গৌরচন্দ্রিকা
পরিবর্তন ও ক্ষয় জীবনের ধর্ম। এসব কথা ভগবান বুদ্ধ আড়াইহাজার বছর আগে বলে গেছেন। বার্নার্ড শ’ খেয়াল করেছেন যে সমস্ত গোলাপসুন্দরীর ভবিতব্য হল একদিন বাঁধাকপি হওয়া।[1] তাই বুদ্ধিমান অভিনেতারা কিছুদিন পরে সময়ের দেয়াললিখন পড়ে ফেলে ক্রমশঃ নায়ক-নায়িকার পালা সেরে দাদা-বৌদি এবং আরও পরে বাবা-মায়ের ভূমিকা স্বীকার করে নেন।
পুরানোর কাজই হল নতুনকে জায়গা ছেড়ে দেয়া। দেখুন, গান্ধী পরিবার এটা মানছে না, ফলে বারবার নাকের জলে চোখের হলে হচ্ছে। বঙ্গে ও ত্রিপুরায় সিপিএম বুঝতেই চাইছিল না যে বয়েস হয়েছে, নতুন চিন্তা দরকার। কেরালায় খেলাটা বুঝে জায়গা অদলাবদলি করে আজও দিব্যি রয়েছে।
বিজেপি এটা বুঝতে পেরে ধুতি -পরা ধনুকবাণ- হাতে রথে- চড়া পিতামহকে বাণপ্রস্থে পাঠিয়ে দিল, ফল পেল হাতে নাতে।
বাঙালির ঘরেও ছেলে-ছেলেবৌকে মেয়ে-জামাইকে ঘর ছেড়ে দেয়ার পালা চলতেই থাকে । কাজেই আমি কোন নবাব খাঞ্জা খাঁ যে ‘যা হারিয়ে যায় ‘ তা আগলে বসে থাকব? শায়েস্তা খাঁর সময়ে টাকায় আট সের চাল পাওয়া যাইত বলে কান্নাকাটি করব?
করছি না, করব না। জানি নাকে কেঁদে কোন লাভ নেই। কালের চাকা পেছনে ঘোরানো যায় না।
“চোখ ভেসেছে বুক ভেসেছে ভেসে যাচ্ছে হিয়ে,
খসম যদি থাকত কাছে পুঁছত নুমাল দিয়ে”।[2]
আমায় রুমাল এগিয়ে দেয়ার জন্যে কোন খসম বসে নেই , সবাই নিজের নিজের তালে আছে। কোন শাপমন্যি করছি না, আমিও তো একই রাশিতে জন্মেছি।
তা বেশ, কিন্তু একটা কাজ করতেই পারি। তাহল পরিবর্তনের কিছু টুকরো টাকরা ছবিকে তুলে ধরা--- মা যা ছিলেন , মা যা হইয়াছেন।
বঙ্গ মানে কোলকাতাঃ
আমার কাছে বঙ্গ মানে কোলকাতা। কলোনিয়াল ঐতিহ্যের কোলকাতা, রিফিউজি কোলকাতা। আমি গ্রামবাংলার মুখ বুড়ো হওয়ার আগে দেখিনি। কোলকাতায় জন্মেও প্রথম জীবনে সুন্দরবন, শান্তিনিকেতন, সিরাজদৌল্লার আমবাগান, দার্জিলিং—কোথাও যাইনি। আমি গল্প শোনাব পঞ্চাশের থেকে ষাটের দশকে কোলকাতা কেমন ছিল।
মানে এমন এক কোলকাতা যেখানে একটাই ব্রিজ-- হাওড়া ব্রিজ, খাবার জলের একটাই ট্যাংক, মানে টালা ট্যাংক। সবচেয়ে উঁচু বাড়ি বলতে নিউ রাইটার্স বিল্ডিং। এবং অক্টরলোনি মনুমেন্ট তখনও শহীদ মিনার হয়নি আর ঘোড়ায় চড়া ইংরেজ রাজপুরুষেরা তখনও উদ্ধত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। যদিও নেতাজি তখন থেকেই ডান- হাতের- সঙ্গে- ডান -পা -এগিয়ে ভুল ভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাই আজও ‘দিল্লি চলো’ বাঙালির জন্যে কথার কথা হয়ে রয়ে গেল।
আমার কোলকাতার সীমানা উত্তরে বাগবাজার--শ্যামবাজার-পাইকপাড়া, পূবে ট্যাংরা--তিলজলা- বালিগঞ্জ স্টেশন—ঢাকুরিয়ার তনুপুকুরের মাঠ। দক্ষিণে গোলপার্ক—পঞ্চাননতলা – বড়জোর সেলিমপুর -যোধপুর পার্ক। তখনও ঢাকুরিয়ার ফ্লাই ওভার তৈরি হয়নি। নাকতলার ছেলেরা যাদবপুর পেরিয়ে ঢাকুরিয়া গেলেই বলত—কইলকাতা গেছিলাম।
পশ্চিমে কাশীপুর থেকে গঙ্গার ধার, বড়জোর চেতলা। বেহালা ঠিক কোলকাতায় মনে হত না।
ধর্মতলা তখনও লেনিন সরণি হয়নি। ডবল ডেকার বাস এবং ট্রাম সগৌরবে চলিতেছে। কোলকাতার কোথাও অটোরিকশার আবির্ভাব হয়নি। করপোরেশন এলাকায় হাত-রিকশা এবং মিউনিসিপ্যাল এলাকায় সাইকেল রিকশা। মোটরবাইক দেখা যায়নি।
দূরদর্শনের দিন দূর-অস্ত। কাজেই সব বাড়ির ছাদে বাঁশের বা পাইপের ডগা থেকে রেডিওর এরিয়ালের জাল বিছানো, মাঝে মাঝে দু’একটা ঘুড়ি পথ ভুলে ফাঁদে পড়ে।
লোকে রেশনের লাল চাল খাচ্ছে, আমেরিকার পি এল ৪৮০’র খয়রাতি গম নিতে মুখ ভ্যাটকাচ্ছে। চিনি ও কেরোসিন নিচ্ছে। বিয়ে হলে চিনির জন্যে আলাদা করে পারমিট নিতে হচ্ছে। তখনও অলিগলিতে হাতরুটি সেঁকা বৌদিরা আবির্ভূত হননি । জলখাবার ছাড়া বাঙালি রুটি খাওয়ার কথা ভাবতে পারত না । না না, চাওমিন, এগরোল, ম্যাগি এসব আশির দশকের আগে দেখা দেয়নি। অনাদি’র মোগলাই পরোটা (৭৫ পয়সা) কেনার পয়সাই জোটা মুশকিল ছিল । দিলখুসা কেবিনের ডিমের ডেভিল কল্পনায় নাচতো। কফিহাউসে ২৫ পয়সায় কফি এবং ৪০ পয়সায় কোল্ড কফি আমাদের কৈশোরোত্তীর্ণ দিনগুলিকে গার্ডেন গার্ডেন করে দিত।
অবশ্য কোলকাতা ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনের কথা না বললে উপর থেকে যিনি দেখছেন, তিনি পাপ দেবেন! ১৯৬৮ সালে চার আনা খরচ করলে কোন হাফপ্যান্ট পরা ধিনিকেষ্ট টেবিলে সাজিয়ে দিত কেকের টুকরো- ১০ পয়সা, কফি- ১০ পয়সা, দুটো পানাম সিগ্রেট—৫ পয়সা।
অনাদি কেবিন এখন উঠে গেছে। সেদিন নস্টালজিয়ায় ভুগে দিলখুসায় ডিমের ডেভিল খেতে গিয়ে একেবারে কে-এল-পি-ডি! নতুন দিলখুসার রাঁধুনি পালটে গেছে, নাকি পঞ্চাশ বছরে আমিই পালটে গেছি! অথবা উভয়েই?
প্রেম, মনপ্রাণদেহ ইত্যাদি
সেসব দিনে গার্লফ্রেন্ডকে লেকের পাড়ে বা গড়ের মাঠে চিনেবাদাম খাওয়ানো যথেষ্ট ছিল, সঙ্গে চা হলে-- তুমি কি ভাল? মেয়েরাও ভাবত—পয়সার গরম দেখাচ্ছে না যখন , ছেলেটার ক্যারেক্টার ভাল।
অনেক সময় পকেট খালি টের পেলে নিজেরাই ছোট্ট পার্স থেকে পয়সা বের করে দিত। তাতে হারামির হাতবাক্স ছেলেগুলোর একটুও লজ্জা হোত না। বলত—এটাই ন্যাচারাল; অন্নপূর্ণার দ্বারে শিব সদাই ভিখারি বটেক!
মেয়েরা ছেলেদের সহজে তুই বলত না , ‘তুমি’ বলত। ‘তুই’ মানে নম্বর কেটে গেছে।
আমাদের বুকের মধ্যে ধুকপুক করত—“রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব-ও-ও -ও!
তখন ছেলেমেয়ে উভয়েই প্রেম নিয়ে ভিক্টোরিয় ছুঁৎমার্গে ভুগত। ভাবত প্রেম একটা বায়বীয় ব্যাপার। ‘যারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গিয়ে আর পেলাম না’। তাই শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম? তাই সন্ধ্যার গলায় “ হয়ত কিছুই নাহি পাব, তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভাল বেসে যাব” শুনে আমাদের টনসিলে ব্যথা শুরু হত ।
কিন্তু এই ভিক্টোরীয় প্রুডারি বা রাবীন্দ্রিক প্রেমের আড়ালে চাপা থাকত বিরাট বঞ্চনার গল্প এবং ছেলেদের বদমায়েশি ও স্বার্থপরতা।
আজকের মেয়েরা মুখোশের আড়ালে মুখ চিনে ফেলেছে। তাই অনায়াসে ছেলেদের সম্বন্ধে বলতে পারে –“প্রেম না বাল, খালি ওইসব করবার তাল!”
অবশ্য এটা বলার সাহস এবং ক্ষমতার পেছনে একটা কারক তত্ত্ব হল জন্ম-নিয়ন্ত্রণে উন্নত প্রযুক্তি এবং তার সুলভ প্রাপ্তি। ১৯৬৮ সালের গোড়ায় যখন নাকতলার মোড়ের দোকানে ৫ পয়সায় একটা এবং ১০ পয়সায় তিনটে করে ‘নিরোধ’ বিক্রি শুরু হল, আমরা হতবাক, আমাদের কৌতুহল মানে- না- মানা। জিনিসটা কী? খায় না মাথায় দেয় । আজকের বাচ্চারা অত নাঈভ নয় ।
বুড়োরা মালা জপতে শুরু করলেন—অনাচারে দেশ ছেয়ে যাবে, তিনপোয়া কলি পূর্ণ হল বলে! বামপন্থীরা পদিপিসির মত গেল-গেল রব তুললেন। বললেন –এসব ইয়াংকি বেলেল্লাপনা! যুবশক্তির চেতনা আবিল করে বিপ্লবকে ঠেকিয়ে রাখা। জন্মনিয়ন্ত্রণ হল গরীবের বিরুদ্ধে ধনীদের ষড়যন্ত্র।
একটা মজার কথা । তখন স্টেটসম্যান পত্রিকায় জনৈক মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি ছাপা হল যার মূল প্রতিপাদ্য – সরকার যদি গরীবদের জন্ম-নিয়ন্ত্রণে বাধ্য না করে তাহলে দেশের সম্পদের বড় অংশ গরীবদের বাড়তি জনসংখ্যার পেটে চলে যাবে!
আমাদের কী আফসোস ! শেষে ‘বালিকা বধূ’ মৌসুমীও! উনি তখন বাংলায় প্রথম ফিল্মেই সুপারহিট নায়িকা। অন্যেরা প্রবোধ দিলেনঃ বাংলায় আরও মৌসুমি চট্টো আছেন।
এখন আছেন, তখন ছিলেন কি? আজও মনটা খচখচ করে।
যখন একই পত্রিকায় সমাজতান্ত্রিক চীনে পরিবার নিয়ন্ত্রণের জন্যে দুইয়ের বেশি সন্তান হলে সরকারি চাকুরেদের ইনক্রিমেন্ট ও প্রমোশন বন্ধ হওয়ার খবর বেরোল, আমরা জানলাম --ওসব বুর্জোয়া পত্রিকার অপপ্রচার। চোট্টামি করে ‘সিনহুয়া নিউজ এজেন্সি’ লিখে দিয়েছে । ওরা কত নীচে নামতে পারে দেখলে?
মাও-চৌ এন-লাইয়ের জমানায় জন্মনিয়ন্ত্রণ? মামদোবাজি! লং মার্চের কঠিন সময়েও মাও জন্ম-নিয়ন্ত্রণ করেননি। লন্ডনে আর্থিক কষ্টের দিনে মার্ক্সও ওপথে হাঁটেননি। তাহলে?
আচ্ছা, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ যদি বার্থ-কন্ট্রোল করতেন তাহলে কি আমরা রবি ঠাকুরকে পেতাম? এর পরে কোন কথা হবে না, হতে পারে না।
আসলে যেটা জানতাম না যে ‘ভক্ত প্রহ্লাদেরা’ সব যুগেই ছিলেন , আছেন ও থাকবেন; এবং বাম-ডান সব শিবিরেই। জানতাম না মার্ক্স বলে গেছেন—প্রযুক্তি জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনে, মজদুরের জীবনেও।
যুদ্ধ-টুদ্ধঃ
বাঙালী ষাটের দশক জুড়ে দু’দুটো সীমান্তে যুদ্ধ (চিন ও পাকিস্তান) সামলে উঠল। রোজ সকালে আকাশবাণীতে “দেশাত্মবোধক গান” (দশ মিনিট)-- “আর এক পা’ও নয় শত্রু, সময় দিলাম পিছু হটবার; অনেক রক্ত তুমি নিয়েছ,সেই ঋণ শোধ কর এইবার”—হজম করে ফেলল। ১৯৬৫ সালে নতুন প্রজন্ম কয়েক মাস ব্ল্যাক আউট এবং সাইরেনের দিন কেমন হয় তা টের পেয়ে পুলকিত হল।
ফোর্ট উইলিয়ামের সামনের মাঠে প্যাটন ট্যাংক মাত্র এসেছে । পাতাল রেলের মাটি খোঁড়া শুরু হয়েছে।লোকজন সিএমডিএ’র ব্যাখ্যা করেছে ‘ কাটছি -মাটি- দেখবি -আয়’। নতুন দেশি নামগুলোর বদলে পুরনো কলোনিয়াল নামগুলোই-- যেমন স্ট্র্যান্ড রোড, হ্যারিসন রোড, রসা রোড , বেন্টিংক স্ট্রিট, সেন্ট্রাল এভিনিউ-- লোকের মুখে চলছে। সল্ট লেক তখনও লবণ হ্রদ, রাজারহাট-নিউ টাউন? মাছের ভেড়ি ও ধান ক্ষেত। কালিকাপুর -সোনারপুরের ধানক্ষেতে কেউ কেউ লালঝান্ডা পুঁতে ধান কেটে আরেকটা নকশালবাড়ি গোছের ঘ্যাম নিয়েছিল।
(এখন সেসব এলাকা দিয়ে যেতে যেতে ‘শূন্যপথে চাই, আর তার কোন চিহ্ন নাই’, পরিবত্তোন এবং নগরায়নের তান্ডবে এক্ষণে সর্বত্র শান্তিকল্যাণ বিরাজমান।)
তখন ধীরে ধীরে বাঙালি লাল-সাদা ও লাল-হলুদ মশলায় বোমা বাঁধা ও তার সকাল সন্ধ্যে কড়- কড়াৎ-বুম শুনতে অভ্যস্ত হয়েছে, যেন সারাবচ্ছরই কালীপুজো।
এসে গেল ‘সত্তরের দশক , মুক্তির দশক’। আমরা দিন গুণছি—কবে ‘বঙ্গের বিস্তৃত সমতল দিয়ে গণফৌজ মার্চ করে যাবে’ ? ফলে ‘স্কুল-কলেজে খিল, রাস্তায় মিছিল, ক্র্যাকারের শব্দে কাঁপে রাজপথ কিনু গোয়ালার গলি’।
কিন্তু মাঝখানে হিসেবের বাইরে কিছু ঘটে গেল। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু, পার্কসার্কাসের থেকে নিত্য ব্রডকাস্ট করছে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র। চীন নাকি ইয়াহিয়া খানের সামরিক জুন্টাকে সমর্থন করছে? ওদের ‘ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট’ বলছে? আমরা বিভ্রান্ত, চারু মজুমদার পুলিশ কাস্টডিতে মারা গেছেন। অসীম চ্যাটার্জি দেওঘরে ধরা পড়েছে। লিন পিয়াও নাকি দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে নিহত?
হে ঈশ্বর! তুমি কোথায়? কত উঁচু মগডালে বসে আছ?
এক সময় আবহাওয়া অফিসের ফোরকাস্ট সত্যি হল। সব ঝড় থেমে গেল। সব পাখি ধীরে ধীরে ফিরিছে কুলায়।
যাদের ছেলে বনে গেছল, তাদের কারও কারও হারানিধি ফিরে এসেছে। কেউ কেউ ফেরেনি। মাতৃভক্ত বাঙালি বলল--তারা সবাই মায়ের ভোগে গেছে।
দেয়াল জুড়ে স্টেনসিলে টুপি পরা মাওয়ের মাথা এবং ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান” লেখাগুলো হয় অস্পষ্ট, নয় মুছে গেছে। তার জায়গায় জ্বলজ্বল করছে “ এশিয়ার মুক্তিসূর্য ইন্দিরা গান্ধি যুগ যুগ জিও”।
এমার্জেন্সি এল এবং মাত্র দু’বছরে চলেও গেল। যুব কংগ্রেসি ছেলেদের বন্দুক ও পাইপগান হাতে ধুনুচি নৃত্য দেখল বাঙালি।
তারপর দেখা গেল দেয়ালের পর দেয়াল জুড়ে চুণকাম করিয়ে তার উপর লেখা-- ‘এই দেয়াল ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ পর্য্যন্ত রিজার্ভ’; নীচে ডানদিকের কোণে সিপিএম।
জীবন বয়ে চলেছে নিজের নিয়মে। নতুন শতাব্দীর প্রথম দশক পেরোতেই ফের পরিবত্তোন! ফের নর্তন- কোঁদন, নতুন বুলি।
জানি , ইস রাত ভী বদল জায়েগি। ‘রক্তমাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি’ একদিন শিশুপাঠ্য কাহিনীতে মুখ ঢাকবে। ইদানীং কারও কারও স্মৃতিচারণে সেই প্রবণতা প্রবল ভাবে দেখা যাচ্ছে।
পুজোটুজো, পালপার্বণ
ও হ্যাঁ, বাঙালির মাত্র তিনটে পুজো। বড়দের দুর্গাপুজো, জোয়ানদের কালীপুজো এবং কিশোর-কিশোরীদের সরস্বতী পুজো। কিছু মাইনর পূজো ছিল বটে, বিশ্বকর্মা পূজো—তার গজবাহন প্রতিমা দেখা যেত নতুন গড়ে ওঠা ফ্যাক্টরিগুলোতে, যেমন জয় ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কিছু ওয়ার্কশপে। তবে বাঙালি ছেলেপুলের জন্যে সেটা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। গণেশ পূজো, রামনবমী হত না। শিবরাত্রির উপোস, মনসা পূজো, জগদ্ধাত্রী পূজো –এগুলো অঞ্চলভিত্তিক। আর জগন্নাথের রথযাত্রা হল ছোট বাচ্চাদের।
একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। সব পূজোর ভাসানের মিছিলে কমন শ্লোগান---- মাঈকি জয়!
যেমন দুর্গা মাঈকি জয়! কালী মাঈকি জয়! সরস্বতী মাঈকি জয়! আবার বিশ্বকর্মা মাঈকি জয়!
তার সঙ্গে ঝুংকুরুক্কুর তাসাপার্টি ও নাচ।
আর একটা নতুন পার্বণ শুরু হল। সরকারের সমর্থনে বাঙলা বন্ধ। শুনশান পিচের রাস্তায় ক্রিকেট।
ঘুড়িওড়ানোঃ
সরস্বতী পূজোর দিন থেকে ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হত , শেষ হত বিশ্বকর্মা পূজোয়। ঘুড়ি উড়ত রাস্তা থেকে এবং বাড়ির ছাদ থেকে। মনে রাখতে হবে তখনকার অধিকাংশ বাড়ি দোতলার বেশি মাথা তুলত না। আর কত রকম ঘুড়ি! পেটকাট্টি, মোমবাত্তি, চাঁদিয়াল, চৌরঙ্গী। দাম? দু’পয়সা থেকে শুরু, তারপর চারপয়সা, দু’আনা, চার আনা; সাইজের ওপর নির্ভর করে। মাঞ্জা দেয়া হত কাঁচের মিহিগুঁড়ো আর বার্লি, চিঁড়ের মাড় বা ময়দার আঠা দিয়ে। প্রায় সমস্ত কর্পোরেশনের বাজারে বেশ ক’টি ঘুড়ির দোকান থাকত। তাতে বিভিন্ন দামের ঘুড়ি, লাটাই , সাধারণ সূতো এবং মাঞ্জা বিক্রি হত।
তারপর একসময় ছাদ এবং আকাশ ছেয়ে গেল টিভির এরিয়ালে আর তার অনেকগুলো এলুমিনিয়ামের পাইপে ঘুড়ি জড়িয়ে অকালে মারা যেতে লাগল।
এখন ঘুড়ির দোকান কদাচিৎ কোথাও চোখে পড়ে ।
খেলার মাঠ
টেলিভিশন আসেনি। তাই বাঙালি পেলে-পুসকাস- লেভ ইয়াসিনের গল্প পত্রিকায় পড়ে এবং রেডিওতে ইস্টবেঙ্গল -মোহনবাগান ম্যাচের ধারাবাহিক ভাষ্য শুনে ইলিশ-চিঙড়ি নিয়ে খেউড় ও হাতাহাতি করে ।
সল্ট লেক স্টেডিয়াম তখন শুধু ইচ্ছে হয়ে মনের মাঝারে বন্দী। গড়ের মাঠে লম্বা লাইন। কাউন্টার খোলার আগে আবির্ভাব হয় ঘোড়সওয়ার পুলিশের। এলোমেলো লাইন দেখলে ঘোড়া ছুটিয়ে হান্টার চালিয়ে লাইন সোজা করে। কিন্তু কোত্থেকে উদয় হয় এক উনপাঁজুরে হাড়-বজ্জাত লক্ষীছাড়া ছেলে। সে এসে চুপচাপ ঘোড়ার গুহ্যদ্বারে গুঁজে দেয় এক জ্বলন্ত সিগ্রেট। জনতা তখন সোল্লাসে দেখে মাউন্টেড পুলিশের তুর্কী নাচ।যারা এন্ট্রি পেলো না, তারা কাছের র্যামপার্টে চড়ে বসে। কোন কোন লাঙ্গুলহীন মর্কট গাছে চড়ে। তাদের জন্যে শস্তায় বিক্রি হয় ঘরে তৈরি পেরিস্কোপ, কার্ডবোর্ডের লম্বাটে বাক্সোর গায়ে দুটো আয়নাকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে ফিট করে তৈরি ।
খেলাধূলো নিয়ে অনেক পত্রিকা বেরোত। ইংরেজিতে স্পোর্টস অ্যান্ড পাস্টটাইম, তাতে ফুটবলের সঙ্গে ক্রিকেট, দাবা সবই থাকত। ওয়েসলি হল-ল্যান্স গিবস-সোনী রামাধীন, ট্রুম্যান-স্ট্যাথাম-টাইসন, ডেভিডসন-মেকিফ-লিন্ডওয়ালের বোলিং্যের ডেলিভারি, সোবার্স ও কানহাইয়ের ড্রাইভ, সুভাষ গুপ্তের লেগস্পিনের ডেলিভারি –সব ছবি কেটে একটা খাতায় আঠা দিয়ে সাঁটিয়ে স্বপ্ন দেখা –একদিন ভাল অফ স্পিনার হব।
কিন্তু শস্তায় ট্যাবলয়েডের মত বিক্রি হত খেলার মাঠ, ময়দান, গড়ের মাঠ, অলিম্পিক। মূলতঃ স্থানীয় ফুটবল নিয়ে । টেলিভিশনের আবির্ভাবে এরা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
ক্রিকেট নিয়ে এত মাতামাতি তখন ছিল না। খেলা হত শুধু শীতকালে, মরশুমি ফুল-ফলের মত। ফুটবল গ্রীষ্ম ও বর্ষাকাল জুড়ে, কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে। কোথায় আর্টিফিশিয়াল টার্ফ?
ক্রিকেট খেলা বলতে শুধু পাঁচ দিনের টেস্ট, তায় মাঝে একদিন রেস্ট ডে। কুল্লে চারটে দেশ খেলত। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া,ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও পাকিস্তান। নিউজিল্যান্ড সবে মাথা তুলছে, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ ব্যাট ধরতে হাত ঘোরাতে শুরু করেছে।
ওয়ান ডে, টোয়েন্টি-টোয়েন্টি? থামুন তো, এমন অভিজাত খেলার জাত মেরে তাকে প্লেবিয়ান লেভেলে নামাবেন না। তখন সবাই শুধু দেশের জন্যে খেলত। ট্রেনে থার্ড ক্লাসে যেত। পেটের জন্যে স্টেট ব্যাংক (বুধি কুন্দেরন, বেদী , অজিত ওয়াড়েকর এবং আরও অনেকে), রেলওয়ে এবং সার্ভিসেসে (কর্নেল হেমু অধিকারী) চাকরি করত। অনেকে অফিস ক্লাবের লীগে খেপ খেলত, মানে সামান্য টাকার বিনিময়ে ভাড়া খাটত। একই ব্যাপার ফুটবল ও হকিতে ; কেউ পেশাদার নন। খেলা কারও জীবিকা নয় । চুনী গোস্বামী স্টেট ব্যাংকের ল’ অফিসার। পিকে ব্যানার্জি ইস্টার্ন রেলে।
গুরুসদয় দত্ত রোডের কোনায় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের মাঠের চারপাশে উঁচু পাঁচিল ছিল না । তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে রবাহুত অনাহুত যে কেউ ভেতরে ঢুকে বাউন্ডারি লাইনের পাশে ঘাসের উপর ধপাস হয়ে খেলা দেখতে পারত। টিকিটের বালাই ছিল না ।
বরং হকি লীগ এবং বাইটন কাপ নিয়ে উত্তেজনা ছিল। মোহনাবাগান, কাস্টমস, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান। অলিম্পিয়ান ক্লডিয়াস, লেফট হাফে লিয়েন্ডার পেজের বাবা ভি পেজ, সেন্টার হাফে ধ্যানচাঁদের ছেলে অশোক কুমার, ফরওয়ার্ডে ইনামূল হক, ইক্রামূল হক, গোলকীপার ক্রিস্টি!
একসময় কোলকাতায় হকি লীগ হত, তাতে ভিন রাজ্য থেকে প্লেয়ার আসত--- ভাবা যায়!
ঢাকুরিয়া লেকের এন্ডারসন ক্লাব ছিল সাঁতার এবং নৌকো বাইচের জন্যে বিখ্যাত, তবে সেসব অভিজাতবংশীয়দের জন্যে ।
হ্যাঁ, তখনও নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম হয় নি।
উৎসব, গানবাজনা, লেখাপড়া এবং কালচার মারানো বাঙালীঃ
উৎসব বলতে দোল-দুর্গোৎসব, রবীন্দ্রজয়ন্তী, তার সঙ্গে নমো নমো করে নজরুল ও সুকান্ত সন্ধ্যা। তখনও বাংলার কোকিল বলতে সন্ধ্যা মুখার্জি, লতা-আশারা অনেক পরে। মান্না দে হেমন্তের পাশে ফার্স্ট রানার্স , পল্লীগীতিতে একছত্র সম্রাট নির্মলেন্দু চৌধুরি।
ছেলেদের নাচ তখনও মধ্যবিত্ত বাঙালীর চোখে অস্বাভাবিক ব্যাপার। উদয়শঙ্করের ক্রিয়েটিভ নাচ বা বামঘরানার শম্ভু ভট্টাচার্য্যের ‘রানার’ এবং ‘অহল্যা’ ব্যালে ব্যতিক্রমের মত। যেমন ব্যতিক্রম ছিল ডিভোর্স এবং বিধবা-বিবাহ।
জীবিকা হিসেবে গান শেখাও ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়ে। নাচের প্রশ্নই ওঠেনা। পেশাদারি অভিনয়? অন্যের বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্যে । বাড়ির মেয়ে গান শিখবে , পাড়ার ফাংশনে একটু আধটু গাইবে, কনে দেখানোর সময় পাত্রপক্ষের সামনে, তারপর ইতি। বাড়ির বৌ স্টেজে উঠে গান গাইতে থাকলে ঘর সামলাবে কে? ছেলেমেয়ে মানুষ করবে কে?
মন দিয়ে পড়াশুনো কর। ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ।
শিক্ষকরা নিয়মিত মাইনে পান না। অধিকাংশ টিচার ঘরে গিয়ে বা বাড়িতে ডেকে ছেলেমেয়েদের পড়ান। টিউটোরিয়াল ্ব্যাপারটা মাত্র শুরু হয়েছে। তখনও নামমাত্র মাইনেতে স্কুল-কলেজে ভর্তি হওয়া যায় । বাচ্চার অ্যাডমিশনের জন্যে বাপ-মাকে ইন্টারভিউ দিতে হয়না। এবং জন্মের থেকেই বড় স্কুলে সীট রিজার্ভ করাতে হয় না।
সেতার-সরোদ-বেহালা বাদন? ওসব এলিটদের ব্যাপার। হাওয়াইয়ান গিটার কিশোর ও তরুণদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে।
বটুক নন্দী ‘মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য’ এবং সুনীল গাঙ্গুলি রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর বাজাচ্ছেন। নজরুল-পুত্র কাজী অনিরুদ্ধ গিটারে বাবার গানের সুর বাজাচ্ছেন এবং কাজী সব্যসাচী কবিতা আবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
স্প্যানিশ গিটার জনপ্রিয় ছিল না। আজ হাওয়াইয়ান গিটার কেউ বাজায় না।
কলেজের তিনদিন সোশ্যালে দ্বিতীয় দিনে এনাদের খুব চাহিদা। প্রথম দিনে অবশ্যই ক্ল্যাসিকাল; এ টি কানন, মালবিকা কানন , প্রসূন ব্যানার্জি, চিন্ময় লাহিড়িরা। সেতারে অমিয়কান্তি, সরোদে রাধিকামোহন মৈত্র, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তৃতীয় দিনে কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের নিজস্ব প্রোগ্রাম , এছাড়া পি রাজের গলায় হিন্দি ফিল্মের গান। ভি বালসারার বিভিন্ন তাক লাগানো যন্ত্রে জনপ্রিয় গানের সুর।
সিনেমাঃ
সিরিয়াস সিনেমায় সত্যজিৎ-মৃণাল এবং ঋত্বিক। প্রথম দুজনের দ্বৈরথে ‘ এ ক্রো- ফিল্ম ইজ এ ক্রো- ফিল্ম’ এবং ‘এ ফিল্ম ইজ এ ফিল্ম’ আমাদের মহাবচনের বাঁধানো খাতায় উঠে গেছে।
সত্যজিৎ এবং মৃণালকে কেন্দ্র করে দুটো মহা সিনে ক্লাব, আঁতেলদের আড্ডা? কিন্তু দুই দশকের মধ্যে শহর-শহরতলী এবং মফস্বলে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছিল একগাদা সিনে ক্লাব। আমার এক বন্ধুর ছিল ছ’টা ক্লাবের কার্ড। ওর সঙ্গে গেছি কখনও নতুন তৈরি নন্দন, কখনও গোর্কি সদন। কিউবান, আমেরিকান, চেক ফিল্ম। জনগণেশের( আম্মো) বেশির ভাগ ইচ্ছেটা আনসেন্সর্ড বিদেশি ফিল্ম দেখার আশায় ডানা মেলে!
জনপ্রিয় সিনেমায় উত্তমকুমার এবং সৌমিত্রকে ঘিরে ভক্তদের দুটো শিবির। কিন্তু মহানায়িকা সুচিত্রার কাছে ধারে কাছে কোন নায়িকা নেই। “সুপ্রিয়া যেন সোফিয়া লোরেন” বলে একটি সিনেমার বিজ্ঞাপন ছিল বটে, ধোপে টেঁকেনি।
দুরদর্শন আসেনি, তাই আকাশবাণীর সংবাদ পরিবেশক এবং ভাষ্যকার বিজন বোস, ইভা নাগ, নীলিমা, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং খেলার মাঠের অজয় বসু, কমল ভট্টচাজ এবং পুষ্পেন সরকারদের প্রায় কাল্ট স্ট্যাটাস ।
বেতার নাটক হত সম্ভবতঃ প্রতি বৃহস্পতিবার রাত আটটায়। অধিকাংশ নাটকের প্রযোজনায় বাণীকুমার – মহালয়ার প্রোগ্রামটির জন্য বাঙালী আজও যাকে বছরে একবার স্মরণ করে। নাটক হত ‘তটিনীর বিচার’ ,’মাধবীকঙ্কণ’, ‘কানু কহে রাই’। একবার শুনেছিলাম শম্ভু মিত্র -তৃপ্তি মিত্রের অভিনয়ে ‘ছেঁড়াতার’।
কিন্তু আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার আসল আকর্ষণ ছিল শনি-রোববারের ‘অনুরোধের আসর’। তাতে পূজোর সময় বিশিষ্ট শিল্পীদের যে ৭৫ আরপিএমের রেকর্ড বেরোত (দু’পিঠে দুটো), তার গানগুলো বাজানো হত । সেসব দিনে বিবিধ ভারতীর অনুকরণে --ঝুমরিতলাইয়া থেকে বচকামল--অনুরোধকর্তাদের নাম-ঠিকানা বলা হত না, কোন রেডিও জকি থাকতো না । ফলে গান অনেক বেশি শোনা যেত। বিশেষ করে প্রতিবছর সলিল চৌধুরির কথা ও সুরে লতা এবং হেমন্তের গানগুলোর আলাদা জনপ্রিয়তা ছিল । সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কথা বলা বাহুল্য। মনে পড়ছে শচীনকর্তা, মানবেন্দ্র, তরুণ, দ্বিজেন, তালাত মামুদ এবং আশা ভোঁসলে, ইলা বসু ও আল্পনার কথা। তখন আজকের মত ঘন ঘন অ্যালবাম বেরোত না। রেডিওয় রোজ সকালে নিয়ম করে রবীন্দ্রসংগীত , নজরুলগীতি ও অতুলপ্রসাদ শোনা যেত। আর ছিল পল্লীগীতি, লোকগীতি শব্দটার চল ছিলনা।
আজকাল সিডি এবং ইউটিউবের আধিপত্যে এসব দুধভাত হয়ে গেছে।
এভাবেই চোঙাওলা হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে দম দেওয়া কলের গান আজ মিউজিয়াম পিস। কুকুরের ছবিওলা ‘সুখী গৃহকোণ, শোভে গ্রামোফোন’ স্লোগান অপ্রাসঙ্গিক। অপ্রাসঙ্গিক নিবের কলম এবং সুলেখা কালি—রয়্যাল ব্লু বা জেট ব্ল্যাক।
পাছু ফিরে দেখাঃ
চলুন, রেলে চড়ে সেই ষাট বছর আগের কোলকাতায় নামা যাক । তবে গুরুর অন্যতম বন্ধু কল্লোল দাশগুপ্তের তৈরি এই ভিডিওটি “ এ ওয়াক ইন দ্য পার্ক স্ট্রিট” দেখে নিতে পারেন। তাতে পাবেন কোলকাতার ৯০ বছর বয়েসি ইহুদি মহিলার স্মৃতিতে ১৯৪০-৬০ সালের পার্ক স্ট্রিটের ফোটোগ্রাফ। লিংক দিচ্ছিঃ
এ প্রাণ রাতের রেলগাড়ি
বাঙালির গল্প রেলগাড়ি বাদ দিয়ে হয় নাকি? অপু-দুর্গা? রবীন্দ্রনাথের রেলগাড়ি নিয়ে গল্প কবিতাগুলো? রেলের চাকরিসূত্রেই বাঙালি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে, উপনিবেশ গড়েছে।
ধরুন, আপনি পঞ্চাশ-ষাটের দশকে হাওড়া স্টেশনে নেমেছেন। প্ল্যাটফর্ম কুল্লে ১৫টি। নতুন স্টেশন, মানে সাউথ অংশটা তখন কারো স্বপ্নেও ধরা দেয়নি। ট্রেনে তিনটে ক্লাস—ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ডক্লাস। ঠিক যেন পরীক্ষার মার্কশিট। সেকেন্ড ও থার্ডক্লাসের তফাৎ একটাই। কাঠের বেঞ্চিতে রেক্সিনের গদি আছে অথবা নেই । চোখে পড়বে ট্রেনের গদি এবং দেয়াল সবতাতে সবুজ রঙ আর বাইরে ট্রেনের গায়ে ইঁটের মত লালরঙ।
কয়লার ইঞ্জিন। কান ফাটানো কু-উ-উ শব্দে সিটি মেরে দুলতে শুরু করে, তারপর ভোঁস ভোঁস শব্দে চলে এবং জল ছাড়ে, ঠিক যেন বুনো মোষ। জানলা দিয়ে ধোঁয়া থেকে চুঁইয়ে আসা কয়লার গুঁড়ো জামাকাপড়ে চুলে এবং চেহারার ছাপ ফেলে যায় । তবে চলার ছন্দে কাহরবা বাজে—ধাগে নাতি নাকা ধিন, ধাগে নাতি নাকা ধিন। বাচ্চাদের কানে বাজে—তুমি থাক, আমি যাই; তুমি থাক, আমি যাই।
এসি মানে আজকের “বাতানুকুলিত কামরা”? না মশাই। আর ইন্টারক্লাস নাম শুধু গল্পের বইয়ে বেঁচে আছে।
কিন্তু দুটো পরিবত্তোন ওই দুই দশকে হয়েছিল।
এক, ১৯৫৭ নাগাদ এল ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিন, শুধু লোক্যাল ট্রেনের জন্যে। বড়দের হাত ধরে দেখতে গেলাম—সবুজ হলুদ রঙ, হুইসল দেয় শাঁখের আওয়াজে।
আর দুটো হুইসিল বাজিয়েই স্পীড তোলে। তাই গেটের কাছে দাঁড়াতে এবং ফুটবোর্ডে ঝুলতে মানা।সে বছর ইস্টার্ন রেল কোলকাতা ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে হৈচৈ ফেলে দিল। চুনী-বলরাম- ভেঙ্কটেশ-ধনরাজ-ওমর -সালাউদ্দিনদের ভীড়ে সবাই শুনল দুটো নতুন নাম—রাইট আউট পিকে ব্যানার্জি এবং কোচ তেজেশ ওরফে বাঘা সোম। আর ওদের লেফট হাফ নিখিল নন্দী সম্ভবতঃ ন্যাশনাল টিমে জায়গা পেয়েছিলেন।
কিন্তু প্রতিভাবান অল্পবয়েসি অসীম সোম ওই ইলেক্ট্রিক ট্রেন হঠাৎ স্পীড নেওয়ায় পা হড়কে ট্রেনে কাটা পড়লেন। এই শোক বাবা তেজেশ সোম সামলে উঠতে পারেননি । ইস্টার্ন রেল, যতদূর জানি, দ্বিতীয়বার লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়নি।
দুই, কয়েক বছর পর ষাটের গোড়ায় এল থার্ড ক্লাস স্লীপার। সামান্য রিজার্ভেশন চার্জ দিয়ে প্রত্যেক সারিতে তিনটে করে সবুজ কাঠের পাটাতন, তাতে গদি জুড়ল আরও ক’বছর পরে। এরপর সেকেন্ড ক্লাস বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেছে ডাকগাড়ির ডাইনিং কার, তার জায়গায় এসেছে প্যান্ট্রি কার।
দূর দূর! কীসে আর কীসে! চাঁদে আর পোঁদে! নেতাজি বনাম পেঁয়াজি? তখনও রেলের একটা ক্লাস ছিল, বৃটিশ যাবার পরেও। কয়লার ইঞ্জিন বিদেয় নিয়েছে, মাঝে দু’দশক ডিজেল ইঞ্জিন। চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্ক্স পটল তোলায় একসময়ের ‘কারানগরী’ (অমল দাশগুপ্তের এই নামের বইটি দেখুন) আজ মৃত।
সে যাকগে, আপনি যদি বিশালকায় হোল্ড -অল আর স্যুটকেস নিয়ে নেমেছেন তো লালজামা লালগামছা কুলিদের শরণাপন্ন হতেই হবে। আজকের নীল বা সবুজ জামা কোথায়? হারিয়ে যাবার ভয় নেই , সবার হাতে তাবিজের মত করে বাঁধা পেল্লায় এক একটি পেতলের চাকতি, তাতে নম্বর লেখা। ওটা মনে রাখলেই হবে। ট্যাক্সির প্রি-পেড বুথ বা স্ট্যান্ড কিস্যু নেই। মিটারে যায়, শেয়ারে যায় । কখনও সামান্য দরাদরি।দুই থেকে পাঁচটাকায় হাওড়া থেকে পার্কসার্কাস।
হালকা মালপত্র হলে ট্রাম বা বাসে চড়ে বসুন। সাবওয়ে উড়ালপুল কিছু হয় নি। ফলে ট্র্যাফিক জ্যাম, বড়বাজার পেরিয়ে হ্যারিসন রোড ( আজ মহাত্মা গান্ধি রোড) বা ডালহৌসি পেরোতে পেরোতে আধঘন্টা। ট্রামে ফার্স্টক্লাসের ভাড়া দশ নয়া পয়সা, সেকেন্ড ক্লাসের আট । দশ নম্বর বাসে দোতলা আছে । তাতে চড়ে দশ পয়সায় পার্কসার্কাস ট্রাম ডিপো বা বেকবাগান স্টপে নামুন।
মাইরি! ঢপ দিচ্ছি না , মিথ্যে বললে পরের জন্মে কালীঘাটের ঘেয়ো কুকুর হয়ে জন্মাবো।
তখন টাকার দাম ছিল। আমার বাবা ১৯৪৯ সালে মিলিটারিতে ৬৫ টাকা মাইনে পেয়ে বিয়ের টোপর পরেছিলেন। আমাদের পার্কসার্কাস বাজারের সামনে তিনকামরা বাড়ির ভাড়া ছিল ৪৮ টাকা। ৬০ বছর পেরিয়ে গেল, বাড়ির মালিকানা তিনবার হাতবদল হল, কিন্তু ভাড়া সেই ৪৮ টাকা।
পঞ্চাশের দশকে এক পয়সা ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে কোলকাতায় বড় আন্দোলন হয়েছিল, গুলি চলেছিল, লোক মারা গেছল।
সে যাকগে, আপনি ট্রামলাইন পেরিয়ে নাসিরুদ্দিন রোডের পাশ কেটে ঝাউতলা রোড , পার্ল রোড হয়ে ধাঙড় বাজারের সামনে সার্কাস হোটেলের উল্টোদিকে ১ নম্বর সার্কাস মার্কেট প্লেসের আঙিনায় চার আনার রবাবের বলে ক্রিকেট খেলতে থাকা বাচ্চাদের পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ১সি ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে খটখটিয়ে কড়া নাড়লেন। তার আগে দরজার পাশে সবুজরঙা লেটার বক্সে—যার গায়ে সাদা রঙ দিয়ে লেখা “দি রয়েজ”—আঙুল ঢুকিয়ে দেখলেন কোন চিঠিপত্তর পড়ে আছে কিনা?
আজকাল কেউ কাউকে চিঠি লেখে না , কর্নেলকে না, বাবা-মাকে না , অফিসের বসকে না, প্রেমিকাকেও না। তার বদলে চলছে ই -মেল, মোবাইলে মেসেজ ও হোয়াটস অ্যাপ।
কেউ আর টেলিগ্রামে “মাদার ইল, কাম শার্প” লিখে মিথ্যে বার্তা পাঠায় না। বন্ধ হয়ে গেছে টেলিগ্রাম বিভাগ, চলন উঠে গেছে পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ডের। পাপ বিদেয় হয়েছে।
এবং সুকান্তের ‘রানার’ কবিতা বা তারাশংকরের ‘ডাক -হরকরা’ গল্প এখন অপ্রাসংগিক।
(আপনি কি সচেতন যে এই হাঁটা পথে আপনি পেরিয়ে এলেন শম্ভুমিত্র-তৃপ্তিমিত্রের নিবাস, বহুরূপী দলটির আবাস, সৈয়দ মুজতবা আলী ও আবু সয়ীদ আয়ুব/অম্লান দত্তের আস্তানা? এবং পবন দাস বাউলের ভবিষ্যতের সাধনসঙ্গিনী মিমলু সেনের মাইকা? কমিউনিস্ট পার্টির দক্ষিণ কোলকাতার কমিউন[3] ? )
তবে এ সেই অবনীর খোঁজে রাতের কড়া নাড়া নয়, এখন সকাল। একজন টুথব্রাশ গোঁফের খাকি হাফপ্যান্ট এসে সাইকেল থেকে নেমে দুটো খবরের কাগজ গোল পাকিয়ে শণের দড়ির টুকরো জড়িয়ে টিপ করে ছূঁড়েছে, একটা বারান্দার রেলিং টপকে দোরগোড়ায় পড়েছে । আর একটা রেলিঙয়ে ধাক্কা খেয়ে ফের নীচে। এই মানুষগুলোকে বলা হত কাগজের ‘হকার’। ও পড়ন্ত বল লুফে নিয়ে আবার ছুঁড়ল—এবার নির্ভুল লক্ষ্যে। এখন বাংলায় ফিল্ডিঙয়ের মান নেমে গেছে, তাই অমন হাতের টিপওলা হকার দেখা যায়না। সবাই বারান্দা থেকে ঝোলানো দড়ির ফাঁসে কাগজটি গুঁজে খালাস। অবশ্যি তখন বেশিরভাগ বাড়িই ছিল দোতলা।
যাক, কড়ানাড়ায় কেউ একজন দরজা খুলেছেন, মুখে এক গাল হাসি—আয় আয়, ভেতরে আয়! সব ভালো তো?
আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে কারও বাড়ি যাওয়া? সে যে ভারি মানহানিকারক! বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঢুকতে অনুমতি নিতে হবে? ছ্যাঃ !
মানছি, তখন প্রাইভেট স্পেসের ধারণাটা বাঙালিদের মধ্যে ছিল না । ছোটদের চিঠিপত্তর খুলে পড়া বড়রা অবশ্যকর্তব্য মনে করতেন, মানে ছোটদের ভালর জন্যেই,-- ওরা কী বোঝে?
ওসব ‘সাহেবিয়ানা’ এসেছে ইদানীং ঘরে ঘরে ল্যান্ডলাইন আর বিশেষ করে ‘মুঠোফোনে’র দৌলতে।
তখন অমন ভারি ভারি লোহার কড়া প্রায় ৯৫% বাড়িতে । আজকে ওই হাতকড়ার মতন কড়া উঠে গেছে, তার জায়গায় এসেছে স্টিলের বা পিতলের ছিটিকিনি –যাতে কড়ার মতনই তালা লাগানো যায়। আর এখন কড়া নাড়তে হয় না। প্রায় সব বাড়িতেই দরজার পাশে কলিং বেল। আগে কলিং বেল থাকতো হাতে গোণা ঘরে--ডাক্তারবাবুর মত পেশাদার বা অন্য হোমরাচোমরাদের বাড়িতে। আমাদের মত হিংসুটে বাচ্চারা পা টিপে টিপে এসে কলিংবেল টিপে দিয়ে দৌড়ে পালাত।
টেলিফোন এবং রেলের বুকিং বিপ্লবঃ
আহাহা, টেলিফোন? সে তো সাদাবাঘের মতই বিরল । ডাক্তার, উকিল বা রাজনৈতিক নেতা এবং উচ্চপদস্থ আমলাদের কাজের জিনিস, কিন্তু আমাদের চোখে এক স্ট্যাটাস সিম্বল মাত্র।ওষূধের দোকানে গিয়ে নামমাত্র পয়সায় ফোন করা যেত। তবে এসটিডি’র জায়গায় ছিল ট্রাঙ্ককল। বুক করে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকুন। কখন ডাক পাবেন খোদায় জানেন।
তেমনই এক ‘সশ্রম একদিনের কারাদন্ড’ ছিল কয়লাঘাটায় রেলের রিজার্ভেশন অফিসে লাইন দিয়ে ট্রেনের বুকিং করা। এর চেয়ে সিনেমা হলে ৬৫ পয়সার লাইনে দাঁড়ানো ছিল অনেক সোজা।
তখন কম্পিউটার আসেনি। সব কাউন্টারে সব ট্রেনের বুকিং হত না। ধরুন , ভিলাই যাবেন বলে বোম্বে মেলের জন্যে ফর্ম ভরে লম্বা লাইনের পেছনে দাঁড়ালেন। ঘন্টা দুই পরে যখন আপনার পালা এল তখন কাঁচ বা তারের জালের পেছনে বসা ধুতিশার্ট পরা ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে একনজর চোখ বুলিয়ে জানালেন – সিট/বার্থ নেই, শেষ হয়ে গেছে।
আপনি করুণ চোখে জানতে চাইলেন –বোম্বে এক্সপ্রেসে আছে কিনা?
--সেটা কি করে বলা যায় ? এখন নতুন ফর্ম ভরে লাইনে দাঁড়ান। আপনার আগে ক’জন এক্সপ্রেসের জন্যে লাইনে আছেন তাতো জানিনে।
তাই ঝাঁকড়া বাবরিচুলো কাঁচাপাকা দাড়ি সত্যেন্দ্রনারায়ণ পিত্রোদা বা স্যাম পিত্রোদা আমার চোখে মস্ত বড় জাদুকর, পিসি সরকারের চেয়েও। কারণ আজ নিজের ঘরের টেলিফোন থেকে দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে কথা বলা , এবং যে কোন কাউন্টার থেকে যে কোন ট্রেনের বা প্লেনের টিকিট বুক করা যায়।আর এসবই সম্ভব হয়েছে ওনার ম্যাজিক ওয়ান্ডের ছোঁয়া লেগে।
চা এবং খবরের কাগজ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারির স্বার্থে ওরা ডিডিটি দিয়ে মশককুল ধ্বংস করল । ম্যালেরিয়া তিনদশকের মত বিদেয় হল। কিন্তু বাঙালির গড়ে উঠল চায়ের অভ্যেস। এটা বোধহয় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসার অ্যান্টিডোট। ফলে হাতমুখ ধুয়ে আপনি দেখলেন জয়েন্ট ফ্যামিলির ঘরে ঘরে বাড়ির ছেলেবৌ, মেয়েরা চা পৌঁছে দিচ্ছে। এর মধ্যে আপনি বাড়ির কর্তার পায়ে হাত ছুঁইয়ে নিজের অ্যাটেন্ডেন্স খাতায় তুলে এসেছেন।
তখন রিফিউজি হয়য়ে আসা সংযুক্ত হিন্দু পরিবারে ‘লিপটন’ , গ্রীন লেভেল, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট –এসব অগুরুগন্ধের চা আয়ত্তের বাইরে । শুধু নামগুলো মুখে মুখে ঘোরে। লাল চা বা চিনি ছাড়া চা ‘ইন থিং’ হয়নি। সবাই খায় কেটলিতে দুধে ফোটানো লিকার চা –একেবারে ‘আসাম-গগন-হতে’ আসা শ্যামল-রসধরপুঞ্জ’ এবং ‘কাথলি-জল-উচ্ছল’ কেস।
এবার চায়ের কাপ হাতে বসে পড়ুন --জামাকাপড় না ছাড়লে সবেধন নীলমণি কাঠের চেয়ারে, ছেড়ে ফেললে লুঙ্গি পরে মাটিতে বাবু হয়ে। তারপর খবরের কাগজ হাতে নিয়ে প্রাত্যহিক আড্ডায় মেতে উঠুন। এই জয়েন্ট ফ্যামিলি নামক দাদুর দস্তানায় তিনটি কামরা, এবং ছাতের চিলেকোঠা মিলিয়ে সতের জন প্রাণী থাকে । আর সব বাড়িতেই একটা মাত্র বাথরুম পায়খানা।
এখনকার নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে সেটা অসম্ভব। আর আজকাল দুটো ওয়াশরুম ছাড়া বেঁচে থাকা কী কঠিন কালীদা!
খবরের কাগজ বলতে দুটো বাঙলা এবং দুটো ইংরেজি কাগজ। আনন্দবাজার ও যুগান্তর। স্টেটসম্যান ও অমৃতবাজার।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া , হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড? নাঃ ; বাঙালি নাক সিঁটকাতো।
এছাড়া টাচলাইনের ধার ঘেঁষে খেলে বেড়াত বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘ দৈনিক বসুমতী’ ও কমিউনিস্ট পার্টির “স্বাধীনতা”। কংগ্রেসের ‘লোকসেবক’ এবং ‘জনসেবক’ নামক ট্যাবলোগুলো কলকে পেত না।
সাহিত্যিক ম্যাগাজিন বলতে সাপ্তাহিক দেশ। বেরোত মোটা কাগজে। লেটারিং সত্যজিৎ রায়ের। ভেতরটি সাদা কালো। কোন রঙিন ছবির বালাই নেই। কিন্তু তার নিয়মিত বিভাগে বিশ্ববিচিত্রা, বিজ্ঞান জগৎ, সাহিত্য, সঙ্গীত। নাটক সিনেমা, পুস্তক সমালোচনা। তাতে অন্ততঃ দুটো ধারাবাহিক উপন্যাস বেরোত। যেমন বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘একক দশক শতক’ ও ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’। বিমল করের ‘খড়কুটো’, মুজতবা আলীর ‘শবনম’, শংকরের ‘কত অজানারে’ এবং ‘চৌরঙ্গী’। অচিন্ত্য সেনগুপ্তের ‘প্রথম কদম ফুল’, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের “সূর্যমুখী”, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের “এই তার পুরস্কার”। সমরেশ বসুর ‘অচিনপুরের কথকতা’ এবং রমাপদ চৌধুরীর ‘ এখনই ‘ ও ‘দ্বীপের নাম টিয়ারং’। মনে পড়ছে সন্তোষ কুমার ঘোষের দুই খন্ডে “ শ্রীচরণেষু মাকে” এবং “সুচরিতাসু তোমাকে”; প্যারিস বাসের পটভুমিকায় শিল্পী মিলন মুখোপাধ্যায়ের “মুখ চাই মুখ” এবং ধনঞ্জয় বৈরাগী ছদ্মনামে নাট্যকার তরুণ রায়ের ইংল্যান্ডে প্রবাসী বাঙালীর জীবন নিয়ে একটি উপন্যাস।
ওতে একটা লাইন ছিলঃ ‘জয়টার কি কোন পছন্দ নেই? কী দেখে মারিয়ার প্রেমে পড়ল? তোবড়ানো গাল, সারাক্ষণ সর্দিতে নাক ভ্যাড় ভ্যাড় করছে!”
ক্লাস ফাইভে পড়ি। মেমসায়েবের নাকও সর্দিতে ভ্যাড় ভ্যাড় করে জেনে বড় স্বস্তি পেয়েছিলাম।
এছাড়া বের হত তুখোড় সব স্মৃতিকথা। যেমন দিলীপ কুমার রায়ের সুভাষ চন্দ্র বসু্র সঙ্গে স্কুল ও কলেজের দিনগুলো নিয়ে “স্মৃতিচারণ”, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের “কেউ ভোলে না কেউ ভোলে”-- নজরুলের সঙ্গে বর্ধমানের চুরুলিয়া ও আসানসোলের স্কুলের দিনগুলো ; পুণ্যলতা রাওয়ের সুকুমার- লীলা মজুমদার -সারদারঞ্জনের গল্প আর অ্যানেকডোটে ভরা “ছেলেবেলার দিনগুলি”, প্রবোধচন্দ্র সান্যালের বৈঠকী আড্ডার স্মৃতি “বনস্পতির আসরে”, শোভনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের “দক্ষিণের বারান্দা”, অরুণকুমার সরকারের অনুবাদে “অ্যান ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি” পড়ে মুজতবা আলির সিরিয়াল লেখা। আর নারায়ণ গাঙ্গুলির “সুনন্দর জার্নাল” ও ফাদার দ্যতিয়েনের “ডায়েরির ছেঁড়া পাতা”র কথা না বললে ঠাকুর পাপ দেবেন। আররম্যরচনায় গৌরকিশোর ঘোষের “ব্রজদার গুল্পসমগ্র” এবং সাংবাদিক তরুণ কুমার ভাদুড়ির চম্বলের ডাকাতদের নিয়ে রিপোর্তাজ –“অভিশপ্ত চম্বল”।
পুজোসংখ্যর উপন্যাস? খালি দুটো নাম বলছি—সুনীল গাঙ্গুলির প্রথম উপন্যাস “আত্মপ্রকাশ” এবং পরপর দু’বছর সমরেশ বসুর “বিবর” এবং “প্রজাপতি”। বিবর নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে যে ঝড় উঠেছিল তা তুলনাহীন।
এই ঐতিহ্যের পর আজকের “দেশ”? সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিক হয়েছে বলাই যথেষ্ট।
ধাঙড় বাজার
তখন মাছ বলতে রুইমাছ, দু’টাকা সের মানে বেশ দাম । কাতলা এবং মৃগেল এর পরে । ভেটকি , আড় মাছ তারও পরে । তারপরে শোল, কালবাউস ইত্যাদি। ইলিশ মাছ বরাবরই রাজকুমার। কিন্তু দামে রুইয়ের থেকে খুব একটা বেশি নয় । বোয়াল, কই , শিঙিমাগুর, এর পরে। আর ছোটমাছ ছিল অকুলীন। ট্যাংরা, পাবদা, বাটা বাচা, পুঁটি, মৌরলা, খলসে, সোনাখড়কে , ছোট চিংড়ি –এদের বেশি ভাও দেওয়া হত না । কমদামে পাওয়া যেত। গলদা চিংড়ি আজকের মত পাওয়া যেত না । বিয়েবাড়িতে ভেটকির চেয়ে রুইমাছ ভাজাই হত। চালের সের আট আনা। পাঁঠার মাংস সের একটাকা। মুরগী দুটাকা । সরষের তেল গণেশ মার্কা একটাকা সের।
সের ও মণের বদলে গ্রাম ও কিলোগ্রাম, মানে মেট্রিক পদ্ধতি এল পঞ্চাশের শেষে । কিন্তু বাঙালি বহুদিন বৃটিশ পদ্ধতিকেই ব্যবহারে ধরে রাখল। জমিতে আজও কাঠা-বিঘে চলে । একর/হেক্টর বাঙালি নেয়নি। আমাদের মেট্রিক পদ্ধতি বোঝাতে ফর্মূলা দেয়া হল—“ডেকে হেঁকে কিল মারো” ! মানে ডেকা-হেক্টো-কিলো-মিরিয়া-- আমার আজও সড়গড় হয় নি। অনেকদিন চলেছে চারপয়সায় এক আনা, তারপর আঁট আনা, ষোল আনায় একটাকা। ২৫ ন প (নয়াপয়সা) তে চার আনা হয়ে ১০০ পয়সায় একটাকা বড্ড খিটকেল লেগেছে। ধীরে ধীরে পঞ্চম নাকি ষষ্ঠ জর্জ নাকি অষ্টম এডওয়ার্ড বা কুইন ভিক্টোরিয়ার মুখ খোদাই করা এবং শুরুর তামার এক পয়সা দু’পয়সা ফুটো পয়সা সিকি আধুলি উধাও হল।বাঙালি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
সেসময় , মানে ষাটের দশকের সেকন্ড হাফ অব্দি পুরো প্যাকেট কিনলে চার্মিনার কুড়ি পয়সা, কিন্তু হলদেটে মোটা কাগজের প্যাকেটের ভেতরে ফিনফিনে কোন র্যাপার থাকত না । ১৯৬৭ সালের জুলাই মাস থেকে ভেতরে র্যাপার জড়াল আর প্যাকেটের দাম আটাশ নয়াপয়সা হল। খুচরো কিনলে পাঁচ পয়সায় দুটো চার্মিনার, অথবা একটা পানামা। রকের আড্ডায় রব উঠল –চারু এবার গেরস্ত হল!
সিনেমা! সিনেমা!
সিনেমা হলে সামনের দুটো সারির কথা বলি। আলেয়াতে (ছারপোকাওলা কাঠের সীট) ৪১ পয়সা , অরুণাতে ৫০ পয়সা, মেট্রো –লাইটহাউস- নিউ এম্পায়ার এবং এলিটে ৬৫ পয়সা। উজ্বলা- বসুশ্রী-ভারতী এবং আমাদের গড়িয়ার পদ্মশ্রীতে ৬৫ পয়সা। তখন না ছিল মল , না আইনক্স।
ছেলেছোকরারা সিনেমার ফার্স্ট শো দেখার জন্যে লাইনে বসত। কারণ ওই প্রথম দুটো সারির টিকিটে অ্যাডভান্স বুকিং হত না । শুরুর এক-আধঘন্টা আগে হলের গায়ে একটা কোল্যাপসিবল গেট একটু করে খুলে গুণে গুণে দারোয়ান ভেতরে ঢোকাত, ফলে লাইন ম্যানেজ করা নিয়ে ঝাড়পিট স্বাভাবিক ছিল। আর দারোয়ানের ঠ্যাঙের ফাঁক বা বগলের তলা দিয়ে স্লিপ কেটে বা ভিড়ের মাথায় চড়ে ঘাড়ের ওপর দিয়ে ডাইভ মেরে ঢুকে পরা বিশেষ প্রশংসার ব্যাপার ছিল । দারোয়ান হাত-পা চালাত। সবাই ভয় পেত মেট্রোর সফিস্টিকেটেড চেহারার ছ’ফুট চেকার বা বসুশ্রীর ডোরাকাটা চাড্ডিপরা টিকিধারী দারোয়ানকে।
ক্লাস টেনে পড়ি। হাফপ্যান্ট পরে মেট্রোর ৬৫ পয়সার লাইনে দাঁড়িয়েছি। ফিলিমটি সোফিয়া লোরেন অভিনীত ‘টু উইমেন’, আলবার্তো মোরাভিয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় গল্প।
ওই ছ’ফূটিয়া আমাকে ঘাড় ধরে লাইন থেকে বের করে দিল—‘এ’ সার্টিফিকেট মার্কা ফিল্ম যে ! একজন বলল—পরের বার ফুলপ্যান্ট পরে এস খোকা।
নাটকের হল বলতে উত্তর কোলকাতা
ছুটির দিনে বাঙালী সপরিবারে যেত চিড়িয়াখানা, বেলুড় মঠ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, যাদুঘর এবং আরও পরে বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম। বড়রা অনেকে থিয়েটার দেখতে যেতেন উত্তর কোলকাতায়। স্টার-বিশ্বরূপা-রঙমহল-- এই তিনটি হলে হত ব্যবসায়িক নাটক। শিশির ভাদুড়িদের দিন শেষ; রাসবিহারী সরকার জাঁকিয়ে বসেছেন। কিছু নাটক যেমন ‘উল্কা’ এবং ‘সেতু’ সুপারহিট। রঙ্গনা হল এল আশির দশকে ।
তখন অ্যাকাডেমি-রবীন্দ্র ভবন—নন্দন-শিশির মঞ্চ-জ্ঞান মঞ্চ কিছুই হয় নি। শম্ভু মিত্র মশাই বাঙলা রঙ্গমঞ্চের জন্যে দিল্লি কোলকাতা দরবার করে জমি ও মঞ্চের জন্য পাবলিকের থেকে চাঁদা তুলেও জমিটমি না পেয়ে সবাইকে পয়সা ফেরৎ দিলেন।
আমাদের দেশে হাকিম নড়ে তবু হুকুম নড়ে না।
উৎপল দত্তের লিটিল থিয়েটার গ্রুপ মিনার্ভা মঞ্চের লীজ নিয়ে অন্যধরণের প্রোডাকশন একের পর এক করে চলেছেন। বড়াধেমো কয়লাখনির দুর্ঘটনা নিয়ে “অঙ্গার”, নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে “কল্লোল” , নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান নিয়ে “তীর”। দক্ষিণে মঞ্চ বলতে মুক্তাঙ্গন। সমস্ত গ্রুপ থিয়েটার এবং গণনাট্য সংঘ ওখানেই ভাল ভাল কাজ করেছে । শৌভনিক, নক্ষত্র, নান্দীকার, থিয়েটার ওয়ার্কশপ—নাটকের স্বর্ণযুগ। সবিতাব্রত দত্ত, জ্ঞানেশ মুখুজ্জে, শ্যামল সেন, বিভাস চক্রবর্তী, অশোক মুখোপাধ্যায়, অজিতেশ , রুদ্রপ্রসাদ, কেয়া চক্রবর্তী, মনোজ মিত্র , মোহিত চট্টো, পার্থ বন্দ্যো –সবাই ওই সময়ের ফসল। অসীম চক্রবর্তী এবং কেতকী দত্ত প্রতাপ মেমোরিয়াল হলে ‘বারবধূ’র রেকর্ড শো করে বিখ্যাত হলেন। কিন্তু বাম মর্যাল পুলিসের কাছে ‘অপসংস্কৃতি’ বলে গাল খেলেন। এছাড়া সেই প্রথম কোলকাতার নাটকের মঞ্চে ক্যাবারে নাচ দেখা গেল। মিস শেফালী এ’ব্যাপারে বিশেষ উল্লেখ এবং সম্মানের দাবি রাখেন। আর বলা উচিত আলোকসম্পাতে তাপস সেনের কথা । এত অল্প আয়োজনে অমন উচ্চমানের শৈল্পিক আলো!
বাদল সরকারের ব্যাপারটাই আলাদা। বাঙালীর বুঝতে একটু সময় লাগলো। প্রথম দিকে ওই মুক্তাঙ্গনে ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’তার বক্তব্যের ভার এবং আঙ্গিকের ধারে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পরে ওঁর প্রসেনিয়ম মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এসে অঙ্গন মঞ্চে দর্শকদের গোল করে বসিয়ে(টিকিটের একটাই দাম—এক টাকা!) প্রপ, মঞ্চসজ্জা বা আলোর মায়া বাদ দিয়ে শুধু দলগত অভিনয়, শরীরকে ব্যবহার করে নাটক! তাতে নায়ক-নায়িকা প্রায় বাদ! ‘ভোমা’’মিছিল’, সুখপাঠ্য ভারতের ইতিহাস, স্পার্টাকাস, সাগিনা, গণ্ডী –এসব তখন বাঙালীর জন্যে নতুন অনুভব।
জ্যোছন ঘোষ দস্তিদারদেরও একটা ঘরানা ছিল। দলটার নাম বোধহয় কর্ণিক।
বিজন থিয়েটার অনেক পরে । মধুসূদন মঞ্চ তৈরি হয়নি। ঢাকুরিয়া ব্রীজ চালু হয় নি। আমাদের কোলকাতা শুরু হত যোধপুর পার্ক থেকে। তার দক্ষিণে মানে সারি সারি রিফিউজি কলোনি।
আমাদের মত বুড়োদের চোখে আজ মঞ্চে মধ্যমেধার দাপাদাপি!
হাসপাতাল
আমি জন্মেছিলাম মেডিক্যাল কলেজের জেনারেল ওয়ার্ডে, স্থানাভাবে মাটিতে পাতা বিছানায়। তাতেও একজন ইন্টার্নের সুপারিশ লেগেছিল। তিনি আমাদের আত্মীয় বটেন। কোলকাতার সরকারি হাসপাতালে রোগীর ভিড় বেড়েছে বই কমেনি। হ্যাঁ, সম্পন্ন লোকজনের জন্যে গলাকাটা টারিফে অনেক প্রাইভেট হসপিটাল হয়েছে। পুরনো দিনে এল এম এফ নামক মেডিক্যাল ডিপ্লোমাধারী থেকে এমবিবিএস ডাক্তার –সবাই আমাদের চোখে ধনন্তরি। এখন এমডি বা এমএস না হলে পুরো ডাক্তার ধরা হয়না।
শ্মশানযাত্রা
আগে ছিল উত্তর কোলকাতার জন্যে নিমতলা, দক্ষিণ কলকাতার জন্যে কেওড়াতলা। অবশ্য কিছু মাইনর শ্মশান ছিল । যেমন কাশীপুরে রতনবাবু ঘাট, গড়িয়ার কাছে বোড়ালে একটি। কিন্তু তাতে কাঠ পুড়িয়েই দাহ করতে হত। এখন ধীরে ধীরে সব শ্মশানেই ইলেক্ট্রিক চুল্লি। আর একগাদা সৎকার সমিতির সুসজ্জিত গাড়ি এসে সম্মানের সঙ্গে শবদেহটি নিয়ে যায় । আগের মত মাঝরাতে পিলে চমকানো—বল হরি! হরি বোল ? আজ আর শোনা যায় না।
শেষপাতেঃ
তাহলে বদল কোথায় হল? শুধু বহিরঙ্গে ? তা কেন ? অন্তরঙ্গেও হল বইকি! বাঙালীর ঘরে এবং বাইরে দখিন হাওয়ার ছোঁয়া । টেকনোলজি ও অন্তর্মন।
বহিরঙ্গেঃ
আজকে বাঙালির ঘরে মাটিতে পাত পেড়ে কেউ খায় না। বাঙালি খায় চেয়ার টেবিলে, অবশ্য কাঁটা-চামচ-ছুরি নয় , হাত দিয়েই। ফলে বিদেয় নিয়েছে কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি, চাটাইয়ের বা কাপড়ের আসন। জেলের কয়েদিদের মত কলাই করা বাসন (এনামেল) মগ অল্পদিনেই বিদায় নিয়েছিল। কাঁসার বাসন বেশ কিছুদিন চলল, তারপর স্টেনলেস স্টিল। এখন সবাই খান চিনেমাটির বা কাঁচের বাসনে।
কয়লার ধোঁয়া বা কেরোসিন স্টোভের গনগনে আগুনের বদলে কুকিং গ্যাস, হাঁড়িকুড়ি ডেকচির বদলে প্রেসার কুকার, শিলনোড়ায় মশলা বাটার জায়গায় গুঁড়ো মশলা ও মিক্সি গ্রাইন্ডার। এসব নিঃসন্দেহে রান্নাঘরের আবহাওয়াকে করেছে স্বাস্থ্যকর এবং কমিয়ে দিয়েছে রান্নার পেছনে সময় ।
এর ফলে সকড়ি এঁটোকাঁটা—মানে ভাতের ছোঁয়া, খেতে খেতে জলের গ্লাস বা অন্য বাসন ছোঁয়া – নিয়ে বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে।
আছড়ে আছড়ে কাপড় ধোয়ার বদলে ওয়াশিং মেশিনের ব্যবহার মুক্তি দিয়েছে পরিশ্রম ও সময়ের অপব্যয় থেকে। মেয়েরা এখন ঘরেতেও নিজের জন্যে অনেকটা সময় বের করতে পাচ্ছেন।
প্রতি আবাসনে কমোড যুক্ত ওয়াশরুমের সংখ্যা বেড়েছে। বাঙালির ঘেন্নাপিত্তি কিছু কমে গেছে? পটি বলে শব্দটি এখন আমাদের চলন্তিকায় ঢুকে পড়েছে।
সাধনা দন্তমাঞ্জন, ফরহান্স, নিম টুথপেস্ট, মার্গো সাবান বীণাকা টুথপেস্ট গেছে।টিকে আছে কলগেট, এবং সাম্রাজ্য বাড়িয়েই চলেছে। তেল-সাবান-শ্যাম্পু- ফেস ওয়াশ, বডি ওয়াশের অনেক বৈচিত্র্য। নারকোল তেল মাথায়, সরষের তেল গায়ে এবং হামাম সাবান শরীরে জাতীয় সহ্জ ফর্মূলা বাতিল। আজ আমরা স্নানের সময় ধুঁধুলের খোসা নয়, ‘লুফা’ দিয়ে গা’ ঘসি।
আগে মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েরা বিউটি পার্লারে যেত না । তাতে প্রায় জাত এবং ক্যারেকটার চোলে যেত। বাঙালির চোখে তখনও সব পার্লারই ম্যাসাজ পার্লার। বোঝো!
এখন অনায়াসে মেয়েরা এবং ছেলেরা পার্লারে যায় , পেডিকিওর করায়। আজকের প্রজন্ম অনেক সৌন্দর্য্য সচেতন , নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে সচেতন। তাই জিমে যাওয়া ছেলেমেয়ে সবার জন্যে একটি স্বাভাবিক ঘটনা ।
পাড়ায় পাড়ায় দর্জিরা টিকে আছে বটে, কিন্তু মল থেকে রেডিমেড ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় কেনার চলন বেড়েছে। বাঙালী অনেকদিন ফটরফটর করা শস্তা হাওয়াই চটি ছেড়ে বন্ধ জুতো এবং স্নিকার্স ধরেছে।
ক্যান্সারের বিজ্ঞাপনে সিগারেট খাওয়া কমেনি, শুধু চারমিনার পানামার মত জনতা সিগারেট গায়েব, অথচ জর্দা দোক্তার বদলে হিন্দিবলয় থেকে আসা গুটকা খাওয়া বেড়েছে।
চুমু-টুমুর ব্যাপারে বাঙালির নতুন প্রজন্ম অনেক বোল্ড। পুরনো দিনে এর জন্যে খুঁজতে হত লেকের ধারে লিলিপুলের পাশে একটা গাছের নীচের আড়াল। জোড়ায় জোড়ায় পিঠে পিঠ। অথবা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা চিড়িয়াখানায় আড়াল খুঁজে সবার আঁখি এড়ানো। এ’ব্যাপারে পুরুষসঙ্গীর সক্রিয়তা চোখে পড়ত। ইদানীং শহর কোলকাতায় দেখেছি ছেলেটি যেন সাঙ্খ্যদর্শনের নিষ্ক্রিয় পুরুষ। আর প্রকৃতিস্বরূপ নারী অনায়াসে ছাতা খুলে বা ওড়নায় ঢেকে নিচ্ছে যুগলের মাথা এবং মুখ।
নে যত পিপিং টমের দল!
তোরা হল্লা করে করবি কি তা বল!
একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় এ’নিয়ে অস্বস্তি হয় কিনা জানতে চাইলে সে অকপটে বলে –জ্যেঠু, অস্বস্তি কিসের? আমরা তো এভাবে বাকি দুনিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে এক নিজস্ব ভুবন গড়ে তুলি। তাতে মগ্ন হয়ে যাই।
স্ট্রিট ফুড বা রেস্তোরাঁয় খাবার ব্যাপারে মেয়েরা অনেক উদ্যোগী, কারণ অনেকেরই নিজস্ব আয় বা স্বতন্ত্র জীবিকা। হরদম দেখি নানান ধরণের কাজে এগিয়ে এসেছে গড়িয়া সোনারপুর বা রাজপুরের মত এলাকার মেয়েরা। মেট্রো স্টেশনে আলাপ হতে একটি মেয়ে আমাকে কার্ড দেখিয়ে বলে এই ঠিকানায় মডেলিং এর জন্যে ইন্টারভিউ দিতে ডেকেছে। এই সংস্থাটির নাম শুনেছেন? একা যাওয়া সেফ হবে?
মেয়েরা আজকে পেট্রল পাম্পে ইউনিফর্ম পরে গাড়িতে তেল ভরে দেয়। সোনাগাছিতে দুর্গাপুজো করে। আজকে যৌনকর্মী একটি স্বীকৃত শব্দ। পুরনো দিনে মাস মাইনে পেলে মুখ লুকিয়ে সোনাগাছি বা হাড়কাটা গলিতে ঢুঁ মেরে আসা যেত। কিন্তু সেখানে তাদের মেয়েকে পড়াতে বা ড্রইং বা অভিনয় শেখাতে যাওয়া? এই ভন্ডামি থেকে কোলকাতা এখন অনেক মুক্ত।
রাস্তায় কাঁকর, কাঁচের টুকরো এবং পেরেক সবই আছে, তবু না হাঁটলে পথ ফুরোয় না। এই প্রজন্মের মেয়েদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি।
অন্তরঙ্গেঃ
বলতে চাইছি—বহিরঙ্গের যে পরিবর্তন চোখে পড়ছে তার খানিকটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উন্নত প্রযুক্তি ও ভোগ্যপণ্যের প্রবেশের ফল, বাকিটা আসলে বাঙালীর ঘরের মধ্যে মূল্যবোধে পরিবর্তনের প্রকাশ।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন মেয়েদের জীবনে।
ছোটবেলায় কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি মেয়েকে সন্ধ্যে সাতটা পেরিয়ে বাড়ি ঢোকার অপরাধে মায়ের মুখঝামটা গালমন্দ মুখ বুজে সহ্য করতে দেখেছি। কারণ মেয়েছেলে হয়ে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার হওয়ার দুঃসাহস!
এখন এমন কথা উচ্চারণ সংবিধান-বিরুদ্ধ। রাতের শহর আর ছেলেদের একচেটিয়া গোচারণভূমি নয়।
ঘরের বৌয়ের অবস্থা আরও খারাপ ছিল। সে শুতে যাবে সবার শেষে রান্নাঘর গুছিয়ে , অথচ উঠবে সবার আগে। শ্বশুর-শাশুড়ি উঠে দেখবেন বৌমা ওঠেনি? সেকী! কী লজ্জা! অথচ তার স্বামীদেবতার আবদার এবং নানান বায়নাক্কা মিটিয়ে ঘুমুতে দেরি হয়েছে। এদিকে বাপের সুপুত্তুর নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন, তাতে কি, ও যে পুরুষ।
এসব একেবারে পালটে গেছে। এখন বৌমা রোজগেরে। সে কখন উঠবে সেটা তার মর্জি। ঘরের কাজের মাসির মাইনে সেই তো দিচ্ছে। সকাল বেলার চা? সেটা কখনও শাশুড়ি, কখনও শ্বশুর বা স্বামী এবং কখনও সে নিজে পালা করে করছে। ছেলেরা মেনে নিয়েছে যে ‘পতি পরম গুরু’ লিখে বাঁধিয়ে দেয়ালে টাঙানোর দিন আর ফিরবে না । ঘরের কাজে , বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো এবং স্কুলে পৌঁছে দেয়া—এসবে তাকেও হাত লাগাতে হবে।
কাজের মাসি? মাস-মাইনের কড়ারে অন্যের ঘর সামলাতে আসা মহিলাকে ‘ঝি’ বলা আজ ‘স্যাক্রিলেজ’, তাকে কাজের মাসি বলাটা পরিবর্তিত মূল্যবোধের বড় ইঙ্গিত।
সবচেয়ে বড় কথা মেয়েদের শরীর তার নিজস্ব। তার ব্যক্তিগত জীবনের সব নির্ণয় সে নিজে নেবে। কার সঙ্গে মিশবে, কাকে বিয়ে করবে, কবে মা হবে, আদৌ হবে কিনা—এসব তার একান্ত ব্যক্তিগত নির্ণয়। সে কাউকেই আগেকার দিনের মত কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নয়।
‘তোমার শ্বশুরের খুব ইচ্ছে শিগগির যেন নাতি-নাতনির মুখ দেখেন, নইলে বাড়ি বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে’ । এসব বলা যে অসভ্যতা সেটা বাঙালি পরিবার শিখেছে।
সত্যজিতের ‘মহানগর’ সিনেমায় বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে যে নতুন মূল্যবোধের অঙ্কুর আমরা দেখেছিলাম, আজ অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে সেই গাছ তার ডালপালা মেলে রোদ্দুর গায়ে মেখে হাসছে।
[1] জর্জ বার্নার্ড শ , “অ্যাপলকার্ট”।
[2] দীনবন্ধু মিত্র , “জামাইবারিক” নাটকে মাণিকপীরের গান।
[3] মানিক বন্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস, “দর্পণ”।
দারুণ!
খুব ভালো লাগলো পড়তে।
দুর্দান্ত একটা লেখা ! নৈর্ব্যক্তিক আবার চোরা টানে ভর্তি। শিশুপাঠ্য কাহিনীসূত্রে স্মৃতিকথার প্রসঙ্গে দারুণ। আহা, কতো কিছুই যে মনে করাল এ লেখা !
অরিন, কাকতাড়ুয়া ও প্রতিভাম্যামকে ধন্যবাদ উৎসাহ দেবার জন্য।
মাইরি রঞ্জন্দা, এই সম্বোধনটা আমায় করতেই হল। কারণ আপনার মানে আমাদের সময়কার এই সম্বোধনটা মনে হয়না এখন আর চালু আছে। কিন্তু তখন এটা বলতনা এমন কেউ ছিল না শুধু আমরা তিন ভাই ছাড়া কারণ আমাদের বাড়িতে ওটা বলা নিষিদ্ধ ছিল - বাবার হাতে থাপ্পড় বড় সাংঘাতিক জিনিষ ছিল। যাকগে, যে কথা বলছিলাম - অসাধারণ একটি দলিল সৃষ্টি করেছেন আপনি। একই সাথে পরম সুস্বাদু এবং সহজ-পাচ্য - অতি উপাদেয়, প্রাণভরে উপভোগ করলাম।
লেখাটা জরুরি দলিল। সহজ ভাষায় কোন কচকচি ছাড়া এতটা জমি কভার করেছেন যে এটা ওই সময়ের কলকাতার প্রাইমার হতে পারে। অল্প কিছু আ্যনাক্রনিজম ঢুকে পড়েছে, যেমন নন্দন - নন্দনের উদবোধন আটের দশকে - তবে ওসব কিছু নয়।
লেখা খুব ভালো লাগল
রঞ্জনদা, ভালো লাগল।
সবাইকে ধন্যবাদ।
সম্বিৎ ,
আসলে নন্দনের উদ্ঘাটনের সময়ে আমি কোলকাতা ছেড়ে দিয়েছি। ভুল হয়েছে। যেটা দেখিনি, সেগুলো বলতে গেলে আজকাল ভুল হচ্ছে। ভবিষ্যতেও ভুল ধরিয়ে দেবেন। আমি যে মহা আলসে সেটা স্বীকার করতে একটু লজ্জা লাগে।ঃ))
অমিতাভ,
আমার মাইরি বলতে খুব ভাল লাগে। এখন কেউ বলেনা। আমি মেয়ে ও বৌয়ের সামনে , বন্ধুদের কাছে এবং গুরুর পাতায় সমানে বলতে থাকি । আমিও ছোটবেলায় 'মাইরি' ' মাক্কালী' আর 'ব্লাডি' বোলে কানে আড়াই পাক খেয়েছি।ঃ)))
এই, আমি কিন্তু হোঅ্যা গ্রূপ্গুলোতে এখনও বলে থাকি। রন্জনদার কথায় খেয়াল করলাম আমার বয়েসিরা আর কেউ আজকাল বলে না!
আর, লেখাটা অতি স্মৃতিকাতরক।
আজকাল মাইরি 'র জায়গায় কি বলে? বাই মেরী ?
;-)