ছে রাজনীতির অসম্ভব বিভেদের মেরুকরণ চলছে, তা সবই মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিচ্ছে ঐ ভাগাড়। কারণ এই ভাগাড়ের মাংসের জাত নেই। ভাগাড় থেকে পচা-গলা পোকাধরা মাংসের স্তূপ নিয়ে এসে সুন্দর করে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে তেল-মশলা-ঝালের সাথে। কুকুর, বিড়াল, ছাগল, গরু সেখানে সব একাকার। কারও কোনও জাত নেই’।
যবে থেকে নিজেকে ভাগাড়ের একতাল মাংস ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না, তবে থেকে নানারকম প্রশ্ন মনে ভিড় জমাচ্ছিল। কিন্তু ঐ একটা কথা সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। আমার সত্যি কোনও অন্যায় ছিল না। সেই শিশুবেলা থেকে একটা নিটোল সংসারের লোভ, স্বপ্ন দেখা, তাকে মনের ভেতর লালন করে চলার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। তবু তোমার চেতনায় আমি বরাবর মৃত বলে আমার স্থান হয়েছে ঐ ভাগাড়ে। সেখানে ফেলে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত। কারণ অসংখ্য মৃত পচা-গলা জানোয়ারদের ভিড়ে আমার আর কোনও আইডেন্টিটি থাকবে না। খুব সহজেই আমি মিশে যাব অন্যসব তালগোল পাকানো মাংসদের সাথে। কিন্তু ঐ যে নিটোল একটা সংসারের লোভ আমাকে তাড়িয়ে এনে ফেললো এই সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটে। কিন্তু ভাগাড়ের গলা, পচা মাংসের দলা কি এখানে মানায় বলো – তাই ঠাঁই হয়েছে ডাস্টবিনের বালতিতে।
মা আমার তোমার কাছে প্রশ্ন – আমার জীবনটা কেন এমন হয়ে গেল? এখানকার মানুষজন তো আমাকে চিনে ফেলেছে - আমার কোনও মনুষ্য সত্ত্বাই নেই, আমি ভাগাড়ের মাংসের স্তূপ। তাই এরা আমাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। সেখান থেকে মিউনিসিপ্যালিটির লোক ফের সেই ভাগাড়ে ফেলে দেবে। তারপর ড্রেসিং হয়ে আবার কোনও ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট।
মা। চুপিচুপি এইবেলা তোমায় একটা কথা বলে রাখি। এবার আর কোনও ফ্ল্যাটবাড়ি যাব না। সোজা তোমার ঘরে। হতে পারে আবার তোমার গর্ভে, সে এ জন্ম না হোক তোমার সামনের জন্মে। আসলে আমার সেই সরল প্রশ্নগুলোর উত্তর যে তোমাকে দিতেই হবে মা। তুমি বুঝতেও পারবে না তখন একটু একটু করে তোমার শরীর মনটাই হবে একটা আস্ত ভাগাড় – হি হি হি।